ছোটদের গল্প -প্রসন্ন প্রভাত

2
48
ছোটদের গল্প

                           প্রসন্ন প্রভাত

                                    মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

                                                            ছবিঃ গৌতম মাহাতো

   রূপ তার আহামরি কিছু না, তবু নাম রূপসী। বাইরের সৌন্দর্য নয় – আসলে কেউ কেউ মনের সৌন্দর্যে উজ্জ্বল – অতুলনীয় হয়ে ওঠে। সেইদিক থেকে বিচার করলে আমি যে রূপসীর কথা বলছি তার নাম যথেষ্টই সার্থক-অর্থবহ। সেই রূপসীর সঙ্গে আমার খুব ভাব। এখন তো আবার ভালো বন্ধুও বটে। এই বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পিছনে আমাদের পিছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস মধুর-টক-ঝাল না তেতো সে বিচারে যাব না। এইটুকু বলতে পারি এখন আমরা দু’জন দুজনার কাছে খুবই ভালো বন্ধু। তাই আর বেশি কথায় না গিয়ে সরাসরি ইতিহাসটাকে ছোঁয়া যাক। 
   আমি যে স্কুলে পড়তাম সেটা মাধ্যমিক পর্যন্ত। ভালো নম্বর পেয়ে শ্রেণিতে প্রথম হয়ে নাইনে উঠলাম। এই নাইনে এসেই ভর্তি হল রূপসী। ও যে স্কুলে পড়ত সেটা নাকি এইট অবধি পড়ানো হয়। কালো, লম্বাপারা, লিকলিকে একটা চেহারার একটা মেয়ে। মুখে ব্রণে ভর্তি। তবে রূপ না থাকলে কী হইবে – শুনলাম পড়াশোনাতে নাকি ভালো। নম্বর যা পেয়েছে সেটাও আমারই কাছাকাছি। তবে আমাকে টপকাতে পারেনি। ভেতরে ভেতরে খুশি হলাম – যাক, আমার থেকে কম নম্বর পেয়েছে। 
   নাইনের সেদিন প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি যেমন বরাবর ফার্স্ট বেঞ্চে বসে এসেছি সেদিনও যথারীতি বসেছি। রূপসী আমার দু’টো বেঞ্চের পর বসেছে। তার সঙ্গে তখন তেমন পরিচয় হয়নি বললেই চলে। 
   আমাদের প্রথম পিরিয়ড ছিল ইংরেজির। ঘণ্টা পড়তেই ইংরেজির স্যার সত্যেনবাবু ক্লাসে ঢুকলেন। রাসভারী মানুষ তিনি। উপরি উপরি কড়া ধাতের মনে হলেও ভিতরটা তাঁর কোমল-নরম। আমরা তাঁকে যেমন যমের মতো ভয় করি তেমনই আবার অত্যন্ত শ্রদ্ধাও করি। ইংরেজির শিক্ষক হলে কী হবে ধোপ-ধুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন। ঠাটে-ঠমকে আভিজাত্যে তাঁর খাঁটি বাঙালিয়ানার চিহ্ন প্রস্ফুটিত। তিনি রুচিবান-সংস্কৃতি সম্পন্ন। বিদ্যালয়ের যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই তাঁর উপস্থিতি একান্তই আবশ্যক। তিনি নাহলে অনুষ্ঠানের মাধুর্যই যেন থাকে না। 
   অসম্ভব জনপ্রিয়, রাসভারী শিক্ষক সত্যেনবাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন – আজই তো প্রথম ক্লাস শুরু হচ্ছে তোমাদের?
   আমরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। 
  -তোমাদের তো তাহলে এখনো মনিটর নির্বাচন করা হয়নি কাউকে?
  -না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম। 
   সত্যেনবাবু বললেন – আজ তোমাদের মনিটর নির্বাচনের একটা পরীক্ষা নিয়ে নেব ভাবছি। 
   পরীক্ষা শুনেই আমাদের মনে একটা ভয়ের উদ্রেক হল। বুক দুরু দুরু করতে লাগল। কী পরীক্ষা বলতে কী নেবেন কে জানে! এ ওর মুখের দিকে তাকালাম। পুরো ক্লাস স্তব্ধ-থমথমে হয়ে গেছে। একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে এমনই পরিবেশ। 
   সত্যেনবাবু মৃদু হাসলেন। বললেন – পরীক্ষার কথা শুনে মনে হচ্ছে খুব ভয় পেলে গেলে তোমরা? আরে! এত ভয়ের কী আছে? শোনো, আমি তোমাদের মাত্র দশটা ইংরেজি শব্দ লিখতে দেব। প্রতিটি শব্দ এক নম্বর করে। যে বেশি নম্বর পাবে সেই হবে মনিটর। নাও, সবাই খাতা–কলম বের করো।
   স্যার শব্দগুলো বলতে লাগলেন। আমরা খাতায় লিখতে থাকলাম। দশটা শব্দ লেখা সারা হলে টেবিলে আমরা ছাত্রছাত্রীরা খাতাগুলো জমা দিলাম। এরপর সত্যেনবাবু খাতাগুলো দেখতে লাগনেল। আমাদের মনের মধ্যে ঔত্‍সুক্য আর 

কৌতুহলের দোলা। দুই, তিন কেউ বা আবার এক – এই নম্বরই পাচ্ছে। আমার মধ্যে একটা অহঙ্কার কাজ করছে। আমি নিশ্চই ওদের থেকে বেশি নম্বর পাব। ক্লাসের সবাইকে আমি চিনি। শুধু একজনকেই জানি না – সে রূপসী। রূপসীর মেরিট আমার জানা নেই। 
   একসময় আমার খাতাটাও দেখা হল। আমি ছয় পেয়েছি। এখন পর্যন্ত দেখা খাতাগুলোর মধ্য থেকে বেশি নম্বর। আমার চিন্তার অবসান। কিন্তু বুকটা এখনো ঢিপ ঢিপ করছে। রূপসীর খাতা দেখা এখনো বাকি। একজনের পর রূপসীর খাতাটা এবার দেখা হচ্ছে। কখনো এরকম হয়নি আমার। আজ আমি নিজের থেকেই শিউরে উঠছি যেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রূপসীর খাতা দেখা সারা। আশঙ্কা সত্যি হল। রূপসী পেয়েছে সাত। বাকি যে খাতগুলো ছিল তাদের কেউ তিনের বেশি পেল না। 
   তার মানে রূপসীই ফার্স্ট, রূপসীই সেরা।
   সত্যেনবাবু গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন – রূপসী মণ্ডল কে?
   রূপসী দাঁড়াল। নতুন ভর্তি হয়েছে সে। 
   সত্যেনবাবু ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন রূপসীকে। বাবার নাম, ঠিকানা, আগে কোন স্কুলে পড়ত সব কিছু জেনে নিয়ে বললেন – তুমিই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছ। আজ থেকে তুমিই ক্লাসের মনিটর। 
   আমার মাথা আপনা থেকেই নিচু হয়ে গেল। সেই প্রথম অনুভব করলাম হারের  জ্বালা কী! সাথী, দেবনাথ, ব্যোমকেশ, ঈশিতা, সোনালি-আমার এতদিনকার পরিচিত বন্ধুরা চুপচাপ বসে থেকে দেখল তাদের বন্ধুর পরাজয়। সেদিন রাতে আমার ভালো করে ঘুম হল না। কোথাকার কে একটা মেয়ে রূপসী এসে আমায় হারিয়ে দিল!
   পরের দিন রূপসী স্কুলে এসেই আমার কাছে এগিয়ে এল। শান্ত-মৃদুকন্ঠে বলল – মনে কিছু করো না সবিতা। এক নম্বর বেশি পেয়েছি, ওটা এমন কিছু না। এসবের পরীক্ষার কোনো ভিত্তি নেই। আমি তো নতুন এই স্কুলে। সবকিছু জানা নেই তেমন। তুমি কিন্তু সর্বদা আমার সঙ্গে থেকো। কী সবিতা, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো? রূপসী আমার হাত ধরল। 
   রূপসীর সরলতা আমাকে মুগ্ধ করল। তার সাথে হাত মেলালাম আমি। তবু কোথায় যেন একটা পরাজয়ের গ্লানি আমার বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে রইল। 
   ক’দিন পরেই বিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি আবৃত্তিটাও করি ভালো। আবৃত্তিতে আমার যথেষ্ট সুনাম আছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যেও এ ব্যাপারে আমাকে নিয়ে গর্ব আছে। অনুষ্ঠানের দিন আবৃত্তি প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিচারকরা যে যার আসন গ্রহণ করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ধর্মদাসবাবু ও সত্যেনবাবু বিচারক হিসাবে আছেনই – আর আছেন এলাকার বিশিষ্ট কবি রমেন দাস। 
   প্রতিযোগিতা নির্ধারিত সময়েই শুরু হয়ে গেল। তিনজনের পর আমার নাম মাইকে ঘোষিত হল। আমি দৃঢ় পায়ে-শরীরটাকে টান টান করে মঞ্চে উঠে গেলাম। দাঁড়ালাম মাইক্রোফোনের সামনে। বিদ্যালয়ের বড়ো হলঘরটাতে আবৃত্তির প্রতিযোগিতা চলছে। পুরো হলঘর স্তব্ধ-চুপচাপ আমার কবিতা শুনবে বলে। মনের মধ্যে একটা অহঙ্কার নিয়ে আবৃত্তি করলাম শুভ দাশগুপ্তের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘আমি সেই মেয়ে’। আবৃত্তি শেষের সঙ্গে সঙ্গে পুরো হলঘর শতশত মানুষের হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলাম – নিশ্চয়ই আমি আবৃত্তিতে প্রথম হচ্ছিই। বিচারকদের চোখে-মুখেও দেখলাম একটা ভালোলাগা – প্রসন্নতার হাসি।
   এরপর আরও দুজন আবৃত্তি করল। গতানুগতিক সাদামাটা। আমার ধারে পাশে আসবেই না তারা। সবশেষে আবৃত্তি করতে উঠল রূপসী-রূপসী মণ্ডল। এই মেয়েটাই কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে প্রথম দিনই ক্লাসের একটা পরীক্ষায় হারিয়ে দিয়েছে। এবার নিশ্চয় বাছাধন কুপোকাত হবে। ও আজ হারবেই হারবে আমার কাছে। আর হারাতে যদি পারি তবে বুকের জ্বালা কিছুটা হলেও জুড়োবে। 
   কিন্তু হায় কপাল! তখন কে জানতো সব হিসেব উল্টে দিয়ে এই মেয়েটা আমার বুকের জ্বালা কমানো তো দূরের কথা – আরো বাড়িয়ে দেবে। এরপর যা ঘটল তা অকল্পনীয়, অপ্রত্যাশিত, অভাবনীয়। রূপসী মঞ্চে উঠে আবৃত্তি শুরু করল শুভ দাশগুপ্তেরই ‘পাহাড় দেখা’। গলা তো নয় যেন কন্ঠে যাদু খেলছে রূপসীর। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করছে আর যেন সুধা ঝরে পড়ছে। কালো-কুত্সিত-বিশ্রী দেখতে মেয়েটা এত সুন্দর কণ্ঠ পেল কোথা থেকে? আবৃত্তি তো নয় যেন তার নিজের জীবনের কথা বলছে রূপসী। অন্য দর্শক-শ্রোতাদের কথা তো বাদই দিলাম রূপসীর কন্ঠের এমন মায়া, 


সাবলীলতা, স্পষ্টতা, স্বচ্ছতায় বিমুগ্ধ-বিমূঢ় হয়ে পড়ছি তো আমি নিজেই। রূপসীর আবেগঘন আবৃত্তির যাদুতে শুধু মুগ্ধ নয় – সম্মোহিত হয়ে পড়ছে যেন সবাই। 
   আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ফলাফল যা হবার তাই হল। রূপসীর কাছে আবার আমার মাথা হেঁট। প্রথম হয়েছে রূপসী, আমি দ্বিতীয়। আমার থেকে রূপসী দু’ নম্বর বেশি পেয়েছে। আমার বুকটা হারের জ্বালায় জ্বলতে লাগল। সে জ্বালায় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো জ্বলুনি বাড়িয়ে দিল ব্যোমকেশ আর দেবানন্দের কথাগুলো। ওরা বলল – কুত্সিত, লিকলিকে মেয়েটার কাছে আবারো কিন্তু তুই হরলি সবিতা। 
   আমি উত্তর দিতে পারলাম না। পরাজয়ের ভ্রূকুটি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। জেদ চাপল পড়াশোনার। পড়াশোনায় রূপসীকে হারাতে হবেই। দু-দু’বার আমি হেরেছি রূপসীর কাছে, আর তৃতীয়বার অন্তত হারতে রাজি নই। 
   যে রূপসীকে নিয়ে আমার বুকে অস্থিরতার ঢেউ উঠেছে, হিংসা না কী হচ্ছে জানি না তবে রূপসীর মধ্যে এসবের কিন্তু কিছু নেই। সে সরল সাপটা, জলের মতোই স্বচ্ছ তার অন্তর। পরের দিনই রূপসী আমাকে বলল এবং বেশ উচ্ছ্বাসভরা গলায় বলল – সবিতা, কাল না তোমার আবৃত্তিটা দারুণ হয়েছে। এক কথায় বলতে পারি অপূর্ব, অসাধারণ! আমি বিচারক থাকলে তোমাকেই প্রথম করতাম। তোমার আবৃত্তির সুর এখনো আমার কানে যেন রিনিঝিনি করে বাজছে। বিশ্বাস করো, এতটুকুও বাড়িয়ে বলছি না সবিতা। 
   রূপসী কথাগুলো এমনভাবে বললো আমাকে আমি না পারলাম তার উপর রাগ করতে, না পারলাম তাকে হিংসা করতে। মেয়েটা এমন উদার মনের অধিকারী হল কীভাবে? তা রূপসী যতই অমায়িক হোক, সরল হোক – ওকে আমাকে একবার   হারাতেই হবে। যে কোনো ভাবে। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। 

                                                              ক্রমশ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here