কবিতা কি, কবিতা কেন– দু র্গা প দ চ ট্টো পা ধ্যা য়-র প্রবন্ধ

0
85
পরিচিতিঃ প্রবন্ধকার ও গবেষক দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে রাঢ় মাটির দেশ বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ৷ গ্রামের নাম তেলেন্ডা ৷ চাকুরী ও রবীন্দ্র অনুসন্ধিৎসা নিয়ে কলকাতায় আসেন সত্তরের দশকে ৷ লেখালিখির সেই শুরু ৷ ‘ বর্তমান ‘ সংবাদপত্রে ধারাবাহিক ও রেডিও নাটক দিয়ে লেখালিখির হাতেখড়ি ৷ লেখক এ যাবৎ চল্লিশটির বেশি বই লিখেছেন ৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে ‘ নরবলির ইতিহাস ‘, ‘ রামায়ণের বাল্মীকি ‘, ‘ সংস্কৃত সাহিত্যে বারাঙ্গনা ‘, ‘ অজানা অচেনা মহাভারত ‘, ‘ মিথ্রিডেটিজম ও ইতিহাসের বিষকন্যা ‘, ‘ শরৎচন্দ্রের জীবনে নারী ‘, ও রবীন্দ্র- বিষয়ক গ্রন্থ – ‘ রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির ইতিবৃত্ত ‘,’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু চেতনা ‘, রবীন্দ্রনাথের বিষাদযোগ ‘, ‘ অচেনা রবীন্দ্রনাথ ‘, অচেনা অজানা রবীন্দ্রনাথ ‘, ‘ রবীন্দ্রনাথের বিবাহবাসর ‘, ‘ রাণুর রবীন্দ্রনাথ ‘, ‘ রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান ‘ ও শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু রহস্য বিষয়ক ‘ শ্রীচৈতন্য : অনন্ত জীবনের সত্যাণ্বেষণ ‘, ( দে’জ পাবলিশিং সং ও ‘ Storytel ‘ নির্মিত ওডিও বুক ) বইগুলি ইতিমধ্যে বিদ্বৎসমাজে সমাদৃত হয়েছে ৷ সাম্প্রতিক প্রবন্ধটিতে লেখক আধুনিক কবিতার পরাবাস্তববাদ ( Surrealism) প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করেছেন । বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ পাঠকদের জন্য তাঁরই একটি প্রবন্ধ।

 

দু র্গা প দ   চ ট্টো পা ধ্যা য়-র প্রবন্ধ

 

কবিতা কি, কবিতা কেন

কবিতার সাথে ইচ্ছে বা অনিচ্ছার কোন সংপৃক্ততা নেই। আবার একজন কবির নির্ণায়ক ভূমিকায় একটি অবয়বী কবিতার জন্ম বা মৃত্যু হয় – এরও কোন বিধিবদ্ধ নিশ্চয়তা থাকেনা। তাহলে কবিতা কি। কবিতার রিয়ালিটি কেমন। কোন অবস্থিতির ওপর কবিতার রিয়ালিস্টিক দাঁড়িয়ে আছে। আসলে কবিতা হল এক লোকাতীত ঘটনাক্রম – তো আমারা যাকে ‘ইউটোপিয়ান’ বলি। শাব্দিক কিন্তু নীরব। অনেকটা সম্মোহিত অসাড়তার মতো এক স্বগতোক্তি। যেন এক কস্তুরী হরিণ। আর এই অশ্রুত গন্ধের মধ্যে কবিতার অব্যক্ত ‘প্রোটোপ্লাজম’ দাঁড়িয়ে আছে। জ্বরের যেমন ক্যালপল কবিতার তেমনই Myth। তুমি কতটুকু Mith জানো, legend জানো, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী জানো, তার ওপর নির্ভর করছে কবির নির্মাণ ডিঙিয়ে তোমার কবিতা হওয়ার সার্থকতা।

গ্রিক শব্দ ‘মিথস’ (Myths) থেকে ‘মিথ’ (Myths)শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অলৌকিক গল্প অথবা কিংবদন্তি। অন্যদিকে ল্যাটিন ভাষায় ‘মিথস’(Myths) শব্দটির অর্থ হল নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান অতিমানবীয় (Superhuman) শক্তির প্রতি বিশ্বাস । কারও মতে, গ্রিক ‘মুথোস’ (Muthos) শব্দ থেকে এসেছে ল্যাটিন মিথুস (Mithus) শব্দ। এ শব্দে নিহিত রয়েছে সঙ্গীত ও কবিতার অপার্থিব ধ্বনিময়তা।

মার্কিন পুরাণবেত্তা ও লেখক জোসেফ জন ক্যাম্বেল(Joseph John Campbell 26 March 1904, 30 October 1987 )একটি প্রতিবেদনে বলেছেন – ” Myths are public dreams, dreams are private myths.” অর্থাৎ মিথ হচ্ছে জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক কল্পনা, আর কল্পনা হচ্ছে ব্যক্তিগত মিথ।

এখন প্রশ্ন হল আমাদের কাল্পনিকতা ঠিক কি। কিসের ওপর ভিত্তি করে ‘এলডোরাডো’ কল্পজগত নিরূপিত হয়। অথবা নির্ণীত কল্পনার কি প্রামাণিক কোন নিশ্চেয় আছে – যার অবস্থান আমাদের অনুমিতির বাইরে কিন্তু অচিন্তনীয় নয়। যদি তা হয় তাহলে সামগ্রিক কল্পনার এক অনাবৃত রূপ থাকা অসম্ভব নয়। এবং আলোচিত myths এরও কোন নিশ্চেয় অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়।

এরকম একটি একার্থক ধারণার তাৎক্ষণিক সূত্রপাত হল এজন্য যে, ইতালির বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক ইটালো ক্যালভিনো ( Italo Calvino 15 October 1923 – 19 September 1985 ) -এর মিথ সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় উক্তি আছে—” Myth is the hidden part of every story, the buried part, the region that is still unexplored because there are as yet no words to enable us to get there. Myth is nourished by silence as well as by words. ” এবং যার অর্থ হল , — মিথ হল প্রতিটি গল্পের লুকানো অংশ, সমাহিত অংশ, যে অঞ্চলটি এখনও অনাবিষ্কৃত কারণ সেখানে আমাদের পৌঁছতে সক্ষম করার জন্য এখনও কোনও শব্দ নেই। পৌরাণিক কাহিনী নীরবতার পাশাপাশি শব্দ দ্বারা পুষ্ট হয়।
সুতরাং যদিও myth হল অলৌকিক বা অতীন্দ্রিয় জগতের বিবরণ, তবুও অলৌকিক বা অতীন্দ্রিয়তার কোন নিশ্চেয় নেই এমন ভাবনার কোন কারণ নেই।

বিশ্বের কোনও সৃষ্টিই স্থিতিশীল নয়, বরং সবসময় পরিবর্তনশীল আবার আপেক্ষিকও বটে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান বলে, শুধু জন্ম আর মৃত্যু দিয়েই সৃষ্টি আর ধ্বংস চিহ্নিত হয় না। এর সাথে অনেক অজৈব বিষয়ও জড়িয়ে থাকে। myth হল সেই অজৈব টেলিপ্যাথি। বিষের মতো এর অবস্থান। সায়ানইডের কথা ধরা যাক। সারা পৃথিবীব্যাপী গুজব আছে যে কেউ একজন কলম হাতে ধরেই সায়ানাইডের স্বাদ পরীক্ষা করতে যান, কিন্তু ‘S’ শব্দটি লেখার পরপরই তিনি মারা যান। ‘S’ দিয়ে Sour (টক) বা Sweet (মিষ্টি), এমনকি Salty (লবণাক্ত)-ও হতে পারে। এই হচ্ছে এই বিষের মারণ ক্ষমতা।

এখন প্রশ্ন হল, কোন বিষ যদি মানুষের কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে প্রাণহানি করতে পারে তাহলে বিষের বিপরীতমুখিন দিয়ে সেই মৃতকে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারিনা কেন? কারণ আমরা এই নিশ্চয়তায় উপনীত হয়েছি যে মৃত্যুকে জীবিত করা অসম্ভব। তাহলে বিপরীতমুখিনতা কোথায় গেল। “মৃতজনে দেহ প্রাণ”। ক্ষুধার অন্ন আছে , তৃষ্ণার জল আছে , অন্ধকারের আলো আছে । সব ব্যাঙ্গমার যদি ব্যাঙ্গমী আছে- তাহলে মৃত্যুর জীবন থাকবেনা তাই হয় নাকি।

আসলে আমরা জীবনের মৃত্যুকে উপলব্ধ করেছি। কিন্তু মৃত্যুর জীবনকে এ যাবৎ খুঁজে পাইনি। আমরা ব্রহ্মাণ্ডের কতটুকু খুঁজে পেয়েছি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শক্তি (energy) সম্পর্কে কেউ পরিপূর্ণ কিছু জানেনা। শক্তি হল বিমূর্ত, বস্তু-নিরপেক্ষ। শক্তি ছাড়া মহাবিশ্ব শুধুই অলীক কণিকা (particle), যাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্ব নেই। কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে এই কণাগুলি উঠছে, আবার কোয়ান্টামে মিশে যাচ্ছে। লেজেণ্ড, মিথ হল সেই মহাজাগতিক স্পন্দন। যেখানে নেই বলে কিছু নেই । ” পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।”

কবিতার জন্ম হয় ঠিক এখান থেকে – মৃত্যুও – তুমি কতোখানি ও কেমন বুড়ি ছুঁয়ে আছো তার ওপর।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here