গৌ ত ম কু মা র গুপ্ত-র একগুচ্ছ অণুগল্প

0
50
পরিচিতিঃ  জন্ম  ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া থানার গোপালনগর গ্রামে।বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের বাসিন্দা।প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা পরে ই সি এলে কেন্দা এরিয়া বিভাগের কর্মী ছিলেন।২০১৯ সালে চাকুরিজীবন থেকে অবসর গ্রহন করেন।শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞান এবং কলা বিভাগে স্নাতক।পরে পার্সোনাল ম্য্যানেজমেন্ট ইনডাসট্রিয়াল রিলেশনে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। আশির দশক থেকে লেখালেখি শুরু।’কালকেতু’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তো বটেই ওয়েব ম্যাগাজিনেও গল্প কবিতা প্রবন্ধ লিখে থাকেন।এ পর্যন্ত তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ  ” সময়ের এই জলসাঘরে,’স্বভাবের সিলেবাস’,’অক্ষর ভাইরাস’ এবং ‘বিষুবরেখার পাখি’ প্রকাশিত হয়েছে।কয়েকটি নাটকও লিখেছেন। “কয়লাক্ষেত্র “নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।।আরো একটি উপন্যাস “কৃষ্ণগহ্বর “শীঘ্র প্রকাশিত হতে চলেছে। আজ বাইফোকালিজমে রইল তাঁরই একগুচ্ছ অণুগল্প।

 

গৌ ত ম কু মা র গুপ্ত-র একগুচ্ছ অণুগল্প

 

তাহলে

 

মন্মথ অন্যদিন ভোর বেলাতেই উঠে যায়,আজ ওঠে নি।অন্তরা একবার উঁকি মেরে দেখে এলো। ওঠার নাম নেই।শরীর খারাপ নাকি কে জানে, বলেও তো না।অন্তরাকে চিন্তিত দেখালো বটে কিন্তু মনে মনে গজরাতে লাগলো।
স্বামী স্ত্রী দুজনেই ডায়াবেটিক,সুগার ফ্রী চা খেতে হয়।অন্তরা দেখলো, ডিব্বাতে সুগার ফ্রী খতম।দুধ-চা খাওয়া কবে বন্ধ করে দিয়েছে,লিকার চা খেতে হয়।কিন্তু লিকার চা এম্নি এম্নি খাওয়া যায় না,সুগার ফ্রী দিতেই হয়।
অন্তরা ভাবলো ও না হয় চোখ বুজে গিলে নেবে কিন্তু ওকে দেবে কী করে?গতকালই বাজার যাবার
সময় পই পই করে বলে দিয়েছিল,সুগার ফ্রী পাউডারটা আনতেই হবে,এক্কেবারে শেষ।যা হয়,আনতে ভুলে গেছেন উনি….উঠুক, একসাথে দুজনে এমনিই খাবে।
আরো একবার উঁকি দিতে গিয়ে দেখলো,ফাঁকা দেওয়ালের দিকে মুখ করে চোখ বুজে বসে আছে।
— কি ব্যাপার, ওই ভাবে চোখ বুজে বসে আছো কেন?
— চোখ বুজে লোকে কী করে জানো না?
— কিন্তু দেওয়ালে তো কোন ছবি টবিও নেই,তাহলে?
মন্মথ চোখ বুজে বসেই রইলো।
লোকটার কি শেষমেষ মাথাটাও গেল?

 

রেট

 

পাড়ার গোপীর সেলুনে চুল কাটতে গেলেন মদন সাঁতরা। গিয়ে দেখলেন দুজনের পরে তার পালা।একটা সিগারেট খেয়ে আসছি বলে দশ মিনিট পরেই ফেরত এলেন।আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর চুল কাটার পালা এলো।গোপী জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন– শুধু দাড়িটা কেটে দাও।চুল আরো দুদিন পরে।
মদন লক্ষ্য করেছিলেন, চুল দাড়ি সত্তর টাকা, শুধু চুল পঞ্চাশ টাকা।মনে মনে ভাবলেন,বাপ রে এতো রেট।না কাটলেই ভাল,তাই দাড়িটা কেটে নিয়ে গোপীকে কুড়ি টাকা দিতে বাধ্য হলেন।
মদন বাড়িতেই দাড়ি কাটেন.. আজ পঞ্চাশটাকা বাঁচিয়ে কুড়িটাকা কষ্ট করে দিলেন।
পরের দিন পাড়ার এক মালি হরিশকে ধরলেন.. লোকটাকে পার্টাইম চুল কাটতে দেখেছেন পাশের বাড়ির ছাদে।লোকটা বাগানও দেখে আবার ফরমায়েসী চুলও কাটে।
একটা টুলের ওপর বসে চুল কাটা হলো।আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন.. মাথার মধ্যপ্রদেশে ভালই টাক পড়েছে….. চুলও কমে এসেছে.. ব্যাটা নাপিতকে খাটতেই হয় না।পঞ্চাশটাকা রেট হয় কি করে,মেরেকেটে তিরিশ হওয়া উচিত।
চুল কাটা শেষ হলেই মদন তিনটে দশটাকার নোট ধরিয়ে দিল।
–এ কি! কম দিচ্ছেন কেন?রেট তো এখন পঞ্চাশ!
– -সে তো সেলুনে হে।যেখানে গদি আঁটা চেয়ার ঝকঝকে সামনে পিছনে আয়না.. ওর সঙ্গে তুলনা করছিস!
— কিন্তু ওখানে তো লাইন দিতে হয়, এখানে বাড়িতে বসে একা একা কাটার সুবিধা পেলেন যে,তার বেলা?
মদন এবার চোখের সামনে আয়না ধরে বললো– দ্যাক্ দ্যাক্, এখানটা মেলাতে পেরেছিস?কেমন এবড়ো খেবড়ো হয়ে আছে।মদন হাতের আঙুল দিয়ে দু চারটে চুল লম্বা করে দেখিয়ে দিল….এ কি বাগানের আগাছা ছাঁটছিস নাকি?
— বসুন,ঠিক করে দিচ্ছি… কাঁচিটা তুলে রেডি হল হরিশ।
— থাক,আর ঠিক করতে হবে না… খুব করেছিস।
যা ভাগ্।
হরিশ গজগজ করতে করতে চলে গেল…..আর ডাকলেও আসছি না.. এই বলে দিলুম।

 

কবির ভুল

 

কবি মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করলেন…..আজ কিছু একটা সচরাচর ঘটিত হয় নি….যেটা হয়ে থাকে।মনে পড়ছে না সঠিক…..রাত তখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই।

সকালে যথারীতি ছাদে প্রাতর্ভ্রমণ ফুল তোলা
গাছেদের শরীরে মরমী হাতের ছোঁয়ায় জলসেচন মাটির অবিন্যস্ত খনন। সবই তো হয়েছে তবু কেন যেন মনে হচ্ছে……আজ কিছু একটা হয় নি।

আজকের জীবনযাপন ছানবিন করে দেখলেন…… প্রাত্যহিকীর কোথাও কিছু প্রমাদ হয়েছে নাকি……..চা প্রাতরাশ মধ্যাহ্ন ভোজন দিবানিদ্রা….দূরদর্শনের করোনা খবর টুকিটাকি সিরিয়াল…….বৈকালিক সূর্যাস্তে ফেলে আসা স্মৃতিচারণ…..অতীতনামার দু এক পৃষ্ঠার খোলসা
প্রতিবেশে স্বল্পায়ু আলাপ কুশল বিনিময়…সবই তো হল তবু কেন খোঁচা মনের ভেতর!

আন্দাজে গরমিল হাতের তালুতে ঠুকলেন…..সরছে না মনের অদ্ভূত রহস্য…..কিছু একটা হয় নি আজ।

রাত তখন সাড়ে বারোটা।কবির একমাত্র নাতি রাত জেগে পড়ছে… সেকসপিয়ারের নাট্যকলায় কবিসত্তা।

দাদুকে অতো রাত জেগে থাকতে দেখে কবিতার….. ডায়েরীটা ধরিয়ে দিয়ে বললো…দাদু,আজকে তোমার কবিতা লেখা হয় নি….লিখে ফেলো।

ডায়েরীটা আমিই নিয়েছিলাম….তোমার কবিতাগুলো পড়ছিলাম…..কবি বুঝতে পারলেন…..এই একটা ভুল কবিকে অনিদ্রায় রেখেছে এখনো………..তারপর ভুল সম্পর্কিত একটি কবিতা লিখতে লিখতে, লিখতে লিখতে রাত ভোর হয়ে এল।

ভোরের আজান ভেসে আসছে দূর থেকে……..পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হল….. গৃহবন্দী মানুষের ব্যস্ততা পায়ে পায়ে।কবি তখন নিশ্চিন্তে ডায়েরীটাকে বুকের ওপরে
নিয়ে ঘুমোচ্ছেন।

ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা।

 

দাগ

 

প্রশ্নটা অনেকের মুখেই শুনেছে হিতেন দাস।আজকেও শুনতে হলো বন্ধু মন্টুর গলায়। মন্টুর সঙ্গের দেখা হয়ে গেল রবিবারে।ঘোষ মার্কেটের সব্জিবাজারে।প্রথমে না শোনার চেষ্টা করলেও দ্বিতীয়বার এড়াতে পারলো না.. কি রে বাজার হয়ে গেল?
— না, জাস্ট এলাম।
— ও, তা তোর ঠোঁটে ওটা কিসের দাগ?আগো তো লক্ষ্য করি নি।কালো একটা স্পট!!
—আরে আমার বউ জয়া বলছে এটা নাকি স্মোক করার ফল,ডাক্তার বলেছে ওটা ডায়াবেটিক রোগীদের হয়।
— তাই নাকি? হা হা হা… তবে বউ যখন বলেছে ওটাই ঠিক।
— তা বটে।বউদের কথা আমাদের মানতেই হবে।মন্টু মাছের বাজারের দিকে এগিয়ে যেতেই হিতেনও হনহন করে এগিয়ে উল্টোদিকের একটা গলিতে ঢুকে গেল।
হিতেন জানে ওর ঠোঁটের কালো ছোট্ট দাগটা নিয়ে
আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব প্রায়ই জিগগেস করে, হিতেনও দায়সারা উত্তর দেয় অথবা উড়িয়ে দেয়…ও যাক্ গে।হচ্ছে হচ্ছে কি করা যাবে… অথবা নিজের মত করে একটা কনসেপ্ট হাওয়াতে ছেড়ে দেয়.. আরো এটা বয়সের জন্য কারো কারো হয়।
হিতেন কিন্তু দাগের আসল কারণটা জানে,আরো একজন জানে, জয়ার পিসতুতো বোন চিত্রা।চিত্রা
তো ঠোঁট চিবিয়ে কথা বলতে এমনিতেই অভ্যস্ত।এটা ওর মুদ্রাদোষও বটে।।আর এই তো বছর দশেক আগে কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দ্যাখা আর তারই ফাঁকে আবছায়া সন্ধ্যাবেলায় চিত্রার ঠোঁটে ..সেই দাগের ট্র্যাডিশন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে হিতেন।

 

মুখোশ

 

বাড়ির রাঁধুনি লতার কাছে তাঁর জীবনের গল্প শোনে বিপাশা।বিপাশাও কথা বলার একটা লোক
পেয়েছে।বৃদ্ধা শাশুড়ীর সঙ্গে কতো আর বকবে

তাঁদের পাড়াটা নিঝুম।আম জামগাছে পাখিদের ডাক ছাড়া এ তল্লাটে কোলাহল বলে কিছু নেই।নির্দিষ্ট রান্নার কাজ ছাড়াও আরো দু চারটে খুচরো কাজ করে দেয় লতা। বিপাশার শাণুড়ীর পরিবারে অকৃতদার বেকার ভাসুর আর দেওরকে নিয়ে মোট পাঁচটি প্রাণী।বড়ো সংসার। লতাকে বাড়তি দু দশটাকা বা ভাল কিছু খাবার দিয়ে বিপাশাকে ম্যানেজ করে।লতা খুশিও হয়।

লতার কম বয়সেই বিয়ে হয়েছিল।স্বামীসুখ কপালে সয় নি। মেয়ের বয়স তখন বছরখানেক,পেটে ব্যথা দুদিনের জ্বর নিয়ে হঠাৎই মারা গেল।অগত্যা শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়ীতে ঠাঁই নিতে হল একমাত্র দাদার আশ্রয়ে।আর পাঁচটা
ঘরে যা হয়,লতাকেও মুখ বুঝে দাদাবৌদির গঞ্জনা
মুখঝামটা সহ্য করতে হয়।মেয়ের মুখ চেয়ে লতাকেও মেনে নিতে হয়।
লতা কাজের খোঁজ করেছিল।পার্টি অফিসে দাদাদেরও ধরেছিল।শেষমেষ বিপাশার শ্বশুরবাড়িতে মাসমাইনে পনেরোশো টাকায় রাঁধুনির কাজটা পেয়েছিল।তার মধ্যে দাদাকে
হাজারখানেক দেয়।বাকি পাঁচশো টাকা নিজের কাছে রাখে।তাও দাদাবৌদির কথাবার্তার চটক দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে।
একদিন লতা বিপাশাকে জানালো–জানো গো বৌদি, তোমাকে একটা গোপন কথা বলি। একজন বামুনঘরের ছেলে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছে দোতলা বাড়ি,মাছের ব্যবসা,পোলট্রি ফার্মও আছে।তবে মেয়েকে রাখতে রাজী হচ্ছিল না।
— বাহ।দারুণ খবর।
— হ্যাঁ,আমি এখনও দাদা বৌদিকে কিছু বলি নি…আমি বলেছি মেয়ে এখন ওয়ানে পড়ে.. ওকে না রাখলে বিয়ে করতে পারবো না।
— সে তো ঠিকই।
শেষে রাজী হয়েছে,জানো।আজ বৌদির কাছে কথাটা পাড়বো।
বিপাশা মুখে খুশির ঝলক দেখালেও রান্নার লোক হারাবে ভেবে চিন্তাগ্রস্ত হয়।
পরের দিন লতা ডগমগ হয়ে খবর দেয়।
— জানো বৌদি এখন আমার দাদা বৌদির খুব মিষ্টি কথা।দোতলা বাড়ি ব্যবসা শুনে ওরা গদোগদো।খুব আনন্দ।
বিপাশা মুখে “ভাল তো” বললেও মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়—নিজের বিরক্তি চিন্তা চাপা দিতে গিয়ে বলে– লতা,দেখলে কেমন… হোক তোমার দাদা বৌদি
মানুষেরই আচার কেমন দেখো.. যেই শুনেছে দোতলা বাড়ি,…ব্যবসা..
–হুম’ বলে লতাও এড়িয়ে যায়।
আজ বিপাশার মুখে ওর বৌদিরই মুখোসটা দেখতে পায় লতা।

—————

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here