ওরফে সৌরীন সেন

0
50

 

পরিচিতিঃ জন্ম- ১৯৫২, হুগলী শহর শিক্ষাদীক্ষাঃ স্নাতক- কবি, স্নাতকোত্তর- ববি; গবেষণাপত্রঃ উত্তরবঙ্গ উপ-হিমালয়ের বনবস্তির আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা; প্রাক্তনী- বন্যপ্রাণ শাখা, বনবিভাগ (১৯৭৬-২০১২); জীববৈচিত্র্য-বাস্তুসংস্থান বিষয়ে গ্রন্থকার, জার্নাল-পর্যালোচক; দেশবিদেশে প্রকাশনা ১৪০। মুক্তির সন্ধানে সঙ্গীত চর্চা। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁরই একটি প্রবন্ধ।

জয়ন্ত কুমার মল্লিক-র প্রবন্ধ

 

ওরফে সৌরীন সেন

অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম ৬০-৭০ দশকের এক প্রথিতযশা রাজনৈতিক সাহিত্যিকের ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে লিখব কারণ ৭০-এর শেষ থেকে ৯০-র প্রথম অবধি সরকারী ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে অন্য দিনগুলো এঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে কেটেছে আমার। আমার থেকে ২০ বছরের বড়, তবু সম্পর্ক ছিল গভীর। দুঃখের কথা, বাজারে এঁর বইপত্র এখনো পাওয়া গেলেও, অন্তর্জাল তন্নতন্ন করে ঘেঁটে বা ডুবুরি নামিয়েও এঁর কোন ছবি, কে, কি বা কেমন তা জানা যাবে না। তাই মুখ পুস্তিকার বন্ধুদের অনুরোধে ও উৎসাহে আজকের এই লেখার অবতারণা। যেমন যেমন মনে পড়ছে তেমনই লিখলাম, হয়ত অনেক কিছু বাদ পড়ে গেল, তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি শাখা রাজনৈতিক উপন্যাস। মোটামুটি উনিশ শতকের কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্সে এই রাজনৈতিক উপন্যাসের সৃষ্টি হয়। বিশ্বে রাজনীতিসম্পৃক্ত সাহিত্যিকদের মধ্যে প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে রুশো-ব্লেক-মার্ক্স-সার্ত্রে-অরওয়েল-চমস্কি হয়েমারিও ভার্গাস য়োসা-অ্যাঞ্জেলা ডেভিস-মায়া অ্যাঞ্জেলো-মার্গারিট অ্যাটউড অনেক নাম। বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস অত্যাধুনিক যুগের অন্যতম প্রতিফলন। কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে এই ধরণের উপন্যাস রচিত হয়। বাংলায় এইসব উপন্যাসের এক অন্যতম রূপকার সৌরীন সেন, যদিও তাঁর আসল পদবী ‘সেন’ নয়, না তাঁর নাম ‘সৌরীন’, ধাঁধাঁর সমাধানে প্রথম সূত্র তাঁর পিতৃদত্ত তিন অক্ষরের নামের শুরু কিন্তু সেই ‘স’ দিয়েই, শুধু ‘স’ দিয়ে নাম আন্দাজ করা মুসকিল, তাই দ্বিতীয় সূত্র দিলাম- নামের অর্থ ‘জল’। তৃতীয় সূত্র, তাঁর প্রদত্ত উপাধি “ভট্ট” গ্ৰামের “আচার্য”; চতুর্থ সূত্র- ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারে জন্ম। তবে সে জমিদারী এখন আর নেই, দখল হয়ে গেছে, কোর্ট কাছারি করেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। পঞ্চম সূত্র- সৌরীন সেনের আসল নামের পরে পারিবারিক মধ্য নাম ‘বিহারী’ কথাটা আছে, যেমন অটল বিহারী। ভাবতে শুরু করুন এখন থেকেই, বিশেষ করে বনবিভাগের বন্ধুরা, যদি মনে পড়ে যায়, নাম বা কোন স্মৃতি; পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।
যতদূর মনে পড়ছে, সৌরীন সেনের জন্মদিন ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯ (না, অ্যাক্সেস থাকলেও আমি তাঁর সার্ভিস বুক চেক করে দেখিনি, সেটা গর্হিত কাজ হত!)। সেই সৌরীন সেন, আমাদের যৌবন কালের অর্থাৎ ৬০-৭০-এর দশকের খ্যাতনামা সাহিত্যিক, শুধু সাহিত্যিক বললে ভুল হবে, নতুন ধারার রাজনৈতিক ঔপন্যাসিক বা রাজনীতিচিন্তক সাহিত্যিক বা কারো কাছে থ্রিলার লেখক হিসেবেও যাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল, যাঁর পাখির চোখ ছিল তৃতীয় বিশ্ব, ১৯৫০-এর দশকে যার অভ্যুদয় আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ওশেনিয়া এবং এশিয়ায় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে। পঞ্চাশ – ষাটের দশকে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও সরকার বিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামের বহু ঘটনা নিয়ে এক কল্পনাশ্রয়ী সাংবাদিকের ভূমিকায় দুরন্ত, গতিশীল সব উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি। তাঁর নিখুঁত পরিবেশন কৌশল ও কৌতূহল উদ্দীপক বৈশিষ্ট্য পাঠককে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বেঁধে রাখত। সেই সময়ে তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাসগুলো হটকেকের মত বিক্রি হত। নতুন তথ্য, অজানা দেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যপার, রাজনীতির দারুণ ঘোরপ্যাঁচ সব কিছুই তখন রীতিমত রোমাঞ্চকর ছিল। সৌরীন সেনের লেখার প্রাসঙ্গিকতা ও বিশেষ পাঠকবর্গের মধ্যে জনপ্রিয়তা এত বছর পরে কিছুটা হলেও অমলিন আছে বলে আমার মনে হয়। ছাত্রজীবনে হুগলী জেলা গ্রন্থাগারে তাঁর লেখা বেশির ভাগ বই রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম, ফলে পরবর্তীকালে আসল সৃষ্টিশীল মানুষটাকে দীর্ঘ দিন সামনে থেকে দেখে বা তাঁর সংগে মিশে গভীরভাবে চিনতে কোন অসুবিধে হয় নি। যদিও তাঁর অনেক বই চতুর্থ সংস্করণ অবধি হয়েছে, আর অন্য প্রকাশন সংস্থাও নতুন করে সেসব বই ছাপাচ্ছে, তাঁর জীবনী কোথাও মেলে না কারণ তখনকার দিনে বইয়ের প্রচ্ছদে লেখকের জীবনী স্থান পেত না, আর তিনি নিজেও এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না; সেই দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রচারবিমুখ। সোজাসাপ্টা কথা বলতেন, যাকে বলে ঠোঁটকাটা, কোন কথা মুখে আটকাত না। কিন্তু হড়বড় করে বকে যাওয়া নয়, ধীরে ধীরে প্রতিটি অক্ষরে জোর দিয়ে কথা বলতেন, অল্প অনুনাসিক টোনে এমন একটা সম্ভ্রান্ত ভাব ছিল, যা উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। তবে একটা অভ্যাসের কথা না বললেই নয়, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে শরীর, এমনকি মনের ভেতরটাও যেন স্ক্যান করে দেখে নিতেন, আর তাইতো এত দারুণ বিশ্লেষণ করতে পারতেন, হয়ত তাতে জিনের বা উত্তরাধিকারের ব্যাপারটাও ছিল। এই কারণেই মনে হল তাঁর কথা বলা দরকার এবং মননশীল মানুষের তা জানার দরকার আছে। কিছুকাল বাদে আমিও হয়ত থাকবো না, তাহলে তো মানুষটা অজানাই থেকে যাবেন। “For heaven’s sake, he does not deserve this, particularly when he is no more!” এমনকি দীর্ঘ বাম জমানাতেও তাঁর সঠিক মূল্যায়ণ করা হয় নি। এই লেখা তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ। আমার অনুরোধ আপনারা সকলে তাঁকে প্রণাম জানান।
নিয়ম মোতাবেক কোন সরকারী কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবে বই বা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে গেলে তাঁকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হয়, আমাকেও নিতে হয়েছিল Handbook of the Mammals of South Asia প্রকাশের পূর্বে। বাস্তবিক লেখক অনেক বই লিখেছিলেন এবং তাঁর কাহিনীগুলো বিতর্কিত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল। তাই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে গেলে হয়ত অনেক সময় লেগে যেত এবং সেই আমলে এই ধরণের রচনা সরকারের অনুমতি পেতই তার কোন নিশ্চয়তাও ছিল না। ফলে লেখক ছদ্মনামেই পরিচিত হয়ে রইলেন এবং তাঁর আসল ব্যক্তি পরিচিতি রয়ে গেল অন্ধকারে। তাই বিংশ শতাব্দীর পাদপ্রদীপের আলো থেকে একবিংশ শতাব্দীর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেলেন আমার অসম বয়সী প্রিয় সখা।
এবার আসি লেখকের কুল পরিচয়ে। পিতা ছিলেন আদর্শবান, সংস্কৃতি মনস্ক; নাম ছিল ক্ষীরোদ বিহারী (ক্ষীরোদ চন্দ্র নয়), প্রথম দিকে অধুনা বাংলাদেশের সুরাজ মোহিনী ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক ছিলেন; মা সুবর্ণপ্রভা, বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের বোন। তাঁদের পাঁচটি(!) সন্তান। ঠাকুরদা ছিলেন দাপুটে জমিদার, নাম রাস বিহারী, সাকিন খানখানাপুর গ্রাম (ফরিদপুর), বর্তমানে জেলা রাজবাড়ী। জমিদারিতে অবশ্য খুব বেশি উৎসাহ ছিল না সাধাসিধে ক্ষীরোদ বিহারীর। তাই দেশ ভাগের অনেক আগেই ক্ষিরোদবিহারী চলে এসেছিলেন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অধুনা উত্তর ২৪-পরগণা জেলার বসিরহাটের এক ছোট গ্রাম আড়বেলিয়ায়, তারপর এই গ্রামেরই স্কুলশিক্ষক হয়েছিলেন।
পিতার সঙ্গীতপ্রীতি ও সাহিত্যচর্চার মানসিকতা গভীরভাবে সঞ্চারিত হয় সন্তানদের মধ্যে। বাড়িতে শেক্সপিয়ারের চর্চা ছিলো, এমনকি ঘরোয়া অভিনয়ও হতো। বাবা, মা, ভাই, বোনেরা অংশ নিতেন অভিনয়ে। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত সন্তান তাই আনন্দধারা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘বলিভিয়া’ বইটি তাঁকেই উৎসর্গ করেন। তিনি বিপ্লবী চে গুয়েভারা সম্পর্কে অনেক কথাই তুলে ধরেছেন তাঁর বইতে। চে একজন অকল্পনীয় যোদ্ধা ও অতুলনীয় নেতা। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসাধারণ পুরুষ। অচিন্তনীয় সাহস, প্রথমেই আঘাত হানার দুর্দমনীয় চরিত্র। ভয়ের প্রতি তাঁর চরম ঘৃণা। শ্ত্রুপক্ষ মনে করে চের মৃত্যু থেকে কতকগুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। যুদ্ধবিদ্যায় চে ছিলেন অতিশয় দক্ষ। তিনি গেরিলা রণনীতির একজন সুনীতিসম্পন্ন শিল্পী। অসংখ্যবার তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন। বিশেষ করে দুবার তিনি অসাধারণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। একবার তিনি যখন সেনাদল নিয়ে সম্পূর্ণ অজানা জায়গায় মুক্ত সমতলভূমিতে শ্ত্রুপক্ষের হাজারো সেনাকে আক্রমণ করেছেন। গেরিলা দলের অন্যতম যোদ্ধা ক্যামিলো তাঁর সঙ্গে ছিলেন। লা-ভিলা প্রদেশে বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে সান্তাক্লারা শহরের দুঃসাহসিক আক্রমণ। বড় জোর তিনশ লোক সংগে- সেখানে শ্ত্রুপক্ষ ট্যাংক, গোলন্দাজ বাহিনী ও পদাতিক সেনাদল নিয়ে প্রস্তুত। পরিচালকের মৃত্যু হতে পারে বিশেষ করে তিনি নিজে যখন ভয়াবহ বিপ্লবী সংগ্রামের সুনীতিসম্পন্ন রূপকার। কিন্তু তাঁর বিপ্লবী শিল্পসৃষ্টির মৃত্যু নেই, যার জন্য তিনি প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যে শিল্পে তিনি তাঁর সমস্ত বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করেছেন।
লেখকের দাদা ছিলেন প্রথমে স্বদেশী, তারপর আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক, পরে বাংলা নবনাট্য – আন্দোলনের পুরোধা – ব্যক্তিত্ব, সু – নাট্যকার এবং সু – অভিনেতা, ভাই বয়সে দাদার থেকে প্রায় ১২ বছরের ছোট হলেও দাদার স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ থেকে কমিউনিষ্ট দলের ফুলটাইমার বা গণনাট্য সংঘের কর্মী হওয়া কিছুটা নিশ্চয়ই ভাইকেও প্রভাবিত করেছিল। দাদার এক পুত্র (সেও নামকরা সাহিত্যিক), ভায়েরও একটি পুত্রসন্তান; তবে দাদার স্ত্রী নামী সাহিত্যিক হলেও, ভাইয়ের স্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত হবার জন্য তাঁরা থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার কেন্দ্রীয় আবাসনে।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর কলমে (জানুয়ারী ১৩, ২০২২) উঠে এসেছে মহাকরণে তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা, “…রাইটার্সের লাইব্রেরি। …দুর্লভ সব বই, গেজিটিয়ারের পাশাপাশি বাংলা ইংরাজি বইয়ের সমারোহ। জনশ্রুতি ছিল, সৌরীন সেন ঐ লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনো করেই ‘ভিয়েতনাম’, ‘আখের স্বাদ নোনতা’র মতো বই লিখেছিলেন”। খুব একটা ভুল লেখেননি লেখিকা; এক দশকের বেশি সময় লেখক কাটিয়েছেন মহাকরণে, প্রথমে থার্ড ফ্লোরে, তারপর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল বনাধিকরণ। ফলে অনেক বছর সময় পেয়েছেন তিনি এখান থেকে লেখার রসদ আহরণ করতে, যখন টানা তাঁর বইগুলো প্রকাশ পাচ্ছিল বছর খানেক অন্তর। পরে আমিও এই গ্রন্থাগারে গেছি পড়াশুনো করতে বা আমাদের গেজেট নোটিফিকেশনের কপি জোগাড় করতে, কিন্তু তখন খুব গোছালো ছিল না এখানকার ব্যবস্থা। থাক সেসব কথা। সৌরীন সেন তাঁর একটি বইতে লেখার উৎস সম্পর্কে লিখেছেন। ‘তপ্ত লোহা, উষ্ণ রক্ত’ বইটির পটভূমি ছিল চেকোস্লোভাকিয়া। শারদীয়া ‘সত্যযুগ’-এ লেখাটি ‘আমরণ’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটিতে লেখক বলেছেনঃ “প্রামাণ্য দলিল ঘাঁটতে গিয়ে হাতে যা পেয়েছি-দেখেছি। ডগলাস রীডের লেখা থেকে শেলেনবার্গের মেময়ার্স। Document on the Resistance Movement of the Czechoslovak People, 1938-1945 থেকে শীরার আর হাল আমলের পেপারব্যাক। রক্ত মাংসের চরিত্রগুলোকে নাড়তে চাড়তে এ্যালেন, বার্জেস-এর সংগ্রহ আমার পুস্তকের অন্যতম প্রত্যঙ্গ”।
এবার সৌরীন সেনের একটি খুবই জনপ্রিয় লেখার প্রসঙ্গে আসি। কুবার সংগে কলকাতার যোগাযোগ ৬০-এর দশকের গোড়ায় যখন চে গুয়েভারা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে দারুণ এক ভাষণ দিয়েছিলেন, জানি না লেখক এর থেকেই বইটি লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা! যাই হোক, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘আখের স্বাদ নোনতা’ (Sugarcane is salty), কিউবার ওপর লেখা। বইটি ২৬শে জুলাই মনকাডা দূর্গে নিহত বিপ্লবী যোদ্ধাদের স্মরণে উৎসর্গ করেছিলেন লেখক কারণ মনকাডা ছিল কিউবা বিপ্লবের সূতিকাগার। বিপ্লবী প্রতিরোধী সংগ্রামের বার্তা নিয়েই একদল তরুণ বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে ওরিয়েন্টি প্রদেশের সান্টিয়াগো শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত কিউবার দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক দুর্গ মনকাডা আক্রমণ করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই। দূর্গ দখল করা খুব সহজ কাজ ছিল না কারণ সেই সময়ের সবচাইতে উন্নত সামরিক অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত ছিল আমেরিকার আশীর্বাদপুষ্ট বাতিস্তার সেনাবাহিনী। ২০০ তরুণ যুবার এই বাহিনীর বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও অপরিসীম দেশপ্রেম, অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি, অসীম জেদ আর অকল্পনীয় প্রতিরোধের নজিরে সময়ের ঘড়ি বেজে উঠেছিল বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে। তাই বিপ্লব উত্তর কিউবায় ২৬শে জুলাই পালিত হয় জাতীয় বিদ্রোহ দিবস হিসাবে।
“প্রকৃত ঘটনা ও চেনা মানুষের সাথে কিছু কল্পনা ও অচেনা চরিত্রকে সঙ্গে নিয়েছি কাহিনী সাজাতে।“- বইটিতে লেখকের অকপট স্বীকারোক্তি। মৈত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তিনটি সংস্করণ ১৩৭২, ১৩৭৪, ১৩৭৬ (২,২০০ X ৩= ৬,৬০০টি কপি ছাপা হয়েছিল; পাঁচ বছরে সব শেষ)। অনেকেরই আবার প্রথম সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে লড়াকু চে গুয়েভারা বা ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় ‘আখের স্বাদ নোনতা পড়ে-
‘মানচিত্রের কিউবা যেন ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ওলটানো একটা হাঙ্গর- ফ্লোরিডাতটে লেজের ঝাপটা মারছে। এই ছোট দেশ আজ গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বিদেশী রিপোর্টার হাভানায় নামছে ঝাঁকে ঝাঁকে। টেলিপ্রিন্টারে খবর ছোটে অবিশ্রান্ত- ফ্ল্যাশ-ফ্ল্যাশ-ফ্ল্যাশ। একদিকে মিলিয়ন ডলার, ক্যাডিলাক, টুইস্ট আর জ্যাজ, – অর্ধউলঙ্গ সুন্দরী নর্তকীর আকর্ষণীয় ফ্লোর শো, ক্যাবারের টেবিলে টেবিলে দলিত দ্রাক্ষার প্রবাহ। …অন্য দিকে আসে বিপ্লব…. তাজা তাজা যৌবনের শাণিত স্রোতে রচিত হয় বিপ্লবী কিউবা। সহস্র কন্ঠে ধ্বনিত হয়, – ফিদেল কাস্ত্রো জিন্দাবাদ। তবু নয়া কিউবাতে শান্তি নামেনি আজ। প্রতিবিপ্লবে জাল বিস্তার করে দেশ-বিদেশের ভয়াবহ গুপ্তচর। কৌতুহল, উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে পাতায় পাতায় রটনা ঘটে চলে। বিপজ্জনক রাজনৈতিক পুতুলখেলার যেন শেষ নেই।..’
অনুপ্রাণিত হয়ে কবি শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এক কবিতা লিখে ফেললেন-
“যখন আখের স্বাদ নোনতা লাগে
লবঙ্গ বনে ঝড়ের হাওয়ারা জাগে…”।
সিগার বা চুরুট মুখে ওই দাড়িওয়ালা মানুষটি তখন ছাত্রদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। পড়েছিলাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কবিতা ‘চুরুট’-
“প্রবন্ধ লেখার আগে জ্বালিয়ে নিতে হয় চুরুট, কথা বলার আগে
এবং কথা শেষ হওয়ার পর ধরিয়ে নিতে হয় চুরুট,
রাতের পর রাত
যখন ঘুম হয় না, তার নিষ্পলক চোখের সামনে
জ্বলতে থাকে চুরুট। তারপর একদিন সত্যিই ঘুম আসে
আর চুরুট খ’সে পড়ে মাটিতে, এমনই-এক সুযোগের অপেক্ষায়
বছরের পর বছর কেটে গেছে চুরুটের।”
ক্ষুরধারবুদ্ধি শার্লক হোমস ও স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল দু’জনেরি প্রিয় ছিলো পাইপ বা সিগার। আমি আবার এই চুরুট খাওয়া শিখেছিলাম দাদার কাছ থেকে, তিনি তাঁর স্টক থেকে দিয়েছিলেন আমাকে, জানি না তাঁর এই অভ্যাসটি কি করে হয়েছিল, হতে পারে সেই দাড়িওয়ালা মানুষটি ছিলেন প্রেক্ষাপটে। শুধু তাই নয়, আলগা তামাক পাতার পাউচ কিনে ঠোঁটের কোণে পাইপ ঝুলিয়ে রেখে খাওয়ার ভংগীটাও নকল করেছিলাম দাদার কাছ থেকে, একটা চমৎকার বাঁকানো মোষের শিঙের পাইপও জোগাড় করে ফেলেছিলাম; বুদ্ধির গোড়াতে ধোঁয়া দিতে বেশ কার্যকরী ছিল এদুটো। তখন অবশ্য নিষিদ্ধ তামাকু সেবনের ‘statutory warning’ জারী ছিল না।
সৌরীন সেনকে তো আমরা তাঁর লেখার বাইরে খুব বেশি পাই না। তাঁর জীবন সম্বন্ধে জানার অবকাশও খুব কমই আছে। জানার সে প্রচেষ্টা কিছুই হয়নি এ পর্যন্ত, সহকর্মীরা কিছু জানতেন বটে, কিন্তু তা একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে জানার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। বনবিভাগ তাঁর লেখায় এসেছে কয়েকবার, যেমন আর্টিয়্যান্ড লেটার্স পাবলিশার্স থেকে ১৩৬৬ (১৯৫৯) সালে প্রকাশিত ‘চেনামুখ’ বইটির শুরুতেইঃ “নাম কে.পি. আয়েংগার। ইম্পীরিয়াল ফরেষ্ট সার্ভিস* (*১৮৬৭ সালে তৈরি হয়েছিল এবং ১৯৬৬ সালে নাম পালটে ভারতীয় ফরেষ্ট সার্ভিসে পরিণত হয়; তাই লেখক সঠিকভাবেই সার্ভিসের নামটা লিখেছিলেন)। ফুড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশানের নিমন্ত্রণে ‘সিলভিকালচারাল স্টাডি টুরে’ গিয়েছিলেন রোমে। এখন দিল্লী হয়ে কাজের তাগিদে চলেছেন কোলকাতায়।” বনবিভাগে এই ধরণের টুর সরকারী বদান্যতায় প্রায় হয়ে থাকে, সেরকম কোন ঘটনার কথাই এখানে বলা হয়েছে।
অন্য কোন খানে উপন্যাসটি ১৩৬৬ (১৯৫৯) সালে রাইটার্স সিন্ডিকেট থেকে প্রকাশিত হয়। লেখকের বাড়ির ঠিকানা তখন ছিল- ২৯/১ পন্ডিতিয়া রোড, রাসবিহারী অ্য়াভেনিউ, ডোভার টেরেস, বালিগঞ্জ, কলকাতা – ২৯। ‘নিষিদ্ধ দেশের ঘুম ভাঙছে’ তিব্বতের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে এক রোমাঞ্চকর উপন্যাস। তিব্বতের ওপর এমন কাহিনীভিত্তিক লেখা তৎকালে বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ও ভিন্নরকম বিরল রচনা। বইটির প্রথম প্রকাশ ছিল ১৯৬১ সালে।
লেখকের আর একটি সফল রচনার কেন্দ্রবিন্দু গহন জঙ্গলাকীর্ণ কঙ্গো। মধ্য আফ্রিকার এই দেশ উপনিবেশীয় মালিকদের অত্যাচার ও লুণ্ঠনে বিধ্বস্ত। স্বাধীনতা লাভের পরও কুটিল কায়েমি স্বার্থের দৃষ্টি এড়ায়নি। প্যাট্রিস লুমুম্বা (Patrice Lumumba) এক উদীয়মান ও প্রগতিশীল নেতা। এই স্বার্থান্বেষী অশুভ শক্তির চক্রান্তে তাঁর মৃত্যু হয়। আফ্রিকার এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঘটনাবলি কঙ্গো থেকে ফেরা উপন্যাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। লেখাটি সাপ্তাহিক ‘দর্পণ’-এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। তারপর নবভারতী থেকে প্রথম প্রকাশ ১৩৭৩ (১৯৬৬), আর ১৩৭৫ সালের মধ্যেই চতুর্থ সংস্করণ বেরিয়ে গিছল। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন শ্রী কনক লাল লাহিড়ীকে। বনবিভাগের পুরোনো লোক ছাড়া বেশির ভাগ পাঠকেরই হয়ত অজানা তাঁর আসল পরিচয়। বাস্তবে রাইটার্সে বনবিভাগে লেখক কর্মরত ছিলেন ৬০-এর দশকের আগে থেকেই। তবে শ্রী লাহিড়ী উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বন সংরক্ষকের দায়িত্ব সামলে ১১.০৫.১৯৬০ থেকে ২৮.১২.১৯৭২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বন সংরক্ষক (Conservator General of Forest) ছিলেন, তারপরে তিনি দিল্লী চলে যান এবং ১৯৭৩-৭৪ সাল তিনি ভারতের Inspector General of Forests ছিলেন।


সৌরীন সেনের অন্য উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে ছিল ‘তেতো কফি’, আনন্দধারা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ ১৩৭৭ (১৯৭০)। ল্যাটিন আমেরিকার গণ আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের এক তথ্যবহুল উল্লেখযোগ্য রচনা। ‘ভিয়েতনাম’, প্রথম মুদ্রণ, ১৯৬০, উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে শ্রীজীব গোস্বামী (বাসুদেব দাশগুপ্ত)-এর লেখা ‘মৃত্যুহীন ভিয়েতনাম’ নাটকটি অভিনয় করতো কৃষ্টিসংসদ। জ্বালা বইটি ১৩৭৫ সালে প্রকাশিত ক্যালকাটা পাবলিশার্স থেকে। কান্না-ঘাম-রক্ত রূপরেখা থেকে মার্চ, ১৯৭০-এ প্রথম প্রকাশিত, আর দ্বিতীয় সংস্করণ, একই বছরে মে মাসে, ভাবা যায়। আর ছিল মুসোলিনী ও মুক্তিফৌজ, আনন্দধারা প্রকাশন, ১৩৭৫, তালাশ, অপারেশন হাইতি, চিলি, অপরিচিতা এবং…, দিল্লীতে এসেই, রেনীগ্রেড, ইত্যাদি।
সৌরীন সেনের আসল নাম ছিল সলিল বিহারী ভট্টাচার্য, সরকারী চাকুরে ও লেখক। অন্যদিকে গণনাট্য আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ৰিজন ভট্টাচার্য ছিলেন লেখকের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। অবশ্য দুই ভাইয়ের চিন্তার অলিন্দে স্থান-কাল-পাত্রের ভিন্নতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
বস্তুতঃ ৭০-এর দশকে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মহাকরণ থেকে বনদপ্তর স্থানান্তরীত হয় বেকবাগানে, সলিলদাও ওই সময় চলে যান আলিপুরের আঞ্চলিক অফিসে কারণ ওখান থেকে তাঁর বাড়িটা কাছে ছিল। তারপর বনদপ্তর ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেসের নিউ সি.আই.টি বিল্ডিং-এ চলে আসে, প্রধান পদটির নাম হয় Chief Conservator of Forests (পূনর্মূল্যায়ণের পর একবিংশ শতাব্দীতে এই পদের নাম পালটে হয় Principal Chief Conservator of Forests), পদে আসীন হন শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী। এই সময়েই আমি এখানে কাজে যোগদান করি।
কদিন আগে গোপালদা (দে), আমাদের সংখ্যাতত্ত্ববিদ, ফোন করেছিলেন; বিকাশ ভবনে আসার আগে বছর পনের এক সংগে কাজ করেছি, জ্বালিয়ে খেয়েছি রোজ দুপুরবেলা কারণ আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল ওঁর, আর আমার কাজ ছিল টিফিনের সময় কাঠের সিঁড়িতে চেপে ধূলিধূসরিত প্রাচীন বইপত্র ঘেঁটে গবেষণা পত্রের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা। ফিরে আসি আসল কথায়। ১৯৬৩ সাল, গোপালদা নিয়োগপত্র পেয়ে খুশি খুশি মহাকরণের বনদপ্তরে গেলেন, দু’টো গোটা দিন অফিস-বাড়ি করে কাটিয়ে দিলেন। গোটা পঁচিশেক কর্মীর ছোট্ট অফিস ছিল তখন। প্রধান বন সংরক্ষকের সহকারী ছিলেন শ্রী অজিত কুমার ব্যানার্জী, যাঁকে সবাই আরাবারিতে যৌথ বন ব্যবস্থাপনার হোতা বলে জানেন। অফিস পরিচালনা করতেন দোর্দন্ডপ্রতাপ বড়বাবু (তখন লামাবাবু), সাধারণ কর্মচারীদের বড় কর্তার ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না; সন্ধ্যে হয়ে গেলেও বড়বাবু না বললে কারোর বাড়ি যাবার উপায় ছিল না। এবার আসল ঘটনাটা বলি। তৃতীয় দিন গোপালদা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এক্কেবারে বড়বাবুর মুখোমুখি, থমথমে মুখ, বললেন ‘এস আমার সংগে।‘ কাঁচুমাচু গোপালদা তাঁর টেবিলের সামনে গেলে গোপালদাকে বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘নতুন?’ জবাব, ‘হ্যাঁ’। পুনরায় প্রশ্নবাণ- ‘হাজিরা খাতায় সই করেছ?’ ফটাফট জবাব, ‘খাতা দেখেছি, আমার নাম নেই!’ বড়বাবুর রক্তচাপ ও চীৎকার ক্রমশঃ বাড়ছে। ‘জয়েনিং রিপোর্ট দিয়েছ?’ সেটা আবার কি! বছর কুড়ি বয়সের অনভিজ্ঞ গোপালদা আকাশ থেকে পড়লেন! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। হাঁড়ি এবার ফাটল- “এটা কি মামার বাড়ি; কাউকে কিছু বলা কওয়া নেই, অফিসে আসছ আর বাড়ি চলে যাচ্ছ। ভেবেছ কি?“ চেঁচামেচি শুনে ততক্ষণে অন্য স্টাফেরা উঠে চলে এসেছে, তার মধ্যে লেখকও ছিলেন। পরিস্থিতি ক্রমশই গুরুতর হয়ে উঠছে! দাদা বুঝতে পারলেন এবার ছেলেটার নতুন চাকরিটা আর করা হল না বোধহয় [আমার ফুটকাটাঃ শুনেছি কোন এক মহিলা কর্মী অফিস টাইমে উল্টোরথ (তখন খুব জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে মহিলাদের কাছে, আমার মাও পড়ত দেখেছি উল্টোরথ, প্রসাদ, নবকল্লোল) পড়ার অপরাধে কাজ হারিয়েছিলেন]। এবার দাদা বিপদ বুঝে আর থাকতে পারলেন না, ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন; খুব কইয়ে-বইয়ে ছিলেন, কথায় সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে পারতেন, তা সে যতই দাপুটে বড়বাবু হোক না কেন। তিনি বড়বাবুকে বললেন, ‘বাচ্চা ছেলে, বুঝতে পারেনি, তাই ভুল করে ফেলেছে। আমি ব্যাপারটা দেখছি।“ এই না বলে গোপালদার হাতটা ধরে হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন নিজের টেবিলের পাশে। তারপর গোপালদার কাছে পুরো ব্যাপারটা জেনে টাইপিস্ট ঊষা চৌধুরীর কাছ থেকে একটা সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে গোপালদাকে দিলেন, লেখা হল চাকরির ‘জয়েনিং রিপোর্ট’। ‘যাও, বড়বাবুর হাতে দিয়ে এস।‘ লামাবাবুর হাতে চিঠি জমা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন গোপালদা। এইভাবে দাদা গোপালদার চাকরি বাঁচিয়েছিলেন। এবার আপনারা বুঝতে পারলেন ধান ভাংতে শিবের গীত কেন গাইলাম, মানুষটা কেমন তা বোঝানোর জন্য। সলিলদা এরকমই ছিলেন, সব বয়সী, সব স্তরের কর্মীদের সংগে সমান হাসিখুশি ব্যবহার, মুচকি মুচকি হাসি, রসের হাঁড়ি একেবারে। পাবলিক ভেহিকেলে যাতায়াত করতেন। মাঝারি উচ্চতা, ভারী চেহারা, মাথায় হাফ টাক, হাফ শার্ট ও প্যান্টেই বেশি অভ্যস্ত, আর শীতকালে তার ওপর একটা হাফ জ্যাকেট এবং কাঁধে অতি অবিশ্যি একটা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, চওড়া হওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় সব জিনিস অনায়াসেই ঢুকিয়ে নেওয়া যায়, সেই ব্যাগটির মধ্যে পাওয়া যেত রোজকার টাইমস খবরের কাগজ, ইংরাজী পত্রিকা ও রেফারেন্স বই; এইগুলোই তাঁকে রাতে লেখার রসদ যোগাত। পরিবেশন ক্ষমতা এত ভালো ছিল যে তাঁর বই শেষ না করে থামা যেত না। তবে আমি কোনদিন ওঁকে অফিসে লেখা মক্স করতে দেখিনি। কেউ বলতে পারবেন না যে উনি অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে উপন্যাস লিখেছেন।
আবার বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে; সলিলদা বদলি হয়ে এই নিউ সি.আই.টি বিল্ডিং-এ, যোগ দিলেন বন্যপ্রাণ শাখায় অর্থাৎ আমাদের অফিসে। ভাগ্যিস এলেন, তাই তো চেনাজানা হল, ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, ওঁর সম্পর্কে লিখতে পারলাম। আবার কয়েক বছর পরে ওঁর পদোন্নতি হল, কিন্তু না, রয়ে গেলেন এই বন্যপ্রাণ শাখাতেই। কালের গতিতে পুনরায় উচ্চ পদে আসীন হলেন, এবার চলে গেলেন তাঁর পুরোনো অফিসে, আলিপুরের সেন্ট্রাল সার্কেলে; ওখান থেকেই অবসর গ্রহণ। তখনতো মোবাইল ছিল না, ফলে সলিলদার সংগে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গেল।
মনে পড়ে ১৯৯০ সালে ডিডি বাংলায় প্রাইম স্লটে দেশ আমার দেশ বলে একটি পাঁচ এপিসোডের সিরিয়াল হয়েছিল, পরিচালক ছিলেন রাজা সেন। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এর নেপথ্যে ছিলেন সলিলদা। অনেক আগে থেকেই পান্ডুলিপির স্তরে আমাদের মধ্যে রোজ এই ব্যাপারে গঠনমূলক আলোচনা হত, কি করে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় এই সিরিয়ালটাকে। এরপর কথা হয় এটিকে জাতীয় স্তরে পরিবেশনার প্রস্তাব পাঠানো হবে। সলিলদা আমাকে স্ক্রীপ্টের ইংরাজী ভারশান তৈরি করার ভার দেন। আমি বানিয়েও দি, উনি সেটা দিল্লীতে পাঠিয়ে দেন। তারপর আর সেটার কি ভবিষ্যৎ হল তা জানতে পারিনি। কারণ ৯০-এর শুরুতেই বন্যপ্রাণ শাখা স্থানান্তরিত হল বিকাশ ভবনে। তখন আমার আর এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, বেহালার শম্ভু মুখার্জী, আলিপুরের অফিসে ছিলেন, তাঁর মাধ্যমেই মাঝেমাঝে দাদার খবরা-খবর পেতাম, আর একটা ক্যাজুয়াল যোগসূত্র অবশ্য ছিল, বেণু (মার নাম মণিকা), সলিলদার ভাগনে, প্রায়ই আসত বন্যপ্রাণ দপ্তরে, আমার চেম্বারে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করতাম- “মামা কেমন আছেন?” খবর পেয়ে আশ্বস্ত হতাম। অবশ্য এই ভাগ্নেকে আপনারা সবাই চেনেন- অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী হিসেবে। তারপর আমিও অবসর নিলাম ২০১২ সালে, আর দাদাও চির বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ২০১৪ সালে ৮৫ বছর বয়সে। দাদার আর এক প্রাক্তন সহকর্মী ড. অজিত ব্যানার্জীও এই বছরেই মারা যান। আর এই বছরটাই ছিল বনদপ্তরের ১৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। কি ট্রাজিক, তাই না!
সময়কে পিছনে ফেলে জীবন এগিয়ে যায়। কিন্তু সুখস্মৃতিগুলো এখনো টাটকা আছে। ভুলতে পারি না, ১৯৮৫ সালে আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেই দক্ষিণ কলকাতা থেকে পদধূলি দিয়েছিলেন আমার হুগলীর পৈত্রিক ভিটেতে, ৫৬ বছর বয়সেও ভরদুপুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে ভারী শরীর নিয়ে হাসিমুখে সিঁড়ি ভেঙ্গে তিন তলার ছাদে উঠেছিলেন। অবশ্য আপ্যায়ন ও পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করেছিল আমার সহকর্মীরাই। সলিলদা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here