ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–চোরাবালি(পর্ব-১২)

0
56
পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র একাদশ পর্ব।

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-১২)

রিং হচ্ছে। গদাই ঘোষ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মেজোবাবু তাপস খাঁয়ের নাম্বারে ফোন লাগালো। প্রথমবার লম্বা রিং হয়ে কেটে যেতে মিনিট দশেক পরে আবার ফোন করেছে গদাই ঘোষ। “… হ্যালো … ক্কেকে বলছেন?” উলটো দিকে তাপস খাঁ ফোন ধরেছে। গদাই ঘোষ মনে মনে একটা কাঁচা খিস্তি আওড়ালো, শালা যার মাসোহারা পাস তার নম্বা্র চিনবি কেন হারামজাদা!
“আজ্ঞে স্যার আমি গদাই ঘোষ বলছি…”
“আরে ঘোষদা… আরে সরি সরি… আসলে এ ফোনটা নতুন তো এই কদিন… বলুন বলুন কি মনে করে!”
“যাক চিনতে পেরেছেন এই কম সৌভাগ্য আমার !”
“হেঁ হেঁ কি যে বলেন… বলুন বলুন…”
“বলছি খবর তো সবই পান… এদিকে যে জল বেড়ে যাচ্ছে ! একদিন একটু বসা দরকার যে আপনার সাথে “
“আরে বলুন না কবে বসবেন? আজ…? নাকি পরশু রবিবার? ঘাটে যাবো না বাড়িতে… বুঝছেনই তো এসব কথা থানায় ঠিক…”
“ঘাটেই আসুন একটু সময় করে, ভালো স্কচ আছে…”
“হেঁ হেঁ আবার ওসব কেন!… আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন করে যাবোখন …”
ফোন রেখে দেয় গদাই ঘোষ। পুলিশ হচ্ছে ঘুঘুর জাত! এদের সামলে না রাখলে ঝামেলা। এতদিন এ ব্যাপারটা গদাই ঘোষ বেশ ভালোভাবে সামলেছেন তাই কেউ তার কেশগ্র ছুঁতে পারেনি। কিন্তু এবারে সময় থাকতে ঘুঁটি সাজিয়ে ফেলতে হবে! গদাই ঘোষের কাছে সবথেকে ভালো মারা হচ্ছে ভাতে মারা। শব্দ হয় না কিন্তু প্রতিপক্ষ কাত হয়ে পড়ে। তারপর যদি কাজ নাহয় তখন দেখা যাবে।
আজ মিলে যেতেই হবে। বেশ কদিন মিলে যাওয়া হয়নি! সনাতন আছে, কিন্তু সে আবার বউ নিয়ে কাহিল। অপারেশানের পর ভালো থাকলেও এখন কিছুদিন রেস্টে থাকতে হবে বলে দিয়েছে ডাক্তার। ফোনে যোগাযোগটা আছেই, সনাতন নিয়ম করে রোজ রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফোন করে গদাই ঘোষকে। গিজার অন করে তোয়ালে নিয়ে স্নানে ঢুকে পড়ে গদাই ঘোষ, উর্মিলা যথারীতি ঠাকুর ঘরে। ঠাকুরের সঙ্গে এই বার্তালাপের সময় গদাই ঘোষ বিরক্ত করে না উর্মিলাকে।
স্নান করে বেরতে বেরতে উর্মিলার পুজো হয়ে যাবে জানা আছে। সাধারনত এ রুটিনের বিশেষ হেরফের হয় না। নিজে হাতে খেতে দেওয়াটা উর্মিলা ধরে রেখেছে আজও, গদাই ঘোষও এই সময়ে সেই খারাপ সময়ের লড়াইয়ের দিন থেকে বিনা অভিযোগে সঙ্গ দিয়ে আসা স্ত্রীর সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ পায়। তা নাহলে তো সারাদিন দেখাই হয় না প্রায়! যত ব্যাবসা বেড়েছে ততো বাড়িতে সময় কমেছে। এমনিতেও সংসার নিয়ে বিশেষ মাথা কোনোদিনই গদাই ঘোষ ঘামায়নি, ঘামাতে হয় নি, যখন যেমন পরিস্থিতি সেভাবে উর্মিলাই সামলে এসেছে। মেয়ে রুমকি ছোটো তখন, একবার টাইফয়েড হয়ে খুব খারাপ অবস্থা, এদিকে গদাই ঘোষ গেছে আসামে কাঠ আনতে! পয়সার জন্য কত কি যে করেছে গদাই ঘোষ, নিজেও মনে করতে পারবে না! সেদিনও উর্মিলাই সামলেছিলো! মেয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি এসেছিলো। তখন ছিলো ভাড়া বাড়ি।
নতুন ছেলেটার কথা হঠাৎ মাথায় এলো গদাই ঘোষের! কি যেন নাম… দেবব্রত সানা… সানা কি তেলি হয়? ধুর… ছেলেটা বেশ লেগেছে হাল্কা বয়স কিন্তু চোখে একটা কিছু আছে! এতদিন লোক চড়িয়ে গদাই ঘোষ একটু আধুটু মানুষ পড়তে পারে দিব্যি! এ ছেলের খিদে আছে মনে হচ্ছে দেখে, এদিকে আবার কলেজ পড়ুয়া মাস্টারের ছেলে! দেখা যাক…
“বলছি একদিন ঘাঘরবুড়ি নিয়ে যাবে?” খাবার বেড়ে দিয়ে উলটো দিকের চেয়ারে বসে উর্মিলা বলে ওঠে।
“উম…ঘাঘরবুড়ি! হঠাৎ?…” গদাই ঘোষ ভাতের থালা থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে।
“এমনিই … একটু মন করছে, আহা মানত ছাড়া যেতে নেই বুঝি !”
“দেখো… কিছু একটা তো তোমার পেটে পাকছে বলেই ফেলো।”
“আরে না না এমনিই, তাছাড়া রুমকিরও সামনে পরীক্ষা টরিক্ষা আছে, যাবে একবার মাথা ঠেকিয়ে আসবে ও ও”
“ওসবে কিছু হবে না… মন দিয়ে পড়তে বলো…”
“তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি… নিয়ে যাবে কিনা বলো?” একটু বিরক্ত স্বরেই বলে উঠে দাঁড়াল উর্মিলা। গদাই ঘোষ একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো।
“আরে যাবেনা কখন বললাম!… আবার আমাকে টানাটানি কেন?”
“একদিন একটু সময় নাহ বের করলে, সারা জীবন তো ব্যাবসা ব্যাবসা করেই গেলে… সবাই মিলে গেলে একটা অন্য রকম ব্যাপার হয়… তোমায় বোঝানো দায়…”
“বেশ দেখছি… জানো কাল একটা নতুন ছেলেকে কাজে রাখলাম, ভালই মনে হচ্ছে তো দেখা যাক”
“তাই!… তা বেশ করেছো , নতুন লোক দরকার বলছিলেই তো সেদিন…”
খাওয়া শেষে হাঁক পেরে রমেশকে গাড়ি বের করতে বলে পোশাক বদলে নেয়। ঝিমলি এসে একবার আবদারে হাঁটুর কাছে মাথা ঘষে গেছে। এটা ওর রোজকার অভ্যেস, এই একটা প্রাণী, সব বোঝে, সব কিছু প্রকাশ করে, শুধু কথা বলে না! কিন্তু তাতে তার মায়া , ভালোবাসা আর নিখাদ প্রেম বোঝাতে কোনো আসুবিধা হয় না।
গদাই ঘোষকে নিয়ে গাড়ি আরামবাগ রোড ধরে ছুটছে। এসময়ে একটু জ্যামের ভয় তাই ভিতর দিয়ে এসে একেবার বিবেকানন্দ কলেজ মোড়ে এসে আরামবাগ রোড ধরেছে রমেশ। আর মিনিট কুড়ি লাগবে মিলে পৌঁছাতে। অভ্যাস মতো সদরঘাট কৃষক সেতু পেরোবার সময় একবার বাঁদিকের জানালা দিয়ে দূরে ঘাটের দিকে নজর চলে যায় গদাই ঘোষের, একটা জেসিবি বড় যান্ত্রিক হাত দিয়ে বালি সরাচ্ছে , দুজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে, একজন তো মনে হচ্ছে পিনুই!
রোদ পড়ে চিক চিক করছে দামোদরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা ক্ষীণ জলধারা। একটা লোক খাপলা জাল ফেলে ওর মধ্যেই মাছ ধরছে , চড়ের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা রঙের কাপড় চোপড় , শাড়ি মেলা রয়েছে অসংখ্য। এই রোদে অল্প সময়েই সব শুকিয়ে যাবে।
মিলের গেটের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়াতেই রমেশ হর্ন বাজায়। ভেতর থেকে বন্ধ, দারোয়ান বজরং এসে গেটে খুলে দেয়, গাড়ি ভিতরে যেতেই আবার লাগিয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে দাঁড়ায় গাড়ির কাছে। মেশিন ম্যান বংশীও বেরিয়ে এলো মিল থেকে, সর্বাংঙ্গে কালিঝুলি মাখা। সনাতন আজ আসবেনা জানিয়েই রেখেছিলো, গদাই ঘোষ অফিসে গিয়ে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো। ড্রায়ারের ঘরঘর আওয়াজ উঠছে , দুটো লেবার লেগে আছে সেখানে। বজরং চা দিয়ে গেলো টেবিলে। চায়ে চুমুক দিতেই গদাই ঘোষের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল একটা শিব বন্দনার রিং টোনে… মনিরুল…
“হ্যাঁ হ্যালো …কি হলো!”
“স্যার আপনি এখন কোথায়?”
“কেন ! আমি মিলে এসেছি…” কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো গদাই ঘোষ।
“স্যার আমাদের একটা গাড়ি বড়শুলে ধরেছে এম ভি…”
“ধরেছে মানে! লোকেশান দেওয়া ছিলোনা?”
“ছিলো তো স্যার … তবু”
“হুম… কে অফিসারের নাম বলো… ধুর ঝামেলা বাড়ল…”
“নাম তো জানি না স্যার!… তবে নতুন জয়েন করেছে শুনলাম”
“আচ্ছা রাখো দেখছি …”
গদাই ঘোষ একটু চুপ করে ভাবতে থাকে। লোকেশান দেওয়া থাকতেও ধরল কি করে! মোটর ভেইকেল অফিস থেকেই রোজ কোথায় কখন চেকিং থাকবে জানিয়ে দেওয়া হয় , সেই মতো ড্রাইভারদের বলে দেওয়া হয়, তারাও ঠিক তার আগে বা পরে সেখান দিয়ে পেরিয়ে যেতে পারে চেকিং এড়িয়ে! একেই বলা হয় ‘লোকেশান’ … মাসিক চুক্তি থাকে এখানেও। বাইরের পার্টি যারা লোডিং নেয় তাদের সঙ্গে এই লোকেশান সমেত চুক্তি হয় যাতে তারা নির্বিঘ্নে বে আইনি বালি বোঝাই ট্রাক নিয়ে যেতে পারে। গদাই ঘোষের যোগাযোগ অনেক দূর অবধি, তাই এরকম ঘটনা খুব একটা হয় না। এছাড়াও আছে সাংকেতিক নামের টোকেন… যা দেখলেই হাই ওয়ে পুলিশ ট্রাক ছেড়ে দেয়। যেমন এ মাসের গদাই ঘোষের টোকেন যাচ্ছে “গব্বর” লেখা। যতদুর এই টোকেন চলবে ততদুর হাই ওয়ের সব থানায় মাসোহারা পৌঁছে যায় নিয়িমিত নির্দিষ্ট অংকের।
কিন্তু তারপরেও এরকম ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটে। কোনো নতুন অফিসার এলে, বা দরকষাকষির জন্য। এসব নেটওয়ার্ক সামলায় সদরঘাট খাদানের পিনুই, গদাই ঘোষ মোবাইল তুলে পিনুকে ফোন লাগায়… একটা চটুল হিন্দি গান বাজছে পিনুর কলার টিউনে…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস– “চোরাবালি”(পর্ব-১১)

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here