গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(অষ্টম পর্ব)”

0
35
পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান-র অষ্টম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(অষ্টম পর্ব)

 

অপু, শম্ভু ও অন্যান্যরা

“ইন আবলো সে পাঁও কে ঘাবরা গ্যায়া থা ম্যায়/জি খুশ হুয়া হ্যায় রাহ কো পুরখার দেখ কর”গালিব
(পায়ের এই ফোস্কা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম/পথ ভর্তি কাঁটা দেখে মন খুশি হয়ে গেল)

শৈশব থেকে তখন কৈশোরে পা দেবার সময়। তার মধ্যেই জল জমি আর জংগলের ভাষা বুঝতে শিখে গেছিলুম আমি। সারা সারা দিন জংগলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঝাঁকর ইঁট তুলে চিংড়ি ধরি, গাছের কোটরে হাত ভরে পাখির বাচ্চা তুলে আনি। হঠাৎ কোথাও সমুদ্র কাঁকড়া দেখতে পেলে কায়দা করে ধরে ফেলি। খুব বেকায়দায় পড়ে গেলে কোমরের প্যান্টুন খুলে তা দিয়ে জাপটে ধরি মোটা মোটা দাঁড়াওয়ালা কাঁকড়া। তারপর তার দাঁড়া ভেঙে তাকে নিরস্ত্র করে আবার প্যান্টুন পরে নেই। এপারের জংগলে খটাস, বাঘরোল, শেয়াল তাড়া করি। সাপেদের গা ঘেঁসাঘেঁসি করে হাঁটি জংগলে। ইয়া বড় বড় খটাস! কী তাদের চেহারা! দিনে দুপুরে গাঙ বাঁধ পেরিয়ে মুরগি হাঁস ধরে দৌড়। আমরা রে রে করে তাড়া করতুম। অনেক সময় মুরগি হাঁস ছেড়ে জংগলে পালাতো খটাস। আমরা সেই মরা মুরগি হাঁস এনে নদীর ধারে রান্না করে খেতুম। শেয়াল বাঘরোল ছাগল ধরে চম্পট দিত। খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। যখন পাওয়া যেত তখন শিকারের মুণ্ডু ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকতনা। আমরা সেই কাটা মাথা এনে ছাল ছাড়িয়ে রেঁধে খেতুম সাবাড় ঘরের কাছে। তখন এরকম ঘন পাড়া ছিল না। এখানে একটা বাড়ি তো আধ মাইল দূরে আবার একটা বাড়ি। সন্ধে নামলেই রাস্তা ঘাটে লোকজন থাকতো না। সাপের ভয় তো আছেই, তার চে বড় কথা ভুতের কল্পকথা তখন গোটা দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছিল। দিনের বেলা ফাঁকা মাঠে যাবার সাহস ধরতো খুব কম লোকেই।
হাড়হাভাতে লোকেদেরকে ভুত খুব পছন্দ করে হয়ত। একদিন দুদিন বাদে এখানে ওখানে ভুত ধরার খবর পেতুম।উৎসাহ নিয়ে দেখতে যেতুম আমি শম্ভু আর নুনা।সে কী ভয়ংকর ব্যাপার! ভুতে ধরা লোককে বেঁধে রাখতে হত। তারপর গুনীন আসত। ঝাঁড়ফুঁক চলতো। কুস্তে দিয়ে মারা হতো ভুতকে। শেষমেশ ভুত ছেড়ে যেত। শ্মশান, বাড়ি আর হাঁটার জায়গা যদি অমন এক ও অদ্বিতীয় হয়, তো ভুত না ধরে উপায় কি? আস্ত দ্বীপটাই ছিল ভুতুড়ে। একেকটা রাত সেই দ্বীপে ভৌতিক বিভীষিকা নিয়ে আসতো।
সেসব অন্য কথা। যা বলছিলুম। আমাদের প্রজন্মটাই বোধহয় দ্বীপের সাহসী প্রজন্ম। দিন নেই রাত নেই, সময় নেই অসময় নেই আমরা জংগলে ঘুরছি। সাপের শংখ লাগা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। শ্মশানের আগুন দেখছি প্রবল কৌতূহল নিয়ে। সক্কাল সক্কাল হাজির হয়ে যাই গতকাল যে মড়া পোড়ানো হয়েছে সেই জায়গায়। কী দেখতে যাই, কী শুনতে যাই সে আমরা নিজেরাও জানতুম না। আমাদের বাড়ির উত্তর পাশের বাঁধ পেরোলেই একটা পুরোনো গেঁওয়া গাছ ছিল আর উত্তর পূর্ব পাশে ছিল একটা প্রকাণ্ড রাধা চূড়ার গাছ। এই দুই গাছে ভুত আর ব্রহ্মদত্তি দেখেনি অমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। শুধু আমি শম্ভু নুনা শ্রীকান্তদা, শংকর দা- আমরা কখনো দেখিনি। ভুত বোধ হয় আমাদের কিঞ্চিৎ সম্ভ্রম করতো। কেন করবে না? আমরা প্রকাণ্ড সব ঘুড়ি বানিয়ে ওই গেঁওয়া গাছে বেঁধেই ওড়াতুম। আমাদের সময় আমরা ঘুড়ি বানাতুম বাঁশের কঞ্চি দিয়ে, তার উপর খবরের কাগজ লাগিয়ে দিতুম বাবলা গাছের আঠা দিয়ে। সাবাড়ের জাল ব’য়ে বা খড়বোটের খড় ব’য়ে দিয়ে যে সিকি বা আধূলি রোজকার করতুম তাই দিয়ে সূতো কিনে ঘুড়ি উড়াতুম।ঘুড়ির উল্টো দিকে কায়দা করে কাগজের ভোমরা লাগিয়ে দিতুম। ঘুড়ি ভোঁ ভোঁ করে আওয়াজ করে উড়তো। তেমন ঘুড়ি এখন কেউ বানায় না আর।
যে কথা বলছিলুম। সাউদের সাবাড় চালাতো মন্টু সাউ। লম্বা চেহারা। মেয়েদের মত চুল। রাত ভিতে হাতে পাঁচ ব্যাটারি লাইট নিয়ে ঘুরতো। লোকটার অদ্ভুত শখ।দেশি মদ খেয়ে শ্মশানের পাশে গিয়ে বসে থাকতো সন্ধেবেলা। গাঙ বাঁধে ঘুরতো। একটা নৌকা বানিয়েছিল অদ্ভুতরকম। ছোট্ট একখান নৌকা। মেরেকেটে চার পাঁচজন বসতে পারে। নাম রেখেছিল ‘আহ্লাদি’। সে বৈঠা বেয়ে একা একা শ্মশানঘাটে চলে যেতো। গাছের সংগে নৌকা বেঁধে রেখে শ্মশানের কাছে বসে থাকতো বিভোর হ’য়ে। মরা গনে ( দ্বাদশি থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা অব্দি) দিনের বেলা নদীর পাড়ে উঠে জোরে ডেকে উঠতো ” জগাইইইইইইইইই! কাই গেলু রেএএএএএএএ, এদিকে আয়।” জগাইএর বাড়ী হাসনাবাদে। সে এখানেই থাকে। সাবাড়ে কাজ করে সারা বছর। সাবাড়ের একটা নোংরা ঝুপড়ি অন্ধকার ঘরে সে থাকে। ঘরের সংগে নিজের চেহারার অদ্ভুত মিল। বেঁটে, রোগা, ঘোর কালো তার গায়ের রং। আমরা তাকে জগাই ভুত বলে ডাকতুম। রাত বিরেতে তাকে দেখলে লোকে ভিরমি খেয়ে যাবে। সে মন্টু সাউর ডাক শুনে সাবাড় ঘর থেকে বেরিয়ে আসত। ” কী হয়েচে দা?”
আহ্লাদিকে খুল।
কুতাও যাবে দা?
হুম। আমি একলা না। তোকেও লিয়া যাবো শ্লা।
কুতায় যাবে দা?
খুল তো আগে শ্লা।
জগাই নৌকা খুলে বৈঠা ধরতো। মন্টু সাউ নৌকায় গিয়ে বসতো। তার হাতে একটা নাইলনের ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে কাঁচের বোতলে দেশি মদ, আর বোমলা শুঁটকির ভাজা। নৌকা মাঝ নদী অব্দি গিয়ে স্বাধীন হয়ে যেত। আর বৈঠা পড়তো না জলে। স্রোতের টানে যেদিকে ইচ্ছা আহ্লাদি ঘুরে বেড়াচ্ছে। নৌকার উপর মন্টু আর জগাই দেশি মদ খাচ্ছে শুঁটকি মাছের ভাজা দিয়ে। অমন করে ঘন্টার পর ঘন্টা নদীর বুকে দিশাহীন ঘুরে বেড়াতো খেয়ালি মন্টু।
আমরা ইতিমিধ্যেই দাঁড়, বৈঠা বাওয়া শিখে গেছি শুধু নয়, একপ্রকার দক্ষ হয়ে উঠেছি। মন্টু সাউ বেবাক দিলদরিয়া মানুষ। তার সাবাড়ের উঠানে গিয়ে দাঁড়ালেই চোখ তুলে বলতো, কীরে? কী লুবু?
তুমার আহ্লাদি।
কেনি? কাই যাবু?
কায়োনা, উমনি, একটু ঘুরবো।
যা, ঘাটে আছে, খুলিয়া লে।
আমি শম্ভু নুনা চড়ে বসতুম আহ্লাদির উপর। যে কেউ বৈঠা ধরে ফেলতো। কেউ জানে না কোথায় যেতে হবে। যে বৈঠা ধরতো সেও বোধ হয় জানে না। হাত আর আহ্লাদির ইচ্ছা যেদিকে হোত সেদিকেই যেতুম। ওপারে ঘন লুথিয়ানের জংগল। কখনো কখনো চলে যেতুম। তখন অত কড়াকড়ি ছিল না। যখন তখন ওপারে চলে যেতে পারতুম। লাল কাঁকড়া তাড়াতুম। ভাসান খালে কাদা বলে যেতে চাইতুম না আমরা। একটু দূরে বিশালক্ষ্মী খাল ছাড়িয়ে বালির খালে চলে যেতুম। চার দিকে শুধু বালি আর বালি। একবার গেলে ঘরে ফিরতে মন চাইতো না আর। নৌকাটা খালে ঢুকিয়ে দিয়ে খুঁটি পুঁতে বেঁধে দিতুম, তারপর গোটা চরের অধীশ্বর হয়ে উঠতুম। জংগলে ঢুকে যেতুম। একেকটা জংগল একেকরকম। কোনোটা শুধু বানী গাছের, কোনোটা শুধু হেঁতাল।

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–হেঁতালপারের উপাখ্যান(সপ্তম পর্ব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here