স্বপ্নধারার পর্বকথা(৯-ম পর্ব) কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য়  ছবিঃ  রা জা   র বি ব র্মা

0
248
শুক্তি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন নিভৃতেই তাঁর লেখা-লিখি নিয়েই ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সাহিত্য পত্র পত্রিকার সাথে। লিখেছেন বাস্তবের আলোকে দেশ-বিদেশের পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী ও বেশ কিছু কবিতাও। এছাড়াও শুক্তি যুক্ত “জিজীবিষা” নামক লিটল ম্যাগাজিনের সাথে। সেখানেও তাঁর নিয়মিত লেখালেখি। নাচ তাঁর ভীষণ প্রিয় এছাড়াও শুক্তির ছবি আঁকা ও ফটোগ্রাফি নিয়ে অগাধ আগ্রহ।আজ থেকে প্রতি সপ্তাহে বাইফোকালিজম্-র পাতায় থাকছে তাঁর এই ধারাবাহিক।

স্বপ্নধারার পর্বকথা(৯মপর্ব)

কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য় 

ছবিঃ  রা জা   র বি ব র্মা

 

“মনে করো বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে…”
রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতা। মা কে নিয়ে বিদেশে আমরা অনেকেই তো যেতে চাই। কিন্তু দেশে থেকে, দেশ ঘোরাতে ক’জন চাই বলুন? আপনি ভাবছেন, স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে এসে আবার ঘ্যান ঘ্যান করে খানিক জ্ঞান দেবে নাকি? না না একদমই তা নয়। আসলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমি এটাই বলতে চাইছি যে, বিদেশ তো অনেক হল, এবার একটু দেশে ফেরা যাক? গ্রীক পুরাণ, ইংরেজি সাহিত্য তো অনেক হল, এবার আসি আমাদের ভারতীয় সাহিত্যের কথায়। চিন্তা নেই, আবার বিদেশি সাহিত্যেও ফিরব, কিন্তু তার আগে নিজের দেশের, নিজের মাটির সোঁদা গন্ধটা গায়ে মাখতে ক্ষতি কি? আরও বেশি আপন লাগবে…
আমাদের ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এক সময়ে উন্নতির শিখরে উঠেছিল। সেই সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিখ্যাত সব নাটক, কাব্য ইত্যাদি। সাহিত্যগত দিক থেকে সেগুলি শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই সমানভাবে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ। আজ ‘স্বপ্নধারায়’ আমরা সেই রকমই একটি নাট্যসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করব। ভাসের “স্বপ্নবাসবদত্তম্” এইরকমই একটি নাটক।
কালিদাস পূর্বের যেসব বিখ্যাত সাহিত্যিক, নাট্যকাররা ভারতীয় তথা সংস্কৃত সাহিত্যকে অসাধারণ কিছু সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভাস হলেন অন্যতম। সাধারনত সে যুগের লেখকদের বৈশিষ্ঠ্যই ছিল স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করা। যদিও তখনকার দিনের অনেক লেখাই কালের কবলে বা আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু ভাসের এই “স্বপ্নবাসবদত্তম্” নাটকটি আগুনে দগ্ধ হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছে।
“ভাসনাটকচক্রেঽপিচ্ছেকৈঃ ক্ষিপ্তে পরীক্ষিতুম্।
স্বপ্নবাসবদত্তস্য দাহকোঽভুন্ন পাবকঃ”

স্বপ্ন নিয়ে ভাসের লেখা “স্বপ্নবাসবদত্তম্” একটি অমর ও তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। উদয়ন, পদ্মাবতী ও বাসবদত্তার কাহিনি নিয়ে রচিত ছয় অঙ্কের নাটক “স্বপ্নবাসবদত্তম্”-এর কাহিনির উৎস সম্ভবত রাজা উদয়ন সম্মন্ধে প্রচলিত লোককাহিনি। গুণাঢ্যের ‘বৃহৎকথায়’-য় উদয়ন কাহিনি ছিল।

বৎসরাজ উদয়নের হৃতরাজ্য ফিরে আনার ইচ্ছায় অবন্তিকার ছদ্মবেশধারিণী রানি বাসবদত্তাকে সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে রাজগৃহ যাওয়ার পথে এক তপোবনে প্রবেশ করেন। সেই সময় মগধের রাজকন্যা পদ্মাবতীও সেই তপোবনেই আসছিলেন সেই আশ্রমের এক জননীর সাক্ষাৎ করতে। এ কথা যৌগন্ধরায়ণ জানতে পারেন ও পদ্মাবতীর কাছে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তাঁর ভগিনীর(বাসবদত্তা) চারিত্রিক শুচিতা রক্ষার দায়িত্ব নেন। পদ্মাবতীও এতে রাজি হন। পরে পদ্মাবতীর এক পরিচারিকার থেকে জানা যায়, অবন্তীরাজ প্রদ্যোত তাঁর পুত্রের সাথে তাঁর বিবাহ দিতে ইচ্ছুক। আবার এক ব্রহ্মচারীর থেকেও জানা যায়, রাজা উদয়ন শিকারে গেলে তাঁর প্রাসাদে আগুন লাগে ও তাতে তাঁর স্ত্রী,তাঁর প্রিয় বাসবদত্তা পুড়ে মারা যান। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণও পুড়ে মারা যান। এই সংবাদে রাজা অন্ত্যন্ত বিমর্ষ ও শোকাতুর হয়ে পড়েছেন। যৌগন্ধরায়ণ তাঁর পরিকল্পনার সাফল্যের খবর শুনে খুশি হন।
ইতিমধ্যে পদ্মাবতী ও বাসবদত্তার পরিচয় গাঢ় হয়ে তা খানিকটা সখ্যতায় পরিণত হয়েছে। কথাচ্ছলে বাসবদত্তা পরিহাস করে পদ্মাবতীকে মহাসেনের পুত্রবধূ বলে সম্বোধন করেন। পদ্মাবতীও রাজার গুণের কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। এই সময়ই ধাত্রী এসে খবর দেয়, পদ্মাবতীকে রাজা উদয়নের সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য বাগদান করা হচ্ছে। বাসবদত্তা উদগ্রীব হয়ে জানতে চান, উদয়ন নিজেই পদ্মাবতীকে বিবাহ করতে রাজি কিনা। ধাত্রী জানায়, অন্য কাজে এলেও পদ্মাবতীর রুপ-গুণে মুগ্ধ রাজা তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন ও সেদিনই শুভ লগ্ন থাকায়, বিবাহও সেইদিনই হবে। এ কথা শুনে বাসবদত্তা দুঃখে আকুল হয়ে পড়েন।
কিছু পরে পদ্মাবতী বাসবদত্তাকে নিয়ে প্রমোদকাননে গেলে, সেখানে যখন তাঁরা দু’জন রাজা উদয়ন সম্পর্কে কথোপকথনে মগ্ন, সেই সময়ে রাজা উদয়নকে নিয়ে বিদূষক প্রমোদকাননে প্রবেশ করলেন। পদ্মাবতী, ছদ্মবেশিনী বাসবদত্তা সম্পর্কে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে(অর্থাৎ, পরপুরুষের সান্নিধ্য থেকে বাসবদত্তাকে দূরে রাখতে) তাঁকে নিয়ে তাঁর সখিদের সাথে মাধবীকুঞ্জে প্রবেশ করলেন। উদয়ন ও বিদূষক সেখানে প্রবেশ করতে গেলে মৌমাছি উড়িয়ে ও বিভিন্ন উপায়ে তাঁদের নিরস্ত করলেন। ধারে-কাছে কেউ নেই দেখে বিদূষক রাজার কাছে জানতে চাইলেন বাসবদত্তা ও পদ্মাবতীর মধ্যে কে তাঁর প্রিয়। রাজা বলেন, পদ্মাবতী রূপে ও গুণে তাঁকে মুগ্ধ করলেও, বাসবদত্তায় আবদ্ধ তাঁর হৃদয় হরণ করতে পারেননি। বাসবদত্তার চিন্তায় তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠতে বিদূষক তাঁর জন্য জল আনতে বাইরে গেলেন।
হঠাৎ পদ্মাবতী সেইস্থানে এসে ও রাজার চোখে কেন জল তা জিজ্ঞেস করেন। ইতিমধ্যে, বাসবদত্তা সেই স্থান ছেড়ে চলে যান, যদিও তাঁর স্বামীর উত্তরে ও তাঁর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ পেয়ে তিনি পরিতৃপ্ত হন। এদিকে বিদূষক ফিরে এসে দেখেন পদ্মাবতী রাজার সম্মুখে ও রাজাকে তাঁর অশ্রুসিক্ত নয়নের কারণ জিজ্ঞেস করছেন, তাই তাড়াতাড়ি তিনি জবাব দেন, ফুলের রেণু পরে তাঁর এই অবস্থা। এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে সকলে প্রমোদকানন ছেড়ে চলে গেলেন।
রাত্রে পদ্মাবতীর অসুস্থতার কথা ও সেই কারণে সমুদ্রতীরে তাঁর জন্য শয্যা রচনা হয়েছে, একথা শুনে উদয়ন সেখানে গেলেন। কিন্তু পদ্মাবতী সেখানে না থাকায়, তিনি অপেক্ষা করতে করতে সেখানেই নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পরেন। এদিকে, বাসবদত্তাও পদ্মাবতীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে সেইখানে এসে উদয়নকে পদ্মাবতী ভেবে তাঁর পাশে শুয়ে পড়লেন। হঠাৎ স্বপ্নের মধ্যে ‘হা বাসবদত্তা’ বলে উঠলে, বাসবদত্তা ভাবেন রাজা তাঁকে চিনে ফেলেছেন। এই ভেবে চমকে উঠে বসলেও পরে আশ্বস্ত হন যে, রাজা স্বপ্নের ঘোরে একথা বলেছেন। সেখানে কেউ না থাকায় তিনি তাঁর স্বামীকে আর একটু দেখার আশায় তাঁর স্বপ্নের সঙ্গেই কথা বলতে থাকেন, ও তাঁর একটা হাত শয্যা থেকে ঝুলে পড়ায় সেই তুলে দিয়ে, কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে সেখান থেকে চলে যান। কিন্তু রাজার ঘুম ভেঙ্গে যায় বাসবদত্তার স্পর্শে। তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে বিদূষক আসায়, তাঁকে তিনি সব বলেন। বিদূষক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু তাঁর সংশয় কাটে না।

এর কিছুদিন পর রাজা উদয়ন, রানি পদ্মাবতীর সাথে নিজের রাজ্যে বাস করছেন। সেই সময়ে অবন্তিকার ছদ্মবেশে বাসবদত্তাও গোপনে সেখানেই আছেন। বাসবদত্তার ধাত্রী রাজা ও রানি অঙ্গারবতীর বার্তা বহন করে উদয়নের কাছে এলেন। উদয়নের কাঞ্চুকীয় উদয়নকে সে সংবাদ জানাবার জন্য প্রতিহারী বিজয়াকে জানালেন। বিজয়া জানালেন, সেদিন হঠাৎ বাসবদত্তার বীণা ঘোষবতীকে পেয়ে রাজা মুহ্যমান হয়ে আছেন। বাসবদত্তার ধাত্রী রানি অঙ্গারবতীর থেকে খবর পাওয়া গেল, পূর্বে উদয়নের সাথে বিবাহ স্থির করে, বাসবদত্তাকে উদয়নের কাছে বীণা শিক্ষার জন্য পাঠান। কিন্তু এই পরিকল্পনা না জেনে উদয়ন, বাসবদত্তাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন। রানিরা তাঁদের জন্য দু’টি ছবিও আঁকিয়েছিলেন। সেটাই দিতে তাঁদের আগমন। পদ্মাবতী উদয়নের সেই ছবি দেখে বুঝলেন, উদয়নের প্রতিকৃতির সাথে এই ছবির অসম্ভব সাদৃশ্য। তাই এটাও বুঝতে পারলেন যে, বাসবদত্তার মতোই এক রমণী তাদের প্রাসাদে আছেন। সে কথা উদয়নকে জানালে অবন্তিকার ছদ্মবেশে থাকা বাসবদত্তাকে সেখানে আনা হল। ধাত্রী তাঁকে চিনতে পারলেন। কিন্তু যৌগন্ধরায়ন তাঁকে তাঁর বোন হিসেবে দাবি করলে, তাঁকেও সেখানে আনা হলে রাজা তাঁকে চিনতে পারলেন। তখন যৌগন্ধরায়ন ও বাসবদত্তা দু’জনই আত্মপ্রকাশ করলেন। এভাবেই উদয়ন-বাসবদত্তার পুনর্মিলনে নাটক সমাপ্ত হল।
আগের একটি পর্বে আপনাদের Vivid Dream-এর কথা বলেছিলাম, মনে পড়ছে? এই ধরনের স্বপ্নে মানুষ আচ্ছন্ন একটি ভাবের মধ্যে থাকে। যে সময়, মানুষ কিছু স্বপ্ন দেখে যার রেশ পরবর্তীকালে থাকে। যদিও গভীর ঘুমে না থাকলেও মানুষ এমনই স্বপ্ন দেখে যা অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়। এক্ষেত্রে উদয়নের সাথেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তাই ‘হা বাসবদত্তা’ বলে ওঠার পর,আশঙ্কা বশে যখন বাসবদত্তা সেখান থেকে তড়িঘড়ি চলে যান, তখন তাঁর সামান্য হাতের স্পর্শে উদয়নের ঘুম ভেঙে যায়। শুধু তাই নয়, এটিকে তাঁর অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ঘটনা (যা শুধুই স্বপ্ন নয়)বলেই মনে হয়। যা vivid dream-এ ঘটে থাকে।

তাহলে বন্ধুরা দেখলেন তো, স্বপ্নের কথা আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যেও ভাস কতো সুনিপুনভাবে তাঁর নাটক ”স্বপ্নবাসবদত্তম” -এ লিখে গেছেন। পরের পর্বে আবার নিয়ে আসব এরকমই কিছু গল্প যা এক হিসেবে বাস্তবও বটে, তবে আপনারা কিন্তু এই রকম বাস্তব, অবাস্তব বিভিন্ন স্বপ্ন দেখতে থাকুন…

শুক্তির আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকেঃ

স্বপ্নধারার পর্বকথা(৮মপর্ব) কলমেঃ শু ক্তি   চ ট্টো পা ধ্যা য় ছবিঃ সু নি পা  ব্যা না র্জী 

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here