প্রিয় স্পর্শ-কে লেখা চিঠি– অপর্ণা দেওঘরিয়া

4
228


অপর্ণা দেওঘরিয়ার লেখা একান্তের চিঠি

                                                                                           ছবিঃ গৌতম মাহাতো

  অপর্ণা দেওঘরিয়া 

                                                           

        মূলত কবি তবে গদ্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ চিরন্তনের।গদ্যের ভাঙাগড়া নিয়ে তার চর্চার পথ চলা।দেশের নানান লিটল ম্যাগাজিন সহ বানিজ্যিক পত্রিকাতেও লিখে চলেছেন নিরলস ভাবেই।

প্রিয় স্পর্শ

                  জন্মে হল না, তবে ও জন্মে ঠিক হবে। শূন্য সাদা পাতায় ঘুরছে কার মুখ, ঘোরানো সিঁড়ির বাঁকে। অবিশ্রান্ত সুধায় অদ্ভুত মায়ায় প্রাণের ভেতর অরূপরতন। তেমনি করেই তাে সে চুপিসারে এসে দাঁড়ায়। হাতের পাতায় দুহাত জড়িয়ে তাকে ধরতে যাই, শূন্য হৃদয়ের মাঝে নিবিড় গভীর বিরামহীন খুশির গানে দিগ্বিজয়ী আকাঙ্খায়, অবিনাশী অহংকারে আবিষ্কারের মিঠা স্বাদে চোখের তারায় তারায় সে আসে, সে-ই তো আমার স্পর্শ। 
                         ঠিক যেন শিব, শিব সুন্দর সত্য। আমি রাতভর সুখ-শান্তির অঞ্জলি দিয়ে ওকেই তাে সাজাই। সম্পর্কের ফাকফোকরে সূর্যবন্দনায় আত্মজ ভালােলাগায়, প্রেমের সুধায়। আমি গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো করি ভীতিশূন্য, অকুতােভয় পত্র-উদ্বিগ্নমনা আবেগে রঙিন প্রজাপতির মতাে জড়িয়ে ধরি। এই স্পর্শ জানাে, তােমার মতাে সুন্দর লাবণ্যময় শব্দবন্ধনে অনুসৃত চিঠি আমি লিখতে পারব না গাে। একলা বিষাদগ্রস্ত বিষন্ন মনে শুধু তােমার কথা ভাবতে পারব। শুদ্ধ গৌরিক শৈলীতে সুষমামণ্ডিত করে তােমাকে দেবরূপের মতাে করে গড়ে তুলতে পারব।
                   আমার আজন্ম লালিত বিশ্বাস হীরক উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতাে তুমি আলােময়, শুভময় মঙ্গলময়, জীবনের আশা-আকাঙ্খার পাঠশালায় আমার চতুর্দশভুবন আলাে করে তুমি বিরাজ করো।
                         জানাে স্পর্শ,এ জন্মে হয়তো পরিপূর্ণ হতে পারলাম না।পরিপূরক তো নয়ই, তবুও আমার পাগল পাগল ভালোবাসা বর্ণমালায় প্রাণপণ বুক চিরে রক্ত-লেখায় তোমার নাম লিখেছি জানাে।
                            প্রলয়ের আশঙ্কা দিশাহারা হয়ে আমি তোমার ধ্যানে পুড়তে থাকি দহনে দহনে  আগুন মেয়ের মতাে। আকাশের লাল ধোঁয়াতে তােমার মুখমণ্ডল ভাসে, আর আমি প্রণয় সুখের অনুভূতিতে আমার প্রাণসখাকে জড়িয়ে উত্তাপ মাখি চৌষট্টি কলার প্রেমে মাতাল হয়ে বনময়ূরীর মতাে, তােমার ওষ্ঠে চুমুর স্বাদ সােহাগমাখা আমার ক্লান্তি, দুঃখকষ্টের চাদর ভরে যায় প্রশান্তিতে উদার আকাশের মতাে। আনন্দপাঠ পরাগরেণু হৃদয় জুড়ায়, তৃষিত বুক শীতল হয়। প্রেম কি নীরবে আসে? ঝরে যায় সরে সরে যায়, ঝরা পাতায় রৌদ্র খেলায়, হৃদয়ের জন্ম জন্মান্তরের প্রতীক্ষার শব্দ-গন্ধে মুগ্ধবোধে চিরন্তন পাপ-পূণ্যের মতাে, স্বচ্ছতোয়া নদী হয়ে প্রেম বয়ে যায়। অনিন্দ্য শাশ্বত সুন্দর তুমি আমার স্পর্শ সুখের উল্লাস, তরুণ বৃক্ষের মতো ঝলমলে মোহিনী ফুল ও ফলে শােভায় ভরপুর।
                সেই ছাতিমতলা, শাল পলাশ  রাঙামাটির পথ আমার স্মৃতির শীতলপাটিতে বসে কত আমোদ-প্রমোদ, উথাল-পাথাল প্রেম। আজ বড় নিঃস্ব মনে হয়। সঠিক নিশান কোথায়? আজানের বােলে কত ঢেউ ওঠানামা করে। 
           শাপলা-শালুক ঘেরা ছোট দিঘি জল টলটল, মরাল-মরালীর হাসি, পানকৌড়ির ডুব-ডুব মন স্বচ্ছ জলে মাছ খেলা করে। সাঁতার দেয় দুষ্টু বালক। আর আমার অনন্ত প্রাণের ভেতর খুশির স্রোত বয়ে যায়।
           তােমার মাথায় কৃষ্ণচূড়ার ফুল ঝরে পড়ে, আমার মনের অজান্তে তোমার হাত চেপে ধরে আমার আঙুল। তােমার স্পর্শ আর আমার স্পর্ধা নতুন আশায় বাঁধন খোঁজে সুখের নীড় খোঁজে নিবিড় উত্তাপে বুভুক্ষু হৃদয়, অভিসারি লুকোচুরি খেলার গােলক ধাঁধায় সৌরভে পাখা মেলে। 
                      স্পর্শ, আমার অসংলগ্ন কথা তােমার কাছে আর্বজনার স্তুপ বাড়ায়। এই বিশাল জনসমুদ্রে কে খোঁজ রাখে পাহাড়তলির মেয়ের কথা | একাকী একাকী হারিয়ে যাই আমি। এই বহমান জগৎ সংসারে উষ্ণ মুঠোভর্তি সােহাগ নিয়ে আমাকে শুধুমাত্র দিও তােমার চরণের সামান্য ধূলিকণা, মায়াপূর্ণ মমতা-মাখানাে সবুজ সবুজ প্রেম। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে তােমার স্পর্শসুখের ভাবনায় হারিয়ে যাই দূরে দূরে।।
                 স্পর্শ, আমি পক্ষপাতগ্রস্তের মতন তােমার অভিরুচিকে অভিলাষকে শ্রদ্ধা করি। অপরিসীম আলাের বিভায় আমার নীল ভাবনায় নীলাম্বর হয়ে শাশ্বত সুন্দরের মতাে তুমি যে বসে থাকো অনন্তকাল ধরে। তােমার জন্য- সুধা ছড়ায়, দিগন্তের ঢেউ ওঠানামা করে যুগযুগান্তর ধরে, রৌদ্র ছোঁয়ার মতাে তরঙ্গ স্রোত জাগে অনুরাগে। আমি আনন্দে হারিয়ে যাই চোখ বন্ধ করে প্রেমে প্রেম উচ্ছ্বাসে। 
                    আর স্পর্শ, তুমি তাে সৌমদর্শন গাছের পাতায় হেঁটে বেড়াও। কদম গাছে বাঁশি বাজাও,রূপকুমার তােমার দম্ভ দেখে ব্রজ সানাইয়ের সুর তােলে বন পাহাড়ের কোলে খেয়ালি ডানায় ভর করে। আমি মৃদু পায়ে বিশ্বাসের মেঘ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রহরে অপেক্ষায ডাক দিই।
              স্পর্শ, কাছে এসাে।
         শরীরে তরঙ্গের স্রোত বড় তৃষ্ণা এ বুকে, আমি পাপী পাপবদ্ধ অসহ্য আগুনের বিভা আমার আলুলায়িত আঁচল অনন্ত পরিমণ্ডল ছুঁয়ে তােমাকে জড়িয়ে ধরে। জানালা দিয়ে তাকালে বৃষ্টির খেলা, শিমুল পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। সরল অপাপ  জল গঙ্গা জলের মতো শুদ্ধ, মন প্রাণ ও শরীর। খুশির সুরে বলাকারা ধরে গান।
                  দিবস রজনীময় তুমি আমার নয়নমণি। গােপাল গোপাল রােদ কখন যে বাম পাশে সরে যায় বুঝতে পারি না। অম্বরচারী পাখিরা কোরাস ধরে। মাঠ থেকে তুলে আনি ভালোবাসার ঘাসফুল। আমি সাধারণ মেয়ে, হারিয়ে যাওয়া খাতার পাতায় অক্ষরে অক্ষরে ক্লান্তির প্রশ্নচিহ্ন, পাথরের সিড়িতে বসে জল ভিক্ষা করি। 
                   স্পর্শ, তুমি কি সেই নদীটিকে জানো? যার স্রোতে আগলে ছিল অসফল প্রেমের স্বরলিপি।তুমি কি সেই আবহমান পাহাড়টিকে চেনো,যে প্রতীক্ষায় আছে হাজার বছর?
              না…না, না এর মধ্যে মনোমোহন রোদ চলে যায়। নভোমন্ডলে সন্ধ্যার আলো,- অস্বচ্ছ,অনুজ্জ্বল প্রগাঢ় বিষন্নতায় ডুবে যায় হৃদয়- পোড়া  রুগ্ন মেয়ে। “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না”। সারাদিন কবিগুরুর মত তুমি সারাজীবন পথে যেতে যেতে একবারও ক্লান্ত হও না অনর্গল পরিশ্রমের পর পিপাসা মেটানো সংগীতের মাধুর্যে সেই তুমি।
                 কতকালের তুমি গো – কতকালের। চরাচরে শুয়ে আছো ছেলেবেলায় মোষের পিঠে বসে রাখাল বালক হতে,-  আদিগন্ত মাঠ ঝিম-ধরা সূর্যের কত নিচে চলমান  মোষের পিঠে তুমি।
            অনেক দূরে পিঠ-খোলা ফ্রক পর়ে তোমার খেলা দেখতে খুব আনন্দ পেতাম। গাছের ছায়াতে ভাগ করে খেতাম গুড়-মুড়ি। মৌমাছি উড়ে যেত ফুলে ফুলে। প্রাণী থেকে প্রাণীর ভেতর ঘুরে বেড়াতো কবোষ্ণ প্রাণ। অনেক দূরে সমুদ্র তবু তার নোনা বাতাস আর সামুদ্রিক উচ্ছ্বাসের খবর ভালো জল ভর করে পেয়ে যেতাম। সময় বদলে গেল ব্রহ্মাণ্ডের সকল দোষ-ত্রুটি সাফল্য ও অসাফল্যের মার্কশিট। স্পর্শ তোমার জন্য সারাক্ষণ  বাজায় অনবদ্য সেতার, বোবা রাজপ্রাসাদের দেউলের চতুর্দিকে ভাঙা ইট অফুরন্ত শ্যাওলা অন্ধকার ভরা ঘরে বাদুড় ঝাপটা মারতে মারতে খুঁজে বেড়ায় অবলুপ্ত সেই চোখ, সেই মুখ ঠোঁট পীনোন্নত বুকের অন্যায় অভিলাষ। ঘূর্ণায়মান পৃথিবী উজ্জ্বল জমাট বরফ, চিমনির ওপর ধোয়া খাওয়া পাখি, পাহাড়তলীর পড়ি আর প্রাচীন ক্যাথেড্রালের ঘন্টার ছন্দে দিন চলে যায় স্রোতে স্রোতে চলে যায় বেঁচে থাকার পরও রসায়ন। করপুটে যেটুকু প্রেম – আমি কোথায় রাখি?
             – তুমি নাও তুমি নাও …তুমি। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে পুবালী বাতাস , অতি বিস্তৃত প্রাণময় হাসি অন্তরের চোখে ওকে দেখতে দেখতে ভাসতে-ভাসতে, মরতে মরতে আমি তলিয়ে যায় আলোকিত ঝরনার ভালোবাসার দেশে। বিপুলা পৃথিবীর তা কেউ জানতে পারে না। আমার স্পর্শকে কাছে পাইনা, মেঘকে ওর মনে ধরে না, চোখে পড়ে না, জ্যোৎস্না হয়ে ঝড়ে পড়ে সকল  অনুরতি, নীল স্রোত।
                 এইমাত্র সুদর্শন ট্রেন থেকে নামলো। ভোরের কুয়াশা আর রেণু রেণু রোদকণা লেগে আছে ওর সর্বাঙ্গের বসনে। শহরের পা রাখতেই সেরে গেল সকল অসুখ। রুগ্ন বৃক্ষের সবুজপত্র হল। বন্ধ্যা নারী কি হল মা। অনোতো গোলাপ চারা দুলে উঠলো নতুন ফুলে। ভালোই আলোময় হল চারিধারে প্রাণবন্ত  অক্ষরেরা ঘুরেফিরে এসে দাঁড়ালো দৃষ্টির সম্মুখে। চা ওয়ালা ওকে চা দিতে গেলে ও বলল –             
                                                                      না।
       মুড়িওয়ালা বলল -মুড়ি খাবেন ?
        ও বলল -না ,না …
 অদ্ভুত ঠোঁট সম্ভাষণে কি  গারো আবেদন।
 শুধু ওর সাহচর্য  যে পায় …এক পরম দেবীর মৃত্যু পায়ে এগিয়ে চলে মনোরম বাগানের দিকে। দুপুর গড়িয়ে যায়  ঝিমন্ত অন্তরে নিভৃতে  যায় খুঁটে। সারা দুপুর যেন ডাক দিয়ে যায় ছড়িয়ে পড়া শীর্ণ পাতা। দুয়ারে দুয়ারে খুলে যায় সুখের চাবিকাঠি।
    – এত সুখ কোথায় রাখি স্পর্শ? তোমার পায়ে?
 পুকুরে তোমার ছায়া কাঁপে তল অতলান্ত পরম জলের অন্তঃস্থলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য পরম চরণ।
  ওই চরণ তলে কে?
  কে বল ওই চরণে বেগ-শূন্য নিদ্রিত?
 কে?
 বলো?
 এ জন্মে হলো না তবে ও জন্মে হবে যদি ভাবো ওদিকে যাওয়ার আগে, আছোঁয়া গোলাপি গালে একবার চুমু দিয়ে যাবে। ভালোবাসা এক মুঠো বাতাস সবুজ জলভূমি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া নীল বর্ণ পাখি।

     ওপারের মেঘ থাকল

         – ঢেউয়ের আশায়

                              ★★★

Leave a Reply to Anonymous Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here