“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ

0
103
পরিচিতিঃ জন্ম ও বড়ো হওয়া মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায়। সেরিকালচার ও বাংলা বিষয়ে স্নাতক। বাংলায় স্নাতকোত্তরের পরই লেখার জগতে প্রবেশ ছোটো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ সাহিত্যের হাত ধরে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশিত বই দুটি- ছোটো গল্প ‘যাপ্যযাত্রা’ (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ২০১৮ হিসাবে ডা: ব্রজগোবিন্দ সাহা পুরস্কারে ভূষিত) ও নভেলা গ্রন্থ ‘আমি বৃক্ষপুরুষের প্রেমিকা’।

 

গরীবের ঘোরা রোগ“-এ রুমকি রায় দত্তর মণিপুর ভ্রমণ

মণিপুরের পথে পথে

১ম পর্ব

ভ্রমণ মানেই তো ঐ দূর দিগন্তছোঁয়া পথ! দিগন্ত ছোঁবো আর পথের কথা বলব না? ধূলিধূসরিত এপথে যাত্রা শুরু হল মিজোরামের রাজধানী আইজলকে পিছনে ফেলে। রাজধানীর রাজকীয় ভারী পোশাকের ঔজ্বল্যে ঢাকা ছিল মিজোরামের নগ্নতা, বুঝতে পারলাম পথে নেমে। দিনটা ২৬শে ডিসেম্বর। একে একে ছুঁয়ে চলেছি মিজোরামের প্রত্যন্ত সব গ্রাম। ঔজ্বল্যহীন দারিদ্রতার চিহ্ন; ধুলোমেখে দাঁড়িয়ে পথের দু-ধারে। অথচ এই বড়োদিনের দশদিন পুরো মিজোরাম উৎসবে মশগুল হয়ে থাকে। একটা করে জেলা ছাড়িয়ে যাচ্ছি আর মাঝে দীর্ঘ বনপথ। যেখানে যেখানে বসতি নজরে আসছে, লক্ষ করলাম প্রতিবাড়িতে গেটের সামনে গাছে টাঙানো উজ্জ্বল রঙের স্টার। রাস্তা ভালো না। গাড়ির কাচ বন্ধ করেই চলতে হচ্ছে ধুলোর জন্য। থমকে থাকা রেলপথের কাজের জন্য কোথাও কোথাও রাস্তা ভীষণ খারাপ। ঘুরপথের অবস্থাও শোচনীয়। সবুজ গাছের পাতার উপর পুরু ধুলোর স্তর। জনমানবহীন পথে হঠাৎ দেখা পাওয়া বলিরেখা আঁকা বৃদ্ধ মুখের। পাইনের বন, বাঁশের ঝাড়, খাদের কিনারা ধরে দাঁড়িয়ে, কিন্তু সে বৃদ্ধ পিঠের টুকরীতে কাঠ ভরে হেঁটে চলেছে সামান্য ঝুঁকে। নিরুত্তাপ! নির্বিকার! অভিযোগহীন এক সংগ্রামী জীবনের প্রতীক।

একটানা তিনঘন্টা চলার পর একটা জঙ্গলের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লাম। পায়ের নীচে ধুলোর চাদর। এতটা পথ এলাম, অথচ পথে একটাও গাড়ি নজরে এল না। আসলে, বড়োদিনের দশদিন মিজোরামে সব গাড়ি বন্ধ থাকে। কোনও গাড়ি বাইরে যায় না, আবার বাইরের গাড়ি আসে না। তবে আমরা কীভবে চলেছি, প্রশ্ন আসতেই পারে। ভোররাতে ঘুমথেকে উঠে কপাল জোরে শিলচরের একটা গাড়ি পাকড়াও করেছি। পুরো বুকিং।

পথের কথা বলতে বলতে, দিগন্তের কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা চলেছি ”মনিপুর”। কিন্তু সে দীর্ঘপথ একদিনে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তাই রাতটা শিলচরে বিশ্রাম। বেরোনোর সময় শুনেছিলাম, মিজোরাম থেকে শিলচর আসলে ঘন্টা চারেকের রাস্তা। কিন্তু অর্ধেক পথ আসার পর বুঝলাম, রাস্তার যা হাল, তাতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় ঘন্টা তো লাগবেই।

আমরা যেখানে ক্ষণিক বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালাম, অনতিদূর থেকেই ভেসে আসছিল গম্ভীর ঝরণার আওয়াজ। একটা সবুজ ঝোপেঢাকা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম, কাছাকাছি কোনও পাহাড়ি ঝরণা আছে, যার জল খাদের পাদদেশ ছুঁয়ে কুলুকুলু রবে বয়ে চলেছে। আর সময় নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই, এখনও অনেকটা পথ বাকি। ঘড়িতে ঠিক দুপুর দুটো।
এন এইচ ৫৪ এখানে অনেক সুগম। প্রায় ৮৩ কিলোমিটার পথা আমরা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালাম একটা ছোট্ট জনপদ। “কোলাশিব” ডিসট্রিক্ট টাউন। সেই আইজলের পর এই প্রথম দেখা মিলল কিছু মানুষের। রাস্তার দু-ধারে অল্প সংখ্যক দোকানের। দুপুর দুটো,মানে খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। গাড়ি একটি ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়াল। এখন আধঘন্টা অনন্ত চলমান জীবনের বিরতি। রাস্তার দু’পাশে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দোকান। লালটুকটুকে পানে রাঙা ঠোঁটের সাদাকালো চুলের ফাঁকে জেগে লাল টকটকে সিঁদুর। ফর্সা চামড়ার গোলমুখের দুই ভ্রু’র মাঝে সূর্যাস্তের সূর্যের মতো উজ্জ্বল টিপ। একজন মাঝবয়সের ভদ্রমহিলা বসে আছেন একটি স্টেশনারি দোকানে। সামনে বয়ামে বয়ামে চকলেটের সার। কথার টোন বুঝিয়ে দিচ্ছে অসমের বাঙালি মানুষ। কিন্তু মিজোরামে বাংলাদেশের মানুষও বাস করে নাকি?
করে। কোলাশিবে মিজোদের সাথে বাঙালিও একসাথেই বাস করে,কারণ কোলাশিব হল মিজোরাম আর অসমের বর্ডার। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা চাষ। মূলত সুপারি, পামতেল,ধান,গম চাষ হয়।তবে মাছের চাষ ও কিছু মানুষের জীবিকা। দুপুরের খাওয়া ঐ হোটেলে সেরে সবাই পাশের দোকান থেকে একখিলি করে পান মুখে দিয়ে আবার চলা শুরু করলাম।
কিছুটা এগোতেই রাস্তার ধারে একজায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। ড্রাইভারদা জানালেন ওটা একটা রিভারভিউ পয়েন্ট। একটা সিমেন্টের ছাতার মতো কিছুটা উঁচু জায়গা। ওখানে উঠে দেখতে হবে নদীকে। বেশ দূর দিয়ে বয়ে চলেছে। গাঢ় সবুজ জলের নদী। দূরবিন নেই, ক্যামেরা জুম করে দেখলাম,কিনারার কাছে রং আরও ঘন। দু-পাশে ঘন ঝোপের বাহার। ঠিক যেন আমাজনের গহিন জলপথ। এখানে নদী আছে জানতাম না। জিজ্ঞেস করলাম ড্রাইভারদাকে, নদীর নাম কী?
তুইরিয়াল(tuirial)।

বাহ্‌! ভারি সুন্দর নাম তো! এ নদীর আরেকটি মিষ্টি নাম আছে সোনাই(sonai). এই নদীর স্বাভাবিক ছন্দকে আটকে ১৯৯৮ সালে নদীর বুকে তৈরি হয়েছে “তুইরিয়াল ড্যাম”, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
ডিসেম্বর মানেই তাড়াতাড়ি সন্ধে নেমে আসা। ঠিক সন্ধের মুখেই জনবহুল শিলচরে প্রবেশ করল আমাদের গাড়ি। আগের থেকে হোটেল ঠিক করা ছিল না। রাস্তার থেকে ২মিনিট হাঁটা পথেই একটা পরিষ্কার ছিমছাম হোটেলে ঢুকে পড়লাম আমরা। বরাবর দেখেছি পথ চলার সময় ক্লান্তিতে মনে হয় হোটেলে ঢুকেই শুধু বিশ্রাম নেব,কিন্তু প্রতিবারই গন্তব্যে পৌঁছানোর পর অদ্ভুতভাবে অনন্ত এনার্জি যেন কোথা থেকে চলে আসে। এবারও তার ব্যাতিক্রম হল না। একটু ফ্রেশ হতেই মনে হল, হোকনা অল্প সময়, তবু একবার শিলচরের পথে পথে পা ফেলে হাঁটব না?
ওদিকে আমাদের স্টকের মুড়ি আর ডিম শেষ। কাজেই এই দুটির খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম দুজনে,কত্তা আর আমি। আমাদের হোটেলটি বেশ জনবহুল এলাকাতেই মানে বাজার এলাকা। কিন্তু এই অচেনা বাজারে কোথায় খুঁজব মুড়ি আর ডিম? তবু হাঁটতে থাকলাম। এক অজানা শিলচরের পথে। যে দোকানেই জিজ্ঞেস করি বলে নেই, একটু এগিয়ে একটা মন্দির পাবেন, উলটো দিকের দোকানে ডিম পেয়ে যাবেন। এগিয়ে চললাম অজানা পথে। আর কতটা পথ পেরোলে মন্দিরের দেখা মিলবে জানি না, চলেছি আমরা দুজনে। বাজার শেষ হয়ে লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ যেন শুনতে পেলাম মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ। হ্যাঁ, একটা দোকানও দেখতে পাচ্ছি।
ডিম পাওয়া যাবে?
দোকানদার মাথা নেড়ে বললেন, ‘ একটু আগেই শেষ হয়ে গেল’।
তবে মুড়িই দিন শুধু।
ওখানেই জানতে পারলাম, আর একটু এগোলেই একটা দোকান আছে, সেখানে ডিম পাওয়া যেতে পারে।

ওখানে দাঁড়িয়েই ভাবলাম, এতটা এলাম যখন, তখন না হয় আরেকটু এগোই। নাহ্‌, এবার আর হতাশ হতে হল না। ডিম আর মুড়ির প্যাকেট হাতে ফেরার পথ ধরলাম। আসলে ডিম খোঁজা একটা নিমিত্তমাত্র। উদ্দেশ্যহীন পথ এভাবে হাঁটা যায় না, অথচ যেকোনো নতুন পথে আমাদের দুজনেরই এভাবে না হাঁটলে মনে একটা অপূর্ণতা বাসা বাঁধে। আস্তে আস্তে ফিরে এলাম ভিড় বাজারে।
ঘড়িতে তখন পৌনে আটটা। রাস্তার মোড়ে ফলের পসরা নিয়ে বসে আছে এক বুড়ি। কমলালেবু, আপেল, আঙুর সাথে ওটা কি? একটা ঝুড়িতে রাখা লাল লাল ছোটো ছোটো গোলগোল! কাছে যেতেই ফিরে গেলাম সেই বছর কুড়ি আগের স্মৃতির দরজায়। স্কুলের গেটের ভিতর থেকে পয়সা ধরা হাত বাড়িয়ে বনকুলের প্যাকেট কেনার স্মৃতি ভেসে উঠল। প্রতি প্যাকেটে বড়জোর দশটা কুল থাকতো। পঁচিশ পয়াসা দাম ছিল তখন। লোভ সামলাতে পারলাম না। কিনে নিলাম ১০০ কুল। ‘দিল খুশ তো সব খুশ’।

ক্রমশ…
লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here