পর্ব ৭ম – নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকারঃ আলেহো কার্পেন্তিয়ের –ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শৈবাল কুমার নন্দ

1
30
পর্ব ৭ম

নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার

                  আলেহো কার্পেন্তিয়ের

          ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শৈবাল কুমার নন্দ

                                                                                             ছবিঃ গৌতম মাহাতো

 নিচে ওখানে আমারই মত বেশ কয়েকজন মাটিতে শুয়ে, রক্তে ভেসে গেছে চারদিক ও নিজেদের দেহগুলােকে টেনে হিচড়ে বুলেটবৃষ্টির মধ্যেই যে বুলেটগুলাে এখনাে গেঁথে আছে দেওয়ালে লাগানাে আয়তাকার স্তম্ভগুলাের ভেতরে। তুমি পেছন ফিরে রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীর দিকে তাকাও ও কান্নায় ভেঙে পড়ে তােমার মাথা গুঁজে দাও তার কোলে।
            “ভয়ংকর। বিভৎস!” তিনি বলেন, “তােমাদের পুলিশেরা একদম বর্বর-পাষন্ড।” “তারা উত্তর আমেরিকা থেকে প্রশিক্ষকদের নিয়ে আসার পরে তাে পরিস্থিতি আরাে খারাপ হয়েছে”, তুমি ফুপিয়ে বলে ওঠো। এতে তােমার ভালােই হয়। তারপর, তােমায় সান্ত্বনা দিতে, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী তােমায় শুইয়ে দেন তার পাশে। তাঁর খােলা শরীরে তুমি বন্ধ করাে তােমার চোখদুটো এবং তখন রাত, কোন দিন? তুমি জানাে না। তারিখ কত ? তােমার কোন ধারণা নেই। কোন মাস? ওটা কোন ব্যাপারই নয়। বছর? একমাত্র যে তারিখটা তুমি এখান থেকে দেখতে পাচ্ছাে সেটা হার্ডওয়ার বিপনির সাইনবাের্ডটাতে : “১৯১২তে স্থাপিত।” “সম্ভবত : এটা এক যুগান্তকারী চিহ্ন হিসেবে থাকবে”, তুমি বিরসভাবে বলে ফেল। এবং তারপর, আরাে ভালােবাসাবাসি, ভালােবাসা, যা তারিখের উর্ধে। যেমন এক ফরাসী গায়ক বলতেন : “পৃথিবী হয়তাে রসাতলে যেতে পারে এবং আমরা সেটাও খেয়াল করিনি।”এই কয়েদখানাতে, ভালােবাসা, এই নির্বিঘ্ন আশ্রয়ে, এই সময়হীন সময়ে, আমার মনে আসে সেই লােকটার কথা যে একটা অদ্ভুত বাড়িতে আফিমের ধোঁয়াতে নেশা করার পর জেগে উঠে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল ফাঁকা শূন্যতায়, এলপানর এর মত, কারণ সে জানত না সে কোথায় ছিল। কিন্তু তুমি রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীকে ভালােবাসাে, তার নাম সিসিলিয়া। তার ফরসা দুই হাতের গভীর আলিঙ্গন তােমার কাছে একান্ত প্রয়ােজনীয়। তােমার কষ্টের সময় তুমি তার মধ্যে পেয়েছে এক মায়ের স্নেহ, এক সেবিকার উদ্বেগ, এক প্রিয়ার উষ্ণতা। সিসিলিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে শুয়ে শুয়ে, তুমি রাষ্ট্রদূতকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার অনেক রকম পরিকল্পনা করতে থাকো। হয়তাে আর্সেনিক দিয়ে? কিন্তু – অন্যের মনােযােগ নিজের দিকে না টেনে কিভাবে ওটা সংগ্রহ করা যায় ? পটাশিয়াম সায়ানাইড? প্রয়ােগ করা খুবই সহজ, এবং তাঁর “শারীরিক বিলোপ” আয়ত্ত করা যেতে পারে একটা চমকপ্রদ উপায়ে : বিষটা কয়েকটা বড়ির সাথে মেশানো যেতে পারে যেগুলাে রাষ্ট্রদূত প্রতি রাতে খান তার হজমের গােলমালের জন্য। বড়িগুলো ঝাকাতে হবে যেভাবে একটা ঘুটির বাক্সে ঘুটি ঝাকানাে হয় দান ফেলার আগে এবং তারপর অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য আর কিছু করার নেই। তবে আজ নয়। আজ নয়। আগামীকাল এটা হবে ; আর তিনটে বড়ি পড়ে আছে। এবং যখন মাত্র দুটো থাকবে

আমরা শবযাত্রার পরিকল্পনা আঁটবাে। কোমরে পরার রেশমি ফিতেগুলাে ও সাজসজ্জা যেগুলাে দিয়ে মৃত মানুষকে তার কবরে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং যখন একটামাত্র বড়ি পড়ে থাকবে ? নীরব আবেগের একটা রাত। কিন্তু …কে যাবে সায়ানাইড সংগ্রহ করে আনতে? কেউ কি ওটা ওষুধ দোকানে কিনতে পারে ? সবচেয়ে কার্যকর জিনিস কিন্তু হত কুরেয়ার,কারণ এটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোনও চিহ্ন রাখে না।ভালো ভাবে বিষ মাখানো সূঁচ দিয়ে শুধু একটা ইনজেকসন এবং শিকার সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে,নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারবে না, ফুসফুসের পেশিগুলাে অসাড় হয়ে যাবে। কিন্তু কুরেয়ার পেতে গেলে, যেটা ছােট ছােট লাউয়ের খােলে রাখা হয়, কাউকে যেতে হবে গুয়াচিনাপা ইন্ডিয়ানদের দেশে, অন্ততঃ একমাস সময় লাগবে ওখানে যেতে, প্রথমে নৌকোতে করে ও তারপরে ক্যানােতে চেপে। তােমরা কেঁদে ওঠো একসাথে তােমাদের একইরকম দুঃখে নিজেদের এত নিষ্ক্রিয় ভাবার অনুভূতিতে কত সুখীই না আমরা হতাম একসাথে কফিনটার ধারে দাঁড়িয়ে!…
          তুমি জানালার কাছে যাও। গুলিগােলা থেমে গেছে। তারা আহতদের – অথবা সম্ভবতঃ মৃতদেরও বয়ে টেনে নিয়ে গেছে। খেলনা দোকানটার জানালার শার্সিটা খানখান হয়ে গেছে একটা বুলেটের আঘাতে যেটা ডােনাল্ড ডাককে তার স্তম্ভমূল থেকে টেনে নিচে ফেলে দিয়েছে এবং তার কার্ডবাের্ড দিয়ে বানানাে বুকটাতে একটা ছােট কালাে ছিদ্র রেখে গিয়েছে। যেহেতু এটা ছিল বীরেদের দিন, দোকানটাতে কেউ ছিল না যে আবার তাকে ঠিকঠাক তার জায়গাতে রাখবে। সে সেখানেই শুয়ে থাকল, তার পা দুটো ছ্যাৎরানাে এবং তার দুই পায়ের কমলা চেটোগুলাে ঝুলছে শূন্যে।

                    বৃহস্পতিবার নিয়ে

যখন বর্ষা শুরু হল, এ দেশের সাথে সীমান্তবর্তী দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কিন্তু খারাপ দিকেই মােড় নিল। সীমানাগুলাে নিয়ে দ্বন্দ্বটা আবার জেগে উঠল এবং বৈরি মনােভাব আবার মাথা চাড়া দিল। কিন্তু এবারে জেনারেল মাবিলান তার সব বাহিনীগুলাে  সচল রেখেছিলেন এবং তার সংঘবদ্ধ প্রচার ও নিষেধাজ্ঞা জারির সংস্থাগুলাে সক্রিয় ছিল যুদ্ধের মত পরিস্থিতিকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টাতে। কারণ তাঁর দরকার ছিল এমন এক বাহিনীর যারা অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়ন চালাবে, সমস্ত জমায়েত বা মিছিল ছত্রভঙ্গ করবে, ধর্মঘটগুলাের অবসান ঘটাবে, দেখবে কারফিউ ঠিকমতাে পালন হচ্ছে কিনা, বাড়ি ও অফিসগুলাের তল্লাসী চালাবে, এবং রাস্তাগুলােতে সতর্ক পাহারা বজায় রাখবে, ইত্যাদি ইত্যাদি, তিনি ভাবেন নি যে বিভিন্ন বিভাগকে অরণ্যবেষ্টিত সীমানাতে পাঠানাের ও নিজের বাহিনীকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখার এটাই এক সঠিক ক্ষণ। একই কারণের জন্য সীমান্তবর্তী দেশের প্রতি তার পুরনাে উগ্রতাও রাজনৈতিক সহনশীলতায় ও পারস্পরিক সহযােগিতায় পরিবর্তিত হয়ে এসেছিল।

                                                            ক্রমশঃ…
                                  ★★★


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here