আত্মচরিত ও লক ডাউন–লিখছেন শ্রীকান্ত মানা

0
42
  আত্মচরিত ও লক ডাউন

                                                                     ছবিঃ গৌতম মাহাতো
       
                      লিখছেন শ্রীকান্ত মানা

                                           

আমরা লেখালিখি বলতে যা বুঝি শ্রীকান্ত তেমন লেখালিখির বাইরের মানুষ। তবে সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ ও পড়াশুনো বারবার তাকে ভাবায় নতুন কিছু নিয়ে তখনই তাঁর হাতে উঠে আসে কলম।অন্য সময় তিনি অন্য মানুষ,অন্য চরিত।

            তখন আমি ১৩। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন পাড়ার নতুন পুকুর থেকে স্নান সেরে ঘরে ফিরলাম। দেখি আমাকে আমার মা খুব কাছের থেকে দেখছে। মাকে আমি তুমিই বলি। 
জিজ্ঞাসা করলাম – ” কী দেখছো অমন করে?”
উত্তর এলো আদেশের সাথে – “এখন থেকে বাইরে বেরোনো বন্ধ” । 
আর শোবার ঘরে মানে ছাদে মশারী টাঙিয়ে বিছানা নির্দিষ্ট হল। আমাদের মাটির বাড়ি। তাই আমরা ‘ উপর ‘ বলি দোতালা কে।
এমনিতেই মায়ের ভিজে হাতের মার খেয়ে বিশেষ করে রবিবার সকালে অনেক বার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বই খুলে দুলে দুলে পড়েছি। কিন্তু কি যে পড়েছি তার মাথা মুন্ডু নেই। তাই এইবারে আর সাহস করতে পারলাম না। কথা মত কাজ। 
বিকেলে দেখলাম আমার জন্য চিঁড়ে ভাজা হচ্ছে। শুনে খুব আনন্দ পেলাম। মা নিজের হাতে করে নিয়ে এলো। 
ঢাকা দিয়ে বলে গেলো “প্রয়োজন মত খাবে”। জানলাম এই গুলোই এখন আমার খাবার।
আর কেউ আমার সাথে কথা বললেও দূর থেকে বলবে। শুধু এইটুকু জানতে পারলাম যে আমার নাকি অসুখ হয়েছে। পাড়ার এক জেঠিমা ও কাকিমা মানে জেঠাই ও কাকি খুব ভালো করে আমাকে দেখে বাড়িতে বলে দিয়ে গেলো যে আমার ‘হাম’ হয়েছে।সারা গায়ে বিশেষ করে পিঠে লাল লাল বিন্দু বিন্দু বেরিয়েছে। 
আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। তাহলে কি সত্যি আজ থেকে আমি ঘরবন্দি। মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। আসলে,  বিকেলে পাড়ার ছেলেদের একটা  খেলা হয় সন্ধ্যে না নামা পর্যন্ত। হৈ হুল্লোর করে সবাই । দারুণ মজা হয়। আজ আমার সব বন্ধ। 
তখন কি আর করবো। পরের দিন স্কুল যেতে পারলাম না। মানে যেতে দিলো না। একদিন যায়, দু দিন যায়। বাড়ির পাশেই রাস্তা। তাই স্কুলের সময় হলেই জানালার কাছে মশারী ঠেলে দেখতাম। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। আবার বিকেলে ফিরে যে যার বাড়ি ফিরছে। আমাদের বাড়ি পেরিয়ে স্কুল যেতে হয় । খুব মন খারাপ করত। 
একদিন বিকেলে  স্কুল ছুটির পর দেখি আমাকে দেখতে এসেছে  “ইস্ট” ভালো নাম ইস্টরঞ্জন ও দুলাল। ইস্টর বাড়ি হাজিচকে। বাড়ির পাশ দিয়েই যাতায়াত করে। আর দুলাল স্কুলের হোস্টেলে থাকে। আমি তাকে “দুলু” বলি। ইস্ট এখন ব্রিটেনে থাকে আর দুলাল নাড়াজোল মহেন্দ্র একাডেমী স্কুলের সহশিক্ষক। 
আমাকে বললো “তোকে দেখতে এসেছি,কেমন আছিস?”
ওরা বাড়িতে ঢুকেনি। দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা এসেছে বলেই আমি মশারির জেলখানা থেকে বাইরে আসার অনুমতি পেয়েছিলাম।
কী বলবো তখন আমি। বুঝতে না পেরে বললাম “আমাকে কি আর দেখবি, এই তো আমি।”
তারপর ওরা চলে গেলো। 
এইভাবে দশ বারো দিন পর মা আমার পাড়ার শীতল মন্দিরে নিমপাতা , হলুদ বাটা, তেল দিয়ে পূজা দিলো। ওইদিন আমি স্নান করলাম ঠাকুরের ওই নিদান দিয়ে। ঘরের বন্ধন মোচন হলো বটে তবে তেলেভাজা জাতীয় কিছু খাবার অনুমতি পেলাম না। সেদ্ধ খেতে দিত। এই কাঁচকলা, লাউ-ডাঁটা, পেঁপে দিয়ে জিরা ঝোল। সত্যি বলতে জিভের তার কেটে গিয়েছিল খেতে খেতে। তাছাড়া ওই সময়ের পর থেকে চিঁড়ে ভাজা আর খেতাম না। এতটাই অনীহা জন্মেছিল।
যাই হোক সেই বারের মতো মায়ের দোয়া থেকে মুক্ত হলাম। এই “হাম”কে আমাদের গ্রামে “মায়ের দোয়া” বলে। 
তখন নতুন কাপড় বা বস্ত্র পরা যাবে না। ঘরে ডাল জাতীয় কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। নিরামিষ খেতে হবে ইত্যাদি। পাশাপাশি বাড়ির বউরাও আলতা বা সিঁদুর পরতে পারবে না, যতদিন না “নিমহলুদ” হচ্ছে। 

২ য় বার গৃহবন্দি

আমি ঘরবন্দী হয়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। আমি মেদিনীপুর কলেজে পড়তাম। এর নাম নাকি “ডে কলেজ”। পরে আসল নাম জানার পর আসল নামেই পরিচিত হলাম। দ্বিতীয় বর্ষ তখন । খুব চাপ । পাশ ও অনার্স মিলে সাত’শ’ নম্বরের পরীক্ষা হবে। 
তখন আবার সেই “মায়ের দয়া” হলো। এইবারে আমি নিজেই ঘরে ফোন করে জানলাম। তখন আমি অভিজ্ঞ। সারা গায়ে ফোস্কা । এইবারে আগের তুলনায় একটু বড়ো মাপের। সেই একই ব্যবস্থা। তবে খুব যন্ত্রনা করত। আর খুব ব্যথা পেতাম। তখন একটু বড়ো হয়েছি তাই মাকে বিশেষ কিছু বলতে হয়নি। 
শুয়ে শুয়ে কি আর সময় যায়! তাই এইবারে আমি বুদ্ধি করে একটা বই নিয়ে গিয়েছিলাম । “রামায়ণের সারানুবাদ” রাজশেখর বসু র । ওই সময় খুব ভালো লেগেছে অলস ভাবে পড়তে পড়তে। কেউ কিচ্ছু বলে না । যখন ইচ্ছে করে পড়ি। ওইসময় মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগার কে অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলাম মনে মনে। 
তবে এইবারে মা আমার শীতলা মন্দিরে নিম হলুদ দিলো প্রায় পনেরো দিন পর।  ঢুলি গুলো খুব বড়ো হয়েছিল আসলে।

৩ য় গৃহবন্দি

আমি একা নয় । আমাদের ভারতবর্ষের প্রায় সবাই। চারিদিকে লক ডাউন চলছে। মারণ ভাইরাস করোনা র জন্য।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বন্ধ দোকানপাট।মানুষের জীবন সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। তাই ভিড় এড়াতে হচ্ছে। বাঁচার জন্য। জীবনে স্বপ্ন পূরণের জন্য আর স্বপ্ন গড়ার জন্য।ধরণীর বুকে এখন তাই হাহাকার। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে । কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন – “সুচেতনা” কবিতায়
“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;
মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”

সত্যি আজ মানুষ বড়ো অসহায়। আজ মানুষের উচিত গৃহবন্দি থাকা, যাতে ভাইরাস না বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। তাই আজ বলতে ইচ্ছে করছে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সেই কবিতা “জন্মভূমি আজ”- 
“মাটি তো আগুনের মত হবেই
যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।”

কবি শঙ্খ ঘোষ এর ভাষা খুব প্রাসঙ্গিক – 
“আমরাও তবে এই ভাবে 
এ-মূহুর্তে মরে যাব নাকি?”
তাই কি যে তা কেউ জানে না। সবাইকে খুব সচেতন থাকতেই হবে। কেননা মানুষ আজ বড়ো অসহায়। তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায় মানুষের করুণ অবস্থা জানিয়ে গেছেন তাঁর ” দাঁড়াও” কবিতায়

“মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে,
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে।
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও,
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও।”

তাই আমরা এখন গৃহবন্দি হয়েই থাকি না!!
নিখিল ভুবন আজ বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য শুধু মানুষ বাঁচতে চায় বলে। 

                                                        ক্রমশঃ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here