আর্যাবর্তের কথা(তিন)

0
78
পরিচিতিঃ দুর্গাশঙ্কর দীর্ঘাঙ্গী দীর্ঘদিন বার্ণপুরে কর্মরত ছিলেন। তাঁর নিজের জন্মস্থান চন্দ্রকোণা নিয়ে লেখকের অদম্য কৌতুহল ও বাবার অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে অবসরের সময়টুকু সেই চর্চা নিয়েই যাপন করছেন। বাইফোকালিজমের একজন অন্যতম সদস্য

আর্যাবর্তের কথা(তিন)

দু র্গা শ ঙ্ক র   দী র্ঘা ঙ্গী

বাংলায় মাগধী ভাষার প্রভাব -পুরাতন বাংলা ভাষা
(Magadha Dialects in Bengal-Old Bengali)

(সাত)

আমরা সেই সমস্ত চর্চা বা সাহিত্যের বিভিন্ন কাজ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মধ্যবাংলা সাহিত্য পাই যেটি
মধ্য বাংলার আদিতম, অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাসের লেখা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, যেটি পঞ্চদশ শতাব্দীর হতে পারে
এবং আরও পিছনে চোদ্দোতম শতাব্দীতে ও
হতে পারে। তারও পূর্বে, আমরা কিছু কবিতার অংশ পেয়েছি যেগুলি কে পুরানো বাংলা ভাষার লেখা। যেগুলি নি:সন্দেহে মুসলিম শাসনের আগে
(১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে) । ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে এগুলি দশম শতাব্দীর আগে অন্য কোন শতাব্দীতে নয়। বলা যেতে পারে
৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তুর্কি বিজয়ের শতাব্দীর ব্যবধানের সাথে যদি বাংলা ও শতাব্দী (১২০০-১৪০০ খ্রী) পরে, আমাদের বাংলা ভাষার
সাহিত্যগুলি ধারাবাহিক ভাবে লেখা হয়েছিল তার যথেষ্ট নমুনা আছে।
যখন বাংলা ভাষার ইতিহাস যখন বিকশিত হচ্ছিল (৬০০-১০০০ খ্রী) সময় কালে মাগধী প্রাকৃত অথবা মাগধী অপভ্রংশ থেকে তখন এই ভাষাতেই কথা বলা হত এই পাঁচ বাংলাতে( রাধা, বারেন্দ্র, বঙ্গ, চাত্তালা এবং সমতট) অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে, উত্তর মধ্য বঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ, দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গ এবং ব-দ্বীপ ( ডেলটা) ) -যার সাথে কামরূপ ও পশ্চিম
আসাম কে যোগ করা উচিত। ( প্রামাণ্য না থাকার জন্য প্রমাণ করা যায়নি।)

 

বাঙালি- সত্তার বিকাশ, সংস্কৃতজ মাগধী প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে বাঙালির নিজস্ব ভাষা মিলন।

(আট)

জৈন, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য মতবাদ কে অতীতের বাংলার আদি বাসিন্দারা গ্রহণ করেছিল এবং নিজেদের আচার আচরণ, জীবনযাত্রা, ধ্যান ধারণা তে পরিবর্তন এনেছিল। আর সংস্কৃতজ মাগধী প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলার নিজস্ব ভাষার মিশ্রণে
এক নতুন ভাষার জন্ম নিয়েছিল। এই প্রক্রিয়া
চলেছিল দীর্ঘদিন ধরে। উত্তর ভারতীয় মিশ্র আর্যদের সঙ্গে অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের মিশ্রণে যে জাতির উদ্ভব হয়েছিল তাদেরই বংশধর বর্তমান
বাঙালি। এই সংমিশ্রণে তাদের মধ্যে দেখা গেল
উন্নত মানের মানসিক পরিবর্তন।
আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন:
” এইরূপে অষ্ট্রিক, দ্রাবিড় ও উত্তর ভারতের মিশ্র
আর্য্য— এই তিন জাতির মিলিত বাঙ্গালী জাতির
জন্মনীড় হইল। রক্তে ও ভাষায় আদিম বাঙ্গালীদের মুখ্যত অনার্য্য ছিল। যেটুকু আর্য রক্ত বাঙ্গালী জাতির গঠনে আসিয়াছিল সেটুকু আবার উত্তর
ভারতেই অনার্য্যমিশ্র হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আর্য্য
ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সৃজ্যমান বাঙ্গালী জাতি একটা
নূতন মানসিক নীতি বা বিনয় পরিপাটি, যাহাকে,
ইংরেজিতে discipline বলে, তাহা পাইল;বাঙ্গালীর
অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রকৃতির উপরে আর্য্য মনের ছাপ
পড়িল। ইহা তাহার পক্ষে মঙ্গলের কারণই হইল।
আর্য্যমনের-ব্রাহ্মণ্যের এই ছাপটুকু, আদিম অপরিস্ফুট বাঙ্গালীকে একটা চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য দিল। ‘(বাঙ্গালীর সংস্কৃতি’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
আকাদেমি সংস্করণ পৃথিবীর ৭-৮, ১৯৯০)
খ্যাতনামা অধ্যাপক ড: প্রণব রায় তাঁর লেখা
বাংলার মন্দির:স্থাপত্য ও ভাস্কর্য গ্রন্থে লিখেছেন:-
” দীর্ঘকাল বাংলা ভাষার বিকাশের যে গতি রূদ্ধ
হয়ে গিয়েছিল, তার পুনরুজ্জীবন ও বিবর্তন হতে
থাকে। বড়ূচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হয়
(আ.খ্রি. পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ), চণ্ডীদাস ও
মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির পদাবলী এবং কৃত্তিবাসের রামায়ণ কাব্য( রচনা কাল খ্রি. আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ) জনমানসে এক বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
গৌড়ের এক সুলতান কবি কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। কাশীরাম দাসের মহাভারত ও রচিত হয় এর পরে। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে
সুলতান রুকন- উদ্দিন বারবক শাহের(১৪৫৫-১৪৭৪খ্রি.) আনুকূল্যে মালাধর বসু
‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’কাব্যরচনা ক’রে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি পান। বাঙালির মনে গভীর ধর্মভাব জাগ্রত
হয়। ‘লোকভাষা’ বাংলা এইভাবে সাহিত্যের উপযোগী হয়ে ওঠে। সংস্কৃত পুরাণের আদলে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীকে নিয়ে বহু মঙ্গলকাব্য
রচিত হয়। এই সময়ে মুসলমান সুফী, পীর, দরবেশ, আউলিয়াদের ধর্মের সঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালিদের তেমন কোন সংঘাত দেখা দেয়নি।
বরং, মুসলমানপীর ফকিরের অহিংস ভক্তিবাদে
বিশ্বাসী ছিলেন এবং স্থানীয় জনসাধারণের বিশ্বাস
ও ভক্তি তাঁরা অর্জন করেছিলেন। তুর্কী বিজয়ের
পর প্রথম দিকে যে সব মুসলমান সন্ত বাংলায়
ইসলামের ধ্বজা জোর ক’রে তুলে ধরতে সক্রিয়
ছিলেন জালালুদ্দিন তাব্রেজী, আলাওল হক, নূর
কুতুব উল আলম এবং যাঁদের পিছনে পরাক্রান্ত
রাজশক্তির বিরাট সমর্থন ছিল এবং তার ফলে
দলে দলে লোক মুসলমান হয়ে যায়, এখন সেই ধরণের প্রচারক ছিলেন না। পক্ষান্তরে, পীর]- সুফী
– দরবেশ-আউলিয়াদের্য়ৃ ধর্মের সঙ্গে একটা সমন্বয়
ঘটেছিল।

তথ্য ঋণ: ১) বাংলার মন্দির : স্থাপত্য ও ভাস্কর্য।
অধ্যাপক ড: প্রণব রায়।
২)The History of BengalBengal-1943
Dr. R.C Majumdar

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here