ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস চোরাবালি(প্রথমপর্ব)

0
247
পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস  ‘চোরাবালি‘-র প্রথম পর্ব

 

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস (প্রথমপর্ব)

 

চোরাবালি

এক

সাইকেলটা ব্রীজের সিমেন্টের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করালো দেবু। এখনো আড় ভাঙেনি দামোদরের, তিরতিরে একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে পূব দিক থেকে। টোল বুথের পাশে ঝন্টুর চায়ের দোকানের ধোঁয়া এসে জমছে চরের উপর। আরো কত আশেপাশের ধোঁয়া এসে স্থির হয়ে আছে চরের ঠিক ওপরে একটা চাদরের মতো। এই সাত সকালেই আরামবাগ রোডে এত ট্রাক কোথা থেকে আসে কে জানে! মাঝে মাঝে আরামবাগ –বর্ধমান রুটে একটা দুটো বাস, বেশ ভিড় নিয়ে “সদরঘাট-তেলিপুকুর–কলেজ মোড় – বীর হাটা – কার্জন গেট – বাদামতলা -তিনকোনিয়া –স্টেশান- ” কন্ডাকটর গলা বাড়িয়ে দরজা পেটাতে পেটাতে পেরিয়ে যাচ্ছে। এই পেরিয়ে গেল “মা মেহুলা’’ বাসটা! এমনিতে বাসে আসে দেবু, মাঝে মধ্যে সাইকেলে করে আসে বিশেষ করে যেদিন টি.ডির কাছে টিউশান থাকে ।

হাল্কা হাওয়ায় মন্দ লাগছে না দেবুর। পকেট হাতড়ে ফ্লেক বের করে ধরায়। আনমনে এমনি দাঁড়িয়ে থাকে নদীর দিকে মুখ করে। দূরে একটা হলুদ রঙের জেসিবি লোহার প্রকান্ড হাত নিয়ে চরের উপর দাঁড়িয়ে। দেবু ঘাড় ঘুরিয়ে এবার সদর ঘাটের দিকে তাকায়, আরও মিনিট পাঁচেক ও দাঁড়াতেই পারে, সময় আছে, তারপর নাহয় টেনে চালাবে সাইকেল। একটা মুশকিল আছে, বার বার চেন পড়ে যাচ্ছে। বাদুলিয়ার বাড়ি থেকে এখান অবধি আসতে তিন বার চেন পড়েছে। মনে মনে একটু বিরক্ত হয় দেবু …ধুস! এই লড়ঝরে সাইকেল চলে নাকি! বাবাকে বলে বলে বোঝাতে পারেনি একটা বাইক নেওয়ার জন্য! আজকাল কত্ত সহজে পাওয়া যায় কিস্তিতে। আজ একটা বাইক থাকলে আধঘন্টা সাইকেল চালিয়ে ওকে আসতে হতো!

জোরালো হর্নে দেবুর এলোমেলো চিন্তার তার ছিঁড়ে যায়।

“ কি বে! এখানে একা দাঁড়িয়ে কী করছিস? কাউকে টাইম দিয়েছিস নাকি!”

রজত, দেবুর বন্ধু, কাছেই পলেমপুরে থাকে, বাবার সার –বীজের ব্যবসা, ছমাসের ঝকঝকে নতুন পালসার নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিঃশব্দে হাসে দেবু। “নারে, একটু ফুঁকে নিচ্ছি, এখনো টাইম আছে। রাতে যা গরম ছিলো, একটু হাওয়া খেয়ে নিলে শরীর একদম তাজা- ফ্রেস । ”
রজত পালটা হেসে বাইক হাঁকিয়ে চলে যায়। দেবু তাকিয়ে থাকে লাল ঝক ঝকে বাইকটা বিন্দু হয়ে যাওয়া অবধি। রজতকে ও চেনে অনেকদিন। ওদের অবস্থা জানতো, গত পাঁচ বছরে অবস্থা ফিরেছে ওদের। পাকা দালান বাড়ি, বাইক, ডিশ টিভি, এল ই ডি – কি না করেছে বাড়িতে! একটা মেয়ে পটিয়েছে বর্ধমানে, ওদের কলেজেই পড়ে। প্রায়ই বাইকের পিছনে করে নামিয়ে দিয়ে আসে রজত, আরও কোথায় কোথায় যায়। দারুন দেখতে। কি যেন নাম …দেবু মনে করতে পারেনা …
কলেজের গেটের কাছে পৌঁছে অল্প হাঁফায় দেবু। গেটের কাছে একটা জটলা, কদিন লেগেই আছে। সামনে কলেজে ইলেকশান। খবর আছে এবারে লাফরা হবেই। মনোজদের দাদাগিরি আর কেউ মানছে না, এইতো সেদিন আর্টস ফ্যাকাল্টি তনুপমস্যারকে ওরা ধাক্কাধাক্কি করেছে। ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়েকে নবীন বরণের দিন সংসদের বরুন ওপেন হাত ধরে টানাটানি করেছে। ভেতরে ভেতরে সব ক্ষেপে আছে। কিন্তু দেবু জানে কিস্যু হবে না, কাউকে নমিনেশান ফেলতেই দেবে না মনোজরা!
চৈতালি ম্যাডামের ক্লাস দেবু মিস করেনা সাধারনত। কেমন নেশার মতো লাগে ওনার পড়ানো! শব্দগুলো কানে আসে ঠিকই কিন্তু দেবুর লক্ষ্য থাকে ম্যাডাম কখন বসছেন, উঠছেন, গলা উঁচিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করছেন কিছু। দেবু তাকিয়ে থাকে ম্যাডামের লম্বা ঘাড়ের দিকে, তার ধীর মোলায়েম মোচড়ের দিকে বুঁদ হয়ে। ম্যাডামের ঘাড়, ঘাড়ের একটা বেশ বড় আঁচিল, একফালি কোমর … পিছন ফিরলে অর্ধবৃত্ত অনাবৃত পিঠ … দেবুর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। ক্লাস শেষ হলে ধীর ছন্দে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যান যখন একটা কম্পন ওঠে ম্যাডামের নিতম্বে। যেতে যেতে প্রথম সারিতে বসা দেবুর দিকে চোখাচুখি হতেই মৃদু ভ্রু কুঁচকে বুকের আঁচল একটু টেনে  নেন অভ্যাসে। বিস্ফারিত তাকিয়ে থাকা দেবু সসঙ্কোচে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় … ফেরাতে ফেরাতে দেবুর চোখে পড়ে ম্যাডামের ভিজে ওঠা ব্লাউজের বাহুমুল…
ঘোর কাটিয়ে স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসে দেবু। একটা সিগারেট খেতেই হবে ওকে, নাহলে মাথা ছাড়বে না। চৈতালী ম্যাডামের ক্লাস  থাকলেই এটা ওর ভীষণ জরুরী হয়ে পড়ে। টি.ডি-র কোচিং ক্লাসে ওকে পৌঁছাতে হবে ১৫ মিনিটে! এখান থেকে ভাতছালা এমন কিছু নয় রাস্তা। দেবু সাইকেল ছোটায়।
ঢুকতে ঢুকতে আড় চোখে দেখে নেয় নন্দিতা পাশে বসা ওমেন্সের মেয়েটার সঙ্গে নিচু গলায় কী বলছে। আগেই এসে পড়েছে মনে হচ্ছে।
“কিরে! ঘেমে গেছিস যে! কেউ তাড়া করেছিলো নাকি!!” নন্দিতা জিজ্ঞেস করে কৌতুকভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দেবুর দিকে। দেবু নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ে হ্যাঁ সূচক। পেতে রাখা শতরঞ্জীতে বসতে বসতে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “তোর বাবা।” নন্দিতা কপট রাগ দেখিয়ে কনুইয়ের গুঁতো দেয় দেবুকে।

ঘন্টা দেড়েক পর ক্লাস শেষ হয়। ওরা তিনটে মেয়ে আর আটজন ছেলে বেড়িয়ে আসে ১০ বাই ১২ ঘরটা থেকে। টি.ডি বসেন একফালি একটা তক্তোপোষে, ওদের বসার জন্য মেঝেয় বড় শতরঞ্জী পাতা থাকে। জানালায় জলের বোতল। প্রয়োজনে একমাত্র মেয়েদের বাড়ির ভিতরের বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি আছে, শর্ত একটাই ভালো করে জল দিতে হবে – এটা প্রথমদিনই টি.ডির স্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের। ওরা টি.ডির স্ত্রীকে ‘বৌদি’ বলেই সম্বধোন করে, নতুনরা কেউ কেউ ‘ম্যাডাম’ বলে ফেলে।
দেবু আর নন্দিতা পাশাপাশি হাঁটছে। নন্দিতা বর্ধমানেই থাকে, শ্যামলালে। দুজনাই সাইকেল ধরে গড়িয়ে নিয়ে চলেছে। দেবু যদিও উল্টোদিকে যাবে, তবে রোজই ওরা ভাতছালা মোড় অবধি একসঙ্গে যায় । সর্বমঙ্গলা মন্দিরের আগে বাঁকার পুল অবধি নন্দিতাকে এগিয়ে দিয়ে তারপর ফেরে দেবু। আজও ধীরপায়ে ওরা এগোচ্ছে ঐদিকেই …

“তোর পাশে ওই মেয়েটা কেরে?” দেবু জিজ্ঞেস করে।

“কেন! তোর কিসের দরকার?” চোখ সরু করে নন্দিতা পালটা প্রশ্ন করে …

“না এমনি …নতুন মুখ তাই …”

“নতুন মুখ না সুন্দর মুখ তাই ..!!!.”

“সেটাও বটে …” হেসে ওঠে দেবু।

“নতুন শ্যাম্পেল দেখলেই নজর পড়ে নারে …শশশালা…”  দেবুর পিঠে একটা মৃদু কিল মারে নন্দিতা।

“মারিস না …তখনকার গুঁতোর ব্যথা এখনও আছে … ”

কয়েক মুহূর্ত ওরা নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। একটা সুন্দর গন্ধ টের পাচ্ছে দেবু। গন্ধের উৎস যে নন্দিতা সেটা বুঝতে পারছে। নিশ্চয়ই নতুন কোনো ডিও! নন্দিতার বাবা ব্যাঙ্কে আছেন, ওরা এক ভাই এক বোন। ভাই নন্দিতার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে, একটু আদুরে হলেও মেয়ে ভালো নন্দিতা। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ওদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব জমে উঠেছে ধীরে ধীরে। পড়াশুনায় ভালো নন্দিতার আলাদা করে কোনো দেমাক নেই অন্য অনেক মেয়েদের মতো – এটা দেবুর মতো মাঝারি মানের ছেলের সবথেকে ভালো লাগে। খুব একটা মুখচোরা না হলেও বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে নন্দিতার সঙ্গেই বেশ খোলামেলা কথা বলে স্বস্তি পায় দেবু। মাঝারি গড়নের, মাঝারি বর্ণের নন্দিতাকে মোটামুটি সুন্দরীদের দলেই ফেলা গেলেও ওর হাবেভাবে মনে হয়না সে এসব নিয়ে বিশেষ সচেতন। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে একটা উদাসীনতা যেন ইচ্ছে করেই নন্দিতা বহন করে। ও জানে ক্যাম্পাসের ঢোকার মুখে বা ক্লাসে অনেক জোড়া চোখই ওকে আপাদমস্তক জরিপ করে, মুগ্ধতায়…লোলুপতায়, ও গ্রাহ্য করেনা। নন্দিতা জানে আর সব মেয়েদের মতই, ও এখন পূর্ণ বিকশিত নারী শরীরের মালিক … যা প্রলুব্ধ করবেই, এ আর নতুন কথা কি! দেবু ওকে সম্ভবত মেয়ে কম বন্ধু বেশী নজরে দেখে, অন্তত ওরতো তাই মনে হয়। এটুকু বয়েসে নন্দিতা অন্তত পুরুষ মানুষের দৃষ্টির ভাষা পড়তে শিখেছে বৈকি। দেবুর খোলামেলা কথাবার্তা বলার ধরন, আলাদা করে বোকা বোকা ইম্প্রেস করতে চাওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করাই ওকে নন্দিতার ভালোলাগার কলেজে অন্যতম বন্ধু করে তুলেছে।

“কি মেখেছিস রে?”

“ফগ-ইয়েলো…ভালোনা গন্ধটা!”

“হুম… তোর সেই কাকুর ছেলের কি খবর?”

“কে ! …ওঃ … এর মধ্যে আসেনি …কেন তোর এত আগ্রহ কেন?”

“ঝুলে পড় …মালটা ভালই, নাদুস নুদুস…মালকড়িও আছে …”

“তোকে জ্ঞান দিতে হবেনা … আমার ভালো আমি বুঝে নেবো …”

“নাঃ! তোর ভালো তোর বাবা বুঝবে…”

“বুঝুক না! … আমি এখন ফাঁসছিনা …”

“তাহলে কি করবি? …যদি জোর করে বাড়িতে!”

“জোরাজুরি করে পাত্তা করতে পারবেনা … আগে গ্র্যাজুয়েশান … বিএড … এস এস সি … তারপর ওসব ফতনা নিয়ে ভাববো … এই তুই খোঁজ নিয়েছিলি ‘আকাশ ফাউন্ডেশান’ এর ব্যাপারটা!”

দেবু চুপ করে থাকে। তাইতো! একদম ভুলে মেরে দিয়েছে! নন্দিতা বলেছিলো বটে …

“তা নিবি কেন! …কলেজে এসে দাঁত বের করে শুধু মেয়ে দেখ … কিস্যু হবে না তোর দ্বারা …”

“দেখব নাতো কি ! শুধু তো দেখি …এই বাজারে একটা বাইক-টাইক নাহলে মেয়ে পটে! লাইফটা হাঁসে খেয়ে দিচ্ছেরে নন্দিতা … ”

“আহারে! তা নিজে একটা কেন না!”

“কিনবো কিনবো … দেখে নিস, ঠিক কিনবো …তোকেই প্রথম চড়াবো …”

“যা যা আর বাতলিং দিসনা দিকি … আমি চললাম, দেরী হচ্ছে …কাল আসবি তো কলেজ …?”

“দেখি …”

“ওক্কে বাই …”

“বাই …”

নন্দিতা সাইকেলে চড়ে প্যাডেলে চাপ দেয়। বাঁ দিকে দুর্গামন্দিরটা পেরিয়ে বাঁকার পুলের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায় …কয়েক মুহূর্ত ওই অদৃশ্যমানতার দিকে তাকিয়ে দেবুও উঠে পড়ে সাইকেলে।

বেশ জোরেই সাইকেল ছোটায় দেবু, এটা ওর স্বভাব। দূরত্ব থাকলেও বাড়ি ফেরার কোনো নির্দিষ্ট তাড়া নেই ওর, কিন্তু ওর নিজের মধ্যেই তাড়া …কিসের তাড়া! ও সম্ভবত নিজেও জানে না। জোরে সাইকেলে সদরঘাট পেরিয়ে দেবু কৃষক সেতুর উপর যখন ওঠে শোঁ শোঁ করে এলোমেলো হাওয়া বইছে ব্রীজের উপর, ওপারের দোকান গুলোয়, বাঁধের পাশের বাড়ি গুলোয় ইতিউতি আলো জ্বলে উঠেছে। অন্ধকার পুরোপুরি নামতে এখনও বেশ দেরী। ঝন্টুর দোকান পেরিয়ে গিয়ে ঢালটায় প্যাডেল ছেড়ে দেয় দেবু … কিছুক্ষণ ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে চলে যাওয়া যায় এখানটায়।
বাদুলিয়া মোড়ে বিপিনদার ওষুধের দোকানে দাঁড়ায় দেবু। মায়ের প্রেশারের ওষুধ, বোন মণির ইনহেলার নিতে হবে, এই দায়িত্বটা বাবা ওর উপরেই দিয়েছে। আসার সময়ে টাকা ধরে দিয়েছে হিসেব করে। ‘নিউ ব্যানার্জি ফার্মেসী’র সামনে সন্ধ্যায় একটা ছোট্ট আড্ডা বসে বিপিনদার বন্ধুদের। দেবুকে দেখে তাদেরই একজন, মলয়দা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল অদ্ভুত ভাবে …
“কি দেবুবাবু! কলেজ থেকে ফেরা হচ্ছে বুঝি? … তা বেশ বেলা হলো মনে হচ্ছে!”

মলয়দাকে বিশেষ পছন্দ করেনা দেবু। পঞ্চায়েত সদস্য হয়ে থেকে হাতে মাথা নিচ্ছে! সবসময় একটা হামবড়া ভাব। সবাই জানে, এবারের ১০০ দিনের কাজে কী কারবার হচ্ছে! মলয়দাও যে খুব একটা ওকে পছন্দ করে তাও মনে হয়না দেবুর … তার মূল কারণ ওকে ঠিক বাগে আনতে পারছে না মলয়দা, যতবার মিছিলে যেতে বলেছে দেবু নানান ছুতোয় এড়িয়ে গেছে, কিংবা যাবো বলেও যায়নি। দেবু জানে ওদের ক্লাব ‘নবারুণ স্পোর্টিং ক্লাব’ এর যে কটা মাত্র ছেলেকে এখনও লোকাল পার্টি পোষ মানাতে পারেনি – তাদের মধ্যে ও একজন।

“হ্যাঁগো …টিউশান ছিলো…তাই …”

“ বটেই তো!… ভালো করে পড়াশুনা কর … তোর বাবার তোকে নিয়ে অনেক আশা … বুঝলি কিনা … যা যা বাড়িতে মা-বোন একা আছে … তাড়াতাড়ি বাড়ি যা…”

ওষুধের প্যাকেটটা ওর পিঠের ব্যাগে ভরে নেয় দেবু। ওষুধ ও বর্ধমানের হোলসেল থেকেও আনে মাঝে সাঝে, কিন্তু বিপিনদার কাছে সুবিধা … এখানে খাতা আছে ওদের দরকারে অদরকারে, অসুখ-বিসুখে বিপিনদাকে হাতের কাছে পেয়ে  যায় ওরা। দোকানের পিছন দিকেই একটা চেম্বার আছে যেখানে বিপিনদা কোয়াক প্র্যাক্টিস করে, রাত-বিরেতে গ্রাম গঞ্জে এরাই তো ভরসা!

সন্ধ্যা নেমেছে দেবুদের বাড়ির পিছনের বিস্তীর্ণ আবাদি প্রান্তরে। দক্ষিন দামোদরের বর্ধিষ্ণু অঞ্চলের গ্রাম হলেও গ্রামের নিয়ম মেনেই সন্ধ্যা নামতেই পাড়া কিছুটা নিঝুম। নেপালদার  আধপাকা টিনের শেডের ‘ধর্মরাজ হেয়ার কাটিং সেলুন’ থেকে মৃদু ভেসে আসছে এফ এম-এর গানের মূর্ছনা… গানের মাঝে মাঝে প্রগলভ গলায় নারী কন্ঠের কথাবার্তা… বছরের এই সময়ে ওদের এলাকায় এফ এম ভালো ধরে। আবছা অন্ধকারে মাঠভরা কচি ধানের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে দেবু। এখন বোরো চাষের সময়। ওদেরও অল্প কিছু জমি আছে কিছু দূরে, শরীকি ভাগে এখন তার পরিমাপ দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন বিঘের মতো। এছাড়া ওদের এই বাড়ি, যা ওর বাবারই করা।  ওদের বাড়ির দাওয়ায় বসে নিচু পাঁচিলের ডান দিক দিয়ে রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। দূর থেকে বাইকের আলোগুলো দেখতে পায় দেবু, এখন অনেক বাইক বেড়েছে ওদের গ্রামে, দশবছর আগেও সারা গ্রামে মাত্র দুটো বাইক ছিলো। বাবা নিতান্ত ছাপোষা মানুষ দেবু জানে, অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুলের টিচার ওর বাবা কার্তিক সানা।  নিজের যতটুকু – তাতেই যেন সন্তুষ্ট বাবা! মানুষ এত অল্পে কি করে সন্তুষ্ট থাকতে পারে দেবু বুঝতে পারেনা। অভাব নেই, ওদের খাওয়া পরা চলে যায় নিশ্চিন্তেই, কিন্তু শুধু কি খাওয়া পরাই যথেষ্ট একটা জীবনে! নাঃ! দেবুর নিজের চিন্তায় তা মোটেও যথেষ্ট নয়। বাইরের ঘরে মা ‘মা’ দেখছে নিবিষ্ট মনে, ভিতরের বাঁদিকের ঘরে মিনু দুলে দুলে পড়ছে, গুন গুন করে পড়ার আওয়াজ আসছে। বাবা এসময়টায় প্রায় কোনো দিনই থাকে না বাড়িতে। সম্ভবত সিধু জ্যেঠুর বাড়ি গেছে, কিংবা বাগদি পাড়ায়। বাগদিপাড়ার দুলেকাকাই ওদের জমিজমা দেখে, ভাগচাষি। বহুকাল ধরেই ওরা দেবুদের জমিজমা দেখছে। দেবু শুনেছে জল নিয়ে কি একটা সমস্যা হয়েছে। পাশের জমির ঘোষেদের সঙ্গে আল কাটা নিয়ে একটা হুজ্জুতি হয়েছিলো গতবার। বোরো চাষে জল বড় জরুরী জিনিষ, এবং তার মূল ভরসা শ্যালো বা ডিপ টিউবওয়েল, ঘন্টাপিছু দর করে জল কিনতে হয় ওদের।

মায়ের দিয়ে যাওয়া চায়ের সঙ্গে মুড়ি কখন শেষ হয়ে গেছে খেয়াল করেনি দেবু। কাপ আর বাটি বারান্দার এক কোণে রেখে উঠে যায় উঠোন পেরিয়ে দরজার বাইরে। দেবুর পরণে একটা পাতলা গেঞ্জী ও বারমুডা প্যান্ট, বাড়িতে এই পরে ও, বাবা চিরকাল বাড়িতে লুঙ্গি পরলেও ওর ওই জিনিসটি একদম পছন্দ নয়। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি ঠিক মতো গরম পড়তে এখনও কিছুদিন। খোলা মাঠের ঠান্ডা বাতাসে পাতলা গেঞ্জী পরা দেবুর শিরশিরানি লাগছে, ভালও লাগছে। গেটের সামনে থেকে একটু সরে গিয়ে বারমুডার পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। কাল ওকে ঠিক খোঁজ নিতেই হবে ‘আকাশ ফাউণ্ডেশান’ এর, নাহলে নন্দিতা ওকে গালাগাল দিয়ে উদ্ধার করে দেবে।

 

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here