কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র  একটি ভ্রমণ কাহিনী-কূয়াপানি

2
174
পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম। কৃৃৃৃষ্ণা, যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা ছদ্মনামেও লেখেন। 

কৃ ষ্ণা   মা লি ক-

 একটি ভ্রমণ কাহিনী 

একটা ধূ ধূ চষা মাঠ। বেবাক পড়ে আছে। বোবা, নিঃশব্দ, অথচ আর্তি আর ভরাটে আলো আলো।আকাশের ছায়াটুকুও সেখানে মুখ দেখাতে আসে না বটে, তবে দুচার ফোঁটা বৃষ্টি নামলে ফসলে ভরে যাবে তার গোঠ।

না না! এ কোন কবিতা বা মুক্তগদ্যের খসড়া নয়। একটা ভ্রমণপথের ক’টি সূচনা পঙক্তি মাত্র। রাত আটটা নাগাদ বর্ধমান স্টেশন থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চেপে বসেছি পুরো সংসার তুলে নিয়ে। অর্থাৎ অল্পস্বল্প বাক্সপ্যাঁটরা, আর স্বামীকন্যাসহ আমার নিজেকে নিয়ে। ট্রেনে যাত্রাপথ মালবাজার পর্যন্ত। সেখান থেকে কোথায় গন্তব্য তা জানাব, তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।

ছোট মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। মা হিসেবে সামান্য স্বার্থত্যাগ করে এবং অতিমারীর চোখরাঙানীর কারণে দুটি বছর গুহাবাসী ছিলাম। পরীক্ষা শেষ হতেই বেরিয়ে পড়েছি।

বড়ো মেয়ে এবার ইভেন্ট ম্যানেজার। তার নির্দেশমতো সবকিছু চলছে। বাড়ী থেকে ডিনার সেরে বেরিয়েছিলাম। তাই ট্রেনে উঠে খানিকক্ষণ এতোলবেতোল কথাবার্তা চলল। ওদিকের কূপের এক দোআঁশলা পরিবারের ন্যাকা কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে দূর ছাই করে শুয়ে পড়ব ভাবলাম। নাহলে জানলায় চক্ষু পেতে মনের হুড়কো খুলে খানিক টো টো কোম্পানির চাকুরে হয়ে যেতাম নিশ্চিত।
দোআঁশলা পরিবার -! এই কারণে, ছয়জনের টিম। তাঁরা ঠিক করতে পারছেন না কোন ভাষায় কথা বলবেন। এক লাইন হিন্দি, পরের লাইন ইংরেজি, তিন নম্বর লাইন, উঁহু বাংলা নয়। হাফ বাংলা, হাফ হিংরেজি। হিন্দির সাথে ইংরেজি মেশানো। সত্যি! প্রবাসী বাঙালি! এত শিক্ষিত! কিন্তু অন্যের অসুবিধা থোড়াই কেয়ার করে পঞ্চমে গলাকে খেলিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।

 

মনে মনে গজ গজ করছি, ভগবান! এনারা ঘুমোলেও তো বাঁচি! আমার মেয়েরা বিরক্ত হয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে উপরের বার্থে উঠে গেল। আমি ওই দলের এক ভদ্রমহিলার অনুরোধে ওনার মিডল বার্থে গেলাম। কারণ তিনি তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে শোবেন, নীচের বার্থ হলে ভালো হয়।

বেলা আটটা নাগাদ শিলিগুড়িতে ওনারা নেমে যেতে তিনবার বললাম, ওম শান্তি! ওম শান্তি! ওম শান্তি!

রাতে তো ট্রেনে ঘুম হলো না। কোনোকালেই হয় না। জানলার কাচে চোখ লাগিয়ে দেখি রাতের রেলগাড়ি কেমন দায়িত্ববান রানার। সবাইকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে দায়বদ্ধ। তার যেন নিজের সুখ দুঃখ নেই। কেবল রাতের অগণ্য গ্রহ তারা অবোধ্য ভাষায় তার সাথে কথা বলে চলেছে। ঘুমন্ত বা আধ ঘুমন্ত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দার্শনিকের মতো কেবল ভাবুক চোখে মানমন্দির লাগিয়ে যেন জ্যোতিষ্ক গণনা করছে।

শুয়ে শুয়ে কতরকম কথা বলে রেলের চাকা, তাই শুনতে শুনতে ঘুমোতে চাই। খুব দরকার আমার একটি নিটোল ঘুম। অসুস্থতাকে কীভাবে প্রতিরোধ করব জানা নেই। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি, তরতাজা একটা মানুষ হয়ে ঘুম ভাঙছে আমার। আর তুড়ি মেরে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামছি। তা যদি না হয় তবে এই আধ ঘুমন্ত রেলের আসনে শুয়ে শুয়ে ছেড়ে যাক আমার আত্মা। তারপর ফ্রি মুডে ব্রহ্মাণ্ড চষে বেড়াই। বেশ হয় তাহলে, মনে মনে ভাবি।

এসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনের দুলুনিতে কখনও কখনও চোখ লেগে যাচ্ছে।

একসময় ঘুমটা ভাঙতে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম। সবে ছটা বাজে। তবু কুমারসাব, যিনি গাড়ির ড্রাইভার, আমাদের মালবাজারে নিতে আসবেন তাঁকে ফোন করলাম।

এবার বলে ফেলি আমাদের গন্তব্যস্থানের নাম। কূয়াপানি। নাম শুনেছেন? এটা কালিংপং জেলার গরুবাথান থানার অন্তর্গত একটি ছোট্ট গ্রাম। লাভা যাবার রাস্তায় পড়ে। ওখান থেকে লাভা মাত্র সাত/আট কিলোমিটার। আমরা দুটো দিন নিরিবিলি জায়গাটিতে গ্যাঁট হয়ে বসে রেলিস করব, ল্যাদ খাব, আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চেটেপুটে যতটা খেতে পারি – এই ভেবে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

আমাদের বন্ধু সুকন্যা আর পথিকৃতদা পোচ্চোন্ড প্রকৃতিপ্রেমিক। কোথায় না কোথায় সারা বছর ঘুরে ঘুরে বেড়ান। ওঁরা কূয়াপানিতে একটা হোম স্টে করেছেন নিজেদের শখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সুকন্যাকে জায়গাটার কথা জিগ্যেস করলাম। কারণ আমরা ভিড় এড়িয়ে দুটো দিন কাটাতে চাইছিলাম। ও কিছু ছবি পাঠাল। তাতেই পূর্বরাগ জন্মাল। মেয়েদের সঙ্গে আলোচনা হলে ঠিক হলো ওখানেই যাব। মাঝে দুটা দিন হাতে নিয়ে আপনারাও বেরিয়ে পড়তে পারেন। ঠকবেন না নিশ্চিত।

শুক্রবার রাতের ট্রেনে উঠে পড়ুন। হোম স্টেতে আগে থেকে বলে দিলে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে মালবাজারে উপস্থিত থাকবেন। নয়তো শেয়ার জিপেও যেতে পারেন। মালবাজার দিয়ে যাওয়াই সুবিধার। কারণ ওখান থেকে রাস্তা মোটে ঘন্টা দেড়েকের। কুমারসাব হোম স্টে-র ভ্রমণার্থীদের মালবাজার থেকে আনা ও নেওয়াটা করে দেন বরাত পেলে।

স্টেশনের রেস্টুরেন্টে আলুপরোটা চা সহযোগে সাঁটিয়ে প্রাতরাশ সমাধা করা গেল। এর মধ্যে কুমারদাদা এসে গেছেন। জিগ্যেস করতে জানা গেলো তিনি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছেন। সাড়ে নটা নাগাদ রওনা দিলাম। যাবার রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে কত্তা কিনে ফেললেন ভারী ভারী ওজনের খান চারেক তরমুজ। আর কেউ খেলে ভালো, না খেলেও তার পরোয়া নেই। তিনি একাই যথেষ্ট। তাঁর তিনদিনের খোরাক। একটা তরমুজ ড্রাইভার দাদাকে উপহারও দিয়ে ফেললেন।

রাস্তার দুদিকে অজস্র সবুজ। অসহনীয় ভালো লাগা। চা বাগানের সৌন্দর্য আর নতুন কথা কী! শ্রমিকদের অসহ্য দারিদ্র্যের কথা আমাদের মাথায় থাকে না, যখন ছবির মতো সাজানো চা-বাগানে মাথায় টুকরি নিয়ে তাদেরকে টুকটুক করে নিঃশব্দে চা-পাতা তুলতে দেখি।

পথের দিকে তাকিয়ে “এ পথে আমি যে গেছি বারবার” গুনগুন করতে লাগলাম। আরও খানিক ছায়াচ্ছন্ন রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি দাঁড়াল। ছবি-টবি তোলা হলো। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ফিকে গোলাপি রঙা একরকম ফুলগাছ চোখে পড়তে লাগল। নাকদোনা টাইপের একটা গাছ দেখিয়ে কুমার দাদা বললেন, এর পাতা হাতের তালুতে রগড়ে শুঁকলে গা-বমি ভাব কমে। সঙ্গে সঙ্গে আমি কয়েকটা পাতা তুলে নিয়েছি, কারণ এই “অল্প হাই অল্টিচুডে”ও আমার এরকম বিবমিষা হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। যে কারণে সবাই পেটপুরে উপাদেয় আলুপরোটা সাঁটালেও আমি ভয়ে ভয়ে আধখানা খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছিলুম।

আবহাওয়া আরামদায়ক হয়ে উঠছে এবার। যদিও আমার মতো রক্তাল্পতায় ভোগা প্রাণিটি একটু পরেই একখানা পাতলা চাদরের খোঁজ করবে নিশ্চিত।

কূয়াপানির অল্প আগে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করালেন ড্রাইভারদাদা একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে। দেখলাম সেখানে আরও কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কানে আসছে পাহাড়ি নদীর টুংটাং বে-তার ধ্বনি।

কুমার সাহেব বললেন, এটা চেল নদী। এ কিছুদূর গিয়ে তিস্তায় মিলেছে। আমরা কৃষ্ণের একথাবা মাখন মার্কা (মাখনবল, ভারতবর্ষের অনেক জায়গাতেই এমন দেখা যায়) একটা বড়ো পাথরের গা দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তায় নেমে গেলাম। উপরের দিকে হিমালয় পাহাড়ের গায়ে জংগলের ভেতর থেকে আচমকা বেরিয়ে এসেছে কোনো কিশোরী কত্থক শিল্পী। তিস্তার উপনদী সম্ভবত। তার স্বচ্ছ শীতল জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়াতে ক্লান্তি উধাও। ছবি-টবি, সেলফি তোলা তো আবশ্যিক কত্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীং।

আচমকা একটা ছোট উৎরাইএ বাঁক পেরোতেই ছবিতে দেখা “গসিপ হোম স্টে”! ভীষণ ভালো লেগে উঠল। সারল্য যেমন একটা বড়ো গুণ, তেমনি এই হোম স্টেটি। দুজন অল্প বয়সী ছেলে এসে ব্যাগ-ট্যাগ এবং কত্তার তরমুজ বগলদাবা করে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট রুমে রেখে এলো।

কুয়াশা মেঘ আর মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি জলঝরি জীবনটাকে খুব লোভে জিভচাটার মতো সুখকর করে তুলল। আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! দূষণহীন, চিৎকারহীন দুদিনের এই আবাস ‘গসিপ’ অজস্র জেড প্লান্ট আর নানা রকম ফুলের টব দিয়ে চমৎকার সাজানো। সামনের সড়ক চলে গেছে লাভার দিকে।

ঘরে গিয়ে উলটো দিকের দরজা খুললেই পাইনের সারি নিয়ে সজলসবুজ পাহাড় ধাপে ধাপে নেমে গেছে। জানলার পর্দা সরালে পাহাড়ও চোখ সরাবে না। কেবল মাঝে মাঝে কুয়াশা আর মেঘ মেখে লুকোচুরি খেলবে, তারা আমাদের ঘরেও ঢুকে আমাদের আলিঙ্গন করে যাচ্ছে কখনও কখনও। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে বারান্দা থেকে ডানদিকে বিস্তৃত শূন্যতার মাঝে অবিরাম বয়ে যাওয়া তিস্তা, রঙ্গিত, চেল বা আরও কোনো নাম না জানা তিস্তার উপনদী ও শাখানদী চোখে পড়ছে। আর বাঁদিকে মেঘধূসর, কখনও নীলাভ পাহাড়শ্রেণী।

অর্গানিক সবজির মুখরোচক মেনুতে দুপুরের ভোজন শেষ হলো। কর্মীদের ব্যবহার ভীষণ আন্তরিক। যে কারণে ফেরার সময় আমাদের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তো তাদের তদারকিতে খাওয়াদাওয়ার পর সামনের অনতিদূরের বাঁকের দিকে আলস্যের ও কৌতুহলের অল্প হন্টন। কারণ পথের বাঁক মানেই কৌতুহল, দেখি তো কী আছে! – এরকম মনোভাব। রাস্তার ধারে দু-একটি কুটির। বাসিন্দারা কৌতুহলহীন তাকিয়ে। যদিও তাঁদেরই একজন আমাকে ডেকে গ্রোয়ার ব্যাগসহ ফুলের গাছ উপহার দিয়েছিলেন। আর আমি এমনই অকম্মার ঢেঁকি, যে বাড়িতে এনে সে উপহার বাঁচাতে পারলাম না!

রুমে ফিরে এসে একটু গল্পগুজব করতে করতেই দিনের চোখে ঘোর নামল। অন্ধকার গাঢ় হলে পাহাড়ের গায়ে দেওয়ালীর আলোকসজ্জা। হোম স্টে-র কর্মী ভোলা বলে ছেলেটি চা দিতে এলো। সে বলল, “দিদি, ওই যে দূরে দূরে বসতির আলোগুলো দেখতে পাচ্ছেন, ওর মধ্যে সবথেকে দূরে আলোর ব্রীজের মতো মনে হচ্ছে যেটা সেটা গরু বাথান, এদিকে তিস্তার উপর দিয়ে একদম ডানদিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে যে মিটমিটে আলো – ওটা মালবাজার। আর ও-ই যে…! ও জায়গার নামগুলো বলে বলে চেনাতে চাইছিল।

আমি ভিড়ের ভেতরে থেকেও নিজেকে একলা করে ফেলতে পারি চিরকালই। ভোলার কথা ধীরে ধীরে মৃদু হতে হতে মুছে গেল আমার শ্রবণেন্দ্রিয় থেকে। আর আমি পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাজানো টুনি বাল্ব, দূরের দিকচক্রবাল পেরিয়ে সমতলের আলোকমালা আর আকাশের সপ্তর্ষীমন্ডল কিংবা বৃশ্চিকরাশিকে একসারিতে ফেলে দিই। সবটা মিলিয়ে এই অন্ধকারের ভেতর এক অখন্ড ব্রহ্মান্ডের বোধ জন্মায়। ভাবি, ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী? শান্তিলাভ? উপভোগ? কর্মবিরতি? জ্ঞানার্জন? নাকি নিজেকে বিরাটের এক অংশ হিসাবে দেখা? বিশ্বখ্যাত পর্যটকদের কথা তোলার দুঃসাহস নেই। আমার ছাপোষা নস্যজীবনে এই সবকিছু ঘেঁটে ঘ হয়ে তার থেকে এক পয়সা, এক আনার তেড়ে কেটে তাক করে তিনদিনের ভ্রমণ কিস্যার নামে ব্যক্তিগত চ্যাংড়ামো।

যাই হোক, পরের দিন সকালের খাবার খেয়ে কূয়াপানির উপরের গাঁ থেকে ভোলার সঙ্গে রাইশাক আনতে চললাম। দুপুরে সরষো কা শাগ খাব। আমি একা যাব ভাবলাম, কিন্তু দলবলকে এড়ানো গেলো না। আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ভোলা দৌড়ে নেমে গেল কিচেনে শাক পৌঁছে দিতে। কারণ সে আমাদের লোভ দেখিয়েছে “মাত্র” সাত কিলোমিটার হেঁটে গেলেই চমৎকার একটা ঝোড়া আছে, আর সেখান থেকে অল্প গেলেই এদিকের পাহাড়ের শেষ টঙে পৌঁছোনো যাবে।

সত্যিই সুন্দর ছিল সেই ট্রেকিং। ঝোরাটা অনবদ্য। চুপ করে বসে থাকলে পাখিদের ডাক আর ঝরনার পাহাড় বেয়ে নেমে যাবার শব্দ মনকে নির্ভার এক মুক্তি দিলো। নুড়ি বিছানো রাস্তার উপর অত্যন্ত স্বচ্ছ ও শীতল জলে পা ডুবিয়ে আরাম পেলাম। সে জল পানও করা চলে। ভোলার সঙ্গে তার দেহরক্ষীর মতো হোম স্টের সারমেয়টি সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। সে জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকটা জল খেলো। তবে আমরা সাহস করে তেষ্টা পাওয়া সত্ত্বেও সে জল পান করতে পারলাম না। ঝোড়াটির উপর একটি প্রাগৈতিহাসিক কাঠের সেতু যেন প্রকৃতির মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখা। তাকে দেখে তৎক্ষণাৎ ভালোবেসে ফেললাম। সম্ভবত ঝোড়াটি “পাগলা” হয়ে উঠলে তাকে পার হতে ওই দারুনির্মিত “প্রচেষ্টা সেতু”! এ হেন এই নিসর্গের ভেতর ভোলা নাকি মাঝে মাঝে এসে দুদণ্ড জিরিয়ে যায়! ওকে আরণ্যকের সত্যচরণের সঙ্গে তুলনা করলাম মনে মনে।

এই অনাবিল সৌন্দর্যের পাশে ভয়ঙ্কর ধসের চিহ্ন দেখে শিউরে উঠলাম। অল্প কদিন আগেই হয়েছে। আরও কিছুটা পাহাড়ী রাস্তা ভেঙে উঠে একটি কুটিরে জল খেলাম। তারপর সেই “এভারেস্টের চূড়া”! সেখানে কত্তা এক বাড়িতে চায়ের বন্দোবস্ত করে ফেলল। এদিকে বৃষ্টিও নামল তেড়ে। ঘন দুধের চা পান হলো, বৃষ্টিও কিছুটা হালকা হয়ে এলে আমরা নামতে শুরু করলাম।

সারা পথে বৃষ্টি আর থামল না। একটা মাত্র ছাতা সঙ্গে। আমি আর ছোট মেয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। ইভেন্ট ম্যানেজার নাকি খুব স্ট্রং। তার ছাতা লাগবে না।

ভোলা আমায় অর্কিড জোগাড় করে দিল। আরও কয়েকটা অজানা গাছালি। বড়ো বড়ো কচু পাতা দিল ম্যানেজারকে আর কত্তাকে মাথা বাঁচাতে। সে নিজেও তাই দিয়ে মাথা ঢাকল বটে, তবে একটু পরেই দূরছাই করে ফেলে দিয়ে ভিজতে ভিজতেই -। চোঁ চোঁ খিদে নিয়ে সাত কিলোমিটার চড়াই উৎরাই পার হবার সময় নাকের ডগায় হোম স্টে-র গরমাগরম খাবারের গাজরটা অবশ্য ঝুলে থাকল। যাহোক, সে রাস্তা পার হয়ে হোম স্টেতে ফিরলাম। আঁতপটকা আমিও চৌদ্দ কিমি ট্রেকিং করে ফেলেছি ভাবতে বেশ গর্ব হচ্ছিল কিন্তু! যদিও শেষের দিকে আমি বলেছিলাম, আর পারব না, আমি ফিরে যাচ্ছি। বাকিরা উৎসাহ দিচ্ছিল যেন ছেলে ভোলাচ্ছে, এ-ই তো এসে গেছি, আর একটুখানি -! ফিরে এসে ওদের থ্যাঙ্কস দিলাম। বিশেষ করে ভোলাকে। একটু ভয় ভয় করছিল, তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের কারও অবশ্য জ্বরসর্দি হলো না।

পরের দিন ফেরা। ফিরতে বরাবরই মনখারাপ লাগে। তবু উপায় কী? ফেরার পথে কুমারদাদা চমৎকার একটা ট্রিপ দিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি দেখলাম, আর গ্রামের কাছেই চোখজুড়োনো চা-বাগানের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তারপর বন্দরের কাল হলো শেষ। নেমে চললাম। গরুবাথানে চেল নদীর পাশে গাড়ি দাঁড়াল। নদীর জল ছুঁয়ে স্মৃতি মাখিয়ে দু-চারখানা নুড়ি কুড়িয়ে নিলো আমার দুই কন্যা ।

আপনারাও যেতে চাইলে যেতে পারেন হাতে দুটো দিন সময় পেলে। পথের হদিশ দেওয়াই রইল। কম খরচে গরীবের ঘোড়া, থুড়ি ঘোরারোগের খানিক উপশম হবেই হবে।

শুরুতে যে চষা মাঠের কথা বলেছিলাম না, দু-চার ফোঁটা জল ঝরে পড়লে ফসলে ভরে যাবে? মনের রুখাশুখা মাঠ ভিজে ঝুপ্পুস হওয়া আমার মতো খুঁতখুঁতে লোকের হয়ে ওঠে না। তবে পাহাড়ি ভেজা বাতাসটা গরম হয়ে গেলেই আবার মন উচাটন হবেই। তখন আবার কূয়াপানিতে পান করতে যেতে হবে।

পথনির্দেশ থাকল – ট্রেনে মালবাজার, অথবা নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি। সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে নিন, অথবা শেয়ার জিপে গরুবাথান হয়ে কূয়াপানি চলে যান।
যোগাযোগ নম্বর – 9932250875
9933100994

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here