ধরা থাক স্মৃতিসুধায়-শম্ভু রক্ষিত–স্বয়ম্ভু রক্ষিত

0
179

ফিরে পড়া শ ম্ভু র ক্ষি ত–স্বয়ম্ভু রক্ষিত

জন্ম ১৬ আগস্ট ১৯৪৮, হাওড়া শহরে। শিক্ষা মেদিনীপুর ও হাওড়া স্কুল-কলেজে। ১৯৬৪-তে প্রথম মুদ্রিত কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮-তে হাংরি। জেনারেশন আন্দোলনে যুক্ত হলে, কবিকে আত্মদর্শনের সুযোগ করে দেয়। ১৯৭০-এ তার সম্পাদিত কবিতার ত্রৈমাসিক। মহাপৃথিবীর প্রথম আত্নপ্রকাশ। ১৯৭৩-এ দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না কাব্যগ্রন্থের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন জরুরি অবস্থা। জারি হলে চালু হয়েছিল সেন্সরশিপ । আইন। এই সময় কলকাতা’ পত্রিকার যে যা রাজনীতি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫-তে ‘রাজনীতি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় বাংলা ভাষায় নতুন এক রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭৬-এ টানা ২১ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। কারারুদ্ধ ছমাস। ২০০৪-এ ৪০জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর সম্মান ও ২০১২-তে মহাপৃথিবী সম্পাদনা-কর্মের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-মধুপর্ণী’ পুরস্কার পান।
প্রয়াণঃ ২৯শে মে ২০২০

শহরেরও আছে

শহরে এলে তুমি দেখবে আর বলবে ওই তাে ওইখানে আমার বাড়ি
ওই সুন্দর আলো বাতাসে ভরা তুষারে ভরা গ্রহটি আমার গ্রহ

সব জিনিসের যখন সাংস্কৃতিক জোট আছে
অরণ্য অঞ্চলের উদ্ভিদের ঔষধি উপকরণ
যেমন উপেক্ষার স্টেরোয়েড শহরের আছে

শহরে এলে ল্যারি ডায়মন্ডের মতো তুমিও
ভয় দেখাবে নানান স্রোতের লোকেদের-
তাভের্নিয়ের মতো ঢাকায় পৌঁছে তুমি লিখবে:
শহরটি খুব বড়, দৈর্ঘ্য সুবিস্তৃত
সবাই নদীর ধারে বাস করতে চায়
শহরটি লম্বায় সাত মাইলের বেশি

দেশ দশ ও সমাজের উন্নতিতে শহরের বিস্ময়ের শিষ্টাচার নেই
প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পরিবেশে শহরের সংবেদনশীলতা বাড়ছে
এবং তা পরিশ্রমসাধ্য রয়েছে
লেক ও জলাশয় ব্যবস্থাপনা শহরে এলে তুমি দেখবে

পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া শহর গড়া যাবে না
এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই মেলবোর্ন ও ভিয়েনা শহরে
এক দিন স্বাধীনতা যুদ্ধ এসেছিল

কোনও দেশে শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে
অরণ্য উপজাতিদের অনেক শর্ত এখনও দিনাতিপাত করছে

সম্রাট জাহাঙ্গিরের ফরমান ছিল
সমগ্র সাম্রাজ্যের বড় বড় শহরে হাসপাতাল স্থাপন করা হোক
এবং এর সেবা শুশ্রূষা ও ঔষধপত্রের
ব্যয়ভার সরকার থেকে নির্বাহ করা হােক

শহরে এলে চিৎ কখনও অসুখের ওষুধ তাই তােমার থাকবে

চরক

আমাদের মুখ গোল, গায়ের রং ফর্সা, আচার ব্যবহার ও ভাষা ভূমধ্যীয়
আমাদের ষষ্ঠীদেবীর একটা পাশ রুপো দিয়ে মোড়া
বিরাট এক উইঢিপির ওপর তৈরি হয়েছে ধুলাে ও মােম দিয়ে।
কপালে চোখ দুটো? নাক কি অনেক!
তার ওপর সিন্দুর দিয়ে কারা টকটকে লাল করে দিয়েছে।

আমরা ভেড্ডিডদের গােঙানির মাঝখানে পড়ােপড়ো ডালপালা ফুরফুদের মতাে আমাদের মেয়েদের হাতে কঙ্কাল ও বাদ্যযন্ত্র আছে।

আমার গৌড়-পুণ্ড্রের লোকেদের মতো শিবের শাস্ত্রসম্মত নিয়মে সেবা করি
কখনও পৃথিবী পদ্মপাতা ইত্যাদি আলপনা মাটির ওপর আঁকি, সুরও ভাঁজি-
আমাদের অষ্টধাতুর শিব বাঁশঝাড়ে বাঁধানো একটি ক্ষেত্রে রয়েছে।

আমরা অবদ্ধ অসঙ্গ। নিয়মের ছন্দে বিশ্বাস রেখে
দিবানিশার বিভাজক রেখায় নিষ্পলক দীপের আলোটি নিয়ে, গঙ্গাতীরে-
মোক্ষ ক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগে মাথার উপর বাঁখারি, পায়ের নিচে দাওকে রেখে একটু জল খাই; তার পর যমালয়ে তিনরাত্রি যাপন করি ।

আমাদের নামগুলি সব ব্রাত্যদের মতো
হ্রস্ব শিরগােষ্ঠীর হওয়ার গর্বে আমরা শেওড়াবনেতে গিয়ে বসতি স্থাপন করি।

নাগারচি দক্ষিণা ধরে। কিছুতেই যেন আমাদের জাতিভেদ না ঘটে
এমন সুবর্ণসুযোগ শনশনে হাওয়ার যুগে-

এ কেমন শর্বতন্ত্র। অজ্ঞান তমাে নাশ করে কারা আমাদের ছবি এঁকে ফেলেছিল
‘ওই আসছে, ওই আসছে’
কেউ সবুজ নারকেল পাতা দিয়ে আমাদের জন্য বিছানা বানাল
কেউ বা ‘সমর্থ, তোমরা কুমার’ উচ্চারণ করে
আবির ধান দুর্বার -আশীর্বাদী পাত্রটি আমাদের কাছে রেখে গেল
আমাদের আদি অস্ত্রাল চিহ্নগুলি মাতৃঅঙ্গ।
আমাদের সবার মাথায় সােনার সুন্দর একটি মুকুটের উপর
আসুরী ভুলিতে মাতৃঅঙ্গ লেখা আছে। মাতৃঅঙ্গ বলে আজ দীক্ষিতের হাতিয়ার।

সামাজিকতা

আমার নিষ্করুণ স্বর পাথরের মাথা আর কাঠের হাতলওয়ালা একটা হাতুড়ি হাতে
অতিদ্রুত নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে কয়েক ইঞ্চি পুরু থিকথিকে কাদা ভেঙে সিধে সড়ক ধরছে এক টিলার ওপরকার গাঁয়ে এসে
চামড়ার পোশাক পেতে হাঁকাহাঁকি করছে ওকি য়ো, ওকি য়ো।

দু’গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি
লুঙ্গির পাড় যে অভ্যর্থনাসূচক আওয়াজ করল
তাতে গম্ভীর আর্দ্রতার সুর মাখানো। কানা!

আমার আলোক-সৌভাগ্য-এর
উৎসাহ ও কর্মশক্তি সদ্ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ আছে

স্থানান্তরের পরিকল্পনা, সতর্ক চলাফেরা
সম্ভ্রমের ছায়া কুঠার দিয়ে
একটা কাঠের গুঁড়ি সমান করছে

এ বার কাঠের গুঁড়ি আর কাদা দিয়ে তৈরি একটি ঘরে মহিষচর্মের পোশাকের ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে রইল

আমার নিষ্করুণ স্বর ক্ষুধার্ত পঙ্গু ও
শীর্ণ অনাথদের প্রতিনিধিদের বাদ্যযন্ত্রের
প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফিসফিস করছে
হোমিওপ্যাথিক টাইপরাইটারের সঙ্গে
আমাকে প্রাতরাশ এর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে

সম্ভাব্য পরিণামের সাংঘাতিক বর্ণনা, জিদ করার সিদ্ধান্ত
আমার ভাড়ার ঘর থেকে
একটা রাস্তা পেরিয়ে আবার ঝিমচ্ছে
উঁহু, আমার নিষ্করুণ স্বর আমার আলােক-সৌভাগ্যের জন্য
হি নো মিচিয়া শব্দ নয়
একটা মস্ত নকল কাঠঠোকরা পাখি তৈরি করছে
ওহাে একটা মস্ত নকল ঠোট দিয়ে
কদর্য সব মুখশ্রীকে সুশ্রী করছে

আমার নিষ্করুণ স্বর ঘাসের শীষের ডগায় গিয়ে উঠল

আমার নিষ্করুণ স্বর আমার আলোক-সৌভাগ্যকে
ক্রমশ তাড়া করছে
আমার নিষ্করুণ স্বরের
পালাবার রাস্তা আটকাবার জন্যে
আমার অনেক-সৌভাগ্য
ছুটে আবার এগিয়ে এল

ৎসুকিয়াে কাতামুকু।

নিয়মকর্তা

শীতের দেশের সূর্যবিচারক, হাততালি দেয়, অবিশ্বাস্য মনে হয় আমার। আমার পারিপার্শ্বিক ধ্যানীরা কেমন রহস্যময় এবং প্রজাপতির মতাে দেখতে। আদিম ডিমের মধ্যে তারা অন্তর্হিত ভেবেছিলাম আমি। ছায়া ওড়ে, ছায়া রহস্যকে বিদ্ধ করে আমাদের জন্য। আমি জানি, স্বচ্ছতার মর্মর সোপানে নিঃসঙ্গ বিবেকের গান গায়, বিষাদের তীব্র বায়ু প্রকোপ থেকে আমাদের রক্ষা করে। আমাদের নিকটতম বাগানে জড়মান অস্তিত্বরাশিদের গন্ধ। মীন ও সমুদ্র হয়ে এখানে স্বপ্নময় আচ্ছন্ন করাে তুমি। যখন সবাই ফিরে গেছে, কোনও এক শব্দহীন মূঢ়তার কাছে। তোমার সমস্ত উত্তেজনা সায়াহ্নের কুয়াশার পর্দার মতাে। পৃথিবী তোমার পৌরাণিক সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। উটের পিঠে চড়ে তপ্ত বালির সমুদ্রে যাত্রা এবং গম্ভীর জীবন তােমার। ঘড়ির কাঁটার মতো তােমার লজ্জা, ঘুমন্ত পরি হয়ে ঘুরতে পারাে তুমি এখন, কোনও হাঙ্গামা নেই। তােমার মাথার উপরে এখন কুয়াশা উড়ছে, তােমার আড়ালে জ্যোতির মতাে সূর্য, জ্বলন্ত। নতুন মানুষ তােমার অবিশ্বাসের সপক্ষে, বহু ক্লেদ জমা হল এবং ধ্বংসের আগেই তুমি নিজের জন্য চিৎকার করে উঠতে পারাে। তুমি যেন স্বপ্নে এখনও আবৃত। তুমি সূর্য অনুভাবক, আমি নির্বিকার। পৃথিবীর আতুরাশ্রমের ভিতরে তুমি নিরুদ্দেশ, তুমি দৃশ্যমান।

অনুসন্ধানী হয়তাে তারা

বানরাজার অরণ্যের অনেক উদ্ভিদ আমাদের অজানা।

বানরাজার অনুসন্ধানী রাজ্যে কোনও বিশেষ ক্ষমতাশালী বিজ্ঞানীরা এখনও আসেনি। জীবাণুক্রিয়ার সতর্ক কাহিনি থেকে কালপুরুষেরাও বিকৃত।

তবে বানরাজার স্বপ্নরাজ্যে, বাকদেবী মাটির উৎসের খোঁজ করছে!
আর যারা মেঘপুঞ্জের মতো ঘুরন্ত অবস্থায় রয়েছে।

বানরাজার স্বপ্নরাজ্যে অদিতির অক্ষমালা, যার সংঘর্ষের অনেক কাহিনি একত্রে গ্রথিত, দেহের অর্ধাংশ সুবর্ণময়, উচ্ছ্রিত।

বানরাজার মানুষমেধ যজ্ঞের অঙ্গনে সঙ্ঘাত দুর্ভিক্ষ যুদ্ধ লােকক্ষয় জাতীয় কাজে নবীন মত্ত অমত্ত পুরুষেরা আছে এবং তাদের ছায়াপত্রে তারামণ্ডলের অনেক অগ্নি অবস্থিত। যােড়শশ্রুত।

বানরাজার স্বর্গরাজ্যে ব্রহ্মা ঋষিদের অস্তিত্ব কোনও দিন বিলুপ্ত হবে না। কেননা, তাদের অরণ্যবাসে বহুসন্ধানী বাহনেরা একত্র। বস্তুত তারা যেন মরুবাসী পুষ্করণা দেশের অধিপতির লক্ষ আলাে বালাম-নৌকা–
যারা জগদ্গৌরীর জন্য কাঁদে বা নির্জনে ভাসায় বিষন্ন গান।

বানরাজার স্বপ্নরাজ্যে, মহাশূন্যচারীরা এক দিনও কালপুরুষমণ্ডলে ঘেসােজমির উপর নিশ্বাস দীর্ঘ করে অলৌকিক রূপলাবণ্যসম্পন্না ঊষার হ্রদ খনন করে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। অনুসন্ধানী হয়তো তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here