বিশ্বমিথের দরবারঃ (৪র্থ পর্ব)–দে ব লী না রা য় চৌ ধু রী ব্যা না র্জি

1
282
দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

 

স্লাভিক মিথলজি(পর্ব চার)

কলমে-দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

ছবিঃ সু নি পা   ব্যা না র্জী 

আবার এলাম স্লাভিক মিথলজির অন্য একটি পর্যায় নিয়ে। বিশ্বমিথের দরবার সিরিজের আজ চতুর্থ পর্ব। আগের পর্বে বলেছিলাম শুভ ও সৃষ্টিশীল শক্তির কথা, আজ তাই স্লাভদের অপদেবতাদের কথা, যাদের ভয় পায় মানুষ, যাদের থেকে দুরত্ব রাখলেই নিশ্চিন্ত বোধ করে। কিন্তু এড়িয়ে চলা আর সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া কি এক? আপনি অমানিশার ঘন আঁধার ভালো বাসতেই পারেন কিন্তু তাই বলে ভোরের আলোর অস্তিত্ব ফুরিয়ে তো যায় না। বেশ, এখানে একটা কথা বলি – এই যে আলো-আঁধার, শুভ-অশুভ, ভালো-খারাপ – এইগুলি কিন্তু একটা সামাজিক নির্মাণ বা social construct। যারা সকলের চোখে খারাপ তারা কিসের নিরিখে খারাপ? বা যারা ভালো, তারাই বা কেন ভালো? কারণ যা কিছুই ভেবে পাবেন তার সবই কিন্তু সমাজসৃষ্ট, সমাজ নির্ধারিত। আর সমাজ? সেও তো মানুষের তৈরি। তাই ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত, সাদা-কালো যাই ভাবুন না কেন, তা কিন্তু Archetypal বা একরকম আদিরূপ যা ভিন্ন ভিন্ন সমাজ প্রচলিত একই প্রকার চিন্তাধারার প্রতিফলন।আর এই জন্যই একটা আফ্রিকান প্রবাদ অনুযায়ী – Until the lion learns to write, everystory will always glorify the hunter. সত্যিই তো, কয়েনের অপরদিকের কথা আর কেই বা বলে! যদি বা বলা হয়, তা ‘অপরদিক’ হয়েই থেকে যায়। আর আজ স্লাভদের সংস্কৃতির সেই অপরদিকের কথাই বলব।

আল্কোনস্ট,ও সিরিন :
(Alconost and Sirin):

এরা পক্ষীমানুষ। দুটির মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নেই। লক্ষ্যণীয় সাদৃশ্য হলো দুই প্রকার কাল্পনিক জন্তুর মুখ মানুষের মতো আর শরীর ঠিক পাখীর মতো। এর সাথে গ্রীকদের সাইরেনের বিশেষ মিল। এরা সুরেলা কণ্ঠে গান গায়। সাইরেনদের অস্তিত্ব যেমন সমুদ্রের সাথে জড়িত, আল্কোনস্টদের ক্ষেত্রেও শোনা যায় যে তারা ইউফ্রেটেস নদীর কাছে নেমে আসত স্বর্গ থেকে। তাদের গান শুনে পথিক সব ভুলে যেত। সিরিন পক্ষীমানুষের কথা রাশিয়ান উপকথায় পাওয়া যায়। লোককথা অনুযায়ী, তারা মানুষের সমূহ বিপদের পূর্বাভাস দিয়ে যেত গান গেয়ে, জঙ্গলাকীর্ণ পথে আবছায়ায় মিশে। এই পক্ষীমানব জাতীয় মনস্টার বা প্রাণীর কথা প্রাচীন ভারত তথা অনেক দেশেই দেখা গেছে। পরের কোন পর্বে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব। আপাতত পরিচয় পর্বটা চলুক।

বোরোভিক, লেশি ও বোলোত্নীক :
(Borovik, Leshi and Bolotnik) :

 

রুশ রূপকথা পড়ে আমাদের রুশ দেশের ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে ছোটবেলাতেই একটা ধারণা হয়ে যায়। বরফঢাকা স্তেপ অঞ্চল থেকে গভীর বনাঞ্চল – এ সবই আছে স্লাভ ভূমিতে। তাই যে সব মনস্টার বা অপদেবতা দেখা যায় তার একটা মানানসই যোগ দেখা যায় প্রকৃতির সাথে। বোরোভিক হলো গভীর জঙ্গলের অপশক্তি। স্লাভরা বিশ্বাস করত যে এরা এমনিতে বামনাকৃতি বৃদ্ধের মতো অন্ধকার বনে ঘুরে বেড়াতো, বড় বড় ছত্রাকের নিচে বাস করত আর ভালুকের রূপ ধারণ করতে পারত প্রয়োজনে। এরা ছিল লেশির অনুচর। লেশি, অর্থাৎ বনদেবতা। তারা আবার নিজেদের আকৃতি খুব ছোট থেকে খুব বড়ো করতে পারত। লেশিদের আবার ভারি দুর্নাম ছিল যে তারা নাকি বাচ্চাদের চুরি করত। মাথায় শিঙ, ঘন কালো রোমে ঢাকা ‘লেশি’রা জঙ্গলকে রক্ষা করত মানুষের হাত থেকে। ভালুক আর নেকড়ের দলকে সঙ্গী নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াতো। গ্রীকদের দেবতা প্যানের সাথে এদের অনেকটা মিল।
স্লাভ অঞ্চলের জলাভূমিতে ছিল মানুষের ত্রাস বোলোত্নীকের বাস। জলাভূমিতে আলেয়ার দেখা মিললে অনেক মানুষই হারিয়ে যায় – এমন বিশ্বাস আমাদের দেশেও প্রচলিত। সুন্দরবনের জলাজমিতে আলেয়া মানুষকে টেনে নেওয়ার গল্প আমরা পড়েছি কখনও কখনও। স্লাভদের মতে অপদেবতা বোলোত্নীক নাকি মানুষকে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। কালচে সবুজ পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কোন অস্তিত্ব আর মেলে না। বিজ্ঞান বা বাস্তবতার নিরিখে দেখলে সম্ভবত এই সব দৃকভ্রান্ত মানুষ সম্ভবত ডুবে যেত চোরাবালির গহীনে।

কিকিমোরা (Kikimora):

 

কিকিমোরাদের ছবি বেশ কিছু রুশ উপকথার বইতে পাওয়া যায়। এরা স্ত্রীলোক। সাধারণত, উপরিউক্ত তিন অপদেবতার স্ত্রী হিসেবেই কিকিমোরার নাম পাওয়া যায়। তারা নাকি বাড়িতেও চলে আসত ব্যক্তির সাথে। ঘরে এলে থাকত তারা রান্নাঘরের কোণায়। গৃহস্থ মানুষের ক্ষতি সাধন করাই ছিল তাদের কাজ। কখনও তারা কুব্জ, বৃদ্ধা, লম্বা নাক ও ওলটপালট চুলে কখনও বা কুচকুচে কালো, রুগ্ন ছোট্ট মেয়ের রূপে ধরা দিত তারা। স্লাভিক মিথ অনুযায়ী এদের পা অনেকটা হাঁসের মতো। স্লাভিক মানুষ মনে করত নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সমস্ত কটু স্বপ্ন দেখায় এই কিকিমোরা। তাই মনস্তাত্ত্বিকদের মতে কিকিমোরা হলো sleep paralysisএর লৌকিক অপদেবতা।

বোগিঙ্কি (Boginki) :

এবার বলি স্লাভদের, বিশেষত স্লাভ নারীদের ত্রাস – বোগিঙ্কিদের কথা। এই অপদেবীর পুজো হতো ভয় থেকে। আমাদের দেশে অলক্ষ্মী পুজোর প্রচলন যেমন এই জন্য করা হয়, যাতে গৃহস্থালির থেকে দূরে থাকেন তিনি। তেমনই পুজো হতো বোগিঙ্কিদের। লৌকিক মতে শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে কোন নারী যদি মারা যায় বা রজস্রাবের হেতু, বা কোন কুমারী মেয়ের মৃত্যু হলেই তার দায় বোগিঙ্কির। এদের রূপ ছিল ভীষণ কদাকার। বৃদ্ধা, লোলচর্ম, হলদেটে চোখ, ঝুলন্ত বুক ও পেট আরনিদন্ত মুখে শ্বাদন্ত বেরিয়ে থাকা অদ্ভুত ভয়াল দর্শন এক নারীরূপ। এরা রাতে আর দুপুরে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলে মনে করা হতো। এরা নাকি শিকারের নাম ধরে ডাকতো বা গান গেয়ে আকৃষ্ট করত তাদের। ছেলেদের নয় মেয়েদেরই পছন্দ তাদের। মিথ অনুযায়ী মেয়ে শিশুদের ক্ষতি করতে গেলে বোগিঙ্কি রুষ্ট হতো। খেয়াল করলে দেখবেন, পুরুষতান্ত্রিকতার ঘেরাটোপে মেয়ে শিশুদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার মানসিকতাও এই পৌরাণিক চরিত্রের ভাঁজে লুকানো আছে সযত্নে।

আস্পিড ও বাসিলিস্ক
(Aspid and Basilisk) :

এই দুটি হলো বিশালাকার দুটি নাগ। আস্পিডের দুটি ডানা আর দুটি শুঁড়ের কথাও জানা যায়। মিশকালো এই নাগকে মানুষেরা ভয় করতো। রুশ উপকথার বইতে বীর নিকিতার সাথে যুদ্ধে হেরেছিল যে নাগরাক্ষস জমেই গরিনিচ তার রূপকল্পটি এই আস্পিডের মতোই। আস্পিড কোথা থেকে উড়ে এসে যে নিঃশব্দে সব ছারখার করে দিতে পারে তা কেউ জানে না। মানুষের ক্ষতিসাধনে এরা ব্যস্ত। স্কাইথিয়ান উপজাতির লোকে বিশ্বাস করত যে আস্পিড থেকেই তাদের সৃষ্টি। এছাড়াও আবার বাসিলিস্ক নাগের কথাও আছে স্লাভদের বিশ্বাসের গভীরে। বনমোরগের ডিম থেকে দৈবাৎ জন্ম হতো বলে মনে করা হতো। স্লাভদের মতে বাসিলিস্ক তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাসেই মানুষ মেরে ফেলতে পারতো । কি ভাবছেন? চীন, জাপানের ড্রাগনের সাথে মিল? আছেই তো। আস্পিডের পাখনা যেমন তেমনিই আছে মায়া সভ্যতার বিশ্বাসে কোয়েৎসাকাত্লের মতোই। বাসিলিস্কের বিবরণে বলা আছে যে তারা ঘন নীল রঙের ও অতল। এবার আমাদের শাস্ত্রে কালীয়নাগকে মনে পড়ছে? আর বৃত্রাসুর? এরাও তো সেই একই রকম। তাই না? আরও আছে। সে কথা পরে হবে । আগে সব প্রাচীন সভ্যতার অলিন্দে ঘুরে আসা শেষ হোক, তারপর। কেমন?

ভল্কোলাক (Volkolak):

 

Lycanthropy কি জানেন? মনস্তাত্ত্বিকদের মতে এ হলো এমন এক মানসিক অবস্থা যাতে মানুষের মনে হয় যে সে কোন পশু বা প্রাণীতে পরিনত হতে পারে। হ্যারী পটার গল্পে প্রফেশর রেমাস লিউপিনকে মনে করুন। তিনি নাকি পূর্ণিমার রাতে নেকড়ের রূপ ধারণ করতেন। ব্যাবিলনের প্রখ্যাত রাজা নেবুচাদনেজ্জারের কাহিনীতেও তার মধ্যে দেখা গেছে এই রোগের প্রভাব। পারর্সিয়ার এক রাজপুত্র মনে করতেন যে তিনি মানুষ নন বরং গাভী। আর্মেনিয়ার এক রাজা তিরিদেত্স তৃতীয়র মধ্যেও ছিল এই একই রোগ। কিন্তু রোগ যতই প্রাচীন হোক না কেন, তার পরিচিতি তো নতুন; তাও আবার বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার পর। প্রাচীন মানুষ রোগের প্রতি ভীত হয়ে তাকেই অপদেবতা জ্ঞানে ভয় পেয়ে কাহিনী রচনা করত। তামাম ইওরোপে Were-wolf এর ধারণা একটি পরিচিত বিষয়। এটি নাৎসী বাহিনীর একটা কালো পরিকল্পনাতেও উঁকি দিয়েছে। মোট কথা এই Were wolf এর অস্তিত্ব আছে স্লাভিক পুরাণকথাতেও। আর তারা হলো ভল্কোলাক। এরা অপশক্তি যারা মানুষের রূপে থাকলেও বদলে যায় ভয়ঙ্কর নেকড়েতে। এদের পূজা পদ্ধতিতেও ছিল নেকড়ের সাজে সজ্জিত হওয়া। বিশ্ব বরেণ্য অভিডের Metamorphosis এর ধারণা কিন্তু বিশ্বব্যাপী।

বাবা ইয়াগা(Baba Yaga) :

খেংড়া কাঠি পা, বসেছে ড্যাং ড্যাং
ঘর জোড়া তার ঠ্যাং
ঠোট উঠেছে তাকে, ছাত ঠেকেছে নাকে।

এই ছিল রুশী উপকথার ডাইনি বাবা ইয়াগা। ভয়াবহ তার রূপ। বৃদ্ধা, পলিতকেশী ডাইনি। তাকে বিভিন্ন রূপে দেখা গেছে উপকথার মোড়কে, যেমন – রাত, সাপ, ক্ষয়াটে চাঁদ, কালো মেঘ, মৃত্যু, সারসপাখি ইত্যাদি। গবেষকদের মতে তিনি Proto Mother Goddess বা মাতৃতান্ত্রিকতার প্রতীক। তিনি একদিকে যেমন নরখাদক অপশক্তি যারা শিশুদের খেয়ে নিত আবার বীর পথিকের সাহায্য করতো ভবিষ্যতবাণী করে। সুতো কাঁটার মতো কাজের সাথে বাবা ইয়াগার যোগ দেখে তার সাথে প্রাক সভ্যতা যুগের ভাগ্যেদেবী বলেও মনে হয় যে মানুষের ভালো করার চেষ্টাও করে আবার ক্ষতিও।

কি ভাবছেন? শেষ হয়ে গেল? দেবতা অপদেবতাদের কি আর শেষ আছে? আরও আছে। এই পর্বে আর না। পরের পর্বে আবার আসব স্লাভিক মিথলজি নিয়ে। স্লাভ সভ্যতার সাথে আরেকটু পরিচয় শেষ হলে আবার আরেকটি প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে লিখব। আর সব শেষে থাকবে একটা তুলনামূলক আলোচনা । পড়তে পড়তে আরও কিছু মনে এলে কমেন্টসে জানাবেন।
আজ এই অব্দি থাক।
আবার দেখা হবে বাইফোকালিসমের আঙিনায়।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here