কা র্তি ক চ ন্দ্র   গ ঙ্গো পা ধ্যা য় লিখছেন– “জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান(২য় পর্ব)

0
42
পরিচিতিঃ কার্তিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ৫ ই অগাস্ট, ১৯৪৮. বংশভিটেঃ সিমডাল, বর্ধমান। জন্মস্থান – বিল্বগ্রাম, বড়োবেলগনা, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর এই ছাত্র ১৯৬০ এর মাঝামাঝি থেকে লেখালিখি শুরু করেন। বর্ধমানের সাহিত্য জগতে তিনি এক মাইলস্টোন। অনুজদের উৎসাহ দিয়ে ও পথনির্দেশ করে সাহিত্যের দিকে তাদের কম্পাসের কাঁটা ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। জহুরির চোখ দিয়ে তিনি চিনে নিতে পারতেন কাচ আর দু-চার আনার সোনাদানার সম্ভাবনা। বর্ধমানের “নতুন সংস্কৃতি”র এক অন্যতম সদস্য তিনি। – যে নতুন সংস্কৃতির সভায় একসময় আসতেন আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ কবিরা। নিয়মিত উপস্থিত থাকা কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অভিন্নহৃদয় বন্ধু কবি অরুনাচল বসুর স্নেহধন্য ছিলেন কার্তিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। অজস্র কাব্যগ্রন্থ, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ কর্ম রয়েছে তাঁর। পেয়েছেন অজস্র সম্মান ও পুরস্কার। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ঃ কুঁড়ির মতো ফোটে, বিরিয়ানির মাছি, ফুটকম্পাস, ইডিপাসের চুমো, বেহালাও ঘেন্না হয়ে যায় ইত্যাদি। ‘রামকৃষ্ণ ‘, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আজকের প্রজন্ম’, ‘ফাঁকার হিসেবনিকেশ’, ‘কাহিনিচলের তত্ত্বতালাশ’ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘পাঁচ পাবলিক এবং তিনি’, ‘ঝিঁঝিঁর সংসার’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। আজ তাঁর জন্মদিনে বাইফোকালিজম্-র পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হলো।

 

“জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান

 

কা র্তি ক চ ন্দ্র   গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

 

দুই

‘শৈলবালার আগে কোনও বাঙালি হিন্দু লেখক অথবা লেখিকা কোনও মুসলমান যুবককে নায়ক এবং হিন্দু তরুণীক নায়িকা করে উপন্যাস লিখেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই।—হিন্দু যুবকের প্রতি মুসলমান তরুণীর অনুরাগ নিয়ে কাহিনী রচিত হয়েছে, কিন্তু মুসলমান যুবকের প্রতি হিন্দু তরুণীর অনুরাগ ‘শেখ আন্দু’ প্রকাশের আশি বছর পরেও হিন্দু সমাজে কিংবা হিন্দুদের রচিত উপন্যাস সাহিত্যে খুব বেশি নজর পড়ে না। —বস্তুত ১৯১৫-১৬ সালে শৈলবালা যে কাহিনী প্রকাশ করেছিলেন তা শুধু সেই যুগে বিস্ময়কর নয়, এখনও প্রায় বৈপ্লবিক ঠেকে। —গভীর আদর্শবোধের হিসাবে গোরার সঙ্গে হয়তো শেখ আন্দুর চরিত্রের কিছু মিল আছে, কিন্তু গোরা আইরিশ মাতাপিতার সন্তান হতে পারে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও মুসলমানের ঘরে তার নায়কের জন্ম কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।’
শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘শেখ আন্দু’ উপন্যাস সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক শিবনারায়ণ রায়। শরীরের শক্তির ও চরিত্রের মাধুর্যের এক সুষম মিশেলে গড়া শেখ আন্দু অর্থাৎ আনোয়ারউদ্দিনের সঙ্গে ‘শুচিস্মিতা শান্ত দৃষ্টি’ বিধবা জ্যোৎস্নার যে পারস্পরিক অনুচ্চারিত ভালোবাসা গভীর গহনে মূর্ছনা তুলছে তাকে কেন্দ্র করেই বুনে চলা উপন্যাসটিতে হিন্দু মুসলমানের দরাজ হৃদয় ও সহায়তা বিনিময়ের যে কথাচিত্র এই বর্ধমান শহরেরই মেয়ে শৈলবালা ঘোষজায়া আমাদের দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যের এক পথিকৃৎ সাহিত্য নিদর্শন।তাঁর অন্যান্য উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থগুলির কয়েকটির নাম আড়াই চাল, নমিতা, মনীষা, শান্তি, বিপত্তি ইত্যাদি।

গোটা তিনেক ছিঁড়ে যাওয়া প্রেমকথা আর একটি ঘনিয়ে ওঠা প্রেমের অস্পষ্ট ইঙ্গিত নিয়ে লেখা বর্ধমানেরই মেয়ে সুলেখা সান্যালের শেষ উপন্যাস ‘দেওয়াল পদ্ম’। এ উপন্যাস মোচড় খায় উপন্যাসের নায়ক সঞ্জয়ের কার্যকলাপ নিয়ে। দু-দুবার জব্বর চোট খাওয়া জীবনকে সঞ্জয় যেভাবে লম্বা চওড়া করে নিয়েছে, যেভাবে অগণিত মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ ও সহযোগিতায় তার স্বেদসিক্ত গাণিতিক জীবনশৈলী তৈরি করেছে তা আমাদের ধাক্কা দেয়। নায়িকা অসীমার তেতো অভিজ্ঞতা ঠাসা জীবন সঞ্জয়ের সঙ্গে সংযোগে ঘুরে দাঁড়ায়। বানভাসি বিস্তৃত নদীচরে ট্রাকটর, ডায়নামো নিয়ে মাটিচষার দুর্জয় ঘোরে সেও সংক্রামিত হয়। দুজনের বন্ধনের মধ্যস্থতা করে এক দেওয়াল পদ্ম যা নাকি নির্জন, ঠান্ডা জায়গা আর পোড়ো বাড়ি ছাড়া জন্মায় না। সে পদ্মলতা কিন্তু লতিয়ে লতিয়ে ওঠেনি। এ এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত টানটান হয়ে মন্দির আর ধ্বস্ত তিনতলা বাড়িটার মাথা পর্যন্ত এক যোগসূত্র রচনা করেছে সবুজ বড়ো বড়ো পানের মতো পাতা গায়ে নিয়ে। আর তাদেরই মাঝে মাঝে অনেক দূরে দূরে মাত্র তিনটে কুঁড়ি সাদা আর হলদে মেশানো। মন্দিরটি ধরা যাক আমাদের ঐতিহ্যের উপমা, ধ্বস্ত তিনতলা বাড়িটি আমাদের বারোয়ারী গেরস্থালী জীবনচলের প্রতিরূপ। বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতা সে গেরস্থালীকে টুকরো টুকরো করেছে। তাই ধ্বস্ত সে বাড়ি।ঐতিহ্যের সঙ্গে সর্বান্নবর্তীতার মেলবন্ধন করছে দেওয়াল পদ্ম।কী সংকেতঋদ্ধ উপন্যাস! মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান সুলেখা সান্যাল। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নবাঙ্কুর’। অসংখ্য ছোটগল্প তিনি লিখেছেন। আর একটি ছোটগল্প ‘গাজন সন্ন্যাসী’র পশুপতি তেভাগা আন্দোলনের বিক্ষত সৈনিক।জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসার পর তার স্ত্রী মানদা সে আবার মানুষ খেপাবে এই আশংকা প্রকাশ করলে পশুপতির হৃদয়-ছেঁড়া উত্তর ‘আদালত আমাগোরে ছাড়েৎ দেছে কোনো প্রমান না পায়ে, নিজের দ্যাশের যে শত্রুতা করে বার করে দেছে।তুইও কি তাড়ায়ে দিতে চাস আমারে?’ তাঁর অন্যান্য গল্পগুলি হলো দাহ, জীবনায়ন, ফল্গু, ছোটমাসি ইত্যাদি।

বিয়ের কথা দিয়েও কথা রাখেনি যে যুবক, বাপ-মা মরা একটি কালোকোলো মেয়ের নিভু নিভু ঠাকুমাকে মেয়েটিকে বিয়ের কথা দিয়েও যে বেমালুম সে কথা ভুলে গেছে, প্রবোধ রাউতের কঠিন কলেমে তারই ক্যারেকটার সার্টিফিকেটে মেয়েটির অজান্তেই তার পায়ের আলতার সুস্পষ্ট দাগ খোদাই হয়ে যায়। গল্পের নাম ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট। ভেদবমিতে আক্রান্ত যে কিশোরটি ঝাঁ ঝাঁ গ্রীষ্মের দুপুরে খোলা মাঠে পরিত্যক্ত হয়ে একনাগাড়ে রাজার পার্ট বলে যায় সে কিশোরের ডুবন্ত চোখে তখন আকাশ যেন যাত্রা আসরের চাঁদোয়া, সূর্য ডে-লাইট আর চারপাশের লেলিহান প্রকৃতি যেন তন্ময় শ্রোতা। দিনের পর দিন ধরে যাত্রাদলের অধিকারীর মন পাওয়ার জন্য তার গোটা দলের কত না ফাইফরমাশ খেটেছে সেই কিশোর! ইচ্ছে অধিকারী একদিন তাকে রাজার পার্ট দেবে। কিন্তু একদিন ভর গ্রীষ্মে গাঁ থেকে অন্য গাঁয়ে গরুর গাড়িতে যাওয়ার সময় সে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়। অধিকারী আতঙ্কিত হয়ে তাকে খোলা মাঠে ফেলে যায়। চলে যায় সারি সারি যাত্রাদলের গরুর গাড়ি।গল্পটির নাম প্রতিহারী।বর্ধমানেরই লোক প্রবোধ রাউতের গল্পে গল্পে আমাদের ভেতরের দ্বিচারিতা আবার অসহায়তাও ধরা পড়ে।ধরা পড়ে আমাদের ব্যবহার করার ফন্দীবাজী আবার ব্যবহৃত হওয়ারও অসহায়তা। তাঁর কাটা কাটা গদ্য চলনে শ্লেষ বিদ্রুপও যেমন ছক্কা হাঁকায়, আবার বেদনা ও বিপণ্ণতাও ঘনতা পায়।

আলোচিত শক্তিশালী সাহিত্যিকরা প্রয়াত হলেও তাঁদের আক্ষরিক উপস্থিতি সমকালীন লেখক লেখিকাদের অনেক সময় সচেতন পরামর্শ দেয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের চর্চায় গত শতকের প্রারম্ভ থেকেই এ শহর যে সামড়্থের পরিচয় দিয়েছে তার সামান্য কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ প্রমান করে যে আমাদের জানার বাইরেও এখানে গদ্যসাহিত্যের অনেক গহীন চর্চা হয়েছে, যার উপযুক্ত প্রকাশ ও মর্যাদাদানে তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। অগণিত ছোটবড়ো পত্রিকায় তাঁদের যেসব লেখা বেরিয়েছে সেগুলির নির্বাচিত গ্রন্থনা অনেক ক্ষেত্রেই করা হয়নি।

স্বাধীনতা আন্দোলনের টগবগে খুনখারাবি উনিশশো দশ বিশের হাওয়া তারিণী চক্রবর্তীকে টেনেছিল কিন্তু তাঁর নরম স্নায়ুস্বভাবে সে হাওয়া হজম হয়নি। বিয়েও হয়েছিল, কিন্তু গেরস্থালী হয়ে থাকার ধাতও তার ছিল না। সন্ন্যাসও নিয়েছিল। কিন্তু মন থেকে সংসার জীবনকেও উপড়ে দিতে পারেনি। তার স্ত্রী শিবানী সন্তান নিয়ে স্বামীর কাছেই আশ্রমে আশ্রয় নেয় কিন্তু ঘর তো সে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি! মেয়ের ব্যবস্থা আশ্রমগুরু স্বরূপানন্দজী করায় বাঁচার শেষ প্রয়েজনটুকুও তার ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু জীবনকে শেষ করার আগে তার ভেতর থেকে পুঁই সজনের চাড় যেন ভিসুভিয়াসের মতো জেগে উঠল। প্রবল আবেগে স্পৃষ্ট করল সে তারিণীকে। অথচ মিলনও একত্রিত করতে পারল না তাদের। তারিণী তাকে ঘরে ফিরে যেতে বলল। কিন্তু শিবানী ঘর নয়, অনন্তের অভিসারী হয়ে গেলো। মাপে ছোট , কিন্তু মজ্জায় তীব্র ছিল বলেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেবীমূর্তির মুখে সে শিবানীর মুখ দেখতে পায়। রাজ্যের না-মেটা সংসারখিদে যেন দেবীমূর্তিকে নয়, শিবানীকেই কংকালমূর্তিতে পরিণত করেছে। চিত্ত ভট্টাচার্যের ‘কামমোহিতম’ উপন্যাস মানবমনের এই জটিল চলনকে অসাধারণ দক্ষতায় রূপায়িত করেছে। চিত্তবাবুর অসংখ্য গল্প কোথাও বৈঠকী মেজাজে, কোথাও শ্লেষবিদ্রুপের তড়িৎস্পৃষ্টে, আবার কোথাও বা বেদনার তীব্রতায় আমাদের নাড়া দেয়।

কামাখ্যাচরন মুখোপাধ্যায়ের গল্পে কালদূষণের ঘনঘটা, কিন্তু আলোর নলি ছিঁড়ে ফেলতে পারে না।তাঁর গল্পে আত্মব্যবচ্ছেদের অনেক জটিল পারঙ্গমতা চোখে পড়ে। সলিল ভট্টাচার্যের গল্পে যদিও শ্রেণিবিভক্ত সমাজের শোষণ অত্যাচারের কথা স্পষ্টভাবেই ধ্বনিত হয়েছে তবু সেই পীড়নকে কেন্দ্রে রেখে সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিপক্ষ এক লড়াকু স্পর্ধাও তাঁর গল্পে গল্পে আসা যাওয়া করে।

ধুলোচল কথার সমর্থ মধ্যস্থতায় স্বপন ঘোষচৌধুরীর গল্পে বিপন্নতা প্রায়শই এক প্রতিযুদ্ধের চেহারা নিয়ে উঠে আসে।সংকট আর অভাব তাঁর গল্পের বৈভব, তাঁতর আবিষ্কারের চালিকা শক্তি।শুধু কবিতা নয়, গল্পেও প্রয়াত তপন চক্রবর্তী আমাদের নাড়া দিয়ে যান। পরপীড়নের মধ্য দিয়ে আত্মক্ষয় ও আত্ম বিষ্ফোরণের ভেতর নিয়ে নবাগত আত্মসংগঠন – মূলতঃ এই দুই বনেদের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর গল্প। বহুজনবহনের এক নাছোড় সচলতা যে আদতে এক গভীর নিঃসঙ্গতার তাড়নে যন্ত্রনাজর্জর, নীলা করের গল্পে তারই প্রবল স্পন্দন আমরা অনুভব করি। বোধদু্র্ভিক্ষের কাপালিকেও হৃদয়বহতার উৎসারকে যে উপড়ে ফেলা যায় না, সত্যনারায়ণ মাজিল্যার গল্পে তার স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করে। সনৎ ভট্টাচার্যের গল্পে বিগত দিনের বাৎসল্যের এক ছায়ামায়াঘোর আমাদের ভেতর সঞ্চালিত হয়। সমীরণ চৌধুরীর গল্পে বোধহননের বিরুদ্ধে এক উন্মূলিত আর্তনাদও যেমন ধরা পড়ে, তেমনই প্রবৃত্তিচালিত উৎকেন্দ্রিকতার ঘোরে আক্রান্ত মানুষের আত্মাদাহের জ্বালাও অনুভব করা যায়। নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে একদিকে চলার কঠিন একলব্যতা অন্যদিকে মধ্যবিত্ত তারল্যের ফেনিলতা – এই দুইএর ধাক্কাধাক্কি আমাদের চোখে পড়ে। ভব রায়ের অনেক গল্পে স্বচ্ছলতা কেমন করে যে আত্মঘাতের চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে তার বিশ্বস্ত চেহারা পাওয়া যায়।দেবেশ ঠাকুরের গল্পে সমাজপরিবারের আলো আঁধারি দ্বৈরথের পটভূমিকায় যে প্রাণগুলি প্রকৃতি ও শোষকের কালগ্রাস থেকে পিছলে বেঁচে গেছে তাদের বাঁচার তীব্র আকুতি মূর্ছনা পায়।
অভিজিৎ তরফদারের গল্প নির্মেদ বিন্যাসে গন্তব্যহীন গতির হাঁফটানকে সাবলীলভাবে তুলে ধরে।অমাপের নির্বুদ্ধিতাপনা নেই, নেই মাপেরও কোনো ভাবচারিতা – অধুনা এই কটু চলাচলের অঙ্গীভূত হতে না পারার নমনীয় অথচ কঠিন ভীষ্মচারিতা শ্যামাপ্রসাদ কুন্ডুর গল্পে ঘোরাফেরা করে। মনোজটিলের দুর্গমে আত্মবিভাজনের যন্ত্রণাতিক্ত তাড়স পাঠকের মধ্যে সংক্রামিত করাই দীপ সাউএর গল্পে ধরা পড়ে। রমেশ তালুকদারের গল্পে রুচির বর্ধমান বিপন্নতার সংবেদনশীল প্রতিফলন আমাদের ভেতরে নাড়া দেয়। পিনাকী চক্রবর্তীর কলমে কখনও সোজা, আবার কখনও বাঁকা চলের সমাহারে উঠে আসে এক স্বতোৎসারিত দায়বদ্ধতা। মানিক অধিকারীর গল্পে দিগন্তজোড়া নৈরাশ্যের মধ্যে আলোর ভ্রুণগুলি টলটল করে। শেখর সেনগুপ্তের গল্পে দেখা যাচ্ছে গত শতকের ষাট-সত্তর দশকের ঝোড়ো দিনগুলির যে ছিলা টানটান অভীপ্সা বঞ্চিত মানুষের শিরদাঁড়ায় ভর করেছিল তারই বিশ্বস্ত প্রতিলিপি পাওয়া যায়।

রূপক মিত্রের গল্পে বিষণ্ণতার এক ঘন বুনটের ভেতর সংযোগের এক আকুল আর্তিকে আবিষ্কার করতে হয়। স্বপ্নকমল সরকারের গল্পে আশা ও আশাভঙ্গের বেদনার সংবেদনশীল অক্ষরচালনা পাঠককে আকর্ষণ করে। সংসারের নান জোড়ফাটের চেহারা রীতা বসুধর ও ছন্দা চক্রবর্তীর লেখায় দেখা যায়।বলরাম পালের গল্প মধ্যবিত্তের সংকট ও তা থেকে মুক্তির অভীপ্সা সুন্দরভাবে ধরে রেখেছে।

উপন্যাস ও গল্প চর্চার এই আলোচনা সম্পর্কে দু-চার কথা বলা দরকার। প্রথমত সীমাবদ্ধ জায়গার মধ্যে এই আলোচনা করতে হওয়ায় দু-এক কথায় আলোচিত লেখকদের যেসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছি সেগুলো শুধু উপরোক্ত লেখকদের পাঠক-পাঠিকাদের সঙ্গে কথাবিনিময়ের উদ্দেশ্যই তুলে ধরে। দ্বিতীয়তঃ দু-চার কথায় কোনো লেখকের মূল্যায়ণ সঠিক হয় না বলেই মনে হয়। কারণ সেই লেখায় আলোচিত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরও অনেক বৈশিষ্ট্য থাকে। তৃতীয়তঃ আমার পড়া বা না-পড়া অনেক সমর্থ লেখকের প্রসঙ্গ আমার স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতায় ও অজ্ঞতায় নিশ্চিতই আসেনি। চতুর্থতঃ কোনো লেখকের সৃষ্টিকর্মের সবটুকুকে তারিফ করতে পারা যায় না। অনাবশ্যক ও ভারী ভারী কথা অনেক গল্পকে নষ্ট করে। ইঙ্গিতের যথাযথ ব্যবহারের অভাব অনেক লেখার ব্যঞ্জনাকে জখম করে। বুননেও অনেক সময় অদক্ষতার ছাপ দেখা যায়। এখানকার অনেক লেখকের কমবেশি এসব উপসর্গ দেখা যায় বলে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন

“জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা”–সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান –লিখছেন–কা র্তি ক চ ন্দ্র গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here