মিথ মন্দিরঃ বেলঘরিয়ার রাধা-মোহনের মন্দির-বাড়ি

2
373
দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

বেলঘরিয়ার রাধা-মোহনের মন্দির-বাড়ি

দে ব লী না   রা য় চৌ ধু রী     ব্যা না র্জি

আলোকচিত্রঃ শুক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

কৃষ্ণ কি শুধুই মুরলীধর মূর্তি হয়েই পুজো পান ভক্তের কাছে? কৃষ্ণ তো আত্মার আত্মীয়, প্রাণের সখা – প্রথাগত মন্দির নয়, বাড়ির ছেলে হয়ে উঠেছে কৃষ্ণ এক পরিবারের ছেলে।

টেকচাঁদ ঠাকুরকে মনে আছে? বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল তিনি। আলালের ঘরে দুলালের রচয়িতা যার আসল নাম প্যারীচাঁদ মিত্র; অমর তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য। তিনি হুগলির এক শিক্ষিত পরিবারের মানুষ ছিলেন। এই প্যারীচাঁদ মিত্রের এক বংশধর, নাম শ্রী নিমাই মিত্র ছিলেন সন্তানহীন। অর্থের কোন অভাব ছিল না তাদের , রীতিমতো বিশাল জমিদারির মালিকানা ছিল। কিন্তু মনে কোন সুখ ছিল না। কারন দুই স্ত্রী থাকতেও তিনি ছিলেন নিঃসন্তান । বহু পুজো-আচ্চার পরেও কোন বংশধর এলো না কোল জুড়ে।

সময় মানুষের অনেক জ্বালা মিটিয়ে দেয়। কিছু বছর পর নিমাইবাবু ভাবলেন, সন্তানের জন্য দুঃখ পেয়ে আর কতকাল নষ্ট করবেন। ঈশ্বর আছেন। কৃষ্ণ আছেন। তিনি কৃষ্ণকেই সন্তানজ্ঞানে বুকে তুলে নিলেন। কাশী থেকে নিয়ে এলেন কষ্টিপাথরের তৈরি রাধা ও কৃষ্ণের মোহনমূর্তি। স্থাপন করলেন , মন্দিরে নয়, বেলঘরিয়ার বসতবাড়ির দোতলায়। ঘরের ছেলে কি মন্দিরে থাকে?


বসত-মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল বারশো পঁয়ত্রিশ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইং 1829 সালে। নির্মাণ করেছিলেন শ্রী নিমাই মিত্র মহাশয়। গেট দিয়ে ঢুকে চারিপাশে বিশাল বাগান, বীথিপথ, পুকুর-ঘাট আর কৃষ্ণতুলসী মঞ্চ। আর পাশেই সাবেকি আমলের দোতলা বাড়ি। কোনো মন্দির নেই। দালান পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই টানা বারান্দা সংলগ্ন বিশাল এক ঘরে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি। পুরোহিত শ্রী ভগবত গোস্বামী নিত্য পুজো করেন। তিনি পুরুলিয়ার মানুষ কিন্তু কৃষ্ণের টানে এখানেই থেকে গেছেন। খুব ঘরোয়া ভাবে পুজো হয় এই মন্দিরটিতে। লোক সমাগম একেবারেই কম। আসলে আমরা দুরের ‘পর্বতমালা’ , ‘সিন্ধু’ দেখতেই বেশী আগ্রহী। বাড়ির কাছে, ব্যস্ত জীবনের ঝলমলে আলোর নিচে ছোট্ট ছায়ার রঙজালি আমরা দেখতে পাই না। গেট বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা অবধি খোলা থাকে কিন্তু অনেক মানুষ তো এখানে যে এক মন্দির আছে, তা-ই জানেন না। এক শহর ভিড়ের পাশে একমুঠো স্নিগ্ধতার মতো মদনমোহন জিউ মন্দির। শুধু রাস আর দোল উৎসবে উদযাপন হয়। মিত্র পরিবারের জ্ঞাতিগুষ্টি ও কিছু বাইরের মানুষ আসেন এখানে। নিমাইবাবুর দেব উত্তরসূরির জন্য রাখা অর্থের তহবিল ও বাকি জ্ঞাতিদের সাহায্যে এই বসতমন্দিরটি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আজও সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বেঁচে আছে।

বেলঘরিয়া থানার ঠিক বিপরীতে, সরস্বতী প্রেসের পাশেই বি টি রোডের উপর, ভিড় রাস্তার জমজমাট পরিবেশ দূষণের মধ্যেই আজও সেই বাগান ও বসতবাড়ি নিমাইবাবুর পুত্রের তত্ত্বাবধানে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধানো পুকুরঘাট, রকমারি ফুলের বিশাল বাগান, কানন- বীথি, পিছনে সবজিক্ষেত সমস্ত সুন্দর করে সামলে রেখেছেন মানব-পিতার দেব-সন্তান আজ প্রায় দুশো বছর ধরে। ব্যস্ত শহরের হৈচৈ ভরা রোজনামচার আড়ালে সময়ের কাঁধে ভর দিয়ে সুস্থ ভাবে বেঁচে আছে এই মন্দির বাড়ি।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here