৩য় পর্ব : নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার / আলেহো কার্পেন্তিয়ের

0
22
৩য় পর্ব

নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার 
                           আলেহো কার্পেন্তিয়ের

  ইংরেজি থেকে অনুবাদ : শৈবাল কুমার নন্দ

           প্রতিস্থাপন, একই স্তম্ভমূলে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে, আমাকে শাশ্বত নিত্যতার কথা মনে করালাে। সম্ভবতঃ ঈশ্বরও এরকমভাবে তার দায়িত্ব থেকে মাঝে মাঝে মুক্তিনে মাঝে মাঝে মুক্তি নেন, অন্য কোন আরাে কতৃত্বশালী শক্তির দ্বারা (ঈশ্বরের মা ? ঈশ্বরদের মায়েরা ? গ্যেটে, দের মায়েরা ? গ্যেটে এ বিষয়ে কিছু বলেছেন ?), যিনি ঈশ্বরের চিরস্থায়িত্বের অভিভাবক। এই পরিবর্তনের ভভাবক। পরিবর্তনের মুহূর্তে, যখন ঈশ্বরের সিংহাসন খালি ছিল, তখনই ঘটতে থাকে রেল দুর্ঘটনাগুলাে, এরােপ্লেনগুলো আছড়ে পড়ে, আটলান্টিক পার হতে গিয়ে জাহাজডুবি হয়, যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, এক মড়ক-মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়। এইরকম কিছু কল্পনার প্রয়ােজন ছিল মারকিওনের বিভৎস বিরুদ্ধ মতকে খন্ডন করতে, যে মত অনুযায়ী এক অশুভ জগৎ কেবলমাত্র সৃষ্টি হতে পারতাে এক অশুভ বা ক্ষতিকর ভগবানের হাতে। খেলনা দোকানের ঐ ডােনাল্ড ডাক আমাকে মনে করালাে জেনাের তীরসংক্রান্ত কুটতর্কটিকেও। সদা অচঞ্চল ও সবসময় একই রকম, তবুও সে ধরে চলেছিল এক দ্রুত লক্ষ্য পথ, দিনের মধ্যে পনেরাে বা কুড়ি বার নতুন ভাবে শুরু করে, যা তাকে নিয়ে গিয়েছিল শহরের সমস্ত দূরতম বাড়ীগুলাের ঘেরাটোপ ও শহরতলির এলাকাগুলােতে। আমার কাছে সে অসাময়িকতার এক বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হত, অস্থিরভাবে দিনরাত তিনমিটার রেললাইনের ওপর সীমাহীন ভ্রমন চালিয়ে যাওয়া মােড় ঘােরার সময় এক বিন্দু লাল আলাে জ্বলা ছােট বিদ্যুৎচালিত ট্রেনটার ঠিক বিপরীত। “আজ কি শুক্রবার ?” আমি রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করি।

“সােমবার, মিষ্টি সােনা, সােমবার।” | কিন্তু আমি কাগজ পড়ি না অনেক দিন। জেনারেল মাবিলান এবং তার নির্মম সেনাদের সম্পর্কে সব কিছুই আমি জানি। আমি কল্পনাতে দেখলাম তিনি তার সহকারীকে জিজ্ঞেস করছেন: “সেই চটপটে ও মার্জিত ইওরােপীয় মহিলাদের কি হল। যারা নিজেদের হয়ে যথেষ্ট বলতে পারে ?” “আমি খােজখবর করেছি, জেনারেল : কোথায় তাদের পাওয়া যাবে সেটা যে ব্যক্তি জানে সে এক বেশ্যাখানার মালিক হিপােলিতা যে তাদেও পার্কের কাছাকাছি কোথাও থাকে।” “আমরা অবশ্যই ঐ এলাকাতে একটা বাড়ি নেবাে, লেফটেনান্ট।” “নিশ্চয়ই, জেনারেল।” আমি ফিরে গেলাম জানালার ধারটাতে এটা দেখার জন্য যে আঠারােতম ডােনাল্ড ডাকটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে ও দ্রুত তার জায়গাতে ঐ দিনই উনিশতমটা এসে গিয়েছে। 8 একটা সােমবার যেটা শুক্রবারও হতে পারে। সীমানা সংক্রান্ত গােলমালটা নিয়ে রাষ্ট্রদূত নিজেও খুব দুশ্চিন্তা ও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলেন। প্রতিদিনই যেন মনে হচ্ছে সমস্যাটা সম্ভাব্য কোন সমাধান থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে, এখন যদিও জেনারেল মাবিলান প্রানপনে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁর অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত রক্তাক্ত ঘটনাগুলাে থেকে সাধারণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানাের – রাতের দিকে এখনাে গােলাগুলির আওয়াজ শােনা যায় – জেনারেল তাঁর নেওয়া। প্রতিটি পদক্ষেপেই দেশের মানুষদের সাহসী করার চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে আসন্ন যুদ্ধের প্রতি তাদের একটা দেশপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বােধ তৈরি হয়। বিভিন্ন ঘরনের স্লোগান যেমন “তোমরা সেই বীরেদের সন্তান যারা”… “আমাদের দেশের সীমানাগুলাে হয়ে উঠুক গৌরবময় এক যুদ্ধক্ষেত্র”… যারা সম্মান পাওয়ার যােগ্য তাদেরকে সম্মান কর…”কোন মৃত্যুই অপেক্ষাকৃত সুন্দর নয় এটার চেয়ে…” ইত্যাদি ইত্যাদি, ইত্যাদি, রেডিও ও টি.ভি.তে একটানা প্রচার হতে লাগল বারবার। রাজধানী শহরের জনমানসে এমনকি আরাে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে, যেখানে তখনাে জেনারেলের অনেক শত্রু ছিল, তিনি ঘােষণা করলেন যে এরকম এরকম একটা দিনে – শরণার্থী জানতাে না দিনটা মাসের দুই, এগারাে না ছাব্বিশতম তারিখ – শহরে শত্রু বিমান বাহিনীর মােকাবিলা করার এক জমকালাে মহড়ার আয়ােজন হবে। সমস্ত বাসিন্দাদের প্রশ্নোত্তরের আকারে ছােট ছােট নির্দেশনামা ধরানাে হল, যাতে নির্দেশ দেওয়া আছে উপর থেকে ছোঁড়া “স্বাভাবিক ভাবে নেমে আসা কি করা উচিৎ।

      মাথার উপর আড়াল করা মেলে দেওয়া এক খবর কাগজ কি যথেষ্ট সুরক্ষা দিতে পারে? – না। খােলা এক ছাতা কি উপযুক্ত সুরক্ষা দিতে পারে? – না। একটা মােটরগাড়ীর কাঠামােটা কি পারে ঠিকঠাক সুরক্ষা দিতে? – হাঁ, কিন্তু পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ধারের জানালাওলাে আরাে নিচে নামাতে এবং ঐ গাড়ির ভেতরে যতদূর সম্ভব একদম মাঝামাঝি জায়গাটাতে বসে থাকতে। এছাড়াও, যখন বিমান বিধ্বংসী গােলাগুলি ছোঁড়া শুরু হবে, মােটর গাড়িগুলাে ফুটসাথে লােকেদের হাঁটার জায়গাগুলোর যতটা সম্ভব কাছে রাখতে হবে ও গাড়ির ভেতর-বাইরের সমস্ত আলাে নিভিয়ে দিতে হবে। সেই প্রত্যাশিত রাত এল, জেনারেল মাবিলান, পুরােপুরি সামরিক পােশাক পরা এবং তাঁর চিবুক বাঁধার ফিতে ঢুকে গেছে তাঁর দুগুন ফোলা চিবুকে, এই মহড়ার তিনিই ছিলেন প্রধান দৃশ্যনির্দেশক ও ব্যবস্থাপক, এবং শত্রু বিমানবাহিনীর দখলে থাকা একটা পাহাড়ের মাথা থেকে তিনিই পরবর্তী ঘটনাগুলাে পরিচালনা করছিলেন। সংকেত দেওয়া আলাে, সাবধান করে দেওয়া তীব্র শব্দ, পুরাে অন্ধকার, উদ্বেগ চাপা কৌতুহল। “শত্রু বিমানের আওয়াজ তােমরা ইতিমধ্যেই শুনতে পেয়েছে। কিন্তু উষ্ণমন্ডলের খেয়ালিপনাগুলাের একটার কারণে, ঐ নির্দিষ্ট দিনের চমৎকার আবহাওয়া পরিণত হল দ্রুত ঘনিয়ে আসা কুয়াশাতে যা ঢেকে দিয়েছিল চারদিকের পাহাড়-পর্বতগুলােকে। “শত্রু বিমানের দল” ঘষা কাচের মত একটা আবরণ ছাড়া নিজেদের বিমানগুলাে বা নিচের জমি কোন কিছুই দেখতে পেল না। নিচের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দুকবাজেরাও হাতির মত ধূসর মেঘের দল ছাড়া আদৌ আর কিছু দেখতে পেল না।

                                 ★★★


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here