“অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প”(৭ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত ও ছবিঃ বি জে তা   সে ন, সুনিপা ব্যানার্জী

0
131
সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৭ম পর্ব)

কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

ছবিঃ বি জে তা   সে ন ও সুনিপা ব্যানার্জী 

 

আফ্রিকার পশ্চিমাংশ ভ্রমন করতে করতে কত কিছুই চোখে পড়লো। মনস্তত্ত্ব, ভৌগোলিক তথ্য, বিজ্ঞান। লোকগল্পের আঙিনায় এগুলো এক একটি ফুল হয়ে ফুটে আছে। একটি একটি চয়নে তারা লোকসাহিত্যের কুঁড়ে ঘরকে আলোকিত করছে। নিরক্ষর মানুষের শিক্ষার জন্য লোকগল্পের জুড়ি মেলা ভার। আজকের পর্বে আছে এমন দুটি গল্প যার সাথে  মিশে আছে বিজ্ঞান চেতনা, ভৌগোলিক ব্যাখ্যা এবং মনস্ত্বত্ত। আসি প্রথম গল্পে। 

১ম গল্প

আমরা সকলেই জানি কিছু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর পর শবদেহ মাটিতে গোর দেওয়া হয়। ইহলোক ছেড়ে তারা  চলে যান অন্যলোকে। তবে কেন এই প্রথার সূচনা তা নিয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ নাইজেরিয়ার এই গল্পে উঠে এসেছে সেই ধর্মাচরণের কথা। 

গল্প- কেন মৃত্যুর পর  মানুষকে কবরে শায়িত করা  হয়? 

সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টিকর্তা যখন নারী,  পুরুষ,  পশু, পাখী সকলকে নিজ হাতে গড়লেন  সেসময় সকলে একসাথে বসবাস করতো। আদিম সৃষ্টিকর্তা ছিলেন ভীষণ দয়ালু, পরোপকারী। একবার  পৃথিবীর সকল মৃত মানুষের জন্য তার ভীষণ  দয়া হলো। তিনি তার একটি বার্তা বাহক কুকুরকে ডেকে বললেন, 
” পৃথিবীতে গিয়ে সকল মানুষ কে  বলো, যখন কেউ মারা যাবে, তখন সকলে যেন  তার  শবদেহ গৃহ প্রাঙ্গনে  শুইয়ে দেয়।  তার উপর  পোড়া কাঠের ছাই শবদেহের উপর ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে ২৪ ঘন্টায় সে ব্যক্তি পুনরায় জীবিত হয়ে উঠবে।”
সংবাদটা নিয়ে কুকুর হাঁটতে হাঁটতে পৃথিবীতে আসে। বহু পথ চলায়  দিনের অর্ধেক সময় ব্যয় হয়ে যায়। ফলে  সে  ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আচমকা এক বৃদ্ধার ঘরের দিকে নজর যেতেই কুকুরটা  দেখে, একটা পাত্রে হাড় সহ অনেক মাংস রাখা আছে।  মাংসের টুকরো দিয়ে খাওয়া শেষ করে কুকুরটা  ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ পর তার  ঘুম ভাঙে কিন্তু সে বুঝতে পারে, সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত বার্তার কিছুই তার মনে নেই। 
এদিকে বহু সময় অতিক্রম করায় সৃষ্টিকর্তা কুকুরের অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে একটি ভেড়াকে ডেকে একই বার্তা পৃথিবীর মানুষের কাছে  পৌঁছে দিতে বলেন।  ভেড়াটি ছিলো  ভীষণ বোকা । সে দীর্ঘ পথ পরিয়ে পৃথিবীতে এসে পরিশ্রান্ত হয়ে ক্ষিধে সহ্য করতে না পেরে খোলা   মাঠের সবুজ ঘাস খেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর ভেড়ার স্মরণে আসে সৃষ্টিকর্তা তাকে কোনো একটি বার্তা পৌঁছে দিতে বলেছেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কী  বার্তা দিয়েছেন, সেটা সে বেমালুম ভুলে যায়।  প্রধান বার্তা স্মরণ করতে না পেরে পৃথিবীর সকলকে ডেকে বলে,
” সৃষ্টিকর্তা আপনাদের জানাতে বলেছেন, কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে তাকে মাটির তলায় কবর দেবেন।”

এদিকে বেশ কিছুক্ষণ পর  পর কুকুরটির সব মনে পড়ে যায়। সে  দৌড়ে এসে সকলকে সৃষ্টিকর্তা মুখ নিঃসৃত বানীর কথা জানালে ও তারা কুকুর কে আর কেউ বিশ্বাস করে না। সকল মানুষ কুকুরটিকে জানায়,  
” আমরা ভেড়ার থেকে সৃষ্টিকর্তার সকল ইচ্ছে জেনেছি। সেই মতো আমরা শবদেহ মাটির তলায় চাপা দিয়েছি।”
মনে করা হয়, এই ঘটনার পর থেকে মানুষের মৃত্যু হলে তাকে মাটির তলায় কবর দেওয়া হয়। তবে 
সে সময় থেকে  কুকুর পৃথিবীবাসীর কাছে অপ্রিয় জন্তু হয়ে ওঠে।  তাদের ধারণা কুকুরের উদাসীনতায় আজ মানুষের এই পরিণতি হয়েছে নয়তো সকলে অমর হতে পারতো। 

বিশ্লেষণঃ

আফ্রিকার এই গল্প মৃতদের সৎকারের কাহিনী হলে ও এর অন্তর্নিহিত অর্থ গভীর। জন্ম হলে মৃত্যু হবেই। 
” All men are mortal”.  প্রিয় বাসভবন থেকে  যেতে হবে অন্তঃরীক্ষের মন্দিরে। আড়াই হাত ভূমির ভিতর আড়াই হাত কাপড় পড়িয়ে শায়িত করা হয় দেহ। আলোকময় জগৎ ছেড়ে সে তখন ভূমি তলের অন্ধকারের বাসিন্দা। কিন্তু  মৃত্যু মানে কী কেবলই শারীরিক দেহাবসান?  তা তো নয়। মানুষের সাথে তার অনুভূতি, ভালোবাসা, স্নেহ,মায়া, মমতার মৃত্যু ঘটে। মাটির তলায় অনুভূতির কোনো স্থান নেই।  আবার দেখুন,  মানুষ জীবিত হয়ে ও হতাশার গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যায়। বিরহে, বিষাদে  মনের মৃত্যু ঘটে। বেঁচে থেকে ও নির্জীবের মতো জীবনযাপন তো মানসিক মৃত্যুর নামান্তর। জীবন থাকতে বৈভব, নাম,খ্যাতির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা  মৃত্যু পর স্তব্ধ হয়ে যায়। সকলকে একদিন এ সমুদ্র ছেড়ে অজানা দেশে চলে যেতে হয়। হৃদয়, সত্তা দূরতর দ্বীপে হারিয়ে যায়। 
এবার আসি পরবর্তী গল্পে। দ্বিতীয় গল্পটি ও দক্ষিণ নাইজেরিয়ার গল্প। এই গল্পে বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাতের বৈজ্ঞানিক দিকটি অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 
ঝড় জলের রাতে আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। গর্জে ওঠে জলদ মেঘের দল। এই গল্পে বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাতের সম্পর্কের সুন্দর একটি সমীকরণ তুলে ধরা হয়েছে। 

২য় গল্পঃ

 
বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাতের বহিষ্কার 

অনেক আগের কথা। একসময় বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাত সকলের সাথে এই পৃথিবীতে বাস করতো। কিন্তু তাদের তান্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে সেখানকার রাজা তাদের শাস্তি স্বরূপ  গ্রামের উপান্তে পাঠিয়ে দিলো।
 এই  বজ্রপাত ছিলো মেষ মাতা এবং বিদ্যুৎ ছিলো তার মেষ শাবক। দুষ্ট মেষ ( বিদ্যুৎ) শাবক তো ভারী রাগী। সে তার আলোর ঝলকানিতে পৃথিবীর চাষবাসের জমি, গাছপালা, ঘরবাড়ি এমনকি মানুষ ও পুড়িয়ে ছাই করে দিতে লাগলো।   যখন সে এসব ধ্বংসলীলায় মেতে থাকতো   তখন মা মেষ অর্থাৎ বজ্রপাত এসে ছেলেকে গর্জন  করে তিরস্কার করতো। কিন্তু  মেষ শাবক ( বিদ্যুৎ)  তো কথা শোনার মানুষ নয়। তার অত্যাচার এতই বাড়তে লাগলো যে  গ্রামের সকলে মিলে রাজার কাছে নালিশ করলো। রাজা রেগে দুজনকেই  গ্রামের শেষে জঙ্গলাকীর্ণ  জায়গায় পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু অরণ্যময় স্থানে গিয়েও  মেষ শাবক( বিদ্যুৎ)  তার কর্মকান্ড থামালো না।  সে  আর ক্রোধের আগুনে অরণ্য জ্বালিয়ে দিতে লাগলো  এমনকি  দাবানল সৃষ্টি করে সব পুড়ে ছাড়খার হতে লাগলো। অবশেষে গ্রামবাসীদের কাতর অনুরোধে রাজা বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাতকে পৃথিবী থেকে আকাশে বিতাড়িত করে দিলো। এখন  আকাশে   বিদ্যুৎ দেখলে মনে করা হয়,   মেষ শাবক ( বিদ্যুৎ)   রোষানলে সব পুড়িয়ে দিতে চাইছে এবং পরে বজ্রপাত শুনে বোঝা যায় মা মেষ তার ছেলেকে চিৎকার করে এসকল কর্মকান্ড থেকে বিরত করতে চাইছেন।  আবার কখন ও মেষ শাবক ( বিদ্যুৎ)  জ্বলে উঠলে ও  মা মেষের (বজ্রপাত)  গর্জন  শোনা যায় না। মনে করা হয়, মা হয়তো কাজের জন্য দূরে কোথা ও গেছেন, ছেলের কাছে নেই। 

বিশ্লেষণঃ

আচ্ছা, বলুন তো? বিদ্যুৎ এবং বজ্রপাতের এই গল্প আমাদের চিরপরিচিত আলোক তরঙ্গ এবং শব্দ তরঙ্গকে মনে করিয়ে দিলো না? প্রথমে  আসি, বিদ্যুৎ সৃষ্টির কারণে। ঝড়ের পূর্ববর্তী সময়ে আকাশের ঘন কালো  মেঘের মধ্যবর্তী  বিভিন্ন শীতল  উপাদান যেমন বৃষ্টি,    তুষার বা বরফকণা  ভূপৃষ্ঠের উষ্ণ  তাপমাত্রার সাথে একটি বৈপরীত্য তৈরী করে। এই সময়  মেঘের নিম্নতল এ নেতিবাচক শক্তির জন্ম হয়। একই সময়  পৃথিবীর উপরিতলের চাষের জমি,  মাটির গায়ে  ইতিবাচক শক্তি গড়ে ওঠে। উভয়ের তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতা থেকে গড়ে ওঠে বিদ্যুৎ। মেঘের ভিতর হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে পারিপার্শ্বিক বাতাস  গরম হয়ে সূর্য অপেক্ষা পাঁচগুণ উত্তপ্ত হয়ে যায়।  তার ফলে মেঘের ভিতর  কম্পন সৃষ্টি হয়। তারফলেই জন্ম হয় বজ্রপাতের।  আমরা মেঘের গর্জন শুনি  বিদ্যুৎ এর পর ।  মজার বিষয় হলো, এই গল্পে ও মেষ শাবক রাগে সব জ্বালিয়ে দেয়। এই রাগ উষ্ণ তাপমাত্রা কে  প্রকাশ করে। অন্যদিকে কম্পন সৃষ্ট  বজ্রপাত বিদ্যুৎ এর পর দৃশ্য হয়। এতো গেলো, ভৌগোলিক কারণ। আর বিজ্ঞান বলে, আলোর গতিবেগ শব্দের গতিবেগের চেয়ে দ্রুত। আলোক বেগ যেখানে সেকেন্ডে  ৩০০০,০০০ কিমি, সেখানে শব্দের গতিবেগ সেকেন্ডে ১২৩৮ কিমি। তাই বিদ্যুৎ এর ঝলক আগে দৃশ্যমান হয় এবং  শব্দ শ্রুত হয় পরে। 
লোকগল্প সমাজকে শিক্ষিত করার আয়না। তাই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেই জাতির সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।  আজ এই পর্যন্ত থাক। পরের পর্বে যাবো আফ্রিকার বেদুইনদের দেশে, পিরামিড এর মাটিতে। 

সুকন্যার আগের পর্বগুলি পড়তে নিচের লিংকগুলি ক্লিক করুন–

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৬ষ্ঠ পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(৫ম পর্ব) কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

অলৌকিক আলোক-ধারার লোকগল্প(পর্ব-৪) কলমেঃ সু ক ন্যা দ ত্ত

অলৌকিক আলোক-ধারার লোককথা(পর্ব-৩)–কলমেঃ সু ক ন্যা   দ ত্ত

অলৌকিক আলোকধারার লোককথা(পর্ব-দুই) কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

অলৌকিক আলোকের ধারায় লোককথাঃ লিখছেন–সুকন্যা দত্ত

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here