সু ব্র ত   ভৌ মি ক-র অণুগল্প

1
176
পরিচিতি : জন্ম ১৯ নভেম্বর ১৯৬৫, বনগাঁয়। সঙ্গীতপ্রিয় ও পেশায় শিক্ষক সুব্রত ভৌমিকএর আপাতত দুটি গল্পগ্রন্থ। ‘পর্ণা আজ বেরোবে’ (একুশ শতক) এবং ‘অন্তর ছিপে ওঠে না’ (উবুদশ)। সদ‍্য প্রকাশিত একটি অণুগল্পের বই ‘অণুগল্প সংগ্রহ’ (অভিযান পাবলিশার্স)। পুরস্কার পেয়েছেন ‘কবি বিশ্বনাথ মৈত্র পুরস্কার’, উদ্ভাস, ই-হিউম‍্যান, বহুস্বর। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ গুচ্ছ অণুগল্পের ডালি রইল পাঠকদের জন্য।

 

সু ব্র ত   ভৌ মি ক-র অণুগল্প

কাঠপোকা

এক

আজও রাত দুটো নাগাদ ঘুমটা ভেঙে গেল। কানে একটা কাঠপোকার শব্দ। কিছু কাটছে?
তমোঘ্ন বিছানায় উঠে বসল। পাশেই তাতান। দু’বছরের ছেলে। তারও ওপাশে মোটা একটা কোল-বালিশের উপর অসতর্ক রাত্রিবাস উঠে যাওয়া তুমুল পা’টা তুলে দিয়ে ওদিক ফিরে হেনা ঘুমচ্ছে। গায়ে হালকা নীলাভ আলো।
তমোঘ্ন মুখ ফেরাল।
টর্চ জ্বেলে পোকাটা খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে একেবারে খাটের নিচে।
হেনা জেগে গেল, ‘একী! ওখানে কী করছ!’
‘আরে, সেই পোকাটা। কিছুতে ঘুমোতে দিচ্ছে না। কুটকুট করে কাটছে।’
‘কী কাটছে!’
‘কে জানে।’
মুখে টর্চ, দু’হাতে কাঠের ফ্রেমটা চেপে ধরে খাটের নিচ থেকে নিজেকে টেনে আনল তমোঘ্ন। মুখে মাথায় ঝুল। একহাত দিয়ে তা ছাড়িয়ে ফের বিছানায়। শুয়ে শুয়ে ভাবল, পোকাটা কি খাটেরই কোনও এক ফাঁকে ঢুকে আছে। কোথায়!

 

দুই

খাটটা বিয়েতে পাওয়া। দামি।
হতে পারে, তমোঘ্ন তাই ভাবছে। না, এইসময় সে বাড়ি ফেরে না। কথা নয়। কিন্তু বেলা বারোটা নাগাদ একটা ফেলে যাওয়া ফাইল নিতে হঠাৎ আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এল সে। এসে দেখল, হেনা খাটে। আর তার ঠিক পাশে হেনারই এক দাদার বন্ধু রজত বোস। অধ‍্যাপক।
তমোঘ্ন চোখ সরাল।
আলমারিটার কাছে গেল।
আশ্চর্য, কানে সেই কাঠপোকাটার শব্দ!

 

নিক্কণ

 

দিদি হাঁটলে মিষ্টি একটা শব্দ হয়, ছুম্।
নূপুরের।
ভাইয়েরই কিনে দেওয়া।
শব্দটা আজ দরজার সামনে এসে থমকাল। ভাইয়ের লুকিয়ে ফেলা ভিডিয়োটা ধরে ফেলল। তারপর বকা, চড়, হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া। সকালে ভাই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সারাদিন আর ফিরল না।
রাতে এলাকার দাদা দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকল। লম্বা হাত। পালানো যায় না। হাত থেকে, শহর থেকে। শহরটা ক্রমশ এক অন্ধ উল্লাসের দিকে। চোখ ফোটে না। সারাটাদিন শুধু জিভ ঝোলে, লালা পড়ে। ধ’রে যাওয়া গা আরেকটা শরীর হাতড়ায়।
এমনই পথ ধরে দাদা। কালো মুশকো, হাতে বালা, গালে ক্ষুর টানা দেড় ইঞ্চি ফালি দাগ। একটা খালপাড়ে নিয়ে গেল। ভরপেট বিলিতি খাওয়াল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘চ। একটা মাল উঠেছে। শালি এট্টু খেলে, তেজী। তবে ডাঁশা। পা-দুটো চেপে ধরবি।’
‘যদি চিল্লায়?’
‘মুখ বাঁধা আছে।’
অন্ধকার পোড়ো বাড়ি। চটের উপর ধরে আনা একটা মেয়ে আমস্তক বিছানো। চোখমুখ দেখা যাচ্ছে না। এলাকার দাদা কালো কেন্নোর মতো গায়ে উঠল। ভাই পা-দুটো শক্ত করে চেপে ধরল। তাতে পা-টা একটু নড়ে গেল।
একটা ক্ষীণ শব্দ হল, ছুম্।

 

আসা

 

প্রায় বছর দেড় দুজনে এক ট্রেনে। এক কামরায়। সাদা পৃষ্ঠার মতো। জানলার ধারে মুখোমুখি বসে। অফিসে যায়।
লোকটি নৈহাটী থেকে ওঠে। সামনে সিট রাখে। শুরুতে তেমন ভিড় থাকে না। পরের স্টেশন থেকে ওঠা কাঁধে ব‍্যাগ, চোখে চশমা, দুটো বড়ো চোখের পাতার মেয়েটি সেই সিটটায় এসে বসে। তারপর বসতে বসতে একদিন একটু বলে, ‘ভালো?’
লোকটি উত্তর করে, ‘হ‍্যাঁ।’
একদিন বলে, ‘হাতে কী হল?’
‘একটু লেগেছে।’
‘ডাক্তার দেখাতে হবে না?’
লোকটি মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা।’
ব‍্যস, আর কথা নেই।
খানিক বাদে দুজনের মাঝখানে যাত্রী এসে দাঁড়ায়। শব্দ এসে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে আর দেখতে পায় না। শুনতে পায় না। পাশে বসলে অবশ‍্য এটা হয় না। কিন্তু কেউ কারও কাছে আসে না। পাশে বসে না। শুধু দমদম জংশনে মেয়েটি নেমে যাওয়ার আগে লোকটি বলে ওঠে, ‘কাল আসছেন তো?’
‘হ‍্যাঁ।’ বলে মেয়েটি একটু চোখ রেখে নেমে পড়ে।

আজও তেমনই যাচ্ছে।
মুখোমুখি, জানলার ধারে বসা। সামনে ধীরে ধীরে জমা প‍্যাসেঞ্জার, ভিড়, শব্দ। খানিক বাদে দুজনে হারিয়ে গেল।
কেউ কাউকে আর দেখতে পেল না। কারও কোনও সাড়াশব্দ এল না সারা পথে। কোনও প্রশ্ন এল না। কথা এল না। ডাক এল না। শুধু নামার আগে লোকটি ফের বলে উঠল, ‘কাল আবার আসছেন তো?’
মেয়েটি গলা নামিয়ে বলল, ‘কাল আমায় দেখতে আসছে।’
‘ও।’ লোকটি চুপ। ফের প্রশ্ন করল, ‘তাহলে পরশু?’
উত্তর এল, ‘দেখি।’

 

কৃষ্ণা

 

‘আর কত দূর?’
‘এই তো, দশ মিনিট।’
দশ মিনিট পরে তবে স্বপ্ন!
এ সুখে আনত স্বর ফুটল, ‘তোমার বাড়ির লোকজন সব কেমন? এ বিয়ে মানবে তো?’ উত্তর এল, ‘কী যে বলো, এমন টানটান ঠাসা ফিগার, রঙ, দ্যাখো না সব কী করে।’
মেয়েটি ফিক্ করে হেসে ফেলল।
সুখ ছুঁতে আর দশ মিনিট।
পৌঁছে দেখল, নির্জন এক ফেলা বাড়ি। ভিতরে ক’টা ষন্ডা মতো ছেলে দাঁত বার করে হাসছে। ঘোমটা-বউ সপ্রশ্ন মুখ ফেরাল, ‘এরাই কি তোমার বাড়ির লোক?’
‘হ্যাঁ তো।’ বর সহাস্যে তাকে সে-বাড়ি ছেড়ে চলে এল।
আসতে আসতে শুনল, কবেকার এক অসহায় মেয়ে-গলা দ্রৌপদীর মতো আর্তনাদ করছে।

চিত্রঃ ২
ঘুরপথ

 

এক

গ্রীষ্মের মুখে লোকটা মনকে বোঝাল, ‘সবই যায়।’
যে থাকবে না, টের পেল। লোকটার কাছে গান শিখত। কিন্তু একদিন তার বাবা ডেকে জানাল, মেয়ে আর শিখবে না। ভালো এক সম্বন্ধ এসেছে। ভালো পাত্র, দোতলা বাড়ি, পয়সাকড়িতে ভারি মনোযোগ।
অতএব ‘ভালো সম্বন্ধ’র ঘরে চলে গেল সে।
রাতে অসহ্য গরম। অনেক রাত অব্দি লোকটা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল। ঘুম আসে না। একবার মনে হল, দরজাটায় কে যেন শব্দ করল। খুলে দেখল কেউ না, হাওয়া।

 

দুই

জীবন ফেরে না কোথাও, পৌঁছায়।
আশ্বিনে এভাবে সে বাড়ি এল। দেখা হল। খুব সেজেছে। গা ভর্তি গয়না, প্রসাধন। ভাল দেখা যায় না। হাতে একদম সময় নেই। ব্যস্ত। তার মধ্যে সাড়ম্বরে জানাল, গত মাসেই তারা একটা গাড়ি কিনেছে। স্বামী খুব পটু। এবার একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য খুব ছুটোছুটি করছে।
লোকটা হাসল, ‘বাঃ।’
‘ইদানীং অবশ্য অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। কী কাজ। কোনও কোনও রাত ফেরে না।’
লোকটা ফের হাসল।
চলে গেল সে।

 

তিন

গেল শীতে লোকটার বাড়ির সামনের রোদটা চুরি গেল। সামনের বাড়ির দশ লাখ বিশে চাকরি বাঁধানো লোকটা গুরুগম্ভীর মুখে তেতলা তুলেছে। তাতে সুদৃশ্য বউ এনেছে।
দিনের শেষে বউটি এখন গ্রিল ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। যেন একটু নিজের কাছে আসে। কিন্তু থাকতে পারে না। পরক্ষণে স্বামীর ডাকে ঘরে ঢুকে পড়ে। টিভি দেখে। দরজাটা ‘দড়াম’ শব্দে বন্ধ হয়ে যায়। বাইরের আকাশে তখন তারা ভরা রাত, চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
ও হ্যাঁ, হেমন্তে সে এসেছিল। মুখটা কেমন হলদে। পড়া বিকেলের মতো৷ থাকেনি। নাকি পারেনি?

চিত্রঃ ৫

চার

হঠাৎই এগাছে-ওগাছে এক কোথাকার হাওয়া। দূরে নারকেল গাছগুলো আবেশে নুয়ে নুয়ে পড়ছে। পাখিগুলো বাতাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। যেন লোকটার পাশ কাটা জীবনটার দিকে মিটিমিটি তাকিয়ে কী একটা খবর কানাকানি হচ্ছে। ঠোঁটে চাপা হাসি। লোকটা অবাক হয়ে চারদিক দেখল। কে এসেছে! কে!
শুনল, সে এসেছে।
সে এলে পাখি ডাকে, হাওয়া বয়। লোকটা ভয় পেল। বুক দুরদুর করতে লাগল। পরদিন ভোর থাকতে সাত-তাড়াতাড়ি একটা কাজে বেরিয়ে গেল। ফিরল দুপুর করে। বিকেলের দিকে সুরমণ্ডলটা নিয়ে বসল। তারপর মুলতানিতে সবে মরমী অন্তরাটা ধরেছে, দরজায় এক ছায়া।
গান থেমে গেল, ‘কে!’
‘আমি।’
সন্ধে লাগা দুয়ার। কামিনী গাছটা থেকে একটা হাল্কা গন্ধ আসছে। দেখল, সে।
আস্তে বাজল, ‘আসব?’
এল। হাতে শাখা-পলা নেই। সিঁদুর মোছা কপাল। মাস দুয়েক হল। আর ফিরবে না। সঙ্গে গানের খাতা। লোকটি আস্তে মুখ খুলল, ‘আবার এলে যে?’
উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেল।’

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here