বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প

0
89
পরিচিতি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় মূলত কবিতা চর্চারর মধ্যেই নিজের মুক্তির ডানা খুঁজে পান।তবে এবারের বাইফোকালিজম্-এর পাতায় থাকল তাঁর ছোটগল্পের এক ঠিকানা।বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় লিটল ম্যাগাজিনের একজন স্বভাষার কলমচি।লিখেছেন দুই বাংলা তথা রাজ্যের বাইরেরও অজস্র পত্রিকায়।বাবার খ্যাতির ছায়া থেকে বেরিয় এসে প্রতিষ্টা করতেে পেরেছেন তাঁঁর নিজস্ব ভাষার নিশান।

বি প্ল ব গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

অনুসন্ধান

শুধুমাত্র স্থিরতার অভাব বা বয়স নয় আরও অনেককিছুই তার চলার ছন্দ কেড়ে নিচ্ছে তা বুঝতে পারে ময়ূখ। কিন্তু এর সমাধান করতে গিয়ে সে বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে নিজের কাছে। আত্মগোপন পর্ব বেছে নেয়। বাড়ির বাইরে বের হওয়া বলতে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া। ফিরে এসে সোজা নিজের পড়ার টেবিলে। লোকজনও আজকাল আর তেমন আসেনা। এলেও ‘শরীর ভালো নেই’ বলে অনায়াসে এড়িয়ে যায় ময়ূখ। অথচ সে তো এমন ছিলনা। হৈ হৈ আড্ডা আর মজলিশই ছিল তার প্রাণ।আজীবন জমজমাট মানুষটি আজ উত্তর চল্লিশে এসে টের পায় কোথাও যেন অঙ্ক ভুল হয়ে গেছে তার। বইপত্র খোলা থাকলেও পড়ায় তেমন মন বসেনা। ঘরময় ছড়ানো কাগজের পাতায় যাবতীয় মীমাংসাবিহীন নিজের অক্ষম ভুমিকার কথা। মাঝে মাঝে অসন্তোষ জাগে অথচ বিদ্রোহ তার ধাতে নেই। এই যে এত এত টাকা দিই বাড়িতে, মুখের সামনে এক গেলাস জল ধরারও কেউ নেই। এরকম কোন দাবি বা অভিমান করতে পারেনা সে। নিজের অস্থিরতার জন্য অন্যদের অপমানিতের বেদনা দিতে অপারগ তার কণ্ঠস্বর। সুরঞ্জন এসেছিল আজ। বলল – ‘এভাবে চুপচাপ বসে থাকিস কেন ? ভ? চল একটু হাঁটি। বেশিদূর নয় এই সামনের সুজন দিঘি অবধি যাই ।’ ময়ুখ মাথা নীচু করে ছিল উত্তরবিহীন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সজোরে।একা চুপচাপ ভাবলেশহীন চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল সুরঞ্জন । দিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতা। বুকের মধ্যে ভারি হয়ে রয়েছে বেদনার সুর। মানুষটা বোধ হয় ভেতরে ভেতরে অল্প অল্প করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। বলল –‘ তুই বোধ হয় এখনও সুজাতার কথা ভাবিস ? ’ -‘না তো।’ একটা আড়াল টানার চেষ্টা করল ময়ুখ। সত্যিই আজকাল সুজাতার কথা তেমনভাবে মনে আসেনা তার। সময় কত নিত্য নতুন সমস্যা নিয়ে আসে আর পুরানো ক্ষতের উপর শ্যাওলা জমে যায়। খোকনের অ্যাক্সিডেন্টের পর সব অঙ্ক গোলমাল হয়ে গেছে তার জীবনে। একটা ভয়ঙ্কর দৈত্য এসে তছনছ করে দিয়েছে সবকিছু। স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় মাত্র ছমাস কাজ করার পরই খোকনের ডানহাতের সম্পুর্ন অংশ দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল লোহার গলিত দ্রবণে। বাঁচার কথা ছিলনা। তবু যমে মানুষে টানাটানির পর খোকন যখন হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরেছিল তখন মনে হয়েছিল ডানহাত চলে গেলেও মানুষটা ঘরে ফিরেছে এর চেয়ে শান্তি আর কোথাও নেই। আজ মনে হয় সবই নিয়তি তার। অ্যাটলাসের মতোই তাকে স্বর্গ আকাশ আর পৃথিবীর ভার মাথার উপর ধরে রাখতে হবে। বহন করতে হবে আজীবন । তার সেই শক্তি বা সাহস নেই। ফ্রোজেন সোল্ডারের নির্মন যন্ত্রনায় ভারি হয়ে থাকে সারা শরীর। নিজের কাঁধের কাছে ডানহাত রেখে ময়ূখ বলল – শরীর ভালো নেই , স্পন্ডিলাইটিসের পেনটা আরও বেড়েছে। সুরঞ্জন হাসল – সব সময় শুয়ে থাকলে তা আরও বাড়বে।

হাঁটাচলা কর। আশালতা ঢুকল তখনই – রঞ্জন এসেছ? খুব ভালো হয়েছে ওর একটা কিছু গতি করো তো বাবা। নইলে ছেলেটা আমার একদম শেষ হয়ে যাবে। দেখেছো, দিন দিন কি চেহারা হচ্ছে? টেবিলে র চা আর বিস্কুট।ধোঁয়া বের হচ্ছে চা থেকে। সুরঞ্জন বলল – আপনি আবার কষ্ট করে চা বানাতে গেলেন কেন কাকিমা?
-“ইচ্ছে থাকলেও বেশি কিছু তো বানাতে পারিনা বাবা। বাতের ব্যথা। উঠতে বসতেই …।” ময়ুখ বুঝল সীমা বা খোকন কেউই আজ বাড়ি নেই। তাই মাকেই চা বানিয়ে আনতে হয়েছে। থাকলে এতক্ষনে বুবুন এসে ঠিক তার কোলে চাপত। গল্প শুনতে চাইত। বইয়ের পাতা থেকে দু একটা গল্প সে বলত আগে। মজার গল্প। হাসির গল্প। ভুতের গল্প। কিন্তু এখন আর এসব ভালো লাগেনা।খোকনের দুর্ঘটনার পর কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে বাড়িটা। কথাটা আবার পাড়ল আশালতা – তোমার পরিচিত সেরকম কোন মেয়ে নেই। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বয়স। গায়ের রঙ মাঝারি সাধারন ঘর।
-আছে কাকিমা। তবে … আশালতা যেন আলোর মুখ দেখতে পেল এতক্ষনে – আবার তবে কেন?
-ওরা ঠিক এদেশিয় নয়। তাছাড়া জাত কুল আপনাদের সাথে মানানসই হবে না। বনেদীয়ানাও তেমন নয়।
-ওসব নিয়ে কে আর এখন মাথা ঘামায় বাবা। তুমি দেখো তো। ছেলের বয়স হতে চলল আমি কি জাত গোত্র ধুয়ে জল খাব?
-মেয়েটা ডিভোর্সি তবে দেখতে শুনতে ভালো। বয়স পয়ত্রিশের মতই হবে যদিও চেহারার চটকে তা বোঝা যায় না। আমাকে অনেকদিন ধরেই ওর দিদি বলেছে তবে আমি কথাটা পাড়তে সাহস পাইনি। আশালতা দ্বিধাহীন ভাবে বললেন – ঠিক আছে রঞ্জন তুমি ওদের বলে দেখতে পারো। আমার কোন আপত্তি নেই। কদিনই আর বাঁচব , বলো , একটু শান্তিতে মরতে চাই।
ময়ুখ ঠাণ্ডা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল টেবিলে। ভুল রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছে মা না কি সে নিজে? অঙ্কের ভুলগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারছেনা সে। কি দরকার এসব ঝুটঝামেলার। বেশ তো আছি মা। এই বুবুন , সীমা খোকন আর দীপাকে নিয়ে জীবন তো চলে যাচ্ছে দিব্যি এইকথাগুলো বলতে গিয়েই থেমে গেল সে।

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে নীল রঙের বাড়িটার সামনে এসে ময়ূখ দেখল কেমন স্তম্ভিত হয়ে আছে চারপাশ। একটা কুকুর শুয়ে আছে দরজার কাছে।রুগ্ন।তার অপরিচিত গন্ধ কুকুরটাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না ।পুরানো মান্ধাতার আমলের বাড়ি। কলিং বেল টেপার কোন সুযোগ নেই। রঙচটা কপাটের গায়ে প্রাচীনতার ছাপ। দুটো কড়া ঝুলছে। সুরঞ্জনকে খুব গাল দিতে ইচ্ছে করছিল। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে তার এইভাবে কেটে পড়া কি উচিত কাজ হল? তার কথামতোই তো আজকের দিনটি নির্ধারিত হয়েছিল। নইলে সে তো এই চক্রান্তের ভেতর আসতে চায়নি। মাঝরাস্তায় সুরঞ্জন যখন অসুস্থতার কথা বলল ফোনে তখন তার মনে হয়েছিল তার আর গিয়ে কোন কাজ নেই। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এই তো সামান্য রাস্তা। সুরঞ্জন যা করেছে করুক, তার পক্ষে কথার খেলাপি করা ঠিক হবেনা। কড়া নাড়ার আগে তার অপ্রস্তুত হাতটা অজান্তেই ঢুকে গেল প্যান্টের পকেটে – মাথার চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে। একটু ঠিক করা দরকার। নইলে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগবে। পকেট থেকে চিরুনি বার করতে গিয়েও থেমে গেল তার হাত। কি হবে বৃথা পরিশ্রমে। কটা তো মাত্র চুল। আসার আগে সুরঞ্জন বলেছিল – একটু কলপ করে নিস। ময়ুখ ইচ্ছে করেই করেনি। সম্পর্কের প্রয়োজনে যেখানে যাচ্ছে সেখানে কি আড়াল মানায়? কড়া নাড়তে গিয়ে বুকটা একটু ধুকপুক করল কি? এই বয়সেও এরকম হয়। নিজের মনেই হাসল ময়ুখ। যে মহিলা দরজা খুললেন সুরঞ্জনের বর্ননা অনুসারে তিনি পাত্রীর দিদি ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। চেহারায় রাগী কর্কশ ভাব। একটু খিটমিটে ধরনের। মুখে রুক্ষতা – আপনি? এই জিজ্ঞাসায় একটু থতমত খেয়ে গেল ময়ুখ – এটা কি রঞ্জনা হাজরার বাড়ি?
-হ্যাঁ। আমিই রঞ্জনা হাজরা।
-ও , আচ্ছা। সুরঞ্জন কিছু বলেনি? আমি গোদাপিয়াশাল থেকে আসছি।
-ভেতরে আসুন। আপনি কি সুমনাকে দেখতে এসেছেন? ময়ুখ মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল
আমি সুমনার দিদি। কিন্তু ও তো বাড়ি নেই। মাকে ডাক্তার দেখাতে গেছে।
কখন ফিরবে?
এত উতলা হচ্ছেন কেন? আজ নাও ফিরতে পারে।
তাহলে আর দেরি করব না, বাড়ি যাই?
আধঘন্টা বসুন। এর মধ্যে এসে যায় তো ভালো। নইলে
নইলে?
আমাকে অফিস বেরুতে হবে।
তাহলে আমিও আজ আসি। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
আধঘণ্টা বসতে বলছি, বসুন। তারপর যা খুশি করবেন।
বসতেই হল। এটা ড্রয়িংরুম। ও পাশে শয়নকক্ষ। সিঁড়ির নীচে রান্নাঘর। পর্দা ঢাকা। চারদিকে কিছু দরকারি অদরকারি আসবাব। বিছানায় নতুন বেড কভার। বেড কভারে গাছের ছবি। সেখানে একটা পাখি উড়ছে। পাখিটার উপর আলতো করে বসল ময়ুখ। ডানদিকের দেওয়ালে নজরুলের ছবির নীচে লোকনাথ বাবা। রণে বনে জলে জঙ্গলে রক্ষা করার অঙ্গীকার দেখে সাহস পেল ময়ূখ। দেওয়ালের অন্যপাশে ফটোফ্রেমে বন্দী সুমনার অল্পবয়সী বাবা। এসব দেখে নিতে দুমিনিটের বেশি লাগল না ময়ুখের রান্নাঘরে খুট খুট কিছু বিচ্ছিন্ন শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ ভেসে এলনা। বিশেষত মেয়েদের উপস্থিতির যে ফিসফিস শব্দ সে আশা করেছিল তেমন কোন কিছুই তার কানে এল না। আসার কথাও নয়। বাড়িতে এই মুহুর্তে সে ছাড়া আর মাত্র একটি প্রানী।


-নিন, দুটো নলেন গুড়ের সন্দেশ। কথাটা খট করে কানের কাছে লাগল ময়ুখের। যেন সে অযাচিত ভাবে চলে এসেছে এখানে। তখনই সুরঞ্জনের মুখ মনে পড়ল তার। রাগে যে কিছু অশ্রাব্য কথা মাথায় এল না এমনও নয়।
-এসবের কিছু দরকার ছিল না। আমি জাস্ট দুটো কথা বলেই তো চলে যেতাম। লজ্জা অস্বস্তি এবং দ্বিধা জড়ানো কথাগুলো বেরিয়ে এল ভেতর থেকে।
যার সাথে কথা বলবেন। সে আসুক
লজ্জা পেয়ে গেল ময়ুখ। আজকাল কি যে হচ্ছে। কথাগুলোও লাগামহীন, অগোছালো ভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে মুখ থেকে। আবার চুপচাপ। নীরব চারপাশ। সত্যি বলতে কি বসে থাকতে ভালো লাগছিল না ময়ুখের। সে যেন ভুল করে এক অজানা জায়গায় চলে এসেছে। যেখানে তার উচিত হয়নি এই আসা। আবার পালানোর পথ ধরাও ঠিক শোভন সুন্দর নয় ভেবে চুপচাপ বসে থাকা।
কড়া নাড়ার শব্দ হতেই চমকে উঠল ময়ুখ। এবার সত্যি তার বুক ধুকপুক করতে শুরু করল। এরকম হওয়ার কথা নয়। চল্লিশে এসে এসব কি মানায়?
মেয়েটি অর্থাৎ সুমনা এল এবং তার মা। ঘরে ঢুকেই নমস্কার করল সুমনা। জড়তা নেই , নিঃসঙ্কোচ। প্রতিনমস্কার করতে গিয়ে হাতে কি কাঁপনের অনুভব সঞ্চারিত হল। ঠিক বুঝতে পারল না ময়ুখ।
-বসুন। আমি একটু রেডি হয়ে আসি।
বসেই তো আছে সে। তবু বসতে বলা নেহাতই সৌজন্য। পাতলা ছিপছিপে গড়ন। কপালের মাঝখানে উজ্জ্বল টিপ। গায়ের রঙফর্সা না হলেও ফর্সার দিকে। মুখে মিষ্টি হাসি। বেশ পছন্দই হল ময়ুখের – রেডি হওয়ার কিছু নেই। জাস্ট দুটো কথা তো। মিনিট দশ লাগবে।
-আমার শরীরটা কদিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। তাই মেয়েকে নিয়ে ডক্টর সেনের চেম্বারে গিয়েছিলাম। দেরি হল কিছু মনে করো না। সুমনার মায়ের গলায় নম্র স্বর । প্রশান্তির রেখা চোখে মুখে। তৃপ্তি অনুভব করল ময়ুখ-আমি তো এইমাত্র এসেছি। কোন অসুবিধে হয়নি । সুরঞ্জনের আসার কথা ছিল। শরীর ভাল নেই বলে আসতে পারেনি।
হ্যাঁ। উনি কাল ফোন করেছিলেন। সবই তো জানো বাবা, নতুন করে আর কি বলব, বলতে গিয়েও সুমনার বাবার আকস্মিক মৃত্যু, বিপন্ন সংসার, অভাব এবং দারিদ্রের ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু ছবি। মাঝ রাস্তায় পড়া থামিয়ে বাবার অফিসে মেধাবী রঞ্জনার গ্রুপ ডির চাকরিতে যোগদান।সুমনাকে বড় করার স্বপ্ন এবং একটা ভুল প্রেম কীভাবে সুমনার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ননা উঠে এল সুমনার মায়ের মুখ থেকে। ভেজা চোখ মুছতে মুঝতে একসময় তিনি বললেন – ঠিক আছে বাবা তোমরা কথা বল। আমার শরীরটা ভালো নেই , বিশ্রাম দরকার।
আবার কিছুক্ষন চুপচাপ।
এবার সুমনাই শুরু করল – সবই তো শুনলেন। এবার আপনার কথা বলুন।
সুরঞ্জন কিছু বলেনি?
বলেছে । তবু আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
ময়ুখ ভুপতিনগর স্কুলের শিক্ষক। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ। পি এইচ ডি করতে করতে মাঝরাস্তায় চাকরি পেয়ে যাওয়ায় গবেষণা আর হয়ে ওঠেনি। তার ছোট ভাই খোকন পড়াশোনা তেমন করতে পারেনি। এইচ এস কয়েকবার ফেল করে শিক্ষাচর্চার পরিসমাপ্তি ঘটায়। পাড়ার একটি মেয়ে সীমার সাথে প্রেমের কারণে দাদাকে ওয়েটিং লিস্টে রেখে সে তড়িঘড়ি বিয়েটা সেরে ফেলতে বাধ্য হয়। বাবা অনেকদিন গত হয়েছেন। মা ছাড়াও বাড়িতে রয়েছে পাঁচ বছরের ভাইপো বুবুন এবং জন্ম বিকলাঙ্গ একটি বোন দীপা। যে কথা বলতে পারেনা। চোখে দেখতে পায়না। একটা লাঠিতে ভর করে কোন রকমে রাস্তা হাঁটে। কিন্তু ময়ুখের অত্যন্ত আদরের এবং প্রিয়। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য কোথায় যায়নি ময়ুখ। কিন্তু সব রোগ আরোগ্যের ঠিকানা পায় না।
এভাবেই ময়ুখ তার এবং তার ফ্যামিলির সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরল।
আপনার ভাই কি করেন? সুমনার মুখে প্রশ্নচিহ্ন।
একটা দোকান করেছিল কিছুদিন। চলেনি । তারপর একটা স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় লেবারের কাজ করত।
করত মানে? এখন করেনা?
না। ওর একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তখন তুতুন তিন বছর। ভরা সংসার খোকনের। একটা হাত বাদ দিতে হয়। তবু চাকরিটা ছিল। একদিন সেই কারখানাও বন্ধ হয়ে যায়। অন্য কারখানায় যে কাজ খুঁজবে সেই শারীরিক সক্ষমতাও ওর নেই। অথৈ জলে পড়ে একদিন কাঁদতে কাঁদতে সীমা এসে জানিয়েছিল সেই দুসংবাদ। চারমাস বেতন হয়নি ওদের কারখানায়। ফ্যাক্টরি লক আউট হওয়ার আর কোন স্বপ্ন নেই, সম্ভাবনা নেই। সীমার ছেঁড়া শাড়ি। তুতুনের যে দুধের বরাদ্দ ছিল তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খোকন চুপচাপ শুয়ে থাকত বিছানায়। একদিন সুইসাইড করতে গিয়েছিল বিষ খেয়ে। সীমার কান্না আর চাপা আর্তনাদ আমার কানে এসেছিল। আমি সীমাকে বললাম –কোন চিন্তা কর না যতদিন আমি আছি।
বুঝতে পারছি । সে না হয় ভালোই করেছেন। বড় দাদা হিসেবে এটা আপনার কর্তব্য। আমার বক্তব্য ঠিক সেখানে নয়। আমি জানতে চাই এরপরেও কি এইভাবেই চলবে? আপনি কি হিমালয় প্রমাণ বোঝা মাথায় নিয়েই রাস্তা হাঁটবেন ?
ময়ুখ বুঝতে পেরেছিল ঠিক এরকমই প্রশ্ন আসবে। তবু খুব অপ্রস্তুত লাগলনা তাকে । এলোমেলো মনে হল না তার মুখের রেখা। সে জানে পরিবারের এই দুর্দশার বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার অভ্যাস সে কখনই রপ্ত করতে পারবে না। তবু বলল – যতদিন না স্থায়ীভাবে কিছু করে।
সুমনা হাসল মৃদু ও মর্মভেদী – সে সম্ভাবনা কম। কে আর পঙ্গু মানুষকে কাজ দেবে বলুন হাসির সাথে তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞার ধ্বনি টুকুও মিশে আছে বাতাসে । থাক। তবু সম্মিলিত অসহায় হাতগুলির সামনে দাঁড়িয়ে সে মিথ্যে বলতে পারল না। দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সুমনা নির্বিকার পা। পিছন ফিরে একবার দেখল ময়ুখের থমকে থাকা মুখ। জিজ্ঞাসু চোখ থেকে বেরিয়ে এল সেই মোক্ষম প্রশ্ন – সুজাতার সাথে আপনার এতদিনের প্রেম। সেই কলেজ থেকে। তা হঠাত ভেস্তে গেল কেন?
সুজাতা। ময়ুখ স্তব্ধ হয়ে রইল অনেকক্ষণ। এখানেও সুজাতার প্রসঙ্গ আসবে সে যে জানত না তা নয়। তাই বারবার করে বলেছিল সবকিছু খুলে বলিস। আমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত আবদ্ধতা মুক্ত হয়ে যাওয়াই ভালো।
সুরঞ্জনের সবকথাই আপনাকে জানানো উচিত ছিল। ময়ুখ উঠতে যাচ্ছিল। ব্যক্তিগত বেদনার পর্বটি প্রকাশ্যে আসায় আহত হল সে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। তবু এড়িয়ে গেলনা। অস্ফুট ঊচ্চারনে গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে বহুদিন সযত্নে লালিত এল এক নীরব দীর্ঘশ্বাস – ঠিক এই কারণে। সুজাতার দুটো অপশন ছিল। আমি এর বাইরে তৃতীয় বিকল্প খুঁজতে চেয়েছিলাম, পাইনি। ওকে বুঝিয়েছিলাম – এতদিনের ভালোবাসা, এককথায় এভাবে ভেঙে দেবে? সে বলেছিল – বিয়ে হলেও তো ভাঙত। আগে ভাঙলে অসুবিধে কোথায়?
আর কোন কথা বলল না কেউ। ময়ুখ উঠে এল গন্তব্যহীনতার দিকে। দরজার বাইরে কি মুক্তির আবহ। সে বুঝতে পারছিল না। তবু দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল পথে।

একটা অর্জুন গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াল ময়ুখ। নিস্তব্ধ শুনশান রাস্তা। এখন কালিগঞ্জ যাওয়ার কোন বাস নেই। তাকে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এই নিস্তব্ধ ছায়ায়। মুখের উপর মনমরা আলো এসে পড়ছে অর্জুন গাছের ফাঁক দিয়ে। শূন্য উদাসীন দিগন্তে সে স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। বাড়ি ফিরে সে কি উত্তর দেবে মাকে। সত্যিকথা বললে খোকন নিজেকে অভিসম্পাত দেবে। বলবে – দাদা , আমি তো বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছিলাম। কেন ফিরিয়ে আনলি। তারপর নিজের অপদার্থ হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলবে সে। ভিজে যাবে করতল। জীবনযুদ্ধের ক্ষত ফুটে আছে হাতের তালুতে। সীমা অপরাধীর মতো এসে দুয়ারে দাঁড়াবে। কি বলবে তাকে ? কিছুই বলার নেই। পারবে কি সে সত্যকে উন্মোচন করতে । পারবে না। আর বুবুন তার শীর্ণ চেহারা নিয়ে রুগ্ন কারখানার বিজ্ঞাপনের সাথে মিশে যাবে। হাড়গুলো গোনা যাবে নামতার মতো। দীপা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকবে বোবা দৃষ্টি নিয়ে। রাগে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে সবকিছু। অপমান থেকে জ্বালা থেকে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে ইচ্ছে করে তার। পারেনা। কলুর বলদের মতো ঘানি টানাই তার নিয়তি। বাকিদের আরাম এবং আয়েসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া কিছুই কাজ নেই তার। এভাবেই মহাকালের আবহবিকারে বিলীন হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ। তবু শিবের এই ত্রিশূল যত ভারিই হোক তাকে বহন করতে হবে অনন্তকাল। সে মহাদেব না হলেও দায়বদ্ধ দাদা। আবার সেই আত্মগোপনের দিনলিপি গিলে নেবে তার সত্তা। ভগ্নস্তুপের ভেতর সে ইতিহাস খুঁজবে ফ্যাকাশে অসাড় সময়ের উপর দাঁড়িয়ে।
একটা পাখি ডেকে উঠল দূরে। পাখিটার নাম জানে না ময়ুখ। কিন্তু মনে হল এত মধুর শব্দ সে কখনও শোনেনি। দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল কে যেন ডাকছে তাকে। এত দূর থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল না তার চেহারা। শুধু পাখির ডাকের মতো তার গলার স্বর ভেসে আসছিল বাতাসে। শাড়িটা চেনা চেনা লাগল তার – আপনি। বিস্ময় নয় ভয়ঙ্কর জ্বালার ভেতর থেকে জিজ্ঞাসার জন্ম হল।
-বলেছিলাম না অফিস যেতে হবে। বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। এবার পরিস্কার হয়ে এল রঞ্জনা হাজরা মুখ । কিন্তু মুখে সকালের মালিন্য নেই। ময়ূখ তাকাল -ও , হ্যাঁ।
-কখন থেকে ডাকছি। উত্তর নেই কেন ? মৃদু উচ্চারণে বলে যাচ্ছে রঞ্জনা। রুক্ষতা নেই। তাচ্ছিল্য নেই। শুনতে পাইনি। এড়িয়ে যেতে চাইল ময়ুখ।
আপনাকে দেখেই তা বুঝতে পেরেছি। আপনি আপনভোলা মানুষ। প্যান্টে পানের দাগ। জামা কোঁচকানো। চুল এলোমেলো। মুখে সরলতা। নিজের দিকে না তাকিয়ে আপনি শুধু অন্যদের ভালোমন্দ দেখেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ময়ুখ। গাছের আড়ালে মরা আলো। তেজহীন রোদ। অস্পষ্ট ছায়া পড়ছে পায়ের নীচে। কেউ যেন কুরে কুরে খাচ্ছে ছায়ার ভাস্কর্য। ময়ূখ নিস্পন্দ। রঞ্জনার বুকের ভেতর থেকে ডানা মেলে বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো -সুমনা আমার বোন। তার একটা বিয়ে ভেঙে গেছে ভুল প্রেমের জন্য। জীবনে ভুল করতে করতে কেঊ সঠিকের সন্ধান করে। কেঊ অনন্তকাল দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কারন প্রত্যেকেই সুখে থাকতে চায়। তার রাস্তা ঠিক কি বেঠিক আমি জানিনা। তার প্রশ্নগুলো অমুলক কি না তার উত্তরও আমার জানা নেই। এই আত্মকেন্দ্রিক দুনিয়ায় সবাই যখন ভোগবাদের অতল গহবরে তলিয়ে যেতে চায়। তখন সুমনাকেই বা কি দোষ দেওয়া যায় ? গড়পড়তা অ্যাভারেজ মানুষ। এইসব ছোট ছোট ছায়ামানুষ দেখতে দেখতেই আমরা বেড়ে উঠি। আপনার ভাই প্রতিকুল পরিস্থিতির শিকার। আপনার বোন ভাগ্যবিড়ম্বিত। অসহায়। এদের বুকে টেনে নিয়ে সারাজীবন চলার ব্রত আপনার। এর জন্য জীবনের সমস্ত স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতেও রাজি। তবু শক্ত হাতে ধরে রাখবেন তাদের। আগলে রাখবেন সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এরকম মানবিক হাত গুটিয়ে আসছে ক্রমশ। অন্যের গলা টিপে ধরবার ,হত্যা করবার দূরে ছুঁড়ে দেবার বা কেড়ে নেবার হাতগুলো প্রসারিত হচ্ছে। বনসাই মানুষে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। বটবৃক্ষ ফুরিয়ে আসছে ময়ুখবাবু ,কে আশ্রয় দেবে। জনবহুল এই দেশে আমি তো এরকম একজনেরই সন্ধান করেছি আজীবন। ঠিক আপনার মতো দীর্ঘ ছায়াময়।
বাস এসে গিয়েছিল। ময়ুখ বলল – উঠুন। একসাথে বাকি পথ গল্প করতে করতে যাওয়া যাক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here