কলকাতার কথকতা(৩য় পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

1
215
পথের পাঁচালির সেই দৃশ্য আজও আছে
প্রান্তিকা সরকার কলা বিভাগে স্নাতক। বর্তমানে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্য, বিশেষত কবিতার প্রতি তাঁর অনুরক্ততা গভীর। নিজেও কবিতাই লিখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাইফোকালিজম্-র আঙিনায় তিনি লিখে ফেললেন একটু অন্য রকম লেখা।কলকাতার কথকতা।লেখালেখি তার একটি নেশার মত। তবে অবসরে গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন।

কলকাতার কথকতা(৩য় পর্ব)

কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

কলকাতার কথকতায় আজ আবারও হাজির হয়েছি পাঠ্য ইতিহাসের বাইরের কিছু তথ্য নিয়ে। যা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই বহুবার আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। গড়িয়া নিয়ে লিখছি আর সেখানে বোড়াল থাকবে না তা কি হয়? তাই আজ কলকাতার কথকতায় থাকবে গড়িয়া মধ্যস্থিত বোড়াল সম্পর্কে কিছু কথা। পশ্চিমবঙ্গের দ: চব্বিশ পরগনার গড়িয়ার অন্তর্গত একটি পুরাতাত্ত্বিক স্হান হিসেবে পরিচিত এই বোড়াল। জানা যায় একসময় আদিগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই বোড়াল গ্রামটি ছিল পাল ও সেন যুগের সমৃদ্ধশালী ও বর্ধিষ্ণু একটি গ্রাম। এরপর গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তিত হলে এই গ্রামটিও ক্রমশ সুন্দরবনের উত্তর প্রান্তের জঙ্গলের মধ্যে বিলুপ্ত হয়। এই বোড়ালের পথেই আদিগঙ্গার ধার দিয়ে কিছু প্রাচীন দেবালয় ও দ্রষ্টব্য স্থানের দেখা মেলে আজও।

বলতে গেলে একটি পুরাতাত্বিক স্হান হিসেবে বোড়াল যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। আগেই বলেছি গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তনের ফলে একসময়ের বর্ধিষ্ণু বোড়াল কার্যত ধবংসস্তূপে পরিণত হয়। পরবর্তীতে বোড়ালে দীঘি খননকার্যের ফলে বেশ কিছু পাথরের মূর্তি যেমন বিষ্ণু মূর্তি, পোড়ামাটির মাতৃকা মূর্তি, যক্ষ মূর্তি, খন্ডিত শিব মূর্তি পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। যেগুলোকে দেখে সম্ভবত পাল ও সেন যুগের বলেই ধারণা করা হয়। বোড়ালের এই প্রাচীন ইতিহাস বহু ঐতিহাসিক দ্বারা স্বীকৃত বলে শোনা যায়। বোড়ালের বিখ্যাত সুবৃহৎ সেন দীঘি একসময় প্রায় ৪২ বিঘা জমি নিয়ে বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও পাল ও সেন যুগে রাজাদের আমলে ও তার পরবর্তীকালেও সওদাগরেরা নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জাহাজ ও নৌকা করে গড়িয়া, বোড়াল প্রভৃতি অঞ্চল অতিক্রম করে তমলুকের প্রধান বন্দরে যেতেন বলেও জানা যায়। গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে প্রাপ্ত রাজা লক্ষ্মণ সেনের তাম্রপট্টলিপি এবং মাটি খুঁড়ে পাওয়া অন্যান্য নিদর্শন দেখে বোড়ালকে সেন যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার কেন্দ্র বলেই মনে করা হয়।

এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল মা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির। এই মন্দিরের কথা অন্য পর্বে আলোচনা করবো। এখানে মায়ের মূর্তিটি ধাতু নির্মিত। এছাড়াও বাবা ঠাকুর ও ধর্ম ঠাকুর নামে দুটি দেব বিগ্রহও বোড়ালে প্রতিষ্ঠিত আছে বলে জানা যায়। যার একটি সেন দীঘির পূর্ব কোণে অবস্থিত ও অন্যটি সরল দীঘির কোণে। এছাড়াও আছেন ‘ককাই চন্ডী’ । একসময়ে এখানে ডর মহাকাল নামে এক দেবতার পূজা বহু প্রচলিত ছিল বলেও জানা যায়। এই বোড়ালেই অবস্হিত মহাশশ্মান ও জোড়া মন্দিরের কথা পরের কোন পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

তবে এইসব পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনকে বাদ দিলেও আরও একটি কারণ আছে যা বোড়ালকে বোড়ালকে আন্তর্জাতিক পরিসরে উপস্থাপন করে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ র কথা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার জানা। হ্যাঁ এই ছবির শ্যুটিং কিন্তু এই বোড়ালেই হয়েছিল। জানা যায় টানা তিন চার বছর ধরে এই বোড়ালেই ‘পথের পাঁচালী’ র চিত্রগ্রহণের কাজ চলেছিল। বলতে গেলে বাংলা চলচ্চিত্রকে বৃহৎ পরিসরে পথ চলতে শিখিয়েছিল এই ছবিটি। ৬২ বছর আগে এই ছবির বেশির ভাগ অংশ ই ক্যামেরা বন্দী হয় এই বোড়ালের গ্রাম্য পরিবেশে। অবশ্য সময়ের স্রোত বেয়ে সেই ৬০ বছর আগের বোড়ালের সাথে আজকের বোড়ালের বিস্তর পার্থক্য চোখে পড়ে। একসময়ের বনাঞ্চলে ঢাকা সেই গ্রাম আজ বৃহত্তর কলকাতার অংশ বিশেষ।

পথের পাঁচালির সেই দৃশ্য আজও আছে

জানা যায় ‘পথের পাঁচালী’ র জন্য যখন সত্যজিৎ রায় বাড়ি খুঁজছিলেন কিন্তু মনের মতো বাড়ি পাচ্ছিলেন না তখন এক সূত্র মারফত তিনি ভবানীপুরের গৌরগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বোড়ালের এই পৈতৃক বাড়ির সন্ধান পান। বাড়িটি দেখে সত্যজিৎ রায় এখানেই ছবির চিত্রগ্রহনের সিদ্ধান্ত নেন। গৌরবাবুর অনুমতি নিয়ে শুরু হয় ছবির শুটিং। একসময়ের নিশ্চিন্দিপুরের সেই এঁদো পাড়া গাঁ আজ অবশ্য শহর বলেই পরিচিতি পায়। মনে পড়ে সর্বজয়ার সেই জরাজীর্ণ কাঠের দরজার কথা? সেই দরজার জায়গায় এখন মূল প্রবেশ দ্বারে শোভা পায় ধাতব গেট। যে দরজা পার হয়ে একসময় অপু, দুর্গা ছুটে গিয়েছিল রেললাইন দেখবে বলে, এখন অবশ্য সেই ফটকের খানিক দূর দিয়ে রেললাইন ধরে ছুটে চলে মেট্রো রেল। এগুলো পড়ে নিশ্চয়ই ধারণা করতে পারছেন সময় ও সভ্যতার অগ্রগতি সম্পর্কে! জানা যায় বাড়ির উঠোনে সর্বজয়ার তুলসীতলাটি আজও আছে আর আছে বাড়ির পাশের বাঁশ ঝাড়টিও।ভাবলে অবাক লাগে ৬০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে অথচ আজও যেন ঐ বাড়িটির আনাচে কানাচে সর্বত্র জুড়ে ছড়িয়ে আছে ‘পথের পাঁচালী’ র স্মৃতি। যা বোড়ালের ঐতিহ্য হয়ে বয়ে চলেছে ইতিবৃত্তের পাতায়। কি করে এড়িয়ে চলা সম্ভব বলুন তো এইসব অতীতকে! তাইতো বারবার ফিরে আসা ইতিহাসের টানে মাটির খুব কাছাকাছি, হয়তো তাই মাটির বুকে কান পেতে শোনা ইতিহাসের গভীর চলনকে। সত্যি বর্তমানে বসে অতীতকে নিয়ে ভাবতে গেলেই যেন গায়ে কাটা দেয়। কতো ঐতিহ্যপূর্ণ দেশ বলুন তো আমাদের তাই না! পরবর্তী পর্বে আবার হাজির হবো আরও কিছু তথ্য নিয়ে, যার খানিকটা হয়তো আমাদের জানা আর খানিকটা না হয় জানার অপেক্ষায় থাকি কেমন!!

লেখা পাঠাতে পারেন

Leave a Reply to DominicVenly Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here