ছোটদের গল্পস্বল্প

0
155

গয়ারাম চোর

লিখছেনঃ তরুন কুমার সরখেল

পরিচিতিঃ
গল্পকার তরুণকুমার সরখেলের জন্ম পুরুলিয়ার এক গ্রামে। সেখানে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবন, উদোম প্রকৃতি তার শিল্পী হৃদয়ে ভাব সঞ্চার করে। ছোট থেকেই লেখালিখির চর্চায় নিজেকে নিজেকে সমর্পন কিশোরভারতী, শুকতারা, গণশক্তির মতো কাগজে তখনই মুদ্রিত হয় তাঁর ছড়া। ১৯৯৫ সালে শুরু করেন ‘সঞ্চিতা’ নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা প্রকাশ করতে। আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকা। পাশাপাশি আরো একটি ছোটোদের পত্রিকা -‘টুকলু’র তিনি সম্পাদক। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, চিরসবুজ লেখা প্রভৃতি পত্রিকায়।
ছোটদের জন্য শুধু ছড়া নয়, গল্পও লেখেন তিনি। রাজ্যের প্রায় সমস্ত শিশু ও কিশোর পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের কয়েকটি কাগজে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
ছোটদের জন্য লেখা এই কবির বইগুলি পড়লেই তাঁর চরিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। তিনি অনাবিল আনন্দের দিশারী। শিশুমনের স্বপ্নলোকে অনায়াসে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি পেয়েছেন অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কার। সংবর্ধনাও পেয়েছেন বহু জায়গায়। অন্যতম পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (২০০২) ও সাহিত্য মন্দির পুরস্কার (২০১৯) ।

গয়ারাম আজ সকালেই বিনু পিসিদের গ্রামে
এসেছে। বিনু পিসির নাম সে অনেক দিন আগেই
শুনেছে। পিসির নাম বলতেই গ্রামের একজন এসে
গয়ারামকে পিসির উঠোনে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
পিসিকে পেয়ে একেবারে আত্মহারা গয়ারাম বলল,
“বলি ও পিসি, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার? হাড়
জির জিরে কঙ্কালসার দেহ। চোখের নীচে কালী
পড়ে গেছে। এই বয়সে এত খাটাখাটুনী কী চলে !”
পিসি চোখ পিট পিট করে বলল, “ তা তোকে
তো ঠিক চিনতে পারলাম না। কে তুই ?”
“আমাকে চিনতে পারলে না পিসি ? আমি হলাম তোমার আপন জেঠতুতো ভাই কানুর ছেলে।
কানুদাকে মনে আছে তো ?”
বিনু পিসি অবাক হয়ে বলল, “কানু ? কী জানি !
তা তোর নামটা কী ?”
“গয়ারাম, তবে আমাকে শুধু গয়া নামে ডাকলেই চলবে পিসি।” এই বলে টিপ করে একটা
প্রণাম করে গয়ারাম পিসির চরণতলে উবু হয়ে বসে পড়ল।
পিসি এবার ভাইপোর কাণ্ড দেখে ফিক করে
হেসে ফেলল। তারপর বলল, “যা বাবা কুঁয়োতলা
থেকে হাতে মুখে জল দিয়ে আয়গে। ঘেমে নেয়ে
গেছিস একেবারে।”
“না পিস এখন হাত মুখ ধুয়ে বাবুটি সেজে
বসলে তোমার কাজ কে করবে শুনি। আগে
কুঁয়োতলাটা একটু রগড়ে পরিস্কার করতে হবে।
শ্যাওলা জমে গেছে। পা পিছলে পড়ে গেলে এই বয়সে কে সেবা করবে পিসি, সে খেয়াল আছে?”
বিকেলে খেয়ে দেয়ে গয়ারাম একটা লম্বা ঘুম
দিয়ে দিল। ঘুম থেকে উঠে গ্রামটা একবার ঘুরে
দেখতে বের হল। গ্রামের মাথায় একটা মুদির দোকান আর তার পাশেই ছোট্ট একটা তেলেভাজার
দোকানও রয়েছে।

ছোলার ডাল শিলে বেটে সেই
ডালে নুন-লঙ্কা মিশিয়ে তেলে বেশ কিছুক্ষণ ভেজে
গরম গরম তুলে ফেলছে দোকানি। তা দেখে
গয়ারাম পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন বের করে
ফেলল। গুনে গুনে দশটা গরম ডাল-বড়া কিনে
পিসির কাছে ফিরে এল।
পিসি ডাল-বড়া পেয়ে খুব খুশি। বলল,
“নিপিনের হাতে ভাজা ডাল বড়া কত দিন খাইনি।
য়াই আমি টিন থেকে মুড়ি নিয়ে আসিগে !”
তারপর মুড়ি কাঁচালঙ্কা আর ডাল-বড়া খেতে
খেতে গয়ারাম বলল, “তা পিসি এই চারখানা ছাগল
ছাড়া তো আর কিছু দেখছিনে ঘরে। আমি ভাবছি
একটি কালো দুধেল গাই কিনলে কেমন হয়? এই
বয়সে মানুষের হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। কালো
গাইয়ের দুধ খুব বলকারী আর তেমনি মিষ্টি হয়।”
এরপর অনেক রাত পর্যন্ত পিসির সাথে শলা-পরামর্শ
চলল গয়ারামের। পিসিকে সে একটা কালো দুধেল গাই কিনিয়েই ছাড়বে মনে হয়।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই গয়ারাম কাজে লেগে
পড়ল। ঘরের চালে পুরনো খড় ঝড়ে উড়ে
গিয়েছিল। গয়ারাম নতুন খড়ের আঁটি নিয়ে চালে
উঠে পড়ল। তা দেখে পাড়ার লোকেরা মন্তব্য করল,
“কোথাকার কোন পাতানো পিসি ! তার জন্যে
ভাইপোর এত ভক্তি কেন?” কেউ কেউ বলল, “শুধু
ভক্তি নয় অতি ভক্তি !”
গয়ারাম দেখল পিসির মতো পিসির
ছাগলগুলোও হাড় জিরজিরে। সেগুলোর জন্য কচি
ডাল-পাতা নিয়ে এসে পিসিকে রান্নার কাজে সাহায্য
করতে বসল।
বিকেলে আবার নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ
করে ডাল-বড়া নিয়ে এসে খাওয়ালো পিসিকে।
ডাল-বড়া আর মুড়ি খেতে খেতে ভাইপো বলল,
“আমি কিন্তু কোন কথা শুনব না পিসি। এই বুধবার আমাকে হাটে যেতেই হবে। দেখেশুনে একটা কালো
দুধেল গাই এনে যতক্ষন না এই উঠোনে বাঁধছি
ততক্ষণ শান্তি পাচ্ছি নে !”
পিসি বলল, “কিছু জমানো টাকা তো আছে।
কিন্তু দুধেল গাইয়ের কী কম দাম ! তারপর গেল
মাসে ওই টাকা দিয়েই তো আরো দুটো ছাগল কিনেছি।”
গয়ারাম ছাগলের কথা শুনে বলল, “আমি
একটা কথা বলব পিসি। হাতের জমানো টাকা রেখে
কোন লাভ নেই। সেগুলো তো আর সুদে বাড়ছে না।
তার চেয়ে একটা গাই-গরু থেকে দশটা গাই গরু
হবে। সেগুলোর দুধ কিনতে উঠোনে লাইন পড়ে
যাবে। আর গাই-গরুর যত্ন করার জন্য আমি তো
রইলামই।”
এ কথাটা খুব মনে ধরল পিসির। আবার সে
একবার ফিক করে হেসে ফেলল আর গয়ারামও
পিসির ফোঁকলা দাঁতের হাসি দেখে বুঝে গেল, পিসি
আর নাম করবে না।
তারপর পিসির উঠোন আলো করে কালো গাই
বিরাজ করতে লাগল। কালো গাইয়ের বাছুর চার
পা তুলে তিড়িং-বিড়িং নাচ করে সকাল থেকে।
পিসি কালো দুধেল গাইয়ের দুধ খেয়ে খেয়ে দ্বিগুণ
আনন্দে পাড়াময় গয়ার নাম কীর্তন করে বেড়ায়।
পাড়ার লোকেরাও বলে, “কী ভাগ্য গো তোমার
বিনু ! এমন করিৎকর্মা ভাইপো এখনকার দিনে
পাওয়া ভার।”
সব গল্পেরই তো একটা শেষ থাকে। এই গল্পটাও
শেষ হল। গল্পের যেমন শেষ হল তেমনি বুড়ি পিসিও
একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেল।
সেদিন সন্ধ্যে থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু
হয়েছে। ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দিচ্ছে মাঝে মধ্যে।
রাত্রে খেয়ে দেয়ে গয়ারাম ঝকঝকে কাঁসার
গেলাসে এক গেলাস আঠার মত পুরু দুধ পিসির
হাতে ধরিয়ে দিল। পিসি সেই গরম দুধ খেয়ে
বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর শুতে শুতে ঘুমিয়েও পড়ল।
আর সেই সুযোগে গয়ারাম নিশ্চিন্তমনে দুধেল
গাই আর তার বাছুরটি নিয়ে অন্ধকারে বেরিয়ে
পড়ল। বাছুরটি রয়েছে তার কোলে। কোলের
বাছুরটিকে অনুসরণ করে কালো গাই নিশ্চিন্ত মনে
গয়ারামের পিছন পিছন হাঁটছে।
গয়ারাম খুব খুশি। তার এতদিনের পরিশ্রম
আজ সফল হয়েছে। পাতানো পিসির কল্যাণে এখন
সে গোটা একটা কালো দুধেল গাইয়ের মালিক।
এক চিলতে হাসি তার ঠোঁটের কোণে উঁকি মারল।
তারপর গয়ারাম কালো গাই নিয়ে গভীর অন্ধকারে
মিশে গেল !

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here