স প্ত দ্বী পা অ ধি কা রী- গল্প

1
77
পরিচিতিঃ লেখিকার বাংলা সাহিত্য নিয়েই পড়াশুনো, গবেষনা ও চর্চা।মূলত গদ্য-সাহিত্যেই তাঁর বিচরণ। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকেন। চর্চা করেন লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে। “কথাকাব্য” ও “রাজকন্যা”(শিশু কিশোরদের জন্য) নামে দুটি পত্রিকারও সম্পাদনা করেন যা করোনার কারণে এবারের সংখ্যা মাঝ পথে পড়ে আছে। প্রথম গল্পগ্রন্থঃ “মৃত্যুর মুখ” দশটি গল্প নিয়ে এই সংকলন। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ–“খেজুর গাছের ঘাট এবং পঞ্চীর ইন্দ্রীয় সকল” প্রকাশকঃ কবিতীর্থ।এই বইএর একটা গল্পের নাম- ‘হলুদ বুটি’।আন্ডারওয়ার্ল্ড এর ভাষা ব্যবহার করা। তৃতীয় গল্পগ্রন্থঃ জায়ান্ট কিলার( কিশোর গল্প-সংকলন) চতুর্থঃ খেঁদির কথা( উপন্যাস) নিম্নবর্গের মানুষের যুদ্ধ কাহিনি।এটিও কিশোর উপন্যাস। একটা কাব্যগ্রন্থ করেছে ৯ নম্বর সাহিত্য পাড়া লেন।কাব্যগ্রন্থের নামঃ প্রায়শ্চিত্ত পর্ব। ইনিও বাইফোকালিজম্ পরিবারের একজন সদস্যা।

মনুষ্য সৃষ্টির ইতিহাস


স প্ত দ্বী পা অ ধি কা রী

 

অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহাতপস্বী বৃদ্ধ ব্রক্ষ্মাকে আপন নাভিপদ্ম হইতে সৃষ্টি করিলেন।এবং ব্রক্ষ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁহাকে রত্নসিংহাসনে উপবিষ্ট হইতে অনুরোধ করিলেন।শুভ্র কেশ,শুভ্র দন্ত,যোগীশ্রেষ্ঠ,সকলের গুরু ও জনক,শান্ত,সুন্দর, সমাহিত ব্রক্ষ্মা মধু ও কৈটভের মেদ হইতে সৃষ্টি করিলেন এই পৃথিবী।অধিকন্তু সাতটি পর্বত,সাতটি দ্বীপ এবং সাতটি পাতাল লইয়া তিনিই গড়িয়া তুলিলেন ব্রক্ষ্মান্ড।এবং তাহার পরই তাঁহাকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখাইতেছিল।তিনি প্রথমেই অহিংসার পুত্র নারায়নকে আহ্বান জানাইলেন।তাহারপর একে একে দিগম্বর মহাদেব,শুক্লবর্ণ জটাধারী,দয়াবান ও দ্বেষশূন্য ধর্মঠাকুর,শুদ্ধসত্ত্বময়ী বীণাধারিণী দেবী সরস্বতী,গৌরবর্ণা,পীতবস্ত্র পরিহিতা দেবী মহালক্ষ্মী,দুর্গতিনাশিনী, সকল শক্তির অধীশ্বরী দেবী দুর্গা,স্ফটিক মণির মতো উজ্জ্বল, শ্বেতবসনা, দেবী সাবিত্রী,তপ্ত স্বর্ণের ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট মন্মথ,অত্যন্ত সুন্দরী কামিনী রতি,জলের অধিদেবতা বরুণদেব,তাঁহার স্ত্রী বরুণা, সকলের প্রাণস্বরূপ শ্রীমান পবনদেব এবং আহ্বান জানাইলেন মহাবিষ্ণুকেও।

সকল দেবদেবীগণ একত্রিত হইয়া স্ব স্ব সিংহাসনে আসীন হইলেন এবং তাঁহাদিগকে জরুরি তলব করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।অতঃপর পঞ্চমুখবিশিষ্ট শ্বেতবস্ত্র পরিহিত কমন্ডুলধারী ব্রক্ষ্মা কহিলেন–‘বায়ুশূন্য,প্রাণীশূন্য,শস্যবিহীন গোলোককে প্রত্যক্ষ করিয়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।অগ্নি নির্বাপিত করিয়া তিনি আপন মুখনিসৃত তেজ বাহির করিয়াছেন।এবং তাহা জলে রূপান্তরিত হইয়াছে।তথায় নানাপ্রকার জলজ প্রাণী সৃষ্টি করিয়াছেন।বৃক্ষরাজী সৃষ্টি করিয়াছেন আপন কর্ণকুহর হইতে।স্বেদবিন্দু হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন পশু-পক্ষী এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ। এক্ষণে আমি এই পৃথিবীতে মনুষ্য সৃষ্টি করিবার প্রয়োজন অনুভব করিতেছি।’
দেবতারা এই অদ্ভুত বাক্য শুনিয়া প্রথমে নির্বাক হইলেন।তাহারপর বিষ্ণু কহিলেন—‘আপনার ইচ্ছা যখন হইয়াছে আমরা অমত হইবার কারণ কী তাহাই তো বুঝিতে পারিতেছি না মহাতপস্বী!’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘কারণ,ইহাদিগকে আমি বুদ্ধিদীপ্ত,তেজস্বী এবং শক্তিশালী করিয়া গড়িয়া তুলিতে মনস্থ করিয়াছি।’
দেবী সরস্বতী অত্যন্ত আনন্দিত হইয়া কহিলেন—‘তাহাতেও আমাদিগের আপত্তি থাকিবার কোনো উপযুক্ত কারণ দেখিতে পাইতেছি না!’
ব্রক্ষ্মা আপন রত্নসিংহাসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দন্ডায়মান হইলেন।সকল দেবগণের প্রতি অকম্পিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন—‘তাহা হইলে আপনারা সকলেই সম্মত হইলেন বলিয়াই আমি ধরিয়া লইলাম!’
নারায়ন কহিলেন—‘আমাদিগের মনে হইতেছে সর্বসম্মতিক্রমে মত প্রকাশের নিমিত্ত আমাদিগের আরো একটু সময়ের প্রয়োজন!’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—” তথাস্তু!’ তদনন্তর সকল দেবতা এবং দেবীগণ গাত্রোত্থান করিলেন।
চৌদ্দ মন্বন্তর অতীত হইলে ব্রক্ষ্মা পুনরায় সকল দেবদেবীগণের স্মরণ লইলেন।সকল দেবদেবীগণ একত্রিত হইলে তিনি ঘোষণা করিলেন—‘ মনুষ্য নির্মিত হইয়াছে।কেবল প্রাণ প্রতিষ্ঠা অদ্যপি হয় নাই।আপনারা অগ্রে তাহার চেহারা অবলোকন করুন।’
এই কথা কহিয়া তিনি সভাস্থলে শুভ্র বস্ত্র দ্বারা আপাদমস্তক আবৃত মূর্তিটি উন্মোচন করিলেন।মূর্তি দেখিয়া দেবদেবীগণের মুখের বাক্য অন্তর্হিত হইল।
কেবল মহাতেজস্বী মহাদেব বলিয়া উঠিলেন—‘দেবতাগণের চেহারা লইয়া কোনো প্রাণী সৃষ্টি হইতে পারিবেক না!’অন্যান্য সকল দেবতারাও মহাদেবকে সমর্থন করিলেন।শান্তির স্বর্গরাজ্য অশান্ত হইয়া উঠিল।
ব্রক্ষ্মা সকল দেবতাদিগকে ক্ষোভ সম্বরণ করিতে অনুরোধ করিলেন।


কহিলেন—‘নিতান্ত নিরুপায় হইয়াই আমি এই সিদ্ধান্ত লইতে বাধ্য হইয়াছি।আপনারা কৃপা পূর্বক আমার সকল বাক্য শ্রবণ করুন।’
কহিলেন—‘পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ,কোটি কোটি জীব আমরাই সৃষ্টি করিয়াছি।কিন্তু তাহারা আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহে।পৃথিবীতে আমাদের পূজা প্রচারের নিমিত্ত মানব-মানবীর সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী।”
অকাট্য যুক্তি।সকল দেবদেবীরা নিশ্চুপ রহিলেন।
অতঃপর দেবতা নারায়ন ইতস্তত করিয়া কহিলেন—‘কিন্তু আকৃতিতে আমাদের সমতুল্য করিবার হেতু কি তাহা জানিতে ইচ্ছা করিতেছে হে দেবতা ব্রক্ষ্মা?’
অন্যান্য সকল দেবতা ও দেবীগন কহিলেন—‘আমাদিগেরও সেই একই প্রশ্ন এবং আপত্তির কারণ!’
অতঃপর ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘যদিচ ইচ্ছা করিলে আমি যেমন খুশি চেহারা সৃষ্টি করিতে পারিতাম।কিন্তু হে দেব ও দেবীগণ একটু ভাবিয়া দেখুন,সাদৃশ্য রহিয়াছে বলিয়াই উহারা আমাদিগকে দেবতা বলিয়া সম্মান করিবেক এবং পূজা করিবেক।আপনারাও অবগত আছেন,যে,বৈসাদৃশ্য সম্মান,শ্রদ্ধা ও পূজার অন্তরায়!’
সকল দেবতা ও দেবীগণ নিশ্চুপ রহিলেন।
তাহারা জানিতে চাহিলেন—‘এই মনুষ্য নামক জীবটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা কবে সুসম্পন্ন হইবেক?’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘সুসম্পূর্ণ হইলেই আপনাদিগকে অবশ্যই স্মরণ করিব হে স্বর্গের দেব ও দেবীগণ!’
ব্রক্ষ্মা পুনরায় চৌদ্দ মন্বন্তর অন্তর সকল দেব ও দেবীগণের স্মরণাপন্ন হইলেন।সকলে সভাগৃহে আসিয়া স্ব স্ব আসন গ্রহণ করিলেন।তাঁহারা দেখিলেন সভামধ্যে শ্বেত বস্ত্রে আদৃত রহিয়াছে দুইটি মনুষ্য মূর্তি।
নারায়ন জিজ্ঞাসা করিলেন—‘হে ব্রক্ষা,আমরা চৌদ্দ মন্বন্তর আগে একটি মনুষ্য মূর্তির নমুনা অবলোকন করিয়াছিলাম।আপনি আমাদিগের সকলের সম্মতি ব্যতিরেকে আরও একটি মনুষ্য মূর্তি নির্মাণ করিবার কারণ জানিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছি।’
ব্রক্ষ্মা স্মিত হাসিলেন এবং সেই তথাকার শুভ্র বস্ত্র উন্মোচন করিলেন।দেবতা এবং দেবীগণ অবাক হইয়া দেখিলেন পূর্বের মনুষ্যমূর্তির পার্শ্বে একটি অতীব কমনীয় মানবী মূর্তি।
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘সৃষ্টি অব্যাহত রাখিতে আমি এই মানবীও মর্ত্যে প্রেরণ করিব।’
দেবতাগণ রমনীয় নারী মূর্তির রূপ মাধুর্য দেখিয়া সবিশেষ চমৎকৃত হইতে লাগিলেন।তাঁহাদের চক্ষের পলক পড়িতেছিল না।ব্রক্ষ্মা কটাক্ষে তাহা দেখিয়া লইয়া অন্তরীক্ষে হাস্য করিলেন।এক্ষণে উপযুক্ত সময় আসিয়াছে।
তিনি কহিতে লাগিলেন—‘এই মুনুষ্যের পদযুগল অবলোকন করুন।ইহা দ্বারা ইহারা যথায় ইচ্ছা গমন করিতে পারিবেক।হস্তদুইটিও অবলোকন করুন।পার্থিব সকল বস্তুই ইহারা এই হস্তদ্বারা আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করিতে পারিবেক।হস্তযুগল এবং পদযুগল একত্রে ব্যবহার করিয়া ইহারা জলে সন্তরণ করিতে পারিবেক,স্থলে দ্রুতলয়ে চলিতে পারিবেক,বৃক্ষাদি এবং পর্বতোপরি আরোহন করিতে পারিবেক।’
মহাদেব মনে মনে কহিলেন—‘দেবদেবীগণের ন্যায় ইহাদের হস্তে অস্ত্র প্রদান না করিয়া আমাদিগকে বাঁচাইয়াছেন!’
ব্রক্ষ্মা রুষ্ট মহাদেবের মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন।তিনি স্মিত হাস্য করিলেন।আর সযত্নে মনুষ্যের অধরোষ্ঠ কিঞ্চিৎ ফাঁক করিয়া দন্তপংক্তি দেখাইলেন।
কহিলেন—‘এই দন্তপংক্তিও আমাদিগের ন্যায়।ইহার শক্তি আপনাদিগের অবিদিত নহে।এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দন্ত দ্বারা ইহারা পার্থিব যে কোনো জীব-জন্তু,গাছ-পাথর মূহুর্তে ছাতু করিয়া ফেলিতে পারিবেক।’
মহাদেব আর নিশ্চুপ থাকিতে পারিলেন না।তাঁহার সন্দেহ দূরীভূত করিবার নিমিত্ত তিনি কহিলেন—‘এক্ষণে উহাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিষয়ে অবগত করাইয়া আমাদিগকে বাধিত করুন।’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘রোষ সম্বরণ করুন ত্রিপুরারি।উহাদের কিঞ্চিত শক্তি প্রদান করিয়াছি,তাহা না হইলে উহারা পৃথিবীর বুকে অস্তিত্ব বজায় রাখিতে অসমর্থ হইবেক।’
অন্যান্য দেবতারা সেই ইস্তক প্রাণহীন উলঙ্গ মানবীর রূপ মাধুরী পান করিতেছিলেন।তাঁহারা ব্রক্ষ্মা ও মহাদেবের বাদানুবাদ শুনিতেছিলেন কী না তাহাতে যথেষ্ট সংশয় রহিয়াছে।ব্রক্ষ্মা অনেক চিন্তা করিয়াই এই উপায় বাহির করিয়াছেন।কিন্তু মহাদেবকে তিনি কিছুতেই বশে আনিতে পারিতেছেন না।তাঁহার সংশয় ও সন্দেহ ক্রমে ক্রমে আরো ঘনীভূত হইতেছে।
রুষ্ট মহাদেব কিঞ্চিত শ্লেষের সহিত কহিলেন—‘তাহাদের অস্তিত্বহীন হইবার কারণ জানিলে বাধিত হইতাম।’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘উহাদের যে ক্ষুদ্র শক্তি প্রদান করিয়াছি তাহা হিংস্র পশুদের সহিত যুদ্ধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার নিমিত্ত!’
দেবাদিদেব মহাদেব হাসিয়া কহিলেন—‘আপনার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে।ব্যাঘ্র,সিংহ ইত্যাদি হিংস্র পশুদের সহিত অস্ত্রহীন অবস্থায় আমাদিগের পক্ষেও যুদ্ধ করা অসম্ভব।আর আপনি কহিতেছেন এই ক্ষুদ্র মনুষ্য…’
বাক্য অসম্পূর্ণ রাখিয়া মহাদেব অট্টহাস্য হাসিয়া উঠিলেন।
অতঃপর হাসিতে হাসিতে কহিলেন—‘হিংস্র পশুদিগের কথা ছাড়িয়া দিন।ভূমির উপর আঁকিয়া-বাঁকিয়া চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে যে সরীসৃপ,আপনার সৃষ্ট এই মনুষ্যজাতি তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিবারও যোগ্য নহে!’এইরূপ বাক্য কহিয়াও দেবাদিদেব থামিলেন না।তিনি প্রভূত মজা পাইয়াছেন ব্রক্ষ্মার সৃষ্টি এমন বালখিল্যপনায়! তাহাই তাঁহার এইরূপ হাসিতে প্রতীয়মান হইতেছে।ব্রক্ষ্মা সহজে রুষ্ট হন না।ইহার সঙ্গত কারণও রহিয়াছে।তিনিই সকলের পিতৃসম।স্বর্গরাজ্যের শান্তি যাহাতে কিছুতেই বিঘ্নিত না হইতে পারে তাহা দেখিবার দায়িত্ব তিনি স্বয়ং গ্রহণ করিয়াছেন।তাই অন্যান্য দেবতাদের ন্যায় তিনি যখন-তখন রুষ্ট হইতে পারেন না।সকলকে বুঝাইবার সকল দায়ভার স্কন্ধে তুলিলে ছোটোখাটো রাগ-অভিমান বিসর্জন দিতে হইবেক।তিনি ভাবিয়াছিলেন শান্ত ও সমাহিত থাকিয়া সকলের নিকট হইতে তিনি সম্মতি আদায় করিতে সমর্থ হইবেন।আর যতক্ষণ না তিনি সকলের সম্মতি পাইতেছেন ততক্ষণ নিজে পিতার দায়িত্ব পালন করিবেন।কিন্তু এক্ষণে মহাদেব তাঁহাকে অপমান করিতেছেন।অপমান এমনই তাহা পিতা-পুত্রের সম্পর্কেও ফাটল ধরাইতে সক্ষম।মহাদেব যত হাসিতে লাগিলেন,ব্রক্ষ্মার রোষ ততই বাড়িয়া যাইতে লাগিল।তাঁহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল।মহাদেব তাঁহাকেই কেবলমাত্র নহে,তাঁহার সৃষ্টিকেও অপমান করিতেছেন।ব্রক্ষ্মার মুখমন্ডল হইতে হাসি অন্তর্হিত হইল।চক্ষুর অভ্যন্তরস্থ শ্বেত বর্ণ রক্তবর্ণ ধারণ করিল।এতাবৎকাল তিনি কৌশলে তাঁহার কার্যসিদ্ধির উপায় ভাবিতেছিলেন।এক্ষণে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ন হইলেন।তিনি জানেন যে,তিনি ভুল করিতেছেন না।মহাদেব তখনো হাস্য করিয়া চলিতেছিলেন।
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘সরীসৃপের ন্যায় এই মনুষ্যজাতি সর্বংসহা হইবে।শুধু তাহাই নহে প্রকৃতির যে কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতি ইহারা মানাইয়া চলিতে সক্ষম।’
মহাদেব অট্টহাস্য হাসিয়া উঠিলেন।


কহিলেন—‘ তাহা হইলে তো আপনার অকারণ চিন্তার কারণ দেখিতেছি না।যান,এই মনুষ্যযুগলকে এক ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র সমীপে হাজির করুন।বিনা অস্ত্রে এই যুগল হস্তযুগল এবং পদযুগল এবং দেব ও দেবীগণের ন্যায় দুই পংক্তি দন্ত লইয়া ব্যাঘ্র- নিধন ঘটাইবে নিশ্চিত।’মহাদেবের হাস্য সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল।
ব্রক্ষ্মা যারপরনাই অপমানিত হইয়াই চলিতেছেন।তাঁহার মস্তিষ্ক গরম হইয়া উঠিল।
তিনি কহিলেন—‘মনুষ্যদিগকে আমি বুদ্ধিবৃত্তি প্রদান করিয়াছি।উহারা অস্ত্রহীন এ কথা সঠিক।কিন্তু উহারা পৃথিবীকে উহাদের ইচ্ছামত এবং সুবিধামত ব্যবহার করিতে পারিবেক।’
মহাদেবের রোষ পুনরায় বাড়িয়া চলিতে লাগিল।তিনি পঞ্চমুখী ব্রক্ষ্মাকে কহিলেন—‘ তথাপি উহারা ধ্বংস প্রাপ্ত হইবেক।উহাদিগকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করুন।এই আমি আমার ত্রিশুল দান করিলাম।এই নিন আমার পিনাক।এই অস্ত্রগুলি আপনার সৃষ্ট মনুষ্যজাতিকে প্রদান করুন।নতুবা উহারা ধ্বংস হইবেক অচিরেই।’
ব্রক্ষ্মার শরীরে কম্পন অনুভূত হইতেছিল।তিনি নিজেকে সংযত করিতে অসমর্থ হইলেন।
কহিলেন—‘ আপনি কি আমার সৃষ্ট এই মনুষ্যজাতির বুদ্ধির পরীক্ষা লইয়াছেন? তাহা হইলে কীসের নিমিত্ত ইহাদিগকে স্বল্পবুদ্ধি বলিতেছেন? শুনুন মান্যবর!ইহারা এমন সুচারুরূপে গৃহ ও সমাজ প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইবেক, যাহা চাক্ষুষ না করিলে ধারণা করিতেও পারিবেন না।ইহারা আয়েশী কিন্তু কঠোর পরিশ্রমী।জেদি।ইহারা এমন অস্ত্র স্বয়ং প্রস্তুত করিবেক যাহার দ্বারা যে কোনো ভয়ংকর পশুকে বধ করিতে সমর্থ হইবেক।পৃথিবীতে একমাত্র এই মনুষ্যজাতিই সকল পশুকে পোষ মানাইতে সক্ষম হইবেক।যে কোনো হিংস্র প্রাণীকেই ইহারা লোহার খাঁচায় বন্দী করিয়া রাখিতে সক্ষম হইবেক।এমন অস্ত্র এই মনুষ্যজাতি স্বয়ং সৃষ্টি করিবেক,যে,যে কোনো হিংস্রতাকেই মুহূর্তের এক ভগ্নাংশ সময় মধ্যে হত্যা করিতে পারিবেক। ইহাদের তৈয়ারি অস্ত্র দ্বারা ইহারা এক একটা পশুর এলাকা কিম্বা একটি সম্পূর্ণ মহাদেশ ভস্মীভূত করিতে পারিবেক।আমি ইহাদের এমন ভাবেই সৃষ্টি করিয়াছি।’
ব্রক্ষ্মার অপমানের চিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছিল।তিনি এই সকল কথা কহিতে কহিতে স্বেদাক্ত হইতেছিলেন।সকল কথাই তিনি পঞ্চমুখে ব্যক্ত করিতেছিলেন।ফলতঃবিকট শব্দ হইতেছিল।এই শব্দ মহাদেবের সন্দেহকে জোরদার করিতেছিল এবং তিনি যারপরনাই কুপিত হইতেছিলেন।
মহাদেব বদান্য,সহজে সন্তুষ্ট এবং কল্যাণপ্রদ।আবার খুব সহজেই ক্রুদ্ধ হন।অর্থাৎ এক আধারে তিনি ভয়ানক ও মঙ্গলময়।এক্ষণে তাঁহার ধ্বংসের রূপ প্রকটিত হইতে লাগিল।তিনি বিষাণ ও ডম্বরু বাজাইতে বাজাইতে এক লম্ফ দিয়া সিংহাসন ত্যাগ করিলেন।তাঁহাকে বন্য হিংস্র প্রাণীর ন্যায় লাগিতেছিল তখন।মনে হইতেছিল তাঁহার সর্বসংহারক নামকরণ সার্থক।তিনি শ্মশান সাজে সজ্জিত হইলেন।তাঁহার মস্তকের সর্পরাও প্রবল বেগে ফণা তুলিয়া দুলিতে ও ফুলিতে লাগিল।তাঁহার গলদেশের কঙ্কাল মাল্য ভীষণভাবে দুলিতে লাগিল। তিনি তান্ডব নৃত্য করিতে লাগিলেন।তাঁহার ললাটের তৃতীয় নয়ন উন্মীলিত হইল।অর্ধচন্দ্রও যেন ব্রক্ষ্মাকে কটাক্ষ করিয়া হাসিয়া উঠিল।নৃত্যের তালে তালে তাঁহার মাথার জটা ভীষণ বেগে দুলিতে লাগিল।তাঁহার পরিধানের রুধিরাক্ত ব্যাঘ্রচর্ম চমকাইতে লাগিল।তাঁহার কৃষ্ণসার মৃগচর্ম উত্তরীয় লম্ফ প্রদানের তালে তালে নাচিয়া উঠিতে লাগিল।তাঁহার বাহন নন্দীও তাঁহার সহিত নৃত্য জুড়িয়া দিল।তাঁহার হস্তের ডম্বরু এবং মুদ্গর সশব্দে বাজিয়া উঠিল। অত:পর তিনি তাঁহার বিশ্বধ্বংসী অস্ত্র পাশুপত প্রয়োগ করিয়া ব্রক্ষ্মার একটি মস্তক কর্তন করিলেন।অন্য সকল দেবতাদিগের এক্ষণে সম্বিত ফিরিয়াছিল।তাঁহারা এমতাবস্থায় পলায়নকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন।সুখের স্বর্গ অশান্তির করাল ছায়া দ্বারা আবৃত হইলে শ্রীকৃষ্ণের আসন টলিয়া উঠিল।তিনি তাঁহার নিশ্বাস বায়ু দ্বারা মহাদেবের ক্রোধ প্রশমিত করিতে অপারগ হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন।মহাদেবকে শান্ত হইতে অনুরোধ করিলেন।
অত:পর চতুর্মুখী ব্রক্ষ্মা জ্ঞানলাভ করিলেন।এবং শ্রীকৃষ্ণসমীপে সকল বৃত্তান্ত অবগত করাইলেন।মহাদেব পুনরায় রুষ্ট হইতেছিলেন।
রোষকষায়িত লোচনে মহাদেব শ্রীকৃষ্ণকে কহিলেন—‘মনুষ্যজাতিকে এমত বুদ্ধি ও ক্ষমতা প্রদান করিলে অচিরেই এই জাতি স্বর্গ দখল করিবেক।দেবতারা তাহাদের ভৃত্যে পরিণত হইবেক।’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘যে কোনো প্রকার শর্তই মানিয়া লইতে প্রস্তুত।কিন্তু পৃথিবীতে আমাদিগের পূজা প্রচারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না!’
কৃষ্ণ হাসিলেন।
ব্রক্ষ্মাকে কহিলেন—‘এইস্থানে দন্ডায়মান এই মূর্তিদুটিই কি আপনার সৃষ্ট মনুষ্য?’
ব্রক্ষ্মা সম্মতি জানাইয়া কহিলেন—‘ আজ্ঞে প্রভু।আমি এই দুইজনের নামকরণ করিয়াছি আদম এবং ইভ।’
রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন—‘বড় সুন্দর করিয়া আপনি মানব গড়িয়াছেন ব্রক্ষ্মা! বড় সুন্দর নামকরণ।’
তদনন্তর তিনি ব্রক্ষ্মা এবং মহাদেব উভয়ের প্রতি নরম এবং মিষ্টি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন—‘তৈলও খরচ হইবে না এবং রাধিকাও নৃত্য করিবেক।’
উভয়েই জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিয়া রহিলেন।
কৃষ্ণ ব্রক্ষ্মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইয়া গিয়াছে?’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘ আজ্ঞে,প্রভু!’
কৃষ্ণ অবাক হইয়া কহিলেন—‘তাহা হইলে উহারা স্ট্যাচুর ন্যায় দন্ডায়মান রহিয়াছে কীসের নিমিত্ত?’
ব্রক্ষ্মা কহিলেন—‘যদিচ চক্ষু সৃষ্টি করিয়াছি তথাপি অদ্যপি দৃষ্টিদান করিনাই।আমরা সকলেই অবগত আছি যে,দৃষ্টি বিনা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত সম্ভব নয়।আর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ব্যতিত যে কোনো প্রাণীই চক্ষু থাকিতেও অন্ধ!চর্ম থাকিতেও নির্লজ্জ!’
কৃষ্ণ যেন লুফিয়া লইলেন ব্রক্ষ্মার কথা।
কহিলেন—‘ব্রক্ষ্মার অভিপ্রায় পূরিত হইবেক এবং মহাদেবের আশংকাও দূরীভূত হইবেক।ইহাতে সন্দেহ নাই।’
মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে কৃষ্ণ কহিলেন—‘মনুষ্যদিগকে হে ব্রক্ষাদেব আপনি যেমত প্রকারে সৃষ্টি করিয়াছেন সেমত প্রকারেই মর্ত্যে প্রেরণ করিবার বন্দোবস্ত করুন।’
ব্রক্ষ্মা হাসিলেন।আর মহাদেবের দৃষ্টি কঠিনতর হইতে আরম্ভ করিলে শ্রীকৃষ্ণ হাসিয়া কহিলেন—‘মনুষ্যদিগকে আমি ‘মন’ দান করিয়া দিবার মনস্থ করিয়াছি।’
উভয়কেই চিন্তাক্লিষ্ট দেখিয়া কৃষ্ণ পুনরায় কহিলেন—‘মন হইবে মানুষের দৃষ্টি-স্বরূপ।জলে-স্হলে-অন্তরীক্ষে এই মন নিতান্ত অযৌক্তিকভাবে গমন করিয়া মানবজাতিকে চক্ষু থাকিতেও অন্ধ,হস্ত এবং পদযুগল থাকিতেও খোঁড়া করিয়া রাখিবে।সম্মুখে সুস্বাদু খাদ্য থাকিতেও মনুষ্যজাতি তাহা গ্রহণ করিতে পারিবেক না।মনের মায়াজালে আবদ্ধ হইয়া মনুষ্যজাতি জ্ঞানী হইলেও অ-জ্ঞানী-সদৃশ কর্ম সম্পাদন করিবে।তাহাদের সমস্ত শুভ বুদ্ধি লোপ পাইবেক। শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে শত্রু জ্ঞান করিবেক।মহাশত্রুকে শ্রেষ্ঠ বন্ধুত্বের মান্যতা দিয়া আপনাদিগের বিনাশ সাধন করিতে নিতান্ত অস্থির হইয়া উঠিবেক।যদ্যপি কোনো একটা সময় তাহাদিগের সম্বিত ফিরিবেক, তথাপি ইত্যবসরে তাহাদের সমস্ত সুখ বিনষ্ট হইবেক। সুতরাং হে দেবাদিদেব আপনি দুশ্চিন্তামুক্ত হউন।আর হে ব্রক্ষ্মা আপনি এই মনুষ্যযুগলকে দৃষ্টিদান – পূর্বক মর্ত্যে প্রেরণ করুন।উহারা কোনোদিনই স্বর্গরাজ্য দখল করিতে পারিবেক না।সকল প্রকার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও উহারা মর্ত্যে আমাদিগের পূজা প্রচার করিয়া নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের কারণ হইবেক।’
আদম ও ইভ এই প্রকারে মর্ত্যে প্রেরিত হইল। ক্রমে ক্রমে পৃথিবী জুড়িয়া মনুষ্যজাতি সৃষ্টি হইল এবং অঘটন-ঘটন পটীয়সী মনের আজ্ঞানুসারে উহারা নাস্তানাবুদ হইতেছে,ক্রন্দন করিতেছে,আর ঈশ্বরের নিকট কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিতেছে আর স্বর্গে বসিয়া ঈশ্বর মুচকি হাসি হাসিতেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here