“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ(৩য় পর্ব)

1
50
পরিচিতিঃ জন্ম ও বড়ো হওয়া মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায়। সেরিকালচার ও বাংলা বিষয়ে স্নাতক। বাংলায় স্নাতকোত্তরের পরই লেখার জগতে প্রবেশ ছোটো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ সাহিত্যের হাত ধরে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশিত বই দুটি- ছোটো গল্প ‘যাপ্যযাত্রা’ (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ২০১৮ হিসাবে ডা: ব্রজগোবিন্দ সাহা পুরস্কারে ভূষিত) ও নভেলা গ্রন্থ ‘আমি বৃক্ষপুরুষের প্রেমিকা’।

 

গরীবের ঘোরা রোগ-এ রুমকি রায় দত্তর মণিপুর ভ্রমণ

 

মণিপুরের পথে পথে

৩-য় পর্ব

 

চলেছি “কেইবুল লামজাও জাতীয় উদ্যান” “keibul Lamjao National Park” দেখতে। গাড়ি ইম্ফলের শহুরে রাজপথ ছেড়ে ছুটে চলেছে। কোথাও আধপাকা ধুলো ঢাকা রাস্তা। একে একে মনিপুরের একেকটি জেলায় পা রাখছে আমাদের গাড়ি। সেনাপতি জেলা ছেড়ে ছুটে চলেছি বিষ্ণুপুরের পথে। এই জেলারই ছোট্ট শহর মইরাং (moirang) এ আছে পৃথিবীর বৃহত্তম মিষ্টিজলের হ্রদ ‘লোকতাক হ্রদ’।


গাড়ি ন্যাশেনল পার্কের সামনে এসে দাঁড়াল। ঢোকার মুখে গেটের বাইরে বাঁ-দিকেই টিকিট কাউন্টার। পাশে কতগুলি শুকনো খাবারের দোকান ও পেইড টয়লেট। সামনের সুদৃশ্য গেটের ভিতরে আঁকাবাকা রাস্তা হারিয়ে গিয়েছে বনের মধ্যে। আমরা ঐ পথেই ছুটে চললাম। অদ্ভুত সুন্দর ভালো লাগায় ভরে উঠল মন ঐ ছায়াশীতল বনপথে। বাঁকে বাঁকে রহস্যের পরত সরিয়ে এগিয়ে চলেছি।এই জঙ্গলে কী কী পশু আছে জানি না, তবে আমরা যাকে দেখতে যাচ্ছি, তিনি পৃথিবীর বিরলতম এক লুপ্তপ্রায় হরিণ “ সাঙ্গাই” ( danching Deer)। আর এই উদ্যানটিও পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান উদ্যান। লোকটাক হ্রদের উপরে ভাসমান এই উদ্যানটি আয়তনে ৪০ বর্গ কিলোমিটার।


গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা সবুজ ঘেরা অংশে। চেয়ে দেখলাম, এই অংশটিরও সৌন্দর্য কম কিছু নয়। একটা কাঠের ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। এইখান থেকেই পুরো ভাসমান উদ্যানটিকে বিস্তৃত অংশে দেখা যায়। আর সৌভাগ্য থাকলে দেখা যেতে পারে সেই বিরল প্রাণী সাংগাইকে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার বললেন, ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় মাঝে মাঝে। ভিউ পয়েন্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম, সরু একটা ডিঙি নৌকা উদ্যানের মাঝে ভেসে চলেছে। দু-পাশে ঘন ঘাস। এই ঘাস ভাসমান। জায়গা পরিবর্তন করে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে নৌকার ত্রিকোণ ঘন নীল জল দুপাশে ঠেলে এগিয়ে চলেছে। ঐ নৌকা গুলোতে পর্যটকদের ভ্রমণ করানো হয় উদ্যানে টাকার বিনিময়ে। আমরা গেলাম না, এক অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলাম সাঙ্গাই- এর খোঁজে। খালি চোখে শুকনো ঘাস ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। ‘নিক্কন কুলপিক্স’ জুম ৩০x ক্যামেরা আমার। ঐ ক্যামেরায় তাক করছি পুরো ভাসমান উদ্যানের যতটা একসাথে পাওয়া যায়। হঠাৎ মনে হল, দূরে সাধারণ দৃষ্টির বাইরে কী যেন একটা ঘাসের বনের বুকে ঢেউ তুলে হারিয়ে গেল! মস্তিষ্ক সচেতন হল আমার। দূরবীন তো নেই। ক্যামেরার লেন্সকেই কাজে লাগিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলাম। যদি সত্যিই দেখে থাকি ঘাসের বুকের ঢেউ, তবে তিনি সেখানেই আছেন। আর অবশেষে তাকে দেখলাম। অতিরিক্ত জুমে পুরো স্বচ্ছ নয়, তবু তাকে দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ‘আমি দেখতে পেয়েছি’।


অনেকেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এই উদ্যানে ঘুরতে এসেছেন তখন। সকলেই আমার দিকে ঘুরে তাকল। কেউ বাঙালি নয়, তবে আনন্দের ভাষা বোঝার জন্য আলাদা করে ভাষা জানতে হয় না। আমাকে দেখেই সবাই বুঝতে পেরেছেন। এক বিদেশী দম্পতি এগিয়ে এসে আমার ক্যামেরায় ছবি গুলো দেখতে চাইলেন। দেখালাম। তাঁরাও উৎসাহিত হয়ে আমার ক্যামেরায় চোখ রেখে অনেক খুঁজলেন,কিন্তু আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ভিউ পয়েন্ট থেকে কিছুটা বাইরে এসেই ঠিক উলটো দিকে এক পাহাড়ি ঢালের গায়ে ধাপে ধাপে উপরে ওঠার পথ নজরে এল।টিলার মাথায় একটা ভিউ পয়েন্ট। পথটি লম্বা খাড়া বনবীথির মাঝ দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। বেশ খাড়া। কিছুটা উঠে শ্বাস ঘন হয়ে আসে। পায়ের পেশিতেও বেশ টান ধরে। তবু ঐ টিলার মাথার হাতছানি উপেক্ষা করা যায় না। উপরে পৌঁছতেই নজর হারিয়ে গেল লোকটাকের সীমাহীন বিস্তৃত শান্ত নীল জলের শোভা দেখে। জলের উপরে ভাসমান ঘাসের রিং যেন। ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবেই তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। সময়ের হিসাব থাকে না, তবু সময়ের হিসাব মিলাতেই হয়। নেমে আসি নীচে। এবার যাব ঐ লোকটাকের নীল জলের কাছে।


কেইবুল পার্ক থেকে বেরিয়ে অল্প মিনিট পাঁচেকের দূরত্ব লোকটাকের অংশের। সরু রাস্তার দু-পাশে খাঁড়ির মাঝে নৌকায় জাল ছুঁড়ছে মাছচাষীরা। এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই ভিতরে বোটিং অফিসের সামনে এসে পৌঁছালাম। ছ’জনে একটা নৌকা বুক করলাম। সাতশ টাকা তখন।আধঘন্টার জন্য। কথা হল, ভালো লাগলে একঘন্টা ঘুরব, আর বাকি টাকা ফেরার পর দিয়ে দেব। এখানে এমনটা হয়।কাজেই আমরা কোনও নতুন ব্যাপার ঘটালাম, এমটা দাবি করি না । সুন্দর সুসজ্জিত বোট। দুটি ছোটো ছেলে চালাচ্ছে। চালাচ্ছে বললে ভুল হবে। শুধু ভাসিয়ে দিয়েছে নৌকা। একটু একটু করে এগোচ্ছি। সেই ভূগোলের বইয়ে পড়া ভারতের বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ লোকটাকের বুকেই আমরা এখন ভাসমান, এ যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।
এখানে আসার আগে নেটে অনেক খুঁজেছি এই অঞ্চলেই লেকের কাছেই কোনো হোটেলে থাকার ঠিকানা। নেটে দেওয়া নাম্বারে বারবার স্থানীয় মানুষদের কাছে ফোন চলে গিয়েছে।

সেই মানুষগুলোর মাঝেই পুরো একটাদিন কেমন ভাবে যেন কেটে যাচ্ছে। আশ্চর্য লাগছে। নৌকা থেকেই লেকের জলে হাত ছোঁয়ালাম। কেমন যেন এক ঐতিহাসিক রোমাঞ্চ জাগল মনে। বাস্তবের আঙিনা থেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো।

ক্রমশ…
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ(২য় পর্ব)

Leave a Reply to Anonymous Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here