ই ন্দ্র নী ল   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় -র লেখা দুটি গল্প

1
198
পরিচিতিঃ আকাশ নেরুদা, মনিপুর, স্থায়ী বাসিন্দা আসানসোল

 

ই ন্দ্র নী ল   ব ন্দ্যো পা ধ্যা য় -র লেখা দুটি গল্প

 

দৌড়
চিত্রঃ ২

 

কাঁঠাল গাছের নীচে ব্যাগটার দিকে চোখ গেল। পাউরুটি আর দুটো কলা সঙ্গে এক বোতল জল ছাড়া আর কিছুই নেই। তবুও ওটাই সম্বল। ব্যাগের উপরে ফুল প্যান্ট আর জামাটা গুটিয়ে রাখা। প্যান্টে সাতাশটা টাকা। ফেরার ভাড়া।

জিনিসগুলোর থেকে চোখ ঘোরালো মাঠের মাঝের গ্রুপের দিকে। একেকটা গ্রুপে পঞ্চাশজন। মোট কুড়িটা গ্রুপ। বিকট ভারী গলার আওয়াজে দাঁড়ানোর জায়গায় চোখ ফেরালো দেবজিত। ‘রাস্তা মে দৌড়না হ্যায়। এক চক্কর কাটকর ইয়াহ ফিনিশ হোগা।’
বেলা একটা বেজে গিয়েছে। এবার দৌড় শুরু হবে। হুইসেল বাজতেই সবাই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবে। দেবজিতের পায়ে সাদা কেটস। মোজাটা নাইলনের। ডানপায়ের মোজার বুড়ো আঙ্গুলটা মোজা থেকে বেরিয়ে জুতো ছুঁয়ে ফেলেছে। নীল শটস। গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। বুকে আর পিঠে  আলপিন দিয়ে কাগজ লাগানো। কাগজে চেস্ট নম্বর লেখা। একাত্তর নম্বর। সবার সাথে সামনের রাস্তার দিকে তাকালো দেবজিত। কুড়ি ফুটের চওড়া রাস্তায় একসাথে পঞ্চাশজন গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। সেকেন্ড ব্যাচের দৌড় শুরু হবে। প্রথম ব্যাচের পঞ্চাশ জন থেকে দুইজন সিলেক্ট হয়েছিল। মনে মনে রানিং স্ট্র্যাটেজি বানালো। এখানে আসা ওর দুইদিন হয়ে গিয়েছে। সকালে উঠে রানিং ট্র্যাক দেখে নিয়েছে। মোটের উপরে খুব জোর হলে দুই কিলোমিটার। এডমিট কার্ডে লেখা ছিল এক মাইল। সাড়ে ছয় মিনিটে দৌড়াতে হবে। পুরো রাস্তাটা এক মাইলের থেকে কিছুটা বেশি। বাড়তি সময়ের কথা কেউ জানায়নি। মাথার মধ্যে সারা রাস্তাকে এক মাইল ভেবেই দৌড়াতে হবে। সময় সাড়ে ছয় মিনিট।

রেডি, অন ইওর মার্ক, স্টেডি গো বলা শেষ হতেই হুইসেল বাজালেন একজন। একসাথে পঞ্চাশ জোড়া পা নড়ে উঠলো ক্ষিপ্র গতিতে। একজন আরেকজনকে ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার কোনো প্রতিযোগিতায় এর আগে দেবজিত অংশ নেয়নি। দৌড় শুরু হতেই মাঠে বসে থাকা সবাই চিত্কার করে উঠলো। কেউ কারো নাম ধরে সাবাসী দিচ্ছে। দেবজিতের নাম কেউ নেয়নি। ও একাই এসেছে।

একশো মিটার যেতে না যেতেই ভীড় ক্রমশঃ একটা লাইনে পরিণত হলো। মাথায় প্ল্যানিং করে রেখেছে দেবজিত। রাস্তাটা আগেও দেখেছে। প্রায় আটশো মিটার যাওয়ার পরেই একটা বাঁক। সেখান পর্যন্ত দম ধরে রাখতে হবে I বাঁ দিকে বাঁকটা নিতেই একটা চড়াই। ওখানে শক্তি লাগিয়ে দিতে হবে। চড়াই থেকে নিচে নিজে থেকেই নেমে যাওয়া যাবে। রাস্তাটা বেশ খানিকটা গিয়ে আবার বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে। সেখানে চড়াইটা অতটা উঁচু নয়। চড়াই থাকলেও প্রথমের চড়াইয়ের থেকে কম। রাস্তাটা একটা মন্দিরের সামনে থেকে আবার বাঁ দিকে বেঁকে গিয়েছে। প্রায় কয়েকশ মিটার যাওয়ার পরেই আবার বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটা ছোট চড়াই চড়লেই ফিনিশিং পয়েন্ট।

রাস্তার ম্যাপ মাথায় নিয়ে ততক্ষণে রাস্তার প্রথম বাঁকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে দেবজিত। শুরুতে প্রায় কুড়ি জনের পেছনে ছিল কিন্তু এখন প্রথম বাঁকের কাছে ও পাঁচ নম্বরে। সকালে দৌড়ানো অভ্যেস করেছে। কিন্তু এই দুপুরে পিচের রাস্তায় দৌড়াতে অসুবিধা হচ্ছে। হাওয়ার গতিকে ঠেলে এগোতে কষ্ট হচ্ছে। দম ফুলে গিয়েছে। মুখ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করেছে। পায়ের জুতোর শুকতোলা আর নাইলনের মোজার ঘর্ষণে পায়ের তালু তেতে গিয়েছে। ডানপায়ের বুড়ো আঙ্গুলে কেটসের সামনের চামড়ায় বারবার খোঁচা লাগছে। শরীরের ঝাঁকুনিতে গলার মাদুলি বারবার চিবুক ছুঁয়ে ফেলছে। পেন্ডুলামের মত মাদুলিটা দুলছে। চড়াই চড়তে গিয়ে সব শক্তিটুকু লাগিয়ে দিল। অতিরিক্ত শক্তি লাগাতে গিয়ে তল পেটের একদিকে টান পড়ল। সকালে তিনবার চা খেয়েছে। এক প্যাকেট পার্লে-জি বিস্কুটও খেয়েছে। তারপরে আর কিছুই খায়নি। সারাটা সকাল রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে I তবুও শেষ শক্তিটুকু লাগিয়ে দিল।

‘রাস্তায় দৌড়ানোর সময়ে ভাববি তুই নদীর স্রোতে ভাসছিস! ট্র্যাক ছাড়বি না! যতক্ষণ না পড়ে যাচ্ছিস ততক্ষণ পা আগের দিকে ফেলবি!’ উত্তমদার গাইড লাইন মাথায় আসলো। চড়াইটা পার করেই শরীরটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে একটু ঢিলে ছেড়ে দিল। হঠাৎ যেন গতিটা বেড়ে গেল। অতিরিক্ত গতিতে বাঁ পায়ের মাসলে টান পড়ল। এবার দৌড়াতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। চড়াই নামার সময়ে আগের চার জনের মধ্যে তিনজনকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সামনের ছেলেটা যেন হাওয়ার সাথে কথা বলছে। কালো বলিষ্ঠ চেহারা। ঘামে ওর মাংস পেশী চকচক করছে। মাথার মিশকালো চুলগুলো পায়ের তালে তালে দুলছে। এখানে আসার পরে সকালে ছেলেটাকে এই রাস্তাতেই সকালে রানিং প্র্যাকটিস করতে দেখেছে। দুর্দান্ত গতিতে দৌড়াতে দেখেছে। সেই ছেলেটাই সামনে। দূরত্ব কুড়ি মিটারের বেশি নয়। বাঁক নিল বাঁ দিকে। সামনের মন্দির পর্যন্ত এই দূরত্বটাকেই মেন্টেন করতে হবে। ওর পিছু ছাড়া যাবেনা।

পায়ের টান যেন বাড়তে শুরু করেছে। সামনেই আরও একটা বাঁক, কিন্তু এখন যেন মাটি পা দুটোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। কেটস ফেলার আওয়াজ বেড়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত পায়ের পুরোটা মাটিতে না ফেলেই দৌড়াচ্ছিল কিন্তু এখন আর পারছেনা। পুরো পা ফেলতেই কেটসের থপথপানি আওয়াজ হচ্ছে। গায়ে হাওয়াও লাগছেনা। রাস্তা জুড়ে একটা গুমোট ভাব। সামনের ছেলেটার চেস্ট নম্বর একানব্বই। দেবজিতের একাত্তর। ওর চেস্ট নম্বর মাঝে মাঝেই অস্পষ্ট হয়ে আসতেই ভেতর থেকে একটা আওয়াজ করে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে দেবজিত। কাছাকাছি পৌঁছে মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে ওকে শেষ পর্যন্ত আর টপকাতে পারবেনা। ঘাম গড়িয়ে চোখে ঢুকে জ্বালা ধরাচ্ছে। ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছে। বুক ফুলে গিয়েছে। নাক আর মুখ দুটো দিয়েই নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে। মাথার উপরে চড়চড়ে রোদ। হাতের পেশীগুলো ফুলে উঠেছে। জুতোর ভেতরে যেন পা শুকতলায় পিছলে যাচ্ছে। হীরামন বাবার মন্দিরের কাছাকাছি এসেই বাঁকের দিকে চোখ পড়ল। খুব জোর হলে আর পাঁচশো মিটার দূরেই ফিনিশিং পয়েন্ট। সামনের ছেলেটা অনেকটা কাছে চলে এসেছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই যখন বাঁ পায়ের মাসলে টান অনুভব করছে তখনই দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নড়ছে। হাতের সুইং আর সামনে পেছনে নেই। উপরের সূর্য যেন মাটিকে ছুঁতে চাইছে, মাটি আকাশকে। তপ্ত রাস্তা থেকে গরম ভাপ উপরের দিকে উঠে আসছে I চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।

হীরামন বাবার মন্দিরের সামনে এসেই সামনের চেস্ট নম্বর একানব্বইয়ের থেকে ওর দূরত্ব বেশ খানিকটা কমে গেল। ততক্ষণে কানে জুতোর শব্দ এলো I পেছনে কেউ কাছাকাছি চলে এসেছে।  কেউ কাউকে ছেড়ে দেবেনা। হাতের মুঠো শক্ত করে শরীর খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিল।  নুঁয়ে পড়া মাথা যেন ঘাড়ের কাছে শক্ত হয়ে আটকে গিয়েছে। কিছুতেই উপরে ওঠানো যায়না। সামনের জনকে টপকানোর থেকে পেছনের জনের এগিয়ে যাওয়ার আশংকা মাথায় চাগাড় দিল। আগের ব্যাচে দুইজনকে নিয়েছে। তৃতীয় হয়ে গেলে সব শেষ। সব শেষ না হলেও লড়াইয়ের সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সামনের জনকে টপকানোর চিন্তা ভুলে পেছনের জনকে এগোতে না দেওয়ার প্রতিযোগিতা যেন বেড়ে গেল। প্রাণপণে মাথাটা উপরের দিকে উঠিয়ে সামনের দিকে তাকালো। গতিটা খানিকটা বেড়ে গেল। এবার পেছনের জনের জুতোর আওয়াজের বদলে সামনের জনের জুতোর আওয়াজটা কানে এলো। ওর পায়ের গোড়ালি দেখা যাচ্ছে। ততক্ষণে শেষ বাঁকের মুখোমুখি। এইভাবে দৌড়াতে পারলেই সামনের বাঁকে পৌঁছে একটা স্প্রিন্ট দিতে হবে।

ওকে কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখে একানব্বই নম্বরের ছেলেটা মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে আরও শক্তিতে দৌড়াতে লাগলো। এবার দেবজিত আর দূরত্ব বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ দেবেনা। ওর পায়ের দিকে নজর রেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। বাঁকের কাছে প্রায় পাশাপাশি পৌঁছে গেল। সামনে ফিনিশিং পয়েন্টে স্কোরার দাঁড়িয়ে। মাঠের মধ্যে বসে থাকা ছেলেরা সবাই দাঁড়িয়ে চিত্কার করছে। কে কার জন্য চিত্কার করছে কেউ জানেনা। একানব্বই আর একাত্তর নম্বরের লড়াইয়ের শেষ দৃশ্য জমে উঠেছে I পঞ্চাশ মিটারের লড়াইয়ে কে প্রথম ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছাবে।

দুজনেই ফিনিশিং পয়েন্টের দিকে মাথা তুলে শেষ শক্তিটুকু ঢেলে দিয়েছে। যেন নদীর জোয়ারে ভাসতে ভাসতে পাড় ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টা। শরীরের ক্লান্তি আর ব্যথা হেরে যাওয়ার ঘূর্ণির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা I ফুসফুস ফুলে ফেঁপে বিশ্রাম চাইছে। পায়ের টান চরমে।

দেবজিতের সামনে শুধু একটা রেখা ছুঁয়ে ফেলার প্রত্যয় I গুমোট বাতাস যেন শাসাচ্ছে। সময় ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে কানে কানে কিছু একটা বলতে চাইছে। গলা জল চাইছে। মুখের ঘাম শুকিয়ে নুনের রেখা বানিয়ে ফেলেছে। চোখের ভেতরে মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের ঝলকানি। ঘামে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ের সাথে সেঁটে গিয়েছে। বুকে কাগজে লেখা চেস্ট নম্বর ন্যাতপ্যাতে হয়ে গিয়েছে। মনের ভেতরের সব শক্তিটুকু পায়ে নিয়ে এসে শেষবারের মত লম্বা পা ফেলল দেবজিত। সারা শরীরের শিথিল হয়ে যাওয়া মাংস পেশীকে শক্ত করে হাতের মুঠো খুলল। পায়ের পাতার উপরে ভর দিয়ে কয়েক পা ফেলতেই একটা বাড়তি গতিতে এগিয়ে গেল I এক পায়ের মত এগিয়ে গেল একানব্বই নম্বরের থেকে। এগিয়ে যেতেই শক্তি যেন বেড়ে গেল। এক ঝলক হাওয়া ওর শরীরে লাগতেই একটা শিহরণ জাগিয়ে তুললো। জিতে যাওয়ার স্বাদের গন্ধ নাকে আসলো। এই গন্ধ বড় তীব্র। যে একবার পায় সে সেই গন্ধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়না। আর মাত্র কয়েক পা। প্রথম হওয়ার স্বাদ আর নিজের নাম লিখিয়ে নেওয়ার ইচ্ছেটা ওকে কিছুটা শক্তি দিল। চোখের দৃষ্টিতে মেপে নিল সামনের ফিনিশিং লাইনের দূরত্ব। লাইনটা যেন সোনার হরিণ।

পায়ের কেটসের থপথপানি আওয়াজটা বন্ধ। দিকশূন্য হয়ে পায়ের পাতার ভরে লম্বা লম্বা কয়েক পা ফেলতেই একজন স্টপ ওয়াচ দেখে বলে উঠলো, ‘চেস্ট নম্বর একাত্তর ছেঃ মিনিট উনত্রিশ সেকেন্ড !’ ঘোষণার আওয়াজের সাথে সাথেই একজনের পড়ে যাওয়ার আওয়াজ কানে আসলো। পেছনে দৌড়াতে থাকা চেস্ট নম্বর একানব্বই পড়ে গিয়েছে। কয়েকজন দৌড়ে ওকে ওঠাতে গেল। সাড়ে ছয় মিনিটের মধ্যে ফিনিশিং পয়েন্ট ছুঁতে না পারার ব্যর্থতা ওকে ফেলেনি। পেছন থেকে কেউ ওকে টপকে ফিনিশিং পয়েন্ট ছুঁয়ে দিল ভেবে ও হয়তো হার স্বীকার করে নিয়েছে।

চেস্ট নম্বর একানব্বই ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছাতে পারলো না সাড়ে ছয় মিনিটে। ততক্ষণে দেবজিতের পা ছুঁয়ে ফেলেছে সোনার হরিণ। অতর্কিতে চোখের কোনায় জল জমে উঠলো। শরীর থেকে একটা ভার নামলো। মনের ভার কমলো। পায়ের পাতার জ্বালা অনুভব করলো। পেট খামচে ধরেছে।  বাঁ পা মুড়তে অসুবিধা হচ্ছে। সারা শরীর থেকে আগুনের হল্কা বার হচ্ছে। চোখে জ্বালা। শুকনো ঠোঁটে জিভ বোলাতেই নুনের স্বাদ মুখে লাগলো। চুল থেকে টপ টপ করে ঘাম গড়িয়ে মুখে পড়েই শুকিয়ে যাচ্ছে। পায়ের মাসল শক্ত হয়ে গিয়েছে। মাটির দিকে ঝুঁকে হাঁটুতে হাত রেখে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকলো। যেন কোনো জানোয়ার ক্ষিধের ইশারায় প্রতিযোগিতা জিতলো। ওর কাঁধে হাত দিয়ে একজন মাঠের এক কোনায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো। সেখানে আগে থেকে দুইজন দাঁড়িয়ে। মাঠের ভীড় থেকে একটা দৌড় আলাদা করে ফেলল দেবজিতকে। চোখ পড়ল কাঁঠাল গাছটার দিকে। ব্যাগটা রাখা আছে। ব্যাগের ভেতরে পাউরুটি আর দুটো কলা সঙ্গে এক বোতল জল। ব্যাগের উপরে ফুল প্যান্ট আর জামা মুড়ে রাখা। প্যান্টে সাতাশটা টাকা।

 

চোখ

চোখ দ্যাখেনা, মন দ্যাখে। মনের চোখ দিয়ে জীবনকে না দেখতে পেলে জীবনে সন্তুষ্টি আসেনা। প্রেমকে হয়তো সেকারণেই মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। আর জীবনকে দেখতে? জাগ্রত করতে হবে মনের চোখ। ওয়িংড কাপিডের চরিত্রটিকে শেক্সপিয়ার দৃষ্টিহীন করে রেখে যথার্থই করেছেন এ কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি এই মুহুর্তে আমার চোখ মেলে রেখেছি সেই পথের দিকে যে পথে হেঁটে চলে গেছে মুহূর্তেরা। মুহূর্তগুলো কোনটা ছিল উজ্জ্বল আলোর মত, কোনটা ছিল নিকষ কালো রাত্রির মত। আমি জানি আমার মুখ যেটা বলতে পারেনা সেটা আমার চোখ বলতে পারে , অনায়াসে। চোখের ভাষা পড়ার জন্য চোখ বন্ধ করে মনের চোখ জাগ্রত করতে হয়। কিন্তু আজ শুধু দেখছি, শুয়ে শুয়ে দেখছি। চোখের ভেতরে যেন আরও একটা চোখ। সেই চোখ মনের চোখ। যে চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি একটা চালচিত্র। চালচিত্রে পাল্টে যাওয়া দৃশ্যগুলো বড় অদ্ভুত। এক দৃশ্যে দেখি কোথাও কেউ নিজের জন্মদিন পালন করতে কেক কেটে একে অপরের মুখে তুলে দিচ্ছে। এক দৃশ্যে দেখি র’ফলা আর জ’ফলা সৃষ্টি করেছে এক অদ্ভূত পরিবেশ। সহ্য আর ধর্ম শব্দ দুটো জ’ফলা আর র’ফলা যোগে নিজেদের নিজেদের জায়গা অর্জন করে বাধিয়ে দিয়েছে তুমুল লড়াই। আর এরই মধ্যে এক দৃশ্যে হঠাৎ করে দেখি, মাতৃদুগ্ধ পানরত শিশু হাতে উঠিয়ে নিয়েছে পাথর। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আশেপাশে কোনো ফলের গাছও নেই, তবু কেন উঠিয়েছে পাথর! এত ছোট ছেলে কার সাথে শত্রুতা করে উঠিয়েছে পাথর! হাড়গিলে ছেলেটার পাঁজর দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো ঢুকে গিয়েছে। গায়ের ত্বক ফেটে গিয়েছে I ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছে। কান দুটো খাড়া। সামনে চ্যাপ্টা এলুমিনিয়ামের থালা। থালাটাতে কিছু একটা রাখা আছে কিন্তু আমার সেটা দেখতে মন চাইল না। আমি শুধু দেখছি ছেলেটা উঠিয়ে নিয়েছে পাথর। হঠাৎ করে ছেলেটার খালি পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম ওর পায়ে কাঁটা ফুটে আছে। কিন্তু ছেলেটা কেন উঠিয়েছে পাথর! জিজ্ঞেস করলাম। ও বলে উঠলো ‘আমি ঈশ্বর কে খুঁজছি।’ বড় বিচিত্র উত্তর শুনে থম মেরে গেলাম। বুঝতে পারলাম ছেলেটা বুঝে ফেলেছে আমাদের মধ্যেকার সব গোলযোগ সৃষ্টিকারী ধর্মের ঈশ্বরেরা আমাদের মধ্যে ধ্বংসের বীজ বুনে দিয়েছে। অথচ আমরা কেউই সেটা দেখতে পাইনি। আমাদের এই খোলা চোখ দিয়ে আমরা শুধু ধর্মগ্রন্থের পাতা উল্টিয়েছি।

ছেলেটা কি তবে সেসব দেখতে পেয়েছে যা আমরা কেউ দেখতে পাইনি! বিস্মিত হয়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে দেখলাম ছেলেটার চোখ দুটো অন্ধ। ছেলেটা মনের চোখ দুটোকে জাগিয়ে ফেলেছে ভীষণ। লজ্জাবনত দৃষ্টি ফেরাতেই চোখ পড়ল থালাটার দিকে। থালাটাতে রাখা আছে বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থ I থালার সামনে জ্বলছে ক্ষিধের আগুন।

শরীরের চোখ সবসময়ে নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। চোখ খুলে যায় শুধু পার্থিব সামগ্রী দেখতে। আমারও চোখ খুলতেই দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল ঈশ্বর কে খুঁজতে থাকা ছেলেটি। ছেলেটি ওর সবকিছু নিয়ে আগুনে পুড়ে যাক এই কামনা করে জানালায় দৃষ্টি ফেরালাম। জানালার বাইরে আরব্য উপন্যাসের চরিত্রের মত ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে। ওর সারাটা শরীর জ্বলে পুড়ে গিয়েছে, শুধু চোখ দুটো রয়ে গেছে অক্ষত।

 

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here