আলেহো কার্পেন্তিয়ের- অনুবাদ সাহিত্য

2
45
           নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার 

                      আলেহো কার্পেন্তিয়ের

      ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শৈবাল কুমার নন্দ

 “রাষ্ট্রপতিনিধিদের সরকারী বাসস্থানগু লােতে রাজনৈতিক কারণে পলাতকদের আশ্রয়। প্রার্থনাকে সম্মান করতে হবে হয় এক অধিকার হিসেবে নয়তাে মানবিক সহনশীলতার। কারণে, যতসর সব দেশের চিরাচরিত প্রথা বা আইনকানুনের মধ্যে যাতে শত আশ্রয়ের অনুমতি দেওয়া যায়” – ১৯২৮ এ হাবানাতে অনুষ্ঠিত প্যান আমেরিন স গৃহীত সমঝোতা পত্র ২ নং ধারা  

                    ১ রবিবার

যেহেতু দিনটা ছিল রবিবার, কাছাকাছি একটা দোকানের জানালা দিয়ে চোখে পড়া একটা মেকানাে সেট গভীর মনােযােগ দিয়ে দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রাষ্ট্রপতি ও গণপরিষদের একান্ত সচিব দশটার দিকে মিরামােন্তেস প্রাসাদে পাঠালেন। এটা ছিল এমন একটা দিন যখন অধিকাংশ লােকই হয় গীর্জাতে নাহলে সমুদ্র সৈকতে গেছে – বিশেষ করে, এই গ্রীষ্মে তাে, অবশ্যই। সপ্তাহের অন্য দিনগুলােতে একান্ত সচিব যথেষ্ট জরুরী রিপাের্ট দেওয়া প্রয়ােজন এমন কাজে ঠিকমতাে মন দিতে পারেন না, কারণ পাঠ করা ঝলমলে সােনালী পােশাকে সজ্জিত রষ্ট্রদুতেরা, উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক অধিকারিক, গণমান্য বিদেশী, ক্ষমতাশালী বা অচেনা পুরােহিতের, দূরবর্তী প্রদেশগুলোর রাজ্যপালের, আবেদনকারী এবং নিবেদনকারীদের অবিরাম স্রোত, যাদের সবাই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী – আগে থেকে ঠিক করে রাখা সাক্ষাৎসুচী অনুযায়ী বা ছাড়াই – বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষাৎসূচী ছাড়াই, বিশেষতঃ সেনাদের ক্ষেত্রে – বা, যদি অপেক্ষাকৃত খারাপ থেকে সব চাইতে খারাপ কিছু হয়, রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে, তার নির্বাহিক ক্ষমতা ছিল প্রশ্নাতীত, যা তিনি তুলে ধরেন মুদুভাবে। এক গমগমে গলায় তিনি বলে বসবেন, “তোমার ব্যাপারে আমি অবশ্যই রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলব”, এবং তারপর, প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে : জেনারেল – আমরা কয়েকজন প্রকৃতি আকর্ষণীয়া ইতালিয়ান সুন্দরী রমনীর ব্যবস্থা করতে পেরেছি।” (এসময়ে তিনি ডান হাতের আঙুলের ডগাগুলাে জড়াে করে শূন্যে চুমু ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিমা করেন।) ধন্য বিত্তবানেরা। “যে ছাপােষা ক্রেওল মেয়ের লোকে তুমি লােলা থেকে আমার জন্য এনে দিয়েছিলে সেগুলােতে আমার বিরক্তি ধরে গেছে, প্রধান বিচারপতি সপ্তাহে কয়েক আগেই জানিয়েছিলেন “আমরা এমন একটা জায়গাতে পৌঁচেছি যেখানে আমাদের সংস্কৃতি মনস্কা, মার্জিত রুচির ইওরােপীয় মহিলাদের প্রয়ােজন, যারা নিজেদের হয়ে কিছু অন্ততঃ বলতে পারবে।”। একান্ত সচিব বিশাল বাড়িটার খােলা উঠানের বাগানটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, বাড়িটার একতলাটা এমন এক রীতিতে তৈরি হয়েছিল যা আবছাভাবে দ্বিতীয় সন্ত্রাটকে মনে করায়; এটাতে কখনােই বর্তমান রাষ্ট্রপতির পুর্বসুরীরা বা যারা এর আগে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাঁরা কেউই থাকতেন না, কারণ এটার অসুবিধাজনক অবস্থান, বিশাল বিশাল আকারের শৌচাগার এবং গােলন্দাজ বাহিনীর কামানের নাগালের মধ্যে এটার অবস্থান যা কোন সামরিক অভ্যুত্থানের সময়ে কৌশলগত কারণেই প্রতিকুল। সমান করে ছাঁটা বক্সগাছগুলাের পেছনে, সার্জেন্ট বেতন একটা স্যাতসেঁতে এসপারাতাে ঘাসের ঝুড়ি থেকে কিছু লেটুস শাক নিয়ে তাঁর পােষা কচ্ছপ ক্লিওপেট্রাকে খাওয়ানােতে ব্যস্ত ছিলেন। “তুমি কি কাগজগুলাে দেখেছ?” সার্জেন্ট, গােছা কাগজগুলাের একটা দোলাতে দোলাতে জিজ্ঞেস করলেন। “হিটলার তাঁর সৈন্যদের বলছেন : তােমাদের না আছে। হৃদয় আর না আছে স্নায়ু যুদ্ধে ওগুলাের কোনটা দরকার নেই। কোনরকম দয়া বা ক্ষমার অনুভূতি যা তােমাদের মনে মাঝে মাঝে আসতে পারে, সেগুলাে পুরােপুরি কাটিয়ে ওঠো। প্রতিটি রাশিয়ানকে হত্যা কর; যদি কোন বৃদ্ধ, কোন মহিলা, ছােট একটা বালক বা বালিকারও মুখােমুখি হও, দ্বিধা কোরাে না; তাদেরকেও মেরে ফেলাে। এটা করার মধ্যদিয়ে তুমি তােমার নিজের জীবন বাঁচাবে, তােমার পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করবে, এবং নিজেকে চিরস্তন গৌরবে ভরিয়ে দাও। ) ওদের সবাইকে গুলি করে শুইয়ে দাও ! আমাকে ক্লসেউইটসের নীতিগুলাে দেখাও, আমি ঠিক সেটাই বলি ! ঐ প্রাশিয়ান একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন!”
            একান্ত সচিব বরাবরই অবাক হয়ে যেতেন রেতন পর এই ক্লসেউইটসের প্রতি তীব্র আবেগ লক্ষ্য করে, যাকে রেতন বিশ্বাস করত কল্পবিজ্ঞানের কৌশলে সামগ্রিক যুদ্ধের উদ্ভাবক হিসেবে- টকটকে লাল রংয়ের মেশিনগুলাে বড় বড় শহরে ঢুকে পড়ছে আর বাড়িগুলােকে গুঁড়িয়ে ফুটপাথে মিশিয়ে দিচ্ছে, বড় বড় ক্রেনগুলো গােটা গােটা অট্টালিকাগুলাে তুলে অনেক ওপর থেকে আবার সেগুলােকে নিচে ফেলে দিচ্ছে। বিন্দুমাত্র প্রতিরােধ ছাড়াই; সুড়ঙ্গের মত মুখওয়ালা আগুনের শিখা নিক্ষেপকারীরা; অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত সাঁজোয়া গাড়িগুলাে যেগুলাের প্রতিটির ভেতরে তিনশ লােক থাকতে পারে। রেতন এই “সামগ্রিক যুদ্ধের উদ্ভাবকের কথা শুনেছিল আর একজন সার্জেন্টের কাছে, যে আবার যথারীতি এই তথ্যগুলাে পেয়েছিল একজন কর্পোরালের কাছে যিনি যুক্ত ছিলেন এক লেফটেনান্টের সহকারী হিসেবে যাঁর কাছে ছিল “অন ওয়ার” এবং “দ্য ওয়াটারলু ক্যাম্পেন” ৫ এর কপিগুলাে এবং যিনি এই বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন।
        ঐ ক্লসেউইটস ছোকরা নেপােলিয়নের থেকে অনেক ভালো।” সার্জেন্ট ক্লিওপেট্রাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে চললেন। এটাই প্রথমবার নয়, এর আগেও একান্ত সচিব এটা ভেবে অবাক হতেন যে কিভাবে এই নরম মনের, সহজ সরল মানুষের মনে সামগ্রিক যুদ্ধের অজানা অভিজ্ঞতা লাভের ইচ্ছে হত, যে মানুষটি তার পােষা কচ্ছপটি অসুস্থ হয়ে পড়লে কেঁদে ভাসায়, যে তার বেতনের সমস্তটা খরচ করে জেলার ছােট ছেলেদের সীসার পুতুল সেনা কিনে দেয়, নিয়মিতভাবে নিষ্ঠা ভরে হােলি কম্যূনিয়ন এ যায়, যার এই কেবল একটি মাত্র বইয়ের বিষয়বস্তু পড়ার ও সঙ্গে রাখার অসাধারণ ও অপরিমেয় অধিকার ছিল, যেটা এমনকি একশােবার মত পড়ার পরে সৌন্দর্য, অভিযান এবং ভালােবাসার প্রতি তার আকাঙ্খার পুরােপুরি তৃপ্তি ঘটাত, ক্ষমতার প্রতি তার গােপন। ও তীব্র ইচ্ছে মিথ্যে স্তোকে তুষ্ট করে রাখত, এবং হয়তাে এই গুরুত্বহীন বিশেষ দায়িত্ব কোন দিন না পাওয়া অফিসারটির মনে যে দার্শনিক সান্ত্বনার রেশ থাকত তা, শুধু খুঁজে পাওয়া যেত বােয়েথিয়াস, এপিকতেতাস, এবং মার্কাস অরেলিয়াসের লেখাগুলােতে – নাম উল্লেখ করতে গেলে, দ্য কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো। এবং একই সময়ে সে স্বপ্ন দেখছিল ভয়ংকর, বিধ্বংসী যুদ্ধগুলাের এবং আসন্ন গনহত্যার। সে আক্ষেপ করত এই ব্যাপারে যে তার দেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলাের মধ্যে বর্তমান যে বিবাদ কোন একটা সীমানা নিয়ে সেটা এতই অস্পষ্ট ও তাত্ত্বিক যে এটা ছিল গভীরভাবে রহস্যে ঢাকা, যেটার একমাত্র উদ্দেশ্য মনে হয়েছিল ঠাই পেতে পারে স্কুল অ্যাটলাসের মানচিত্রগুলােতে, যে বিবাদের মীমাংসা কোন ভালাের জন্য করা উচিৎ নয় বরং অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই তার সমাধান করা যায়। এবং সবথেকে মারাত্মক অস্ত্রের প্রয়ােগেই”, সে আরাে যােগ করত, স্বপ্ন দেখতাে এক অস্ত্রাগারের যা ভর্তি রয়েছে ভয়ানক সব যুদ্ধের এঞ্জিনগুলােতে যেগুলাে। দেখা যায় গ্রহগুলাের মধ্যে পারস্পরিক অভিযান চালানাের সময়, রবিবারের কমিকসগুলােতে যেগুলাে স্থানীয় খবর কাগজগুলােতে স্প্যানিশে অনূদিত হয়ে ছাপা হত।
             পম্পেইয়ান রীতিতে সাজানাে তার অফিস ঘরটাতে ঢুকে একান্ত সচিব দেখতে পেলেন বেশ কতকগুলাে দলিলের গােছা যেগুলাে তার তাড়াতাড়ি নজরে পড়ার মত করে সাজানাে একটা নেপােলিনীয় ঈগলশােভিত কালির দোয়াতের পাশে। এই কাজটা শেষ হয়ে গেলে তিনি প্রাসাদের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ও নির্জনতার আনন্দময় অনুভূতি উপভােগ করতে করতে সময় কাটাতে লাগলেন যতক্ষণ না সার্জেন্ট রেতন তাঁর এই নিঃসঙ্গ জায়গা যা আজ সাধারণ লােকজনেরা, দারােয়ানেরা ও সান্ত্রীরা সবার কাছেই পরিত্যক্ত। তিনি মহান পঞ্চদশ লুইয়ের বৈঠকখানার ঘরটা পেরােলেন, যেটাতে চটকদার মনভুলানাে ভুতুড়ে পুতুলগুলাে এবং সােনার নকশা খােদাই সাদা পিয়ানাে রয়েছে, গ্রন্থাগার, যাতে না পড়া মমসেন, দুরুয়ি, মিচেলেত, সিসারে কানতু নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতির পত্নীর জন্য সুরক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টস, সবকিছুই সাজানাে চমৎকার এবং গুইসােতের বইয়ের সেটগুলাে সাজানাে; এবং এবং | নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ্নীর জন্য সুরক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টস, সবকিছুই সাজানাে চমৎকার আধুনিক এক রীতিতে। পলিক্রোমের জনপরীরা তাদের হাত দিয়ে ধরে রেখেছে আয়নাগুলােকে, এবং আ লা মুচার আঁকা বিষন্ন আলখাল্লা পরা ভাঁড়েদের ছবি, আবছা ভাবে মনে পড়ায় অব্রে বিয়ার্ডসলেকে, চাঁদের আলােয় ম্যান্ডোলিন বাজাচ্ছেন, চিত্রিত এক পর্দা যার আড়ালে লুকোনাে হাতমুখ ধােওয়ার বেসিন ও একটা কমােড – যেটা চল্লিশ বছর আগে শহরে একটা কেচ্ছা তৈরি করেছিল, যখন ফ্রান্স থেকে এটা আনা হয়েছিল চরম সন্দেহজনক রহস্যময়তার সাথে। সাধারণ শ্রোতাদের বসবার ঘর এবং নথিপত্র জমা দেওয়ার ঘরটাতে কোনভাবে একটা মধ্যযুগীয় পরিবেশ, এর আখরোট কাঠের দেওয়ালে যুক্ত সরু টেবিল, যুদ্ধের সাজসজ্জা রাখার ব্যবস্থাদি, এবং দেওয়াল ঢাকা পর্দাযুক্ত চাঁদোয়া রাষ্ট্রপতির চেয়ারের ওপরে যেন তুলে ধরে এক ইলেক্স বৃক্ষর নীচে সন্ত লুই এর বিচার সভা পরিচালনাকে। যখন দুপুরের খাবার পরিবেশন হল, একান্ত সচিব খাওয়ার ঘরে ঢুকলেন, ব্যাকাসের প্রথমেই আঁকা হয়েছিল প্যারিসের ইকোলে দেস বয়স্ক-আর্টস এর এক কৃতী ছাত্রের দ্বারা, একটা লম্বা তৈলচিত্র ছিল যা তুলে ধরে একটা ভেউভে- ক্লিকোতের বােতল- এর লেবেলটা ভালােমত সাঁটানাে সামনে-এটার কর্কের ছিপিটার ভেতর থেকে যেন উপচে বেরিয়ে আসবে ছােট ছােট দেবদূতেরা ও সুন্দর শিশুরা। একান্ত সচিব বিশাল টেবিলটার একদম সামনে বসলেন, রাষ্ট্রপতির নিজস্ব আসনেই। সত্যিটা হল এই যে রবিবারগুলােতে মিরামােনতেসের এই প্রাসাদে তিনি প্রায়ই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবেই কল্পনা করেন। কোন একবার তিনি সত্যিসত্যিই রাষ্ট্রপতির রেশমি ফিস্টুলা একটা পরেও ফেলেছিলেন যাতে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অনুভূতি পরখ করতে পারেন। পূজারিনীদের ও সেনটরদের ছবিগুলোর মধ্যদিয়ে, যেগুলাে এই শতকের প্রথমেই আঁকা হয়েছিল প্যারিসের ইকোলে দেস বয়স্ক-আর্টস এর এক কৃতী ছাত্রের দ্বারা, একটা লম্বা তৈলচিত্র ছিল যা তুলে ধরে একটা ভেউভে- ক্লিকোতের বােতল- এর লেবেলটা ভালােমত সাঁটানাে সামনে-এটার কর্কের ছিপিটার ভেতর থেকে যেন উপচে বেরিয়ে আসবে ছােট ছােট দেবদূতেরা ও সুন্দর শিশুরা। একান্ত সচিব বিশাল টেবিলটার একদম সামনে বসলেন, রাষ্ট্রপতির নিজস্ব আসনেই। সত্যিটা হল এই যে রবিবারগুলােতে মিরামােনতেসের এই প্রাসাদে তিনি প্রায়ই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবেই কল্পনা করেন। কোন একবার তিনি সত্যিসত্যিই রাষ্ট্রপতির রেশমি ফিস্টুলা একটা পরেও ফেলেছিলেন যাতে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার অনুভূতি পরখ করতে পারেন। পূজারিনীদের ও সেনটরদের ছবিগুলোর মধ্যদিয়ে, যেগুলাে এই শতকের “তুমি কি জানাে রাস্তাতে তারা কি বলাবলি করছিল ?” রেতন বলল, “যে জেনারেল মাবিলান তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এক অভ্যুত্থানে। শহরে তাই উত্তেজনা চরমে। আমাদের এখানে যেটা প্রয়ােজন তা হল সামগ্রিক যুদ্ধ – যতক্ষণ না সীমানার অন্য প্রান্তের একজন লােকও অবশিষ্ট থাকে আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে ..।” কিন্তু একান্ত সচিব কোন ছবিগুলাের প্রতিরূপে ভরা একটা ছােট বই বের করলেন। অন্য যে কোন ধারার প্লাস্টিক চিত্রকলার তুলনায় পল ক্লির কাজই একান্ত সচিব বেশি পছন্দ করতেন। সাড়া ছিলেন না, তিনি তার পকেট থেকে পল ক্লির আঁকা আঁকা ছবিগুলাের প্রতিরূপে ভরা একটা ছােট বই বের করলেন। অন্য যে কোন ধারার প্লাস্টিক চিত্রকলার তুলনায় পল ক্লির কাজই একান্ত সচিব বেশি পছন্দ করতেন। সােমবার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা। আমি কখনােই এটাতে অভ্যস্ত নই। এবং তারপর স্বাভাবিক কাজগুলাের পুনরাবৃত্তি। কুড়ি বছর আগেও যা হত, আজও ঠিক তাই। আয়নাতে তােমার প্রতিবিম্বকে বেশ বয়স্কই দেখায়। এবং দাড়ি কামানাের ক্ষুর। সেই একইরকম ভাবে গালের ওপর দিয়ে টানা। একই মুখভঙ্গি। উচিয়ে থাকা রােমকুপের
গােড়াগুলাে এখনাে উচিয়েই রয়েছে। তারপরে তােমার দাঁতগুলাে। রাষ্ট্র জোর দেয় বিছানাতে শোয়া ও রাস্তাতে থাকার মধ্যেকার কাজগুলাের বাধা সরানাের দিকে -বিশেষ করে কেউ যদি রাষ্ট্রপতি ও গণপরিষদের একান্ত সচিব হয়; প্রস্টেটের সমস্যা নিয়ে বিছানাতে শুয়ে থাকা ও পুরােদস্তুর সাজপােশাক পরে বাইরে বেরিয়ে পড়ার মাঝে। যেদিন থেকে মানুষ জন্মেছে, তার অস্তিত্ব থাকে বুকে ভর দিয়ে হাঁটায়, হামাগুড়ি দেওয়াতে এবং কাপড়চোপড় ও হাঁটার ছড়ি নিয়ে ঢাকাটুকি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ায়, যা কারাের জীবনের ইতিহাসে সবসময় এক অংশ হয়ে থাকবে। তার সদ্যোজাত অবস্থায় গায়ে দেওয়ার প্রথম চাদরগুলাে থেকে সেই শােকাচ্ছন্ন পােশাক যা গায়ে চাপিয়ে তাকে কবরে দেওয়া হয়, সে যেন একটা ছুঁচোর মত সুড়ঙ্গ দিয়ে এ জামা থেকে ও জামাতে যায়, এক কোট থেকে অন্য কোটে, যতক্ষণ না – অন্য কারাের হাতে সেজে – সে ঢােকে কবর দেওয়ার দায়িত্ব পাওয়া লােকটির ছােট ঘরটাতে। আমার এখনাে মনে আছে আমার দারিদ্রের দিনগুলােতে পরা সেই সবুজ স্যুটটার কথা, যেটা শেষমেশ রং চটে হলদে হয়ে গিয়েছিল; আমার মনে পড়ে সেই ইংলিশ দুটো বুকপকেটওয়ালা নীল। জামাটার কথা যেটা আমার জীবনে প্রথম সাফল্যের সময় আমায় সঙ্গ দিয়েছিল; এবং সেই টুঈড স্যুটটা যা আমি পরেছিলাম যেদিন আমি সােনিয়ার কাছে প্রেমপ্রস্তাবের জন্য নিজেকে মেলে দিয়েছিলাম; এবং সেই ধূসররঙা জামাটা একটু একটু করে খুলছিলাম, যখন সে, এর মধ্যেই নগ্ন হয়ে, একটা পিচে কামড় দিচ্ছিল, এবং বাকী সব পােশাকগুলাে, তাদের কেনার তারিখসমেত, সমৃদ্ধ বছরগুলােতে তৈরি হওয়া ভালাে জাতের মদের মতই। যে মুহূর্ত থেকে মানুষ তার চোখদুটো খােলে যতক্ষণ না সে সেগুলােকে বােজায় – এবং এমনকি সেগুলাে বােজানাের পরেও – মানুষ নিতান্তই বিভিন্ন খাপে ঢাকা একটা ছাতার ভূমিকাই পালন করে; ধরে নেওয়া হয় যে খাপণুলাে তুলে ধরে চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তি, এবং সামাজিক অবস্থান।সময় হয়ে গেছে। এবার মিরামােন্তেসের প্রাসাদে যেতে হবে, আমার স্যুটে ঠিকঠাক লাগানাে আঠারােটা বােতামসমেত (দুটো ভেতরের পকেটগুলােতে, কোমরবন্ধনীতে ছটা, জ্যাকেটের ওপরে তিনটা, ওয়েস্টকোটে সাতটা)। আজ নটাতে প্রতিবেশী দেশগুলাের সীমান্ত সংক্রান্ত দাবি দাওয়া নিয়ে একটা ক্যাবিনেট মিটিং রয়েছে। আমি মিরামােন্তেসের প্রাসাদে পৌঁছে যাই এবং দেখে অবাক হই যে অধিকাংশ পথচারীই কিছু একটা ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সার্জেন্ট রেতন সেন্ট্রি বক্সে বসে রয়েছে, পুরােপুরি সশস্ত্র অবস্থায়, দুটো কার্তুজের বেল্ট বেড় দিয়ে ঝুলছে তার শরীরে। প্রহরীদের ঘরটাতে একটা উত্তেজনাভরা অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেল, ঘরটার বারান্দা (যেটা হলে ঢােকার প্রবেশ পথও বটে) দেখা যায় রাস্তা থেকে। এই মুহূর্তে অর্থমন্ত্রী তার জাগুয়ারে চেপে ঢুকলেন : তাকে দেখে দরজা খােলা হল স্বাভাবিক সৌজন্য দেখিয়ে, কিন্তু যখনই তিনি হলে ঢুকলেন তার কাঁধদুটো কর্কশ ভাবে চেপে ধরা হল এবং এক মিলিটারী প্রহরীর হাতে মাকে তুলে দেওয়া হল। যখন জনকল্যানমন্ত্রী তার ক্যাডিলাকে চেপে পৌছােলেন তখনও একই জিনিস ঘটল। এবং একইরকম অবস্থা হল স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বরষ্টসচিব, ও এবং পরিবহন ও যােগাযােগ মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও … বেতন তােমায় দেখতে পেয়েছে। সে উপরে আসছে। “তুমি কি ভেতরে আসছে না, ডক্টর? আজ তাে একটা ক্যাবিনেট মিটিং আছে।” এবং সে তার ভারী হাতদুটো ধপ করে তােমার কাঁধে রাখে। আমি এক্ষুনি আসছি,” তুমি বলে ওঠো; “কিন্তু আমি কোনের ঐ দোকানটা থেকে কিছু সিগারেট আনতে চাই।” আমি তােমাকে এনে দিচ্ছি।” “সার্জেন্ট,” তুমি এমন কর্তৃত্বের সুরে বলাে যে রেতন স্তম্ভিত হয়ে যায়, “একজন সৈন্যের কখনােই তার জায়গা ছেড়ে যাওয়া উচিৎ নয়। তুমি অবশ্যই ক্লসেউইতস আবার পড়াে, এছাড়াও আমার তো মনে হয় তুমি খুব ভালােভাবে খুঁটিয়ে তার লেখা পড়েনি।” রেতন হতবাক হয়ে যায়, কিন্তু একান্ত সচিব এ ব্যাপারে সচেতন যে যখনই তিনি বারের কোনটাতে ছােট তামাকের দোকানে যাবেন রেতন তাকে অনুসরন করে চলবে। এবং একটা মাউজারকে খুব তাড়াতাড়ি লােড করলে যে ক্লিক ক্লিক করে সতর্কতার শব্দ শোনা যায় রেতন উপভােগ করত সেটা তাকে কেউ শুনতে দিক।ভারতে রাস্তার অন্য দিক দিয়ে ঢােকার দরজা নেই তুমি নিজেকে বললে, “আমাকে এক প্যাকেট চেস্টারফিল্ডস দাও”। রেতন তখনাে পর্যন্ত তােমার উপর নজর রেখে চলেছে। সময় নাও, নড়াচড়া করাে যাতে সার্জেন খুব সহজেই তােমায় দেখতে পায় ও দেরী হওয়ার কারণ বুঝতে পারে। “ঐ ঠান্ডা পানীয়ের বােতলগুলাের একটা আমি নেব।” বােতলটা ঠান্ডা। তবু তুমি বলে ওঠো : “এটা ভালাে ঠান্ডা নয়। আমাকে কিছু বরফ টুকরাে দিও দয়া করে।” খবরের কাগজে শিরােনামগুলােতে দেখা যায় : অন্তরীক্ষ বাহিনী জেনারেল মাবিলানের বিদ্রোহে যােগ দিয়েছে। এবং তাই প্রাসাদের নিজস্ব বাহিনীও তাই করেছে”, তুমি নিজের মনে বিড়বিড় করে ওঠো, “দয়া করে, আরেকটা ঠান্ডা পানীয় বোতল। হঠাৎ প্রহরীদের ঘরটাতে এক তুমুল হট্টগোল শুরু হল। রাষ্ট্রপতি এইমাত্র প্রধানমন্ত্রীর সাথে এসে পৌঁচেছেন। এরকম গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনদের মুখোমুখি হয়ে রেতন এতই উত্তেজিত হয়ে ওঠে যে সে তার সেল্টি বক্স ছেড়ে নেমে আসে ও প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বেশ কবার গুলির আওয়াজ শােনা যায় – রাষ্ট্রপতির দিক থেকে প্রতিরােধের এক নিম্কল চেষ্টা, যেমনটা আমি পরে শুনেছিলাম। এই সাময়িক অস্থিরতার সুযােগ নিয়ে তুমি বারটা ছেড়ে চলে যাও ও নিউইয়র্ক ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকের অফিসগুলাের দিকে দৌড়ে যাও, যেগুলাে সেই লোকের ভিড়ে ভর্তি যারা এখনাে জানে না পঞ্চাশ গজ দূরে কি চলছে। তুমি পাশের রাস্তাটা ধর এবং শহরের পুরনাে দিকটাতে চকিতে ঢুকে পড়,যেখানে কেউ চেনে না তোমায়।

                                                            ক্রমশ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here