শ র্মি লী   দে ব   কা নু ন গো -র দুটি অণুগল্প

2
122
পরিচিতিঃ শর্মিলী দেব কানুনগো। আসামের শিলচর শহরে থাকেন। অর্থনীতি নিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কিন্তু সাহিত্যকে ভালোবেসে লেখালেখির জগতে চার পাঁচ বছর হলো জড়িয়ে পড়া। “ঘাসফুল কথা” নামে একটি অণুগল্পের সংকলন রয়েছে তাঁর।

 

শ র্মি লী   দে ব   কা নু ন গো -র দুটি অণুগল্প

 

ফেরিওয়ালা

শেষ পর্যন্ত একচোট হয়ে গেল নিমাইর সঙ্গে। নিমাই বিপিন বাবু র অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। হত না যদি বড় সাহেব দশ কথা না শুনাতেন বিপিন বাবুকে। এ নতুন কিছু না। বিপিনবাবুর জীবন টা এভাবেই যাপিত হচ্ছে। আর সেটা অনেক দিন ধরে। বাজার থেকে মাথা গরম করে এসে বৌকে কথা শুনানো, তারপর সেটার রেশ বাস কন্ডাক্টর হয়ে অফিস অব্দি পৌঁছে যায়। কখনও বা অফিস ফেরতা মনের ঝাল বাড়ি অব্দি পৌছে যায়। মাঝপথে পাড়ার দু একজনও ঝাড় খান নাম মাত্র দোষে অথবা বিনা দোষে। এসবের মাঝেই বিপিন বাবু বেঁচে থাকার রসদ পেয়ে যান। কিন্তু আজকাল কেমন একটা অন্যরকম ঠেকছে সবকিছু। কেমন যেন ছন্দ পতন। সবাই যে তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে সেটা নজরে পড়েছে বিপিন বাবুর। তাই তিনি বেশ চিন্তিত।এর একটা উপায় বের করতেই হবে। অন্তত এসময় একটা সিগারেট খাওয়ার খুব প্রয়োজন অনুভব করায় রাস্তায় আসলেন তিনি।
—সুখ চাই সুখ… শান্তি নেবে গো শান্তি….. ভালোবাসা চাই ভালোবাসা…..
চমকে গেলেন ফেরিওয়ালার গলার স্বরে। কান পাতলেন। না.. কোনও ভুল নেই। সুখ শান্তি ফেরি করছে ব্যাটা! ভালো করে তাকিয়ে চিনতে পারলেন ওকে। আগে কলম বেচত,তারপর ব্যথার মলম, এবারে দুর্লভ বস্তু। রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিলেন। লোকটা আবার হাঁকল
—সব সমস্যার সমাধান… সস্তায়… আসুন দেখুন নিয়ে যান..
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। লোকটা দুই পা এগিয়ে এল।
—সব চিন্তা দূর হবে দাদা…. নিষেধ যান আমার স্পেশাল লকেট।
খদ্দের কে পুরোপুরি কব্জা করার অব্যর্থ তীর এবার ছাড়ল,
—গৃহ শান্তি ফিরে আসবে… বস পকেটে ঢুকবে.. সম্মান পুনরুদ্ধার হবে… পত্নীর মনে প্রেম আবার ফিরে আসবে.. জীবন স্বর্গ হয়ে যাবে দাদা… শুধু একটা লকেট…. নিয়েই দেখুন…
বিপিনবাবু দরদাম শুরু করলেন। সুখ আর শান্তির লকেটের দাম কম। সেজন্য সেটার স্থায়িত্ব কম সময়ের। তবে ভালোবাসার লকেট তুলনামূলক দামী। তবে হ্যাঁ যেমন দাম তেমন কাজ হবে। যাকে বলে স্থায়ী সমাধান। একটু ইতস্তত করে স্থায়ী সমাধানের দিকেই ঝুঁকলেন। তবে কিছু নিয়ম মানতে হবে এই যা। হোক গে…, নাহয় মেনেই নেবেন। খুশিমনে কড়কড়ে দু হাজারের নোট লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিনিময়ে গলায় ঝুলল ভালোবাসার লকেট। লোকটা কানে কানে বলে দিল লকেটের সার্থক কার্য কারিতার নিয়মাবলী। একটু কষ্টকর, তবে অসম্ভব নয়। ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালেন বিপিন বাবু।
ঘরে পা দেওয়ার মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল নিয়ম। আজ আর রেগে মেগে নয়, হাসিমুখে ঢুকলেন ঘরে। সেটা দীর্ঘদিন পরে দেখলেন পরিবারের সদস্যরা। স্বভাবতই আশ্চর্যান্বিত। চা নিয়ে এলেন স্ত্রী। চুমুক দিয়েই আবার মনে পড়ল ভালবাসার লকেটের নিয়ম। কিছুটা বাধ্য হয়ে হেসে বললেন,
—বাঃ.. বেশ হয়েছে চা..
প্রতিদিন চায়ের দোষ খুঁজে পান যিনি, তার মুখে উল্টো পুরাণ ! অবাক চোখে তাকালেন স্ত্রী। তারপর থেকে হাসিমুখে লকেটের নিয়মাবলী নিয়মিত ভাবেই পালন করতে লাগলেন বিপিন বাবু। আর বিরক্তিভাব, কথায় কথায় রাগ দেখানো… এসব তো একেবারেই নিষেধ। এমনকি অফিসেও নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়ম পালন শুরু করলেন।
ভাবে কদিনের মধ্যে হাতে হাতে ফল পেলেন। অফিস যাওয়ার পথে পাড়ার দাসবাবুর সঙ্গে দেখা। লকেটের নিয়ম মানতে হেসে জিজ্ঞেস করতেই হল,
—কেমন চলছে?
উনি হেসে জবাব দিলেন
—ভালো।
সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে পাড়ার দোকান থেকে পান খাওয়ালেন দাসবাবু ।
অফিসে ঘোষদা একটু সাহায্য চাইলেন। ব্যালেন্স শীট মিলছে না। আগে হলে পত্রপাঠ বিদায় দিতেন। অবশ্যই গালাগাল সহযোগে। আজ বেফাঁস অবস্থা। ভালবাসার লকেট। তাই নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়ালেন।ঘোষদা সবার কাছে স্বীকার করলেন “বিপিন বাবু মানুষ ভালো ”। পরের দিন অফিসের সবাইকে বড় আপন লাগলো। কই আগে তো এদের এমন লাগেনি? লকেটের গুণ আছে বলতে হবে। বাড়িতে আজকাল গিন্নী অপেক্ষা করে থাকেন মন মতো খাবার নিয়ে। একসঙ্গে বসে দুজনে চা খান। সেদিন তো হাতে হাত রেখে বসলেন দুজনে। অবাক বিস্ময়ে পরিবর্তিত জীবন কে দেখছিলেন তিনি। বেশ লাগছে।
আজ তো সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটালো লকেট। অফিস বসের মেজাজ একেবারে টং হয়ে আছে। বেশ করে কথা শুনালেন বিপিন বাবু কে। কিন্তু তিনি প্রতি বারের মতো উত্তপ্ত না হয়ে কষ্ট করে ‘সরি’ বলে দিলেন। আর বস আশ্চর্যান্বিত। এখন শুনা যাচ্ছে বস নাকি উপর মহলে বিপিন বাবু র প্রমোশনের জন্য সুপারিশ করছেন।
আনন্দে আত্মহারা বিপিন বাবু লকেটকে চুম্বন করলেন। শুধু কুচুটে বলে খ্যাত পানু রায় দেখল সেটা। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
—কি ভায়া, বস কি করে পটলো… তন্ত্র মন্ত্র নাকি?
সাবধান হয়ে গেলেন বিপিন বাবু।
তবে কদিন পর দেখলেন সেই ফেরিওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে পানু রায়। তারপরের দিন থেকে সেও কেমন নিরীহ গোছের হয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝলেন বিপিনবাবু পানু রায় লকেটের নির্দেশ প্রাণপণে মানছে।
কিন্তু কে জানত সুখ যে বিপিন বাবুর কপালে সইবে না। হঠাৎ করে লকেটটা হারিয়ে গেল। অথৈ জলে পড়লেন তিনি। কি করে কাটবে বাকি জীবন লকেট ছাড়া!
হন্তদন্ত হয়ে ফেরিওয়ালাকে খুঁজে বের করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিপিন বাবুর কারন সে এখন দাঁতের মাজন ফেরি করে।

রাতের বেলুন

আমার ইদানীং একটা ভীষণ সমস্যা হয়েছে। মানে রাস্তা ঘাটে সন্ধ্যার পর আর বেরোতে পারছি না। ভয় করছে। ভীষণ ভয়। কিসের ভয়? স্বাভাবিক এটা ই জানতে চাইবেন। কিন্তু কি করে যে বলি!! আরে মশাই দিন সাতেক আগে বিকেলের দিকে পার্কে গেছি হাওয়া খেতে। আমি ঐ হাওয়াই খাই। আর তেমন কিছু খাই টাই না। তবে সেদিন যে কি হলো আমার। নির্ঘাত আমার খারাপ সময় চলছিল কোষ্ঠী মতে। না হলে এমন হয়! হঠাৎ ই দেখলাম একটা লোক ছোট একটা ব্যাগে করে কিছু একটা বিক্রি করছে। নেহাত কৌতূহল বশতঃ গেলাম দেখতে। কি বলব মশাই… আগে এই জিনিস কখনও দেখিনি আমি। অদ্ভুত দেখতে একটা ছোট ফল। বেশ লাল টুকটুকে দেখতে। কিন্তু কেমন যেন স্বচ্ছ ফলটা। ভিতরের বিচিগুলো দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। তা কিনে একটা খেলাম। মন্দ নয়। বেশ কাঁচা মিঠে খেতে। খাওয়ার পর ই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই ফল ওয়ালা কে আর দেখতে পেলাম না। সেদিন রাত থেকেই আমার সমস্যা টা হচ্ছে। রাতে বিছানায় শুয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি একটা বেলুন হয়ে যাচ্ছি। আর তারপর ফরফর করে সারা শহর ময় উড়ে বেড়াচ্ছি। ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে বেলুন জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছি। কি ভয়ানক ব্যাপার! শুধু কি তাই? এই যে সারা রাত ধরে আমি উড়ছি কতকিছুই দেখছি। বড় অবাক লাগছে জানেন তো! দিনের আলোর মানুষজন রাতে কেমন বদলে যায়! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস ই হতো না আমার। আচ্ছা এই গতকাল রাতের গল্প টাই বলছি। আমাদের হারুদা কে সবাই কিপটে হারু বলেই জানে। মোড়ে র মাথায় চা আর চপ বিক্রি করে। জীবনে কখনও হারুদা কাউকে বিনি পয়সায় কিছুই দেয় নি। এমন কি কুকুর বেড়াল পর্যন্ত হারুদা র হাত থেকে কোনও দিন কিছু পায় নি। সেই হারুদা র দোকানে র সামনে গতকাল সকাল বেলা পাড়ার কজন এনজিও দাদা এসে গরীবদের খাবার দাবার বিতরন করলেন ঘটা করে ছবি তুললেন। তারপর আমরা সবাই ওদের সেই দয়ার শরীর দেখে ধন্য ধন্য করলাম। শুধু হারুদা মুখ বাঁকিয়ে দোকানে বসে র ইল। আমরা জানতাম ওর এসব সহ্য হবে না। মহা কিপটে লোক মশাই। আমরা কজন ওকে এ নিয়ে দু কথা শুনিয়ে ও দিলাম। তবে প্রতি উত্তরে কিছু বলল না সে।
সেদিন রাতে আমি যথারীতি বেলুন হয়ে উড়ে যাচ্ছি হারুদা র দোকানে র উপর দিয়ে। হঠাৎ দেখলাম হারুদা একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে রাস্তার মোড়ে গেল। আমি ও গেলাম উপরে উপরে। দেখলাম আশেপাশের সব রাস্তায় ঘুমনো বাচ্চাদের হারুদা বিক্রি না হ ওয়া চপগুলো হাতে তুলে দিচ্ছে। ওরা অভুক্ত খিদে নিয়ে গপাগপ সেসব খাচ্ছে আর হারুদা তৃপ্ত চোখে তা দেখছে। আমাদের কিপটে হারুদা রাতে এমন হয়ে যায়! ক ই দিনে তো এসব কিছুই বলে না আমাদের। দমকা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলেছি। দেখলাম নীচে সেই দিনের বেলার এনজিও বাবুরা দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। একটা ভিখারি এসে হাত পাতল। বাবু সারাদিন কিছু খাইনি….। এনজিও বাবু ধমকে দিল লোকটা কে। বাজে একটা গালাগাল ও দিল। লোকটা হতাশ মুখে চলে গেল। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একেই তো সকাল বেলা আমরা কত ভালো ভালো কথা বলে প্রশংসা করেছি। তবে কি রাতের অন্ধকার মানুষকে পাল্টে দেয়! না কি অন্ধকারে মানুষ কে ভালো চেনা যায়! ধপাস করে বিছানায় পড়লাম এসে। ভোরের পাখি ডাকছে। আমি রাতের অপেক্ষায় থাকলাম…..

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here