সু কা ন্ত  দে-র দুটি ডানাওয়ালা গদ্য

5
193
পরিচিতিঃ জন্মস্থান – বর্ধমান। পেশা – ব্যবসায়ী। নেশা – সাহিত্য চর্চা ও সমাজসেবা। কবিতা, গদ্য, রম্যরচনা ও প্রবন্ধই মূলত তাঁর লেখার বিষয়। অসম্ভব প্রাণশক্তি নিয়ে সুকান্তর প্রশস্ত বুক নিরঙ্কুশ একঝাঁক জোনাকি। আর বিন্ধ্যপর্বতের ছোটভাই যে চুলহীন মাথাটা, তার উপর একটা এরোড্রাম। সেখানে গোটা বর্ধমান শহর তো বটেই যত জান-পহেচান আছে গোটা জীবন জুড়ে সবার জন্য আপতকালিন ঘাঁটি তৈরি। শুধু বান্ধবীদের জন্য দায়িত্ববোধের পাল্লাটা সামান্য ভারি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘স্পীড’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ‘অনর্গল’ নামের পত্রিকাটির সম্পাদক ও সংগঠক হিসাবে শহর বর্ধমানের সাহিত্য – সংস্কৃতি জগতে তিনি প্রায় অপরিহার্য । ‘যাপনের ছায়াপথ’ ও ‘কুরচিফুলের আতসকাচ’ রাবুণে হাসির মানুষটির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। বাইফোকালিজম্ জুড়ে আজ তাই তাঁরই দুটি নির্মেদ গদ্য রইল পাঠকদের জন্য।

সু কা ন্ত  দে-র দুটি ডানা ওয়ালা গদ্য

উমার আর্তি

শরীর বললে ততটা বলা হয় না, কাম বললেও নয়। শরীর ঠিক ততটা সরল নয়। মন না থাকলে সে ফাঁকা। আর মন তো কখনও সবুজ আলো ফেলে কখনও লাল। তার ঠোঁটে একদিন ঠোঁট রেখেছিলাম। অথচ সে আমাকে বলেছিল, আমি শুশ্রূষা ঢেলেছিলাম ফোঁটা ফোঁটা। আমার ঠোঁটের মধ্যে যখন গলে পড়ছিল স্তনবৃন্ত, তার হৃৎপিন্ডের জোড়ালো ধুকপুক তাকে অন্ধকার প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে দিচ্ছিল খোলা আকাশ আর আলোর দিকে। আমি অবশ্য সেসব কিছুই বুঝিনি শুধু একবার মুখ তুলে তাকিয়েছিলাম তার অপার্থিব দৃষ্টিহীনতার দিকে। কতবার সন্ধিপুজোর খ্যানের সময় গদগদ হয়ে তাকিয়েছি। দুর্গার মাটির মুখে কৃত্রিম ঘামতেল ছাড়া কিছুই দেখিনি। অথচ আজ রাত্রে যখন টুনির আলো রঙিন বৃষ্টি-ফোঁটার মতো ঝরছিল। চারপাশ ফাঁকা। গান হচ্ছিল — “বাঁহো মে চলে আও/ হামসে সনম কেয়া পর্দা” তখন গেটে তালা ঝোলানো মন্দিরের ভেতর দুর্গার মূর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হল সে এই মাটির শরীর ভেঙে বেরিয়ে আসার আকুতি নিয়ে ডাকছে। একটা মানুষী শরীরের জন্য কতো কতো যুগ তার তপস্যা। হয়তো এ সবই আমার ভ্রম। মায়া। হয়তো আমিই মনে মনে খুব চাইছি শরীর মন্দিরের তালা খুলে, কেউ মুক্ত করে দিক আমায়।

বেহালার স্রোত

দাড়িওলা কবি-লেখক-গায়ক-নাটক-বুকডিবডিব দেখলেই মনে হয় কিছু মুহূর্তে এদের দাড়ি প্রলয়ঙ্কর চুলকায়। মহাবিস্ফোরণের মতো, সৃষ্টি বেরিয়ে আসে। জ্যোতিষশাস্ত্রে লেখা আছে এরা গুণমুগ্ধ বন্ধু লাভ করে। ১৯৯৫ সালের এক বিকেলে আবিষ্কার করলাম আমি একজন গুণমুগ্ধ বন্ধু। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে চান্স পেয়ে ওরা বাবা-মায়ের মুখে হাজার ভোল্টের ল্যাম্পপোস্ট  পুঁতে চলে গেলো। আর কদিন আগে এক বন্ধু ছড়া কেটে বললেন — “ড্যাশকোটি সন্তানেরে জনক ও জননী / ইঞ্জিনিয়ার ও ডাক্তার করেছো / IAS করতে পারোনি” সে কথা থাক। সেই ৯৫ সালেই আমি বন্ধুত্ব বিষয়ে হাঁটুজল অভিজ্ঞতা লাভ করি। পকেটে খুচরো প্রশংসা নিয়ে ঘোরা বন্ধু চিনতে শিখি। তাদের কুঁচকিতে ঘামাচির বুটি। অসম্ভব চুলকানি সত্ত্বেও তারা চুলকাচ্ছে না। নিশপিস করছে তাদের হাত। ইহা এক প্রবল রোগ। যাহা, ফিরিয়া ফিরিয়া আসে। নারীকণ্ঠে এক লাইন গান — ‘সেলিকল! সেলিকল! সেলিকল মলম’। সেই কণ্ঠ এক যুবতীর। পরবর্তীতে কোমরজল, বুকজল অভিজ্ঞতাও হয়েছে। পাঁচালীর সুরের মতো সেসব অভিজ্ঞতা আমার ভেতরে কাঁদে, হাসে, হেঁচকি তোলে, সিকনি ঝাড়ে আর অসহ্য ভাড়াটের মতো থেকে যায় । জলের লাইন কেটেছি, পায়খানায় ঝঞ্ঝাট করেছি অথচ তারা হাতে বাঁশ পিছে হ্যারিকেন হয়ে থেকে গেছে বছরের পর বছর। আবিষ্কার করেছি চাহিদার সাথে ঈর্ষার সম্পর্কটা জামাই ও শেলেজ এর। এতটা দূরত্ব যে সম্ভোগ করা চলে। নিজের ছায়াকে অনুসরণ করতে করতে এভাবেই মানুষ ভুলভুলাইয়ায় ডান্ডি নাচে। বন্ধুর সাফল্য কেক এর মতো কেটে খায়। ডাকহাঁকের বন্ধুত্ব বাজারের ফর্দ হয়ে ঘেমো পায়জামার সাথে ধোপার আছাড়ে ফর্দাফাঁই। এতকিছুর পরও লেখার কাছেই থেবড়ি কেটে বসি। আশা করি। আশা। আসলে প্রতিটা লেখাই একটা দীর্ঘ কবিতার অংশ। প্রতিটা নতুন বন্ধুত্ব, সম্ভাবনা। বিশেষণের খাটো ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া। সেইজন্যই ডানা। সামাজিক ও সমাজ বহির্ভূত। যখন আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। বন্ধুকে একটুও বুঝতে না দিয়ে দাঁতকেলাই, তখন আমার অসামাজিক ডানাটাকে আড়াল করে সামাজিক ডানাটা। শুধু তাই নয়, আমার মুখে একটা নির্লিপ্ত হাসি আমি আয়না ছাড়াই দেখতে পাই। অথচ একপাটি ডানা নিয়ে ওড়া যায় না। তখনই একটা সম্ভাবনা জন্মায়। সে এসে আমার বৌকে বলে — ‘তোমার মন্ত্রপূত স্বামী তোমারই থাকবে। শুধু ওর যে মাথাটা লেখে সেই মাথাটাকে কোলে নিয়ে দু-দান লুডো খেলতে চাই। আমাকে তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। অন্তত আমি নিজেকে তোমার বন্ধুই মনে করি। ওর এক-একটা লেখা, রাজকীয় ভিক্ষুকের মতো আমার দরজায় দাঁড়ায়।। একরকম ইচ্ছে তৈরী করে। এ কোনও চাহিদা নয়। স্বপ্ন। সেটার মধ্যে বসেই দেখতে চাই মুহূর্তটা সময়ে ছক্কা ফেলতে পারে কিনা’।


সেই আমাকে দেখিয়ে দেয় আদতে ছক্কা বলে কিছু নেই। পুট বলেও না। বন্ধুত্বের মধ্যেই সম্ভাবনাময় শত্রুটিও বাস করে। নৈকট্যের ভেতরে দূরত্বের ব্যাপ্ত চরাচর। বিপরীত নয়। বিপ্রতীপ।
একটা আস্ত কামরাঙার মাঝখানে ফালি অংশ। পুরুষ-পুরুষ বন্ধুরা জীবনের একের-তিন অংশ সেখানে পুড়িয়ে ফেলে। নিজের ক্ষত খুলে দেখিয়ে যে কাঁদতে শেখায় তাকে আমি বন্ধু বলি। সে এক সময়-ভ্রমণ। ফুলটাইমার কবিরা সেখানে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। কাঁটা চিবুতে চিবুতে সাদা কাগজ লাল হয়ে যায়। লালমাটির ধুলো উড়ে একতারার আদল। সেই আদলটির কপালে একটা সিঁদুরের টিপ। শুখার বালি খুঁড়ে জল। জলের দার্শনিক ডিসপ্লের নাম জীবন। জীবনের নাম বন্ধুত্ব। বন্ধুর নাম অবনী। সে বেপাত্তা। তাকে খুঁজতে ‘ত্বমেব পিতা… সখা ত্বমেব’ গুহায় ছবি আঁকছে আদিম মানুষ। ডিফল্ট ভ্যালু শূন্য। শূন্যের ভেতর তিনমহলা। সেখানে ঝরকাকাটা আলো ঠিকরে অক্ষর। অক্ষর সাজিয়ে খুঁজতে থাকা। সেই যে একবার মামারবাড়ি গিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে একটা দৃশ্যের অংশ হয়ে গেছিলাম। ঝিঁঝিঁর ডাক নিস্তব্ধতা বুনতে ব্যস্ত। মাঝখানে রাস্তার আভাষ। তার দু-পাশে ধানগাছ। গোড়ায় জল। জলের বুকে জোৎস্নার মুখ রাখা। পুবদিকে কোড়াচাঁদ। সেই অতলান্ত চরাচরে সকলেই জীবন্ত। তারা আমাকে গ্রহণ করলো। তেমনই একটা দৃষ্টিকে লিখতে চেষ্টা করছি। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সে তার স্থির দৃষ্টি ঢেলে দেবে যাত্রীটির চোখে। ভয় পুড়িয়ে দেবে। একাকীত্ব পুড়িয়ে বলবে –আছি।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here