আফ্রিকার গল্প : ২

0
176

বুশরা আল-ফাদিল (সুদান)-এর লেখা

অনুবাদঃ কামারুজ্জামান

মেয়েটার পাখি উড়ে যাওয়ার গল্প

বাজারে হাজারো মানুষের অদ্ভুত ভিড়। ভিড় ঠেলে কোন ক্রমে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। শুধু স্যালাডের সব্জি কেনার মানুষ ছিল না, সেখানে ছিল ভিখারি, কষাই আর চোর, আর সামনের দু’পা তুলে লাফিয়ে বেড়ানো ঘোড়া, কিছু মানুষ নবির প্রশস্তি করে বেড়াচ্ছিল, ছিল কিছু উদ্ধত প্রকৃতির সেনা, কিছু নবাগত এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, তাদের থলথলে ও অক্ষম চেহারা। ফেরিওলারা ফেরি করে বেড়াচ্ছিল, রাস্তার বাচ্চারা ঘুনঘুন করে কাঁদছিল। কেউ ঈশ্বরের গুষ্টিতুষ্টি করছিল, কেউ বা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। ছিল সাদা পোশাক পরা ব্যবসায়ী, তারা মার্জিত ও কিছুটা বিমূঢ়। ভিড়ের মাঝে ছিল আমাদের নির্ব্বাচিত জন-প্রতিনিধিরাও, তারা তাদের দু’টো চোখ, হাত ও গোটা শরীর দিয়ে মেয়েদের পিছনে পড়ে ছিল, কামাত্মক দৃষ্টি বা খেয়ালি খোয়াবে বিভোর ওইসব অবিবেচক মানুষগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেয়েরা তাদের সামাল দিয়ে উঠতে পারছিল না।
আমি ঘুরপট্টি বাঁক ঘুরে পথ করে নিয়ে সেই ভিড় কাটিয়ে এলাম, রাস্তার একজন যন্ত্রণায় তার নিজের কাঁধটা খামচে ধরল, তারপর একটা ’মাফ কিজিয়ে’ ধরনের অজুহাত। তারপর একজন মহিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল চিপসে দেওয়ার পর ’ভুল হোয়ে গেছে’ বলে ক্ষমা প্রার্থনা। তারপর অন্য একজনের গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দেওয়ার পর ’গোস্তাগি মাফ’ বলে আবেদন। কাজেই আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার কী জবাব এল তার জন্য আমি আর অপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না।
আর পাঁচটা গরমের দিনের চেয়ে দিনটা ছিল বেশ ফুরফুরে। মাথায় লাগানো পাগড়িটার জন্য আমার কেমন যেন নিজেকে খুব খুশী খুশী লাগছিল, যেন কোনো বেদুইন নগরে দ্বিতীয়বার ভ্রমণে এসেছে। মহিলা কর্ম্মীরা কেউ আমার মতো সুখী ছিল না, বাড়ির বউরাও নয়। আমি সেন্ট্রাল স্টেশনের ছেলে, পকেটে মাকড়সা, মানে আমি ধনী! ঘাড় তুলে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা বা চোর ধরা পড়ার গোলমাল দেখি। আমি জেগেই ছিলাম, রাস্তায় নেমে এলাম। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছিল, যাকে বলে ’গরুর জালতি’ – সেখানে কাজের সন্ধানে এসে হতাশও লাগছিল। নিজের অস্থিরতাটা চেপে রাখলাম। নিপীড়িতের সন্তান নিপীড়িত – কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সুখী। কোন দুর্ভাগা আমার সুখ কেড়ে নিতে পারে? অসম্ভব। হেনতেন কিছু ভাবনা নিয়ে আমি ঘুরতে লাগলাম। আমার চাদ্দিকের লোকজন ডাঁই করা মানুষ-তরমুজ, প্রতিটা ডাঁই বাসের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি একটা ডাঁইয়ের দিকে পা’য়ে পা’য়ে এগিয়ে গেলাম এবং লাইনে দাঁড়ানোর যন্ত্রগুলো বের করলাম – একটা কনুই আর আমার হাতের তালু – এবং তারা সবাই মিলে আমার দিনের পর দিন ক্ষয়ে আসা এবং বছরের পর বছর ধরে অক্ষম হোয়ে আসা শরীরটা উঠিয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল। তারপর আমি চোখ দু’টো কটমট করে চেয়ে দেখতে লাগলাম … দেখতে লাগলাম … চাদ্দিক চেয়ে এবং যা দেখলাম জমিয়ে রাখলাম।
দেখলাম একজন অন্ধ তার সামনের দিকে চেয়ে তাকিয়ে আছে যেন সে একটা দৈব-পুস্তক পড়ে চলেছে যার আগে আর কোনো পুস্তকই লেখা হয়নি, সেই পুস্তক সবার নিয়তির পুস্তক। আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেটা সে নিজের কাছে ধরে রেখেছিল, কিন্তু তবুও আমি অনুভব করলাম আমার পকেটের পয়সা গায়েব হোয়ে গিয়েছে। তারপর একজন মহিলাকে দেখলাম. সে এতই মোটা যে যখন সে তার ছেলেকে ’ওই হিশাম’ বলে ডাকল, তার ’হ’-য়ের অনুরণন তার চর্বি দিয়ে শোনা যেতে লাগল। দেখলাম রুষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকা একজন লোককে, দেখলাম একটা ছেলেকে যে পা’য়ে করে একটা খালি টিনের পাত্র ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। দেখলাম বহু কণ্ঠস্বর, শুনলাম অন্তহীন খুশবাই, এবং তারপর আমি এত কিছুর মাঝে মেয়েটাকে দেখলাম, হঠাৎই। দেখলাম দরবেশটা আমার বুকের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠল। আমি মেয়েটাকে দেখলাম: পাখায় দোলা না দিয়েই সে অন্তরীক্ষের উচ্চতায় উড়ে চলেছে। তার গায়ে গমরঙ – আমরা যেমন দেখি তেমন নয়, গমই যেন তার গায়ের রঙ নিজের গা’য়ে মিশিয়ে নিয়েছে। সৈনিকের মতো তার দাম্ভিকতা। মানুষের অন্তরের মতোই তার অন্তর। তাকে বারবার দেখলেও কারুর তৃপ্তি মিটবে না, কখনই।
আমি নিজের মনে বললাম, ’এই সেই মেয়ে যার পাখিরা উড়ে পালিয়েছে।’
তার মুখটা গোল, ঠিক এইরকম দেখতে:

তার নাকটা তাজা সব্জির মতো আর আহা কী তার চোখ দু’টো! ফারাওদের মতো ঘাড়টা, দু’দিকে শক্ত দড়ির মতো মসৃণ চুল, মাথাটা ঘোরালেই তবে চোখে পড়ে। এবং যখন সে তার মাথা ঘোরাল, আমি ভাবলাম যেসব মহিলারা সেদ্ধ কড়াইশুঁটি আর নুন মাখানো সূর্য্যমুখী ফুলের বীজ বিক্রি করছে তারা বুঝি পালিয়ে যাবে, গোটা রাস্তায় যেমন নোংরা ছড়িয়ে ছিল তেমন রেখেই ছুট দেবে, যেখানে মাংস বিক্রি হচ্ছিল সেখান থেকে রক্তের আঁশটে গন্ধ ভেগে যাবে। আমার ভাবনা দূর ভবিষ্যতে ভেগে যাচ্ছিল যেমন আমি চাইছিলাম। কেউ যদি তার মাথার মুকুটে জল ঢেলে দিত, তবে তা তার কপাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ত। সে ঢেউয়ে ঢেউ তুলে হেঁটে যাচ্ছিল, তার শরীরটা যেন একটা তুরপুন, কাঠের রশিগুছির মধ্যে দিয়ে পাক খেয়ে চলেছে।
সে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম। নিজেকে ধাতস্থ করে তুললাম। যখন সে আমার আরও কাছে এসে পড়ল, আমি দেখলাম সে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছে, সবদিক দিয়ে তাকে দেখতে ঠিক তার মতো, তবে তার মধ্যে শিশুর মতো তুলতুলে একটা ভাব। তাদের হাত দু’টো একসঙ্গে জোড়া, যেন তাদের ওইরকম নিখুঁতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেন তারা একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে চায় না। তারা দু’জনই উদাসীনের মতো চোখ কুঁচকিয়ে তোলে, এমনই যে চোখগুলো তখন দপ করে জ্বলে ওঠে – তাতে মনে হয় তারা যেন তাদের চারপাশের বুভুক্ষু দৃষ্টি থেকে তাদের মুখগুলো ধুয়ে নিতে চায়।

’এই সেই মেয়ে যার পাখিরা উড়ে পালিয়েছে,’ আমি বললাম।
আমি তার বোনের দিকে ঘুরে বললাম, ’এই যে তাবিজটা ও নিয়ে এসেছে নিশ্চয় তা অশুভ শক্তির ভূতকে ভাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কী অদ্ভুত বেগে তার শান্ত ভাবটা তার তালু থেকে উড়ে পালালো।’
যতক্ষণ না নিজেকে তাদের তুলনায় জঘন্য বলে মনে হোল, আমি তাদের দিকে তাকিয়ে চেয়ে রইলাম। এটাই আমাকে আশ্চর্য করে তুলল। তাবিজটার দিকে আমি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকালাম। কী অনুপম ও নিখুঁত তার মুখের চেহারা, যেন সে জীবনে কখনো ওকরা স্ট্যু খায়নি – সেটাই ক্রমশঃ আমাকে বিষাক্ত করে তুলছিল। চারপাশ তাকিয়ে নিয়ে আমি ফিরে আবার তাদের দিকে তাকালাম, তাকিয়ে রইলাম, তাকিয়ে রইলাম – ওহ, কীভাবে আমি তাকিয়ে ছিলাম! – ততক্ষণে মন্থর গতিতে একটা বাস এসে থেমে পড়েছিল এবং হঠাৎ করেই দিনটার একটা গতি হয়েছিল। যদিও এটা তাদের রীতি নয়, লোকজন অপরিচিত ওই দু’জন মেয়েকে পথ করে দিল এবং তারা হপ করে লাফিয়ে তাতে চড়ে বসল। দরজার পাশে হুড়োহুড়ির কারণে ধুলো উড়ছিল, তারই মধ্যে দিয়ে আমিও কখন বাসে উঠে পড়েছি।
আমরা হুড়মুড় করে এগিয়ে চললাম। আমার পাশের লোকটা ধূমপান করছিল এবং তার পাশের লোকটার মনে হোল সে বুঝি পেঁয়াজের গাদায় ঠেসে গিয়েছে। দিনটা যদি না ফুরফুরে হোত আর সেই মেয়েটা ও তার তাবিজ এবং আগেই বলা তার সৌন্দর্য্যরে পরশ না থাকত, আমি মাফ না চেয়েই সেই লজঝরে বাস থেকে নেমে পড়তাম। পাঁচ মিনিট পর পেঁয়াজগন্ধ লোকটা গম্ভীর স্বরে চালককে বলল, ’আরে ইয়ার, থামাও, আমি এখানেই নামবো।’
সে নেমে পড়ল এবং দরজাটা এমন দড়াম করে বন্ধ করল যে মনে হোল তাদের দু’জনের মধ্যে বুঝি হিংসাহিংসি করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। চালক তার ডান গালটা ঘষল যেন দরজাটা দড়াম করে তাকে এসে ধাক্কা দিয়েছে। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল, ’মানুষের দয়ামায়া বোলে কিছু নাই।’
পেঁয়াজগন্ধ লোকটা পিছন ফিরে চোখ পাকিয়ে চালকের দিকে তাকাল। ’কী?’ লোকটা রেগে উঠে বলল, ’কী, কী বললে তুমি?’
’দোহাই তোমার, আরে যাও তো,’ চিৎকার করে আমি বললাম। ’ও তোমার কথা বলছে না।’
বাসটা ছাড়তেই পেঁয়াজগন্ধ লোকটার অপমান ও খিস্তি মটোরের ঘ্যান ঘ্যান আওয়াজের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল। চালক যেন আমাদের উত্যক্ত করতে চেয়েই নিজের মনে বকবক করে চলল, ’মানুষ এক একটা জন্তু…’। ঘটনাটার জন্য সে মানব-চরিত্রকে দোষারোপ করল, হেনতেন বলে, এইভাবে চলল তার খিস্তি-খেউড় আর অভিশাপ যতক্ষণ না আমরা বড়ো রাস্তার একটা খন্দে এসে ধাক্কা খেলাম। বাসটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠল, গ্যাঁক গঁক করতে লাগল যতক্ষণ না সে তার হাওয়া বের করিয়ে দিল এবং গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করাল, তারপর ’জামজারা জামজারা’ বলে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করল।
বাসটার নিষ্ঠুর চলনে আমার পিঠে ব্যথা করতে লাগল। কিন্তু যখন আমি মেয়েগুলোর দিকে ফিরে তাকালাম, আমি অনুমান করলাম তারা ঠিক আসনের আকার গ্রহন করেছে, কারণ মনে হচ্ছিল তাদের কিছুই হয়নি, হাড় থেকে তাদের মাংসে কম্পন ওঠেনি। অবশেষে আমরা গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম। তারা নেমে পড়ল, আমিও তাদের পিছনে নামলাম। সবাই শুনতে পেলেও আমি তাদের পা’য়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম না, তাদের পা’য়ের আওয়াজ আমার পা’য়ের আওয়াজে চাপা পড়ে গিয়েছিল। আমি প্রায় কান খাড়া করে ছিলাম। তারা কি লম্বায় বেড়ে গিয়েছিল? আমি তাদের পিছনে চলতে লাগলাম। এটা সুদানের রাস্তা নয়, তাদের দেখতে পাওয়ার আগে আমি অন্যান্য পথচারীদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম। তবুও মনে হচ্ছিল তারা আমার ভাবনার ছন্দকে অনুসরণ করে চলেছে, আমি নিজের মনে বললাম, তারা আগেই চলুক। ছন্দ সুরকে সঙ্গত করে চলারই কথা। তারা সামনেই চলেছিল, অসীম মঞ্জিমার সঙ্গীত বিস্তার করে, আমি তাদের পিছনে – বিভ্রান্ত, উতলা বেতালা।
হঠাৎই তারা ঘুরে পড়ল, সুন্দর, ভাষাতীত রোষের রঙে রাঙানো তাদের মুখগুলো।
বড়জন বলল, ’কী ব্যাপার তোমার? তুমি আমাদের পিছু নিচ্ছো কেন?’
’না, না, বোন আমার,’ আমি বললাম, তাদের রোষের রশি আলগা করে দিতে। ’আমার ঠিক তোমার মতো একজন সুন্দরী আছে। আর আমি সেই ধরনের নই যে হাতে রাইফেল নিয়ে রাস্তায় সুন্দরীদের পিছনে ধাওয়া করে বেড়াবো।’
’আমরা হাজারবার এইসব কথা শুনেছি,’ সে বলল।
’তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না। আমি বলতে চাইছি যে আমার আগে থেকেই একজন মেয়েবন্ধু আছে। আমি তাকে ভালোবাসি আর সে-ও আমাকে ভালোবাসে। আর আমার উটটাও তার উটনীকে ভালোবাসে। [১] হাজারবার আমি তার রোষে পড়েছি, হাসি মুখে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছি। মনে হয় যেন সে আনন্দের কারখানায় বাস করে। আজ সকালে তাকে এমন ভরপুর করে নিয়ে ছেড়ে এসেছি যে রাস্তার লোকেরা আমাকে শুনিয়ে সিটি মারছিল।’
হাসির বদলে মেয়েটার গলা থেকে একটা বিশুদ্ধ স্বরগম বেরিয়ে এল যার পাখিগুলো উড়ে গিয়েছিল। তারপর আমরা নির্বাক হয়ে পড়লাম।

আমার মন আমার প্রেমীর স্মৃতির দিকে ফিরে এল। কী আফ্রিত শয়তানই না সে ছিল! [২] এতই নিশ্চিন্ত সেই মেয়ে, এতই সে প্রত্যয়ী। একবার যখন চরম গরমি কাল, আমরা গানের জলসা থেকে ফিরছি, সে আমাকে বলল: ’আমার নানি এমন সুন্দরী ছিলেন যে সুরর নিজে এসে তাঁকে গান শোনাতেন। [৩]
’সুরর ও অন্যান্য গায়করা ধীরে ধীরে হাকিবা কবিদের কাছে হেয় হয়ে যাচ্ছিল।’ [৪] আমি তাকে বললাম, ’যতদিন না তারা সুরেলা জোশ ও নোংরা কথায় মোহিত হোয়ে অনুতাপ, ক্ষোভ ও দ্বিধায় দোলায়িত হোয়ে উঠেছিল।’
’তুমি কী বলতে চাইছো?’ সে জিজ্ঞাসা করল।
’তাদের কবিরা কষাইয়ের মতো পাউন্ডের দরে মেয়েদের বিক্রি করে। যখন কেউ কষাইয়ের দোকানে যায় সে ”সিনা! সিনা! গাল! গাল!” বলে চিৎকার করে গান গাইতে শোনে। কাজেই সে তার পছন্দের টুকরোর দিকে না তাকিয়ে মেয়েদের অঙ্গগুলোই খুঁজে বের করে, তখন যাতে না সে ভুল করে সেই কণ্ঠস্বর তার সৌন্দর্য্যরে অংশগুলোর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। সে পেঁয়াজের সঙ্গে সিনার মাংস বা আরগুলা মেশানো পাঁজরা, আর বাড়িতে অতিথি থাকলে আস্ত রানটাই কিনে নিয়ে যায়।
আমার প্রণয়িনী বলল, ’ছাড়ো ওসব নোংরা কথা। জিভ সামলে কথা বলো। তোমার কি মনে নাই যে গায়কদের মধ্যে খলিল ফারা [৫] ছিলেন?’
সে আমাকে হতবাক করে দিল। সেটা নিশ্চয় নতুন করে ফিরে আসা আমার একটা খোয়াব ছিল কারণ যখন আমি এদিক ওদিক চেয়ে তাকালাম, যার পাখি উড়ে গিয়েছিল সেই মেয়েটা বা তার বোনের কোনো হদিশ খুঁজে পেলাম না।
আমি আমার বোধকে তালাশ-যন্ত্র করে তুললাম। আমার দু’টো কান দু’টো শব্দযন্ত্র হোয়ে উঠল, চোখ দু’টো দু’টো ক্যামেরা, নাকটা একট রসায়নাগার, এবং জিভটা একটা সম্প্রচার যন্ত্র। তালাশ-যন্ত্র নিখুঁতভাবে কাজ করে চলল যা আজকাল আমাদের কারখানায় তৈরী কিছুর মতোই ছিল না। সেখান থেকে আমি পরিস্থিতি নিরীক্ষণ করতে লাগলাম একটা ইঁদুরের মতো – নিজেকে রক্ষা করার জন্য বহু-পুরানো শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রেখে চলে। কিন্তু তখন আমি মেয়েটার রাডারে ধরা পড়ে গেলাম। আমি আমার গতি বাড়িয়ে দিলাম, সে আমাকে অপমান করবে এই ভয়ে। কিন্তু সে আমার পিছনে ধেয়ে এসে বলল, ’কেন আমাকে নির্যাতন করছো? তুমি কী চাও?’

’কিচ্ছু না,’ আমি বললাম, ”শুধু তোমাকে দেখতে চাই। চাই তোমাকে নিয়ে গান করতে। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ! তোমার আমার মাঝে যন্ত্রণার কোনো কারণ নাই। সন্দেহ নাই এটা নিছকই একতরফা আকর্ষণ, কারণ তোমার মতো একজনের প্রতি আমি অনুরক্ত। তার সামনে পড়ে আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি হয় … হীনমন্যতা।’ শুনে মেয়েটা হাসল এবং আমাকে যাচাই করে দেখল যেন আমার অদ্ভুতত্বটা কী তা চিহ্ণিত করতে পারার অভিলাষে। তাই আমি নাছোড় হয়েই বললাম:
’তুমি লোহিত কণিকা দিয়ে তৈরী, তাই তো? আর তোমার হৃদয়টা ছিল শুধুই একটা গোলাপ যার উপর দিয়ে একটার পর একটা বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে চলার কারণে নিজেকে তার মধ্যে পাপড়ি গুটিয়ে নিয়েছে?’
সে হাসল, আবার। এবং আমার হৃদয়ে পরম-প্রাপ্তি ও আনন্দের অনুভূতি ঝরে পড়ল তুষাার পাতের সান্ত্বনার মতো।
’তুমি কবি?’
’লোকে তো তাই বলে,’ আমি বললাম, পরে বললাম, ’তুমি কী কোরে জানলে?’
’আমরা শুনেছি,’ সে বলল।
’তোমার সঙ্গে কে এমন থাকে যে তুমি নিজেকে বহুবচনে সম্বোধন করলে? কেন, তোমার মুখ মসৃন, তোমার কণ্ঠস্বর মসৃন, আমার চোখের জলে ভেসে থাকা তুমি একটা আলোকিত আরশি, তাই আমি কাঁদি।’
’ভারী সুন্দর,’ সে মুখ শুকিয়ে বলল। ’আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম কিন্তু এবার বুঝি সত্যটা বেরিয়ে এলো। তুমি তো আজকালকার যুবকদের জানো – বড়ো বেহায়া – কাণ্ডজ্ঞানহীন।’
’কিন্তু তার গভীরে যাও, মূল্যবান ধাতু খুঁজে পাবে যা বাইরে পাওয়া যায় না,’ আমি বললাম। ’পিঁপড়ের চেয়ে আমার দোস্ত সংখ্যা অনেক বেশী, তাদের অধিকাংশই বোঝে, তাদের বোঝাও যায়।’
যে-মেয়েটার পাখি উড়ে গিয়েছিল সে আনন্দের জোশে লাফিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। সে অদৃশ্য হয়ে পড়া পর্যন্ত তার আকার আকৃতি আন্দোলিত হোতে থাকল, তার ঘন্টির রুমঝুম মিস্টি ধ্বনি আমার কানে এখনও বেজে চলেছে। তার চোখ দু’টোর প্রতিচ্ছবি আমার মনে রয়ে গিয়েছে – উজ্জ্বলতর থেকে নিভু নিভু, নিভু নিভু থেকে আবার উজ্জ্বল। তার মুখটা এখনও আমার আনন্দের স্মৃতিতে পুষ্ট হোয়ে আছে। তার পাখিরা উড়ে গিয়েছিল, দূরে। দূর থেকে দূরে। আরও দূরে।
এবং ঠিক এইভাবে আমরা বন্ধু হোয়ে উঠি। পুরো একমাস ধরে আমাদের সাক্ষাত ঘটতে লাগল। কখনো এ রাস্তায়, কখনো ও রাস্তায়। লাফালাফি, হাসি, কথাবার্তা – তার গভীরতা ঠিকভাবে যাচাই করতে না পেরেও – আশঙ্কা হোতে লাগল যে সে শুধু আমার বাইরেটাই ছুঁতে পেরেছে। আর তাই এক বুধবারে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম:
’তোমার ডাইনে ওই ছোট্ট মেয়েটা কে?’
’আমার বোন,’ বলল সে। ’বাজারে বের হলেই ওকে আমার দরকার হয়। সে আমাকে গাড়ির অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা করে।’
’তাবিজ?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
’কী?’ সে বলল।
’একটা মাদুলি বা পূতমন্ত্রের মতো। সে তোমাকে ঈর্ষার চোখ থেকে রক্ষা করে, তাই না?’ তারপর আমি নিজের মনে বললাম: মৃত্যু যদি ইতিমধ্যেই তার নখরদন্ত বিস্তার করে, তবে কোনো তাবিজই কাজে আসবে না। আমি বহুক্ষণ ধরে সুন্দর মেয়ে দু’টোর দিকে চেয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছোটোটা গুটিয়ে পড়ল, জলযানে একটা ষাঁড়ের মতো তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হোয়ে এল। সন্দেহ নাই যে তার অন্তহীন গার্হস্থ্য কর্ম্ম তাকে তার বয়সের সামনেই বাড়িয়ে তুলেছে। আমি আবার তাদের সঙ্গে বাসে চড়লাম। যাত্রীদের চোখগুলো কাচের করাতের মতো যুবতী মেয়েদের নিতম্বে, চোখে ও মুখে ঘুরঘুর করে উড়ে বেড়াতে থাকল। আমি ঘাড় ঘোরালাম। আমার চতুর্দিকে যাত্রীদের মুখবিহ্বর নুনের খালি পাত্রের মতো হাঁ হয়ে আছে। তাদের চোখগুলো পাখা মেলে দিয়েছে, প্রত্যেকের মুখে শুধু দু’টি গর্ত – বিবর। আমার চশমা আমার চোখ দু’টোকে আটকে রাখতে পারত, কিন্তু আমার সহজাত উৎসুক ভাবকে ধরে রাখতে পারল না। পরিসংখ্যান নিতে গিয়ে আমি গভীর আনন্দ উপভোগ করলাম: গুণে দেখলাম তাদের শরীরে মোট নিরানব্বইটা চোখ, একটা বিজোড় সংখ্যা আমার মনে একটা অদ্ভুত ভাবনা সৃষ্টি করল, চারপাশে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম একটা লোকের শুধু একটা মাত্র চোখ।

রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার কাগজপত্র হাতড়ে আমি যা খুঁজছিলাম শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলাম। আমি তক্ষুণি ফিরে যাওয়ার ঠিক করলাম। তখন মধ্যদিন, দুপুরবেলা। সূর্য্যটা তখন কটকটে চোখ নিয়ে জেগে। আমি ক্ষিপ্ত হোয়ে উঠলাম। বাসের দরজাটা কচুকাটা পাকস্থলির মতো খোলা। আমি প্রবেশ করলাম। ভিতরটা নোয়ার আর্কের মতো। সব মুখই কল্পনা করে নেওয়া যায়। সব ধরনের মানুষ। একবার আসন নিলে খুব সহজেই মনকে অন্যদিকে সরিয়ে সুরুৎ করে খোয়রি খোয়াবের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায়। আমি বসে পড়লাম এবং আস্তাবল থেকে আমার পাথুরে ক্ষুরের মদ্যা ঘোড়াগুলোর লাগাম খুলে দিলাম যাতে তারা আমার কল্পনা ও আজব জগতের তৃণভূমি জুড়ে যথেচ্ছ ছুটে বেড়াতে পারে।
আমি যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। যেন সেই শক্তিটা হঠাৎ করে উবে গিয়েছিল। আমার ভাবনা আমার দিকে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। চিৎকার করতে লাগল। আমার দু’টো চোখ কিম্বা অন্য কারুর চোখ আমাকে জাগিয়ে তুলল না। আমি জমে উঠতে থাকা বরাদ্দ খাবার, ধূমায়িত পিরীচের সন্তান হয়ে উঠলাম, কিন্তু তারা আমাকে জওয়ার ও দুধের বদলে হতাশায় ভরিয়ে দিল। [৬] পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আমি অন্যদের আনন্দে ভরিয়ে দিলাম, কারণ আমার নিয়তি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল কিন্তু অন্যদের নিয়তি এর থেকে ভালো ছিল (আর সেটা তাদের পক্ষে অনুকূলই ছিল!) মনে হচ্ছিল যেন আমি তাদের অস্তিত্বের জন্যই সৃষ্টি হয়েছি, এবং তাদের অস্তিত্ব আমাকে নিছকই জুলুম করার জন্য।
আর, হ্যাঁ, আমি নিদ্রার অচেতন সন্তান, আমি দীর্ঘ পূর্বাভাস ও অপূরিত প্রতিশ্রুতির সন্তান। আমার স্মৃতিতে বিরাজমান শুধুই একজন প্রেমপ্রিয়া এবং কামনা। আমার মতো কেউ শুধু তার মতো কারুর জন্য আশা করে যায়। এবং তার মতো কেউ আমার মতো কারুর দ্বারা কখনই তৃপ্ত হোতে পারে না। তো, আমি ঠিক কার মতো? তুমি একটা গরু, আমি নিজেকে বললাম, তুমি একটা পশু। একজন মানুষ যে রোগে ঠাসা, ব্যাকটিরিয়ার বাসা, যার রূপান্তর ঘটে, যে ঝাঁকুনি খেয়েই চলে, যার প্রবল উত্থান এবং ধপাস পতন। যেসব মেয়েরা সুখের সন্ধানে তার চতুঃষ্পার্শ্বে এসে দাবি ওঠায় তারা শুধু চাবুক খাওয়ার মর্মযন্ত্রণা খুঁজে পায়। যারা একজন বন্ধুর সন্ধান করে সে তাদের সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করে, এবং যেসব মেয়েরা তার চারপাশে এসে ভিড় জমায় তাদের পাখিরা সেই কবে উড়ে পালিয়েছে – এবং তবুও কোথাও এমন কিছু নাই যার জন্য সে কলরব করে যায়। এতসব সত্ত্বেও, সে দাবি করে যে একমাত্র সে-ই সেই জন যে বোঝে, যে জানে, যে লড়াই করার পথ বেছে নিয়েছে, বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
আমার হতাশ অবস্থায় ফিরে এসে আমি বুঝতে পারলাম আমি এখনও সেই লক্কড় বাসেই পড়ে আছি। চারপাশের লোকজন অন্যদের কথায় নাক গলিয়ে বাদানুবাদ করে চলেছে, মেয়েদের আসন ছেড়ে দিতে চাইছে না, আর মেয়েরাও অভিধানে লেখা দু-পাঁচ কথার গালমন্দ শুনিয়ে দিতে ছাড়ছে না। বাগেতি আসার আগেই আমার নেমে যাওয়া দরকার ছিল। যখন আমি তাই করলাম, দেখলাম উৎসুক মানুষের স্রোত হাসপাতালের দিকে ছুটে চলেছে। আমিও তাদের চেয়ে কম উৎসুক ছিলাম না। কিন্তু সম্ভবতঃ আমার ঔদ্ধত্য ছিল আরও বেশী। আমার প্রতিটা অভিব্যক্তি ও বিস্মিত ভাব নিঃশেষ হয়ে আসার পর আমি জনতার স্রোতেই বয়ে চললাম।
’কী ব্যাপার?’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা একই ধরনের জিজ্ঞাসার হট্টগোলে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কয়েককটা ব্যাখ্যা ছুটে এল আমার মনে। প্রতিটার সঙ্গে প্রতিটা অসম্পর্কিত। একসঙ্গে মিলে কিছুটা আঁচ করে নেওয়া যায়, বাকিগুলো ধর্তব্য নয়। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিল তাদের জবাবে কাজের কাজ কিছু হল না, আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে দিল শুধু, সামনে মানে আমার ঔৎসুক্যের উৎসের দিকে। ঘূর্ণাবর্তর আশপাশের জনতায় আমি ভেসে গেলাম, কাছে, আরও কাছে এসে আমি আর্তনাদ করে উঠলাম –
’রক্ত!’
মনে হচ্ছিল যেন একটা ক্ষুর আমার চোখ থেকে আলো কেটে নিয়েছে। যেন আমার মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। একটা রক্তস্নান। একটা স্নান যার বর্ণ রক্ত এবং সংঘর্ষ। তাবিজে রক্ত আর আতঙ্ক মেশানো। মেয়ে দু’টোর রক্তও সেইরকম – হেনার রঙ। খুনিদের মতো তাদের হাতে রক্ত, এবং পা দু’টো খুন হয়ে যাওয়ার মতো, এখানে, ওখানে সর্ব্বত্র, বোঝা যায় না কোথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। আমি চিৎকার করে উঠে বললাম: ’নিশ্চয় গাড়ি দুর্ঘটনা।’
’না, তা হোতে পারে না,’ বলে উঠল গোল মুখওলা উত্তেজিত একজন।
’তাহলে কী?’ আমি নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করলাম। মুখ হাঁ করে থাকা বাকি দর্শকদের সঙ্গে আমিও একজন শান্ত কন্ঠের ছেলেটার দিকে ঘুরে তাকালাম। ’ওরা সাগরের তীরে ছিল,’ সে বলল। ’কুণ্ডলি পাকিয়ে এইরকম অজ্ঞান হয়ে ছিল। একজন মোটাসোটা মানুষই তাদের দেখে পুলিশে খবর দেয়।’
’এটা গাড়ি দুর্ঘটনা,’ আমি চিৎকার করে বললাম।
আমার এক প্রতিবেশী ঘটনাক্রমে জনতার মধ্যেই ছিল, ’তুমি কি পাগল হয়েছো?’ সে আমার দিকে ঘুরে বলল, ’সাগর তীরে পথ দুর্ঘটনা? এটার কী মানে দাঁড়ায়? একটা নৌকোর সঙ্গে তারা ধাক্কা খেয়েছে? না কি পানি থেকে একটা মাছ লাফিয়ে উঠে তাদের ঝাপ্টা মেরেছে?’
এটা একটা পথ দুর্ঘটনা, কোনো সন্দেহ নাই, আমি নিজের মনে বললাম। তারপর অগত্যা আমি চওড়া রাস্তার দিকে ঘুরে তাকালাম। হাসি মাখানো আর্তনাদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সকৌতুকে আমার নসিহৎ শোনালাম: ’না, না, না। না! তার পাখিরা উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল! তার পাখিরা উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল! উড়ে … পালিয়ে … গিয়েছিল…’
কিছু পথিক যেতে যেতে আমার দিকে চেয়ে তাকাল, মাথা ঝাঁকাল, ভাবল আমি নিশ্চয় একটা পাগল। তারপর তারা যে যার কেটে পড়ল।
’উড়ে … পালিয়ে … গিয়েছিল।’
একজন তার গাড়ি নিয়ে এসে থামল। হাসতে হাসতে তার গলার শিরা ফুলে উঠল এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ’কী উড়ে গিয়েছিল?’
’তার পাখিরা…’ আমি জবাব দিলাম।
চালক হাসতে লাগল যতক্ষণ না তার হাসির উচ্ছ্বাসে রাস্তার পিচ নুড়ি পাথর সব কেঁপে উঠল। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হল। গাড়ি থেকে একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সে ইঞ্জিন চালু ধাঁ করে ভেগে পড়ল।

উড়ে … পালিয়ে … গিয়েছিল… এটা হতে পারে? এটা নিশ্চয় কোনো শক্তি তাদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। কোনো ধরনের ছলনা, কিম্বা কোনো ধরনের ধৈাঁকাবাজি। আমি কি তাদের মুখে কোনো ভয বা ত্রাস দেখতে পেয়েছিলাম? তাবিজের ত্রাস এবং মেয়েটার মর্মাঘাত যার পাখিরা উড়ে গিয়েছিল? না … সে এসে নামল … নামল … এসে নামল।
একদল জনতা আমার পাশে এসে ভিড় করল। তারা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল যেন আমিই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তাদের দিকে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম: ’ওরা উড়ে পালিয়ে গিয়েছিল! সে উড়ে পালিয়ে গিয়েছে!’ কিন্তু রাস্তার নুড়ি পাথর পিচ আমার সামনে ছড়িয়ে পড়ল। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটা আর হাঁটা। কী দুর্বিষহ দিন! আমি আমার স্বপ্নের উৎসে পৌঁছুতে পারিনি, বাড়িতেও না। নদীটা খুব কাছেই, প্রেমীদের চোখ ভরসা যোগায়। তাই আমি সেখানে যাওয়াই ঠিক করলাম। সম্ভবতঃ নিজেকে নির্মল করে নেওয়ার জন্য কিম্বা তাদের চোখের তারার অন্ধকারে মাথা পেতে তাদের পীনোদ্ধ শুভ্রতায় ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। সে আমার শূন্যতা ভরিয়ে দিল এবং আমার নিয়তিতে যা ঘটে গিয়েছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ঘুম থেকে জেগে উঠল। [৭] যতকাল পর্যন্ত নিরীহ পাখিরা পাথরের ঘা’য়ে ও স্বার্থপর কামনায় নিহত হতে থাকবে, তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এইরকম জঘন্য নোাংরা জায়গায় নেমে আসবে, কখনো সখনো হিংসা ও ঘৃণার পূর্ণতা নিয়ে।

তথ্য


১. প্রাক-ইসলামী যুগের কবি আল-মুনাখখাল আল-ইয়াসকুরি (৫৮০-৬০৩) রচিত একটি দ্বিপদী কবিতা।
২. সুদানি পুরাকথার এক বর্হিজাগতিক দুষ্ট জীব।
৩. আল-হাজ-মোহাম্মদ আহমেদ সুরর (১৯০১-১৯৪৬) আধুনিক সুদানি সঙ্গীতের একজন প্রতিষ্ঠাতা।
৪. ১৯২০ দশকে হাকিবা ধারার সঙ্গীত ও কবিতার উদ্ভব ঘটে যাতে কবিতার আধুনিকতা যৌনাত্মকতার সপক্ষে সওয়াল করা হয়।
৫. খলিল আফান্দি ফারা (১৮৯৪-১৯৩২) একজন উপনিবেশবাদ-বিরোধী কবি ও রাজনৈতিক কর্মী।
৬. জওয়ার ও দুধ দারফুর, দঃ কর্দোভান ও হোয়াইট নাইল প্রদেশের উপাদেয় খাদ্য।
৭. আল-মুতানাব্বি রচিত একটি প্রশস্তি কবিতার একটা লাইন যা তাঁর পৃষ্ঠপোষক সাইফ আল-দাউলার উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here