খুকু ভূঞ্যা’ র গুচ্ছ কবিতা

0
110
কবি খুকু ভূঞ্যা
জন্ম : ২২ শে অক্টোবর ১৯৮৪ । পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার অন্তর্গত জঁহাট গ্রামে
নিপাট গৃহবধু ।লিখছেন নানান লিটলম্যাগাজিনে।নিরন্তর সাহিত্যে তাঁঁর যাপন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দু’টি – লেপের আদর খোঁজে ফুটপাত এবং মাটিপাঠ ।

মন্থন

দই পেতেছে মা
নিঝুমের ভেতর ঘুমিয়ে,
বাঁশের দন্ডটা ঘুরতে শুরু করলে অসম্ভব হালকা হব
অতঃপর উড়ে যাব হাওয়ায় ভাসা ইন্দ্র তুলোর মতো
শূন্যতা যেখানে কৃষিকাজ করে।

সেই অর্জুন শিঙের মাঠ
পাশাপাশি পাটের গল ভাঙাচ্ছি
সূর্য নেমে আসছে আংরা কাঠ হয়ে
আঁচলে ঢাকছো দহন,ঘাম
বেড়ে যায় বাঁচার স্পন্দন।

জীবনে অর্ধেক রোদ হোক
কৃষ্ণপক্ষ বেঁধে দিলে জন্ম নাড়ীতে
আমি নদী হতে চাই
স্রোতের গান বাজে শিরায় শিরায়
কাঁকর বাছা দুপুর দিলে লেপে।

আরেকবার মন্থন করো
লক্ষ্মী উঠে আসুক পাতাল থেকে, চাঁদ মরাচরে–

মাটির অর্ঘ্য

চেঁচকো ফুলের গায়ে হীরের সকাল
সেইদিকে তাকিয়ে আটা ঘাঁটা খেয়ে বড়ো হওয়া ভজজেঠু
কৃষিকাজের গল্প বলছে নতুন প্রজন্মকে।
চারপাশে নতুন বৌয়ের মতো রোদ
দূরে সেলো থেকে জল পড়ছে
সেচের জলে স্নান সারছে ফিঙে শালিক বক।
যতদূর চোখ পাতা যায় সাধ হয় মাটির অর্ঘ্যে সাজিয়ে নিই নিজেকে
সারা গায়ে লেগে থাক ধুলোচন্দন
রোদ ঢুকে পড়ুক শিরায় শিরায়
তুলসির মাতৃত্ব পেতে ঋতুমতী হোক
নিভৃতের কুমারী অক্ষর–

আজ কাল

কাল ওপারে খুব অন্ধকার ছিল
ওপারে ভীষণ ভয়–
কুয়াশা ওড়না জড়িয়ে চোখ মুছছিল কেউ
বীজতলার পাশে দাঁড়িয়ে।
পাখি দম্পতি বুড়ো পালকে ঠোঁট গুঁজে ভোরের চিন্তা করছিল।
মৃত্যু ছিল অনেক,
রক্ত স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল নতুন চারার শেকড়।
পেরিয়ে এসেছি অন্ধকার।
আজও চারপাশে কারা যেন রাত চাদর পেতে দিয়েছে অকাতরে, তবুও নতুন এসে দাঁড়িয়েছে ভাঙা আঙিনায়
অতিথি নারায়ণ
ধরা যাক স্বজন এসেছে মৃত্যু বেশে
আনন্দ করে যাবে দান।

পরমান্ন

এতো ধুনো গন্ধ কেন চারপাশে?
হত্যালীলা বন্ধ হোলো বুঝি?
মানুষ বুঝেছে প্রাণের মূল্য?
প্রেমের ছায়ায় দাঁড়িয়েছে দুপুরে ছাতারের মতো?
আহা কী চন্দনের ওম!
রক্ত শিরার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে

কেউ জানো–
চন্দনের চাষ হচ্ছে তুমুল?
ভাই ভাইকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে
বন্ধু বন্ধুকে উপহার দিচ্ছে শুভ সকাল
সাম্যের মিছিল চলে যাচ্ছে আলপথ থেকে রাজপথে
ভরা শিশু কোলে জননীর মাই ধরা হাত
বৃদ্ধ পিতাকে সূর্যোদয় দেখাচ্ছে সন্তান।

হোক না চোখের দোষ
নব প্রভাতের পরমান্ন রাঁধুক জননী
সততার মাটি চষে উঠোনে দাঁড়াক ক্ষুধার্ত পিতা
সত্যম শিবম পুরুষের মতো।

লাল পেড়ে ছায়া

যে কথা লিখতে চাইছি, পাখির গান হয়ে উড়ে যাচ্ছে শূন্যে,চেয়েই আছি।
পাখি ফেরে ধূসর সাঁঝে
ঠোঁট ভর্তি খড়কুটো নিয়ে।
এই খড় আমার রক্তকণা
পুড়ে গেলেই নাভিশ্বাসের শব্দ পাই।
মাটিতে হাত পা ছড়িয়ে ঘোমটা টেনে যে বসে আছে
মনে হয় মাটির ভেতরের সব কথা জানে সে
গভীরে ঘুমন্ত বীজটির কথা বীজের সুপ্ত স্বপ্ন
আর শিকড়ের কথা,সব–
লাল পেড়ে শাড়ি পরে বসে আছে, শস্য পুর্ন মাঠ হয়ে।

আগ্ৰাসী

অন্ধকার থেকে আলো ছুঁড়ছি
ধরতে পারলে ভাববো আপনার কেচিং পাওয়ার ভালো।
খোলা চোখে সূর্যের দিকে তাকাতে পারেন
একপোয়া দুধের ওপর ভাসিয়ে রাখেন চাঁদ
সূর্যমুখী চাষ করা লোকটাকে বসার জন্য পেতে দেন বুক
আপনি বড়ো অমায়িক দয়ালু
ভাতের থালা ছেড়ে উঠে পড়েন ,শান্তি মূর্মূ অথবা
সিধু হাঁসদার মতো কেউ এলে।
ধান খেতের মতো অন্তর যাদের সেখানেই ছড়িয়ে দেন ফুলের বীজ
আপনি চট করে রেগে যান না
খুবই সংযমী,বিনয়ী, ক্ষমাশীল
কলসি ভরে জল আনা বধূর মতো দরদ টলটলে মন
ভালোবাসেন শাঁখের আওয়াজ দীপের আলো

আর যদি এ সব কিছু না হোন
শুধু মানুষের মতো
ভেতরের পশুটাকে লালন পালন করছেন সের সের দুধ খাইয়ে।

ঘাসঘর

সকালে উঠেই সুন্দর এক ঘাস দেখলাম–
দুঃখের থেকে সুন্দর,
ঠিক যেন কোলের শিশু
মাই ধরিয়ে মা ধান সেদ্ধ করছে।

তখনও একটি ধুলোর কণা উড়ে আসেনি তার গায়ে
পবিত্র অশ্রু শিশিরে গা ধুয়েছে সবে, অতঃপর রোদের
উত্তরীয় পরে পুজোয় বসবে।

সুন্দর সেই ঘাস-
খুন করে এসে কেউ রক্ত মোছেনি তার মাথায়
কাদায় ভরিয়ে দেয় নি তার বুক
যেন দুখা শবরের স্বপ্নে দেখা ধানমাঠ
ভরাট রাতে শুকনো মুড়ি ঝেটাতে ঝেটাতে
একটা বদলের স্বপ্ন দেখছে।

মংলি অথবা জড়ুল কবিতা

বসে আছি একবিন্দু শিশিরের কাছে।
তেঁতুল আর বাঁশপাতার গরীব গল্প শুনতে শুনতে
ঠিক যেন মংলি।
সেবার মাস উজানিতে দেঁতো বড়ি দিতে দিতে
ভয়ঙ্কর অশ্রু দেখেছিলাম তার চোখে
সে এক আকাল মাঠের গল্প।

নারী অনেক মরণে মরে, অনেক গল্প অনেক ইতিহাস।
শুনেছিলাম এক সিঁথি সিঁদুরের জন্য তার কান্না
দুপুরের পর দুপুর ভাত না পাওয়ার গল্প,
ছেঁড়া শাড়ির ফুলে ফুলে দেখেছিলাম ঝাঁক ঝাঁক প্রজাপতির কবর। ভাবছিলাম, টাইগার হিলের সূর্য কখনও কি তার টিপ হতে পারে? কিংবা সাবিত্রী পাহাড়ের মতো উঁচু তার অহংকার?বা অনন্ত সমুদ্রের ফেনা তার অশ্রুর নিরাময়?

এ সব কোনো কালেই হয় না
তাই আমিও খুঁজতে যাই না শনিবারের হাট
শুশুনিয়া দার্জিলিং বা নাটোরের কোজাগর।

সে ধান শুকোচ্ছে
ছেঁড়া ব্লাউজের ভেতর থেকে দরিদ্র বুক নিরস হচ্ছে ক্রমশ
পাশাপাশি দুটো পাখি পোকা খুঁজছে ঘাসে ঘাসে
একটির পা নেই,অপরটি তাকে বকুনি দিচ্ছে পাখি ভাষায়,
ওঠো, দাঁড়াও, তোমার দানা তুমি খুঁজে নাও
কে কাকে বহন করবে যুগ যুগ?
এই হয়তো সিংহলের বধূ, কালিম্পংয়ের কুয়াশা রোদ
এই তো আমার শান্ত ভোরের ভেতর দুধে ভাতের স্বপ্ন,
শুভ জড়ুল কবিতা।

এসো বৃক্ষ হই

উত্তরা হাওয়া বইছে বেশ মাঠের চারদিকে সফেদ কুয়াশার ভেতর
বকেরা মেলে দিচ্ছে ডানা
মাটির আদরে ফাটছে সর্ষে বীজ
হলুদ উষ্ণতার অপেক্ষায় উদাসীন মাঠ।
কিছু পরে শুরু হবে রোদের উৎসব
এসো,যোগমগ্ন হবার এই মরশুম
চঞ্চলতা দমন করে বৃক্ষ হই পাশাপাশি
নিঃশব্দে ঝরবে পাতা,বাকল,,
গৃহহীন ভেবে আমরা আর্তনাদ করব না একটুও অন্ধকার থেকে তুলে নিয়ে আশ্বাস পরস্পরকে সাহস যোগাব, ভরসা দেব, অতঃপর
আঁধার জীবাশ্ম ঠেলে কিশলয়ে ছয়লাপ
রঙের উজানে ভেসে যাচ্ছে শত বর্ষের পাথরকাল–

সাঁঝঘর

এসো আমরা দাগী হই,
আঙুল বাড়িয়ে ছায়া মিছিল মুখগুলো চিৎকার করে বলুক
দ্যাখো, ফুলের ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার শব্দে
বেড়ে যাচ্ছে পাখিদের আহ্ণাদ।
কী নির্লজ্জ,
আকাশের সিংহদ্বারে এঁকে দিচ্ছে নক্ষত্রের জন্মলিপি।
তারা চিৎকার করুক শেয়াল শেয়াল মিছিল শব্দে
কী বেহায়া,,,
চুমু খাচ্ছে সাপের ঠোঁটে
সাঁঝ ঘর সাজিয়ে দিচ্ছে প্রদীপ সারিতে।

এসো মন্দ হই
কালো সুরের ঝংকার উঠুক, অনেক কালো আঙ্গুল উঠুক
কালো মন, কালো চোখের ছায়ায় ঝুঁকে আসুক রাত
এসো ভালোবাসতে বাসতে নিজেকে ভুলে যাই

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here