কৃ ষ্ণা ক র্ম কা র-র গল্প “বল্লম”

0
25
 পরিচিতিঃ  কৃষ্ণা কর্মকারপেশায় শিক্ষক নেশায় নাট্যকর্মী। লেখায় অনিয়মিত। অবরে সবরে মাথায় ঝোঁক চাপলে খাতা কলম নিয়ে বসা কিংবা কীবোর্ডে আঙুল চালানো হয়ে যায়। দু একটা পত্র পত্রিকায় সেসব ছাপাও হয়। তবে নিজেকে লেখক হিসেবে দাবি করার স্পর্ধা হয় নি কখনো।

কৃ ষ্ণা   ক র্ম কা র-র গল্প

বল্লম

ইতিহাসের দিদিমণি বেলাদি বলতেন, “তুমিই হিস্ট্রি হবে, যদি মেরুদণ্ডটাকে বল্লম বানাতে পারো”!
টুপুরের মাথার ওপর দিয়ে তখন তার অর্থ উড়ে যেতো ডানা ঝাপটে, রেখে যেতো ধোঁয়াটে একটা রেশ।
ছাত্রীদের হার্টথ্রব এই বেলাদির নিজের মেরুদণ্ডটা ধারালো বল্লম কি না, বোঝার আগেই ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী টুপুর দেখলো, বেলাদি রেজিগনেশন দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন স্কুলের গেট পেরিয়ে। পিচ রাস্তার ওপর দিয়ে সাদা শাড়িটা ছোট হতে হতে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল। রাস্তাটা পড়ে র‌‌ইলো বিকেলের মরা আলো জড়িয়ে।
বাতাসে উড়ে এলো, এলোমেলো কানাঘুষো, “চরিত্র বাঁকাচোরা না হলে কি আর স্বামী-সন্তান, বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, এমন সোনার চাকরি, সব ছেড়ে দেশান্তরী হতে হয়! শুধু কথার জাগলারিতে কত ভুলবে মানুষ! সত্যিটা একদিন সত্যি হবে।”
কী সত্যি, কী মিথ্যা জানে না টুপুর, শুধু জানে, ওই যে উঁচু ঘাড়টা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে শূন্যের দিকে, যেতে যেতে সে টুপুরের বুকে গেঁথে দিয়ে যাচ্ছে তিনটে শব্দ — “মেরুদণ্ডটা বল্লম বানাও”।

কবেকার কথা। তবু কী আশ্চর্য স্পষ্ট। যেন সিনেমা দেখছে। ভাবতে ভাবতেই গলিটার শেষ প্রান্তে তার ক্যাবটা এসে থামলো। টুপুরের সম্বিত ফিরলো ড্রাইভারের কথায়,
—— হাম আ গায়া ম্যাম।
মোবাইলে চোখ রেখে সে দেখলো, গুগল ম্যাপ নির্দিষ্ট লোকেশনটাই শো করছে। ক্যাব ছেড়ে দিয়ে নেমে দাঁড়ালো টুপুর। ঠিকানা মিলিয়ে দেখলো, নম্বরটা মিলছে, কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে বসত বাড়ি। অফিস নয়। তার ওপর ভেতর থেকে বন্ধ। এপাশ ওপাশ চোখ চালিয়ে দেখলো, রাস্তার দিকের দেয়ালে হোর্ডিং ঝোলানো, “টাইম অ্যান্ড টাইম নন গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন”। ঠিক জায়গাতেই এসেছে তাহলে।
আসলে এই এন জি ও – টা আজ তাকে ইন্টারভিউতে ডেকেছে। সত্যি! জীবন যে কাকে কখন কোথায় এনে ফেলে! এই মাসতিনেক আগেও সে ছিল “ন্যাশনাল অ্যাকোয়াসিওর” কোম্পানির চীফ ডেমনস্ট্রেটর — মোটা স্যালারি, কোয়ার্টার উইথ ফার্নিচার, টি. এ…. সব মিলিয়ে ওজনদার ব্যাপার। কিন্তু অতিমারীর ছাঁটাইয়ের কোপ হঠাৎ‌ই এসে পড়লো তার ঘাড়ে। তিন বছরের কনট্র্যাক্ট এপ্রিলে শেষ হতেই কোম্পানি এক সপ্তাহের নোটিশে ডিসমিস করলো। কর্মীছাঁটাই না করলে প্যানডেমিকের ঠেলায় কোম্পানি নাকি লাটে উঠবে। মানবিকতা দেখাতে দুমাসের স্যালারি গিফট হিসেবে হাতে ধরিয়ে বিদেয় দিল। বাধ্য হয়ে টুপুরকে ইন্দোরের পাট চুকিয়ে পরিযায়ী তকমা গায়ে এঁটে ফিরতে হলো আসানসোলে বাবা মায়ের কাছে। “আজীবন বিয়ে করবে না”, সিদ্ধান্তটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবার পর থেকেই বাবা মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা একেবারেই আলগা হয়ে গেছে। সুতরাং বাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা প্রত্যাশামতোই জুটলো না। পরন্তু পুরনো কাসুন্দি ফের ঘাঁটা শুরু হলো। টুপুরের ঘরযাপনের মুহূর্তগুলো বিষাক্ত হতে হতে তাকে ডিপ্রেশনের কিনারায় এনে ফেলছে। অথচ তার ঝুলিতে ইউনিভার্সিটির শেষ ধাপ পর্যন্ত কয়েকটা গ্ল্যামারাস সার্টিফিকেট, এক্সক্লুসিভ ফোটোগ্রাফারের স্বীকৃতি, সঙ্গে একখানা শক্ত একরোখা ঘাড়। সে থমকে যাবে একটা অদেখা ভাইরাসের জন্যে! একটা অস্থায়ী পরিস্থিতির কফিনে বন্দী করে দেবে তার স্বপ্ন আর যোগ্যতাকে! না, কিছুতে না। লড়াকু মনটাকে জিইয়ে রেখে সে নিজেকে সঁপে দিল অনলাইনের ময়দানে। ঢুঁরে ফেললো কর্মখালির প্রত্যেকটি সোস্যাল সাইট। শেষমেষ আজ সে এসেছে ইন্টারভিউ দিতে।
কিন্তু এ কেমন অফিস? দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। লোকজনের যাতায়াত নেই। আশেপাশের বাড়িগুলোও এই দুপুরে দরজা এঁটে বিশ্রাম নিচ্ছে। নক করবে কি করবে না! এদের যে কনট্যাক্ট নম্বর দেওয়া আছে, তাতে একটা ফোন করা যেতে পারে — এই এক ঝামেলা, ডায়াল করলেই লম্বা আনলক ফিরিস্তি শোনো! লোকে তো নিয়ম মেনে উল্টে দিচ্ছে! রিং হচ্ছে। একটু পরেই ওপার থেকে একটা মার্জিত মহিলা কণ্ঠ,
—– আপনি কি ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?
—– হ্যাঁ, কিন্তু ডোর তো লক…..
—– আপনি নক করুন। আমাদের লোক খুলে দেবে।
ফোনটা কেটে দিল। টুপুর নক করতেই একজন সাদামাটা কমবয়সী মেয়ে দরজা খুললো। ভেতরে একটা বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার পাতা। মেয়েটি বসতে বলে ভেতরে গেল। আর কোনো ক্যানডিডেট নেই নাকি? একটু ধন্দে পড়লো টুপুর। ডুপ্লিকেসি নেই তো? চারদিকে তো গাপ্পির ফাঁদ! বিপদে পড়লে কীভাবে নিজেকে বের করে নিয়ে যাবে, বসে বসে প্ল্যান কষতে শুরু করলো টুপুর। মিনিট দশেকের মধ্যেই ভেতর থেকে ডাক এলো। ও মনে মনে তৈরি হয়েই ঢুকলো। একটা সাদামাটা ড্রয়িং রুম। একটা বড়ো টেবিল ঘিরে গোটাচারেক চেয়ার। ওপারের দুটোতে দুজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। মুখে মাস্ক থাকার দরুন পুরো আদল এবং বয়স কোনোটাই বোঝা যাচ্ছে না তেমন। তবে একজনের রূপোলি চুল আর চোখের ভাঁজে বয়সের চিহ্ন ধরা। তিনিই ডেকে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন টুপুরকে। ইনিই ফোন ধরেছিলেন, বেশ ডিগনিফায়েড। টুপুরের বায়োডাটা নাড়াচাড়া করতে করতে দুজনে প্রথাগত কয়েকটা তথ্য জেনে নিলেন। তারপর জানালেন, ওনাদের সংস্থার ডিরেক্টরকে অ্যাসিস্ট করার জন্য টুপুরকে তাদের প্রথম পছন্দ বলে আগে ডেকেছেন, এখন ও যদি ইন্টারভিউ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারে তাহলে অন্য কাউকে পরে ডাকা হবে। এতক্ষণে ও চান্স পেলো জিজ্ঞেস করার,
—– এন জি ও-টার কাজ কি?
—– সময়ের বিনিময়ে সময় দেওয়া।
—– মানে? ঠিক বুঝলাম না। চাকরি মানে তো স্যালারির বিনিয়মে শ্রম।
—– সেটা তোমার মতো যে এখানে চাকরি করতে আসবে তার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে যারা স্বেচ্ছাসেবক তাদের ক্ষেত্রে এই “সময়ের বিনিময়ে সময়” ব্যাপারটা প্রযোজ্য। এখানে তিনজনকে মাত্র মাইনে দিয়ে রাখা হয়, আর তার টাকাটা আসে কয়েকজনের ব্যক্তিগত ফাণ্ড থেকে। বাকিদের জন্য সময়ের অ্যাকাউন্ট আছে। সেখানে প্রত্যেকের নামে নামে সময় জমা হয়।
—– আমি এখনো বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা করতে পারছি না।
—– বেশির ভাগই পারে না। আমাদের এন জি ও বয়স্ক একলা মানুষ এবং সঙ্গীহীন প্রতিবন্ধী মানুষকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় সঙ্গ দেয়। আর এই সঙ্গ দেওয়ার কাজটা করে সংস্থার কমবয়সী মেয়েরা। তাদের অ্যাকাউন্টে সেই হিসেবে সময় জমা হয়। তারা সেইসময়টাকে নিজেদের বার্ধক্যে বা রোগেশোকে অথবা তাদের কোনো প্রিয়জনের জন্য খরচ করতে পারে। এখন যাদেরকে সংস্থার পক্ষ থেকে সঙ্গ দেওয়া হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই এখানে কাজ করে সময় জমিয়েছে।
—– আই সি…. কিন্তু …. এক্সকিউজ মি, এদের চলে কী করে? আই মিন খাওয়া পরা?
—– সবাই বাইরে ছোট বড়ো যা হোক কাজ করে। নানা প্রফেশনের মানুষ, এমনকি দেহব্যবসায়ীও আছে।
শুনতে শুনতে টুপুরের মাথার ভেতর এত কিছু ভাবনা একসাথে পাক খেতে লাগলো যে ওর কথা হারিয়ে গেল। থম মেরে বসে র‌‌ইলো। কখন ওনারা উঠে গেছেন ও টের পায় নি। হঠাৎ রুপোলি চুলের ডাকে হুঁশ ফিরলো,
—– কাজটা করতে চাইলে করতে পারো। অবশ্য ইচ্ছে অনিচ্ছে তোমার।
চেয়ার থেকে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে মাস্কটা খুলে মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। টুপুরের মনে হলো, এই হাসিটা তার খুব চেনা। হঠাৎই টুপুরকে চমকে দিয়ে উনি জিজ্ঞাসা করলেন,
—— তুমি তো বিনোদিনী গার্লস এর স্টুডেন্ট। দুহাজার দশের এইচ এস। দুহাজার নয়ে আমি….
সঙ্গে সঙ্গে ওই চেনা হাসির জট খুলে গেল টুপুরের। “মেরুদণ্ডটা বল্লম বানাও” শব্দগুলো হবহু ওই মুখটার সাথে জুড়ে গেল — “বেলাদি”!!!

টুপুর “টাইম ‌অ্যান্ড টাইম” ‌এ এখন শুধু অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের জব‌ই করছে না, কয়েকজন একলা মানুষকে সময় দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে সময় জমাচ্ছে। যে প্রশ্নটা তাকে কুরে কুরে খেতো, তার উত্তরটাও সে জেনেছে বেলাদির কাছে,
— দিদি, ছাত্রীদের মেরুদণ্ডকে বল্লম বানাবার শিক্ষা দিতেন, অথচ আপনার মেরুদণ্ড নুয়ে পড়েছিল কেন সেদিন? কেন ছেড়ে এলেন স্কুল?
–কে বললো নুয়ে পড়েছে? আমি সকাল বিকেল বেশ্যাদের পাড়ায় গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াতাম। আমার পরিবার, আমার সন্তান, আমার স্কুল, আমার বন্ধুবান্ধব কেউ মানতে পারে নি। তারা আমাকে ফোর্স করেছিল, যেন ও পাড়ায় না যাই। আমি ও পাড়া ছাড়ি নি। ওদের ছেড়েছি। আজ আমার ওই পাড়ার ছেলেমেয়েরাই আমার এই কর্মযজ্ঞের হাতিয়ার।

টুপুর এখন নিশ্চিন্তে পথ চলে —- নিশ্চিন্তে ঘুমায়। নিজের অন্তরের বল্লমটার স্পর্শ যে সেও পায় আজকাল!

 

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here