ছোটগল্পঃ মোগলি ভূত

0
66
পরিচিতিঃ
গল্পকার তরুণকুমার সরখেলের জন্ম পুরুলিয়ার এক গ্রামে। সেখানে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবন, উদোম প্রকৃতি তার শিল্পী হৃদয়ে ভাব সঞ্চার করে। ছোট থেকেই লেখালিখির চর্চায় নিজেকে নিজেকে সমর্পন কিশোরভারতী, শুকতারা, গণশক্তির মতো কাগজে তখনই মুদ্রিত হয় তাঁর ছড়া। ১৯৯৫ সালে শুরু করেন ‘সঞ্চিতা’ নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা প্রকাশ করতে। আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকা। পাশাপাশি আরো একটি ছোটোদের পত্রিকা -‘টুকলু’র তিনি সম্পাদক। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, চিরসবুজ লেখা প্রভৃতি পত্রিকায়।
ছোটদের জন্য শুধু ছড়া নয়, গল্পও লেখেন তিনি। রাজ্যের প্রায় সমস্ত শিশু ও কিশোর পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের কয়েকটি কাগজে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
ছোটদের জন্য লেখা এই কবির বইগুলি পড়লেই তাঁর চরিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। তিনি অনাবিল আনন্দের দিশারী। শিশুমনের স্বপ্নলোকে অনায়াসে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি পেয়েছেন অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কার। সংবর্ধনাও পেয়েছেন বহু জায়গায়। অন্যতম পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (২০০২) ও সাহিত্য মন্দির পুরস্কার (২০১৯) ।

তরুণকুমার সরখেল-এর ছোটগল্প

মোগলি ভূত

ঠাকুরদা ছিলেন যেমন রাশভারী তেমনি
পরোপকারী। তাঁর চিকিৎসায় কত লোক যে
উপকৃত হয়েছিলেন বলে শেষ করা যাবে না।
সেবার ঘোর বর্ষায় ঠাকুরদা রোগী দেখে ফিরছিলেন
পাশের গ্রাম ধনুকতোড় থেকে। তখন আবছা
আঁধার নেমে এসেছে। মাঝে ধানখেতের পাশে
একটা পুকুর রয়েছে। পুকুরপাড়ে অনেক দিনের
পুরনো পাকুড় গাছ। সেই গাছটার নাম অনুসারে
পুকুরটাকে সকলে পাকুড়বাঁধ বলে। ঠাকুরদা
পাকুড়বাঁধের কাছাকাছি আসতেই সন্ধ্যেবেলার আবছা আলোয় দেখতে পেলেন গ্রামের একজন বউ
ঝুঁকে পড়ে জল থেকে গেড়ি-গুগলি তুলছে। গ্রামের
অনেকেই এসময় পুকুর থেকে গেড়ি-গুগলি তুলে
নিয়ে যায়। ঠাকুরদা বউটাকে দেখে

একটু গলা খাঁকারি দিলেন।কিন্তু তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না।

ঠাকুরদা ডাক্তার
মানুষ। গ্রামের সকলেই তাঁকে মান্যি-গন্যি করেন।
গ্রামের বউরা ডাক্তার বাবুর গলার আওয়াজ
পেলেই মাথায় ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু
গেড়ি-গুগলি তুলতে বউটা এতটাই মগ্ন যে ডাক্তার
বাবুর উপস্থিতি বোধ হয় টেরই পায়নি সে।
তিনি সাইকেলটি পাশে রেখে একটু দূরে
দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর বউটির দিকে তাকাতেই
তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। এক ফাঁকে সে একেবারে মাঝপুকুরে চলে গেছে। সেখানে অন্ততঃ এক
তালগাছ জল। বউটি অতদূরে গেলই বা কখন আর
কীভাবেই বা গেল। তাছাড়া গভীর জলে ওভাবে
কোমর ঝুঁকিয়ে গুগলি তোলা তো সম্ভব নয়। তিনি
কি ভুল দেখছেন ? না ভুল হবার নয়। ঐ তো বউটির নড়া-চড়া এতদূর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে।
তিনি আর সেখানে দাঁড়ালেন না।
গ্রামে ফিরে তারাপদ মাইতির সঙ্গে দেখা।
তারাপদকে ডেকে ঘটনাটা বলতেই সে বলল, “এ
আর নতুন কথা কী ডাক্তারবাবু ? মোগলি ভূতকে
তো অনেকেই পুকুরপাড়ে গেড়ি-গুগলি তুলতে
দেখেছে। মোগলিকে আপনার মনে নেই বুঝি ? ঐ
তো সেবার গেড়ি-গুগলি তুলতে গিয়ে জলে ডুবে
মরল। বেচারা মোগলি সাঁতারটাও জানতো না যে।
গুগলির নেশায় এতটাই মশগুল ছিল যে কোন
সময় জলের গভীরে চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি।
তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল বলে সেখানে কোন
লোকজনও ছিল না। বেচারা বেঘোরে প্রাণটা
হারাল। সেই থেকে তার গুগলি তোলার নেশাটা
এখনও যায়নি। তবে ও কারো কোনদিন ক্ষতি
করেনি।”
ঠাকুরদা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“এবার বুঝলাম। মোগলির বাড়িতেও আমি
গিয়েছিলাম একবার। ও বেচারি তখন ম্যালেরিয়ায়
মরতে বসেছিল। আমার চিকিৎসাতেই সেবার বেঁচে যায়।”
মজাটা হল এর কয়েকদিন পর। ঠাকুরদা
একদিন সেই পাকুড়বাঁধের পথ দিয়েই ফিরছিলেন।
পথঘাট শুনশান। সরু রাস্তা দিয়ে সাইকেল
চালানোর সময় হঠা‌ৎ পায়ের কাছে কিছু একটা
পড়ল। জিনিসটা বেশ ভারী মনে হল। পিছনের
ক্যারিয়ারে আটকানো ঔষুধের ব্যাগটা পড়ল কী?
না। তিনি পকেট থেকে ছোট্ট টর্চ বের করে
জিনিসটার উপর আলো ফেললেন। সেটা আর কিছু
নয় জ্যান্ত একটা রুই মাছ। মাছটা এখানে এসে
পড়ল কীভাবে ? ঠাকুরদা এদিক ওদিক তাকালেন।
না কেউ নেই। হঠা‌ তাঁর মোগলি ভূতের কথা মনে
পড়ল। এ নির্ঘাৎ তারই কাজ। ডাক্তারবাবু রুই মাছ
পছন্দ করেন, এটা মোগলি এখনো ভোলেননি।
বেঁচে থাকতে ডাক্তারবাবুকে সে অনেকবার রুই
মাছ দিয়ে এসেছে।
ঠাকুরদা আর দেরি না করে চটপট মাছটা তুলে বাড়ি নিয়ে এলেন। অবশ্য বাড়িতে এই ভূতুড়ে
কাণ্ডের কথা একবারও বললেন না। কী জানি
ভূতের দেওয়া মাছ তারা যদি না খায় তাহলে তাঁর
সাধের রুই মাছ খাওয়াই হবে না। তার চেয়ে না
বলাই ভাল।
এরপর প্রায়ই ঠাকুরদাকে জ্যান্ত রুইমাছ সাইকেলে
ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে। তবে সে মাছ
তিনি কোথায় পেয়েছেন তা কখনই প্রকাশ করেন
নি। মোগলি মরে গিয়েও তাকে নিয়মিত মাছ সাপ্লাই
করে গেছে, এরকম উপকারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here