বেবী পোদ্দার-এর কবিতাগুচ্ছ

0
111
বেবী পোদ্দারের জন্ম ৬ই আগস্ট , পুরুলিয়া জেলার উপরগুগুই গ্রামে । বাবার শান্তিরাম পোদ্দার ও মা কালিবালা পোদ্দার । কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি সূত্রপাত । কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা দেওয়ার তাগিদে এবং কবিতাকে ভালোবেসে প্রথম কবিতা লেখা ।কবিতার মধ্য দিয়ে সাহিত্য জগতে পা রাখলেও ক্রমে প্রবন্ধ , ছোট গল্প ,অনুগল্প লেখেন। খুব কম সময়েই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি ও প্রকাশ।

অনুভূতিমালা

যা কিছু অপূর্ণতা সব তুলে রাখি কবিতায় ,
লিখে রাখি যা কিছু না বলা কথা,
স্মৃতির ফুলদানিতে গুছিয়ে রাখি
অপূর্ণ ইচ্ছার ফুলগুলি ।
সম্ভাবনার রোদে পুড়তে থাকা কচিকচি পাতাদের যন্ত্রণা লিখি,
অপূর্ণতার ব্যথা সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দে মিলিয়ে যায়…
লিখে রাখি কবিতায়, দীর্ঘশ্বাসের শব্দে
অপূর্ণতার গল্প লিখি ।
লিখে রাখি বোধেরও অতীত কিছু
ভাষাহীন অনুভূতিমালা ।

জীবন গড়িয়ে যায় বিকেলের রোদ্দুরের মতো,
অপূর্ণতার ক্ষতে রক্তাক্ত হতে হতে
মনে হয় মাথার উপর থেকে সরে যাচ্ছে আকাশ ।
একটু শক্ত মাটির আশায় বেঁচে আছি ।

আমি দিশাহীন নাবিকের মতো খুঁজে বেড়াই
আশ্বাসের তীরপ্রান্ত ,
এক দূরতর দ্বীপ ।
আমার ব্যর্থতাগুলো নিয়ে যায় গভীর অন্ধকারে
অতল সমুদ্রের আরও গভীরে
আমাকে নির্জনতা ঘনিষ্ঠ করে নেয় ।

আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা

যদি কোনো দিনও বেলা শেষে
সূর্যাস্তের রক্তিম আভায়
কোন এক প্রিয় মুখ ভেসে ওঠে
বুঝে নিও সে মুখ আমার ।

যদি তোমার নিদ্রাহীন রাত্রে মনে পড়ে
একটি অসংলগ্ন স্মৃতির প্রলাপ;
মোমের শিখার মতো একটি ভীরু, কম্পিত
কন্ঠস্বরের অপরিমেয় দ্বিধার সমর্পণ,
বুঝে নিও সে আমি ।
যদি কোনো দিনও অন্ধকার ঘিরে নেয়
তোমার চারপাশ
তাহলে আমি তোমার হাত ধরে নিয়ে আসবো
বিস্তীর্ণ মাঠে ,
যেখানে মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশ,
ভেসে আসবে অঘ্রাণের ফসলের ঘ্রাণ,
দূরের টিলার থেকে ভেসে আসা রাতজাগা পাখিদের ডাক…
তোমাকে রোমাঞ্চিত করে দেবে ,
আমি দেব তোমার ক্লান্ত চোখে ঘুম ।
হে পৌরুষ জেগে ওঠো ,
জলাভূমি ভেদ করে ,
উদ্ভিদের মতো তোমার পত্রে পুষ্পে লেগে থাকবে
পৃথিবীর আরোগ্য সকল ।

অগ্নিপথ

পুড়তে থাকে যুবক, ঘুমিয়ে পড়ার আগে
রাতের থেকে গভীর তার যন্ত্রণারা জাগে;
স্বপ্নে জাগে ভয়, তার স্পর্শকাতর মন
প্রশ্ন যখন ওঠে -তুমি কি করছো এখন ?

গলতে থাকে বরফ, ভাঙতে থাকে মনের পাড়
কাজ জোটেনি জেনেও এই প্রশ্ন করার কি দরকার !
নতুন সূর্য উঠবে আর নেইতো বেশি দেরি
সফল হবে যুবক, তার বন্ধ হাতঘড়ি —

আবার চলবে সময় মতো, ঘুরতে থাকবে কাঁটা
জীবন মানে অগ্নিপথেও দু-চার কদম হাঁটা ।

প্রাইভেট মাস্টার

সন্ধেবেলায় ঘরে পড়ান ইস্কুল মাস্টার
চৌকাঠের বাইরে তার চটিজুতোর স্তুপ।
স্কুল থেকেই নিয়ে আসেন চক আর ডাস্টার
এখন তিনি শিক্ষা দিতে আগ্রহী তো খুব।

যদিও তিনি দশটার পর বাজার থেকে এসে
একটুখানি বিশ্রাম নেন টিভির সামনে বসে।
তারপর যান স্কুলের পথে, টিচার্স রুমে অল্প
বসেই তিনি শুরু করেন দুনিয়া জোড়া গল্প।

ছেলেরা তখন হাসছে, খেলছে, ছিঁড়ছে বইয়ের পাতা
ইনি তখন ব্যস্ত খুবই নিয়ে হাজিরা খাতা,
তারপরে যান ক্লাসরুমে আর পড়ান টুকটাক
বলেন’ পড়া অনেক হল , এবার বই ঢুকিয়ে রাখ।

বাচ্চারা তো ভীষণ খুশি পড়তে হয় কম ;
এই ছবিটাই চোখের সামনে দেখছি হরদম ।

সব আছে , তাও পঠন নেই সরকারি ইস্কুলে ,
বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিতে শিক্ষক যান ভুলে।
অথচ তিনি সন্ধে বেলা বন্ধ করে ঘর
প্রাইভেট টিউশন করতে ভীষণ তৎপর।

এমনটা যে সবাই নয় সেটাও আমি মানি ,
কিছু শিক্ষক নিঃস্বার্থ সেটাও আমি জানি।
তবুও কেন মাস্টারদের ঘরের মেয়ে, ছেলে
দল বেঁধে পড়তে যাচ্ছে প্রাইভেট ইস্কুলে!

চিরন্তন

সবাই আছে অথচ কেউ নেই।
প্রয়োজন পড়লে আসে হঠাৎ করে
আবার প্রিয়জন হলে অকারণেই চলে যায়।
সবাই আছে, মানুষের অভাব নেই
কিন্তু প্রিয়জনের অভাব প্রতিমুহূর্তে টের পাই।

অথচ দেখো আকাশ, নদী, সমুদ্র
তাদের আসা আছে কিন্তু যাওয়া নেই।
তারা থাকতে জানে ,ভালোবাসতে জানে
কোনো দিনও নদীকে ভালোবেসে দেখবে
তার শীতলতা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেবে সে আছে।
সমুদ্রকে ভালোবাসবে তার ঢেউ জানিয়ে দেবে
আমি আছি ,আমি থাকবো জোয়ার – ভাটায়।
আর আকাশকে একবার বলে দেখবে মনের কথা
জানিয়ে দেবে সে আছে আমাদের মাথার উপর সর্বক্ষণ।

মঞ্চ

একটা মঞ্চ আত্মপ্রকাশের মাধ্যম,
একটা মঞ্চ সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে,
একটা মঞ্চ যেখানে গিয়ে অনেকেই
দাঁড়ায় , কেউ পায় প্রতিষ্ঠা
কেউ আত্ম আক্ষেপের গভীর অন্ধকারে
হারিয়ে যায় । আজকের প্রসঙ্গ
আগামী কাল প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেললে
একটা অপারগতার আক্ষেপ ঘুণ পোকার
মতো কুরে কুরে খেয়ে ফেলে যা কিছু
সাময়িক, যা কিছু সার্থসর্বস্ব কর্মসূচি।
একটা মঞ্চ কখনো হয়ে উঠতে পারে না
আত্মপ্রকাশের সর্বোচ্চ প্রতিফলনের প্রতীক।
হয়তো প্রতিষ্ঠার উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য
একটা মঞ্চই যথেষ্ট, যদি নিখাদ প্রস্তুতি থাকে।
অন্যথা সেই আলো, সাজানো মঞ্চের
আড়ালে সমস্ত ছলনাময় মুখোশ
লুকিয়ে লুকিয়ে বিদ্রূপের ছলে হাসতে থাকে।

ব্যর্থতা

ব্যর্থতা যেন একটা ঝরে যাওয়া পাতা
আর সাফল্য যেন নব কিশলয় ।
নব কিশলয় হতে আমরা সবাই চাই
ঝরা পাতা কি আর কেউ হতে চাই ?
কিন্তু বিবর্ণ পাতা ঝরে যাওয়ার পর
বৃক্ষ যখন নিস্পত্র হয়ে যায়,
তার আপাতরিক্ততায় বেজে ওঠে
তীব্র ও সকরুণ বেদনার সুর।
আবার নতুন পাতা গজানো শুরু করে
এটা আমরা সকলে ভুলে যাই,
যেন গজানো পাতায়, সব সৌন্দর্য লুকিয় আছে
ঝরে যাওয়া পাতার মধ্যে আছে শুধু
একটা ব্যর্থতা , একটা আক্ষেপ।
কিন্তু ওই ঝরে যাওয়া পাতা
একদিন ছিলো সবুজ, সতেজ
একদিন প্রভাতের নতুন সূর্যকিরণ,
জ্যোৎস্নার রূপোলি আভায় ঝলমল করে উঠতো
সময় সবকিছুকে কালের নিরিখে ব্রাত্য করে
দেয় বলেই নতুনের এত জয়গান।
নব কিশলয় হবো, ঝরে যাবো
এইতো নিয়তি ….

রাঙা দিদি

আমাদের গ্রামের সমস্ত মানুষের মনে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে
আমাদের আই সি ডি এস সেন্টারের দিকে তাকালে আলোকিত চৈতন্যে ওঠে মধুর গুঞ্জন।
যেখানে ছোট ছোট শিশুরা ফুলের পাপড়ির মতো নিষ্পাপ সৌন্দর্যে ঝলমল করতে থাকে।
আমাদের গ্রামের সমস্ত অসুখের অব্যর্থ ঔষুধ
আমাদের আই সি ডি এস সেন্টার।
সকালের আলো ফুটবার পরেই আই সি ডি এস সেন্টারের তালা খুলেন রাঙা দিদি।
শীত , গ্রীষ্ম , বর্ষা , বসন্ত সমস্ত ঋতুর উপর দিয়ে হেঁটে আসা রাঙ্গাদিদির উঠোনে আলপনা আঁকা আর হল না। বাজলো না সানাই কোনো দিন।
মিড -ডে – মিলের ভাত ,ডাল , ডিমের গন্ধ মাখা আঁচলে হলুদের ছাপ নিয়ে রাঙাদিদি ঘরে ফিরে যায়।
যে আঁচলে ভালোবেসে কেউ তুলে দেয়নি গুচ্ছ বকুল।
সমস্ত মন খারাপ পথের ধুলায় ফেলে রাঙা দিদি ঘরে ফিরে গেলে
সমস্ত গ্রাম পরবর্তী সকালের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।

জীবনের অপেক্ষিকতা

জীবনের সুখ দুঃখগুলো জোয়ার ভাটার মতো ;
কোনো কিছু থাকে না যে দীর্ঘসময়, সবকিছুই অপেক্ষিক।
শুধু সময় মেপে রাখে জোয়ার – ভাটার গভীরতা।
নুড়ি পাথর শুধু জানে টিকে থাকার কৌশল,
আর জানে প্রবাহকে প্রতিরোধ করতে
নিজের সমস্ত অস্তিত্বের বিনিময়ে।
জীবনকে কোনো দিনও স্পর্শ করতে পারিনি,
পেরেছি যেটুকু তা ওই মুহূর্তে মুহূর্তে অনুভব।
জীবনে কারো জন্যে কেউ অপরিহার্য ছিলনা কখনো,
শুধু পথে পথে অঙ্কিত থাকে আসা যাওয়ার পদচিহ্ন যত।

সন্দেহ ও সম্পর্ক

সন্দেহ রাক্ষসীর মতো গিলে খেল একটা সম্পর্ককে।
মুহূর্তে বাড়তে থাকা সন্দেহের বান
যাপনে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে।
দিনরাত্রির বিরাম চিহ্ন হয়ে শুধু থেকে যায় সময়।
কত মানুষ আসে, কত মানুষ যায়
বছর পেরিয়ে শতাব্দী গড়ায় ;
আসা যাওয়ার খেলায় মাতে শুধু ঘড়ির কাঁটা।
প্রতিটি সম্পর্কের একটা আলাদা গন্ধ থাকে ;
এভাবেই আমাদের তার গন্ধে গন্ধে হেঁটে চলা।
প্রতিটি ঝড়ের পর গ্রামকে যেভাবে দেখেছি শান্ত
তেমনি প্রতিটি ভাঙ্গনের পরেও সম্পর্কের গন্ধ লেগে থাকে
আমাদের মননে , চিন্তনে , দিনলিপির প্রতিটি অক্ষরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here