বিশ্বমিথের দরবার– লিখছেনঃ দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি

3
300
দেবলীনা রায়চৌধুরী ব্যানার্জি পেশায় ইংরেজীর অধ্যাপিকা তবে তাঁর ভালোলাগা ও ভালোবাসায় গাঁথা হয়ে আছে দেশ বিদেশের পুরাণে। ইদানিং দেবলীনা সেই পুরাণ সাহিত্য ও প্রতীকীবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। প্রধানত, আন্তর্জাতিক জার্নালে লেখালেখি ও বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন। একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা কবিতার বইয়ের পর,সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে “Into the Myths” নামে দেশ-বিদেশের পুরাণ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন। Myth Muhurto নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলরও কর্ণধার। দেবলীনাও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

বিশ্বমিথের দরবার

লিখছেনঃ দে ব লী না                রা য় চৌ ধু রী   ব্যা না র্জি

ছবিঃ সুনীপা ব্যানার্জী

মিথলজি বা পুরাণকথা নিয়ে মানুষের কৌতূহল প্রচুর। দেশ বিদেশের পুরাণকথা, পুরাকাহিনীর মানুষের মনে রূপকথার মায়াজাল সৃষ্টি করে। কিন্তু এই বিষয়ের গভীরে লুকিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অর্থ ও ধারণাগুলি যে মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট, তা কিন্তু নয়। এই সিরিজের লক্ষ্য হলো মিথ ও মিথলজির ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে মুল ধারণা বা basic idea নিয়ে আলোচনা করা। পরবর্তী পর্যায়ে দেশ ও কালের গণ্ডীতে সীমিত না থেকে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সমস্ত দেশের মিথলজির সম্বন্ধে একটা মৌলিক ধারণা দেওয়া। মিথলজি বিষয়টি খুব সহজবোধ্য নয়। বলা যায় জীবনের নানাবিধ ঘটনা, টানাপোড়েন, শিক্ষা, অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে গল্পের দেহে বাঁধা যে তাকে যত গল্প বা মিথ্যা ভাবা যায়, ততই তা জটিল ও বিভ্রান্তিকর লাগে। তাই আসুন একটু ধরে ধরে সহজভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

মিথ ও মিথলজি কি এক? প্রথমে দেখা যাক এই শব্দদুটির অর্থ। এই দুটি শব্দের কোন যথার্থ তর্জমা সম্ভব না। তাই এই শব্দের বহুল প্রচলন বাংলা ও অন্যান্য ভাষাতে দেখা যায়।
শব্দদুটির মধ্যে একসূত্রিতা থাকলেও এই দুটি শব্দের ভিন্নতা অস্বীকার করা যায় না। মূল গ্রীক শব্দ *Mythos* বা *মিথস* থেকে এই শব্দের উদ্ভব যার অর্থ হলো – কোন এক সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস, ধারণা ও রীতিনীতি প্রভৃতি। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট জনজাতির জীবনধারা বা জীবনচর্যা, যার থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে জন্ম নেয় ধর্ম ও পরে দর্শন। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে *Myth*, a symbolic narrative, usually of unknown origin and at least partly traditional, that ostensibly relates actual events and that is especially associated with religious belief. It is distinguished from symbolic behaviour (cult, ritual) and symbolic places or objects (temples, icons). এই সংজ্ঞা থেকে প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে পুরাণকথার প্রাঙ্গণে দাড়িয়ে সত্য বা মিথ্যা যাচাই করে সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই, কারণ তা Symbolic বা প্রতীকী। ভাষা সৃষ্টির আগে চেতনা ও জ্ঞানের সৃষ্টি। মানুষ জীবনের প্রাক্কাল থেকে নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার অভিজ্ঞতা, বোধ, চেতনা, সংস্কার, জ্ঞান প্রভৃতিকে দিয়ে যায় তার উত্তরসূরিদের। এই অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের প্রবাহ পরবর্তী প্রজনন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করার সব থেকে সহজ ও প্রশস্ত উপায় হলো গল্প। আর গল্পতে কল্পনার অবদান অনস্বীকার্য। অতএব *মিথ* হলো মানুষের জীবন থেকে পাওয়া জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা যা কল্পনার রঙে সেজে গল্প হয়ে উঠেছে। যে কোন বিষয়ে একাধিক মানুষের একই সংস্কার বা ধারণা থাকলেই তাকে মিথ বলে। কিন্তু মিথ আর মিথলজি এক নয়। বেশ কিছু একমুখী চিন্তাধারা, জ্ঞান ও বিশ্বাস একত্রিত হলে তাকে *মিথলজি* বলা যায়। এটি একটি বৃহত্তর স্তর যেখানে , সৃষ্টি, ধ্বংস, শিক্ষা, রাজনীতি আর্থসামাজিক অবস্থান সবটাই এসে যায়।

স্বনামধন্য পুরাণবিশেষজ্ঞ জোসেফ ক্যাম্পবেলের মতে, Mythology, in other words, is psychology misread as biography, history and cosmology. প্রকৃতপক্ষে মন বা বুদ্ধি দিয়েই আমরা প্রতিটা জিনিসকে চিনি, যে কোন ব্যাপারকে বোঝার চেষ্টা করি। তাই জন্যই পৃথিবীর সমস্ত পুরাণ কাহিনীতেই একটা প্যাটার্ন বা ধারা লক্ষ্য করা যায়। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যে কোন দেশের পুরাণকথায় মানুষের জীবনচর্যারই কথা – সৃষ্টি, অনুপ্রেরণা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ধ্বংস ইত্যাদি।

মিথলজি বা পুরাণ সাহিত্য রূপকথা নয়, কল্পকাহিনীও নয়, বরং নির্দিষ্ট জনজাতির ঐকিক ও সার্বিক জীবনধারা, মনস্তত্ত্ব, ভৌগলিক অবস্থান, প্রকৃতিচেতনা, অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির যোগফল। যা দিয়ে জাতি বা গোষ্ঠীর ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কার, আচার নির্ধারণ করা হয়। আধুনিককালের পুরাণ বিশেষজ্ঞ দেবদত্ত পট্টনায়ক বলেছেন, “Mythology is the subjective truth. Every Culture imagines life in a certain way”। আসলে সমাজ মানুষের তৈরি তাই সমাজের গঠন, পরিবর্তন, ভাঙন… এগুলি মানুষেরই হাতে বা বলা যায় তা অনেকটাই পরিচিত। কিন্তু মানুষ প্রকৃতির সৃষ্ট। তাই প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার একটা প্রবল আকর্ষণ রয়েছে মানুষের। এ আকর্ষণ অচেনার প্রতি। এও এক রকম ‘wanderlust’ যার ঘোরে মানুষ নিজের সৃষ্টি ও অস্তিত্বকে খুঁজে পেতেই অস্পষ্ট অভিজ্ঞতার উপর কল্পনার সাহায্যে গড়ে তোলে মিথলজি বা পুরাণকথার ইমারত। গাছের ফল পেতে গেলে যেমন তার মূলের পরিচর্যা প্রয়োজন ঠিক তেমনই সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মকে বুঝতে গেলে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা পুরাণ কাহিনী জানা দরকার। আর নিজেরটুকুই নয়, তুলনামূলক সংস্কৃতির সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা প্রয়োজন নিজেদের সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য।

এই তো গেল মিথ ও মিথলজির সম্পর্কে একটা basic idea বা মুল ধারণা। পরবর্তীতে পুরাণ সাহিত্যের গুরুত্ব, প্রয়োগ, প্রয়োজনীয়তা এবং তারও পরে দেশ বিদেশের পুরাণ বা World Mythology সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য নিয়ে দেখা হবে আবার *বাইফোকলিজমের* আঙিনায়।

লেখা পাঠাতে পারেন
পরের সোমবারে চোখ রাখুন পরবর্তী অংশের জন্য…

দেবলীনার অন্যান্য কিছু লেখা

মিথ মন্দিরঃ বেলঘরিয়ার রাধা-মোহনের মন্দির-বাড়ি

মিথ মন্দিরঃ৩- রহস্য ও ইতিহাসে মোড়া গন্ধেশ্বরী মন্দির

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here