গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পাঁচ)

1
135
সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পাঁচ)

লিখছেনঃ সুকন্যা দত্ত

বড়ে গুলাম আলী খানের নাম শোনেননি, এমন মানুষ হয়তো বিরল। এই ওস্তাদ ধ্রুপদী গায়ক পাটিয়ালা ঘরানাকে উজ্জ্বল করেছেন, একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়। ভারতের পাঞ্জাবের পাটিয়ালা স্থানের নাম থেকেই এই পাটিয়ালা ঘরানার উৎপত্তি। ১৯ শতকে, এই ঘরানার জন্ম দেন ফতেহ আলী খান এবং আলী বকস জারনালি। এই দুজন গায়ক পাটিয়ালার মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ফতেহ আলী এবং আলী বকস দিল্লি ঘরানার তানরস খান ও কালু খান এবং গোয়ালিয়র ঘরানার হাদ্দু খান ও হাসসু খানের থেকে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন খেয়াল,গজল,ঠুমরী গানের জন্য এই দুই গায়ক সকলের কাছে সমাদৃত হন। এই ঘরানার গানে একতাল ও তিন তালের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। পাটিয়ালা ঘরানার গায়ন শৈলীতে তানের প্রাধান্য রয়েছে। ছন্দ, বক্র, ফিরাত তানের সাথে সাথে এই ঘরানার গান চক্রাকার ছন্দে আবর্তিত হয়। পাটিয়ালা ঘরানার বিখ্যাত গায়করা হলেন, ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী, বরকত আলী খান, ইকরামুল মাজিদ খান,বসন্ত রাও দেশপান্ডে, পারভীন সুলতানা, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ।

খেয়াল গানের অপর একটি বিখ্যাত ঘরানা হলো কিরন ঘরানা। এই ঘরানার গায়ন শৈলীতে স্বর, মিষ্টতা, এক একটি সুর প্রাধান্য পায়। উচ্চ তন্ত্রীতে এই ঘরানার সঙ্গীত গীত হয়। উত্তর প্রদেশের বর্তমান শ্যামালী জেলার কৈরানা নামের ক্ষুদ্র গ্রাম থেকে এসেছিলেন। তিনিই এই ঘরানার প্রবর্তক।১৯ শতকের শেষের দিকে আব্বুল করিম খান এবং আব্বুল ওয়াহিদ খান খেয়াল গানে বিলম্বিত লয়ের অন্যমাত্রা তুলে ধরেন। এই ঘরানার গানে কোমল রিষভ এর প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। গোয়ালিয়র রাজসভার ওনার ঘন ঘন যাতায়াতের জন্য কর্নাটক ধ্রুপদ সঙ্গীতের দ্বারা ও আব্বুল করিম খান প্রভাবিত ছিলেন। এই ঘরানার প্রখ্যাত গায়করা হলেন, আশীক আলী খান, সুরেশ বাবু মানে, হীরা ভাই বড়োদেকর, সরস্বতী রানে প্রমুখ।

রূপোলী চাঁদের আলো জড়িয়ে , দূর্গের অলিন্দ ঘিরে , ধীর গতিতে বয়ে চলা নর্মদা নদীর কোলে বাস করছে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর। দূর্গের কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনিত সুর ও তানের মূর্চ্ছনা। এই ঘরানার জন্মদাতা আমীর খান। তিনি আব্বুল করিম খান,আমন আলী খান, রাজাব আলী খান এবং আব্বুল ওয়াহিদ খানের সঙ্গীত শৈলী রপ্ত করে তার সাথো নিজের শৈলীর সংমিশ্রণ করে এই ঘরানার সূচনা করেন। ইন্দোর ঘরানার সঙ্গীত বিলম্বিত লয়ে গীত হয় এবং এটি রাগ প্রধান। বোল, আলাপ ও সরগমের ক্ষেত্রে মেরুখন্দের প্রভাব লক্ষিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে তেহাই লক্ষিত। ১৯৭৪ সালে কলকাতায় গাড়ী দূর্ঘটনায় আমীর খানের মৃত্যু হলে ও আধুনিক হিন্দুস্তানী সঙ্গীতের এই ঘরানা গীত মহলে পাকাপাকি জায়গা করে নেয়। পরবর্তী গায়কদের মধ্যে পন্ডিত অমরনাথ, শংকর লাল মিশ্র, কঙ্কনা ব্যানার্জী প্রমুখরা হলেন বিখ্যাত।

১৯ শতকের শেষ দিকে আল্লাদিয়া খানের হাত ধরে সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেছে জয়পুর আটরৌলি ঘরানা,তবে এই ঘরানার অপর নাম জয়পুর ঘরানা। আল্লদিয়া খান আলীগড়ের আটরৌলিতে বাস করতেন,পরে জয়পুর এসে বাস করতে থাকেন। জয়পুরের মহারাজার দরবারে খুব সহজেই তিনি জায়গা করে নেন। ধ্রুপদ গায়ন শৈলীর ডাগর বানী ধারা অনুসারী জয়পুর ঘরানা। পরবর্তীতে এই ঘরানার গান জয়পুরের রাজ দরবার অতিক্রম করে যোধপুর, উনিয়ারা,বুন্দি, আটরৌলি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। জয়পুর আটরৌলি ঘরানার অধিকাংশ গান হাভেলী সঙ্গীত ও ধ্রপদ ঐতিহ্যের অনুসারী। এর গায়ন শৈলীতে লয়কারী, রাগের প্রাধান্য বিশেষত জোড়া রাগ ও সংকীর্ণ রাগ এর শোভা বৃদ্ধি করেছে। আলাপ ও তানের পরিবর্তে সুরের চলনে তির্যক ভঙ্গীমা ও সূক্ষ্মতা লক্ষ্য করা যায়। সমান্তরালের তানের পরিবর্তে গমক এই ঘরানার গায়ন শৈলীর বৈশিষ্ট্য। এই ঘরানার স্বনামধন্য গায়করা হলেন, মাঞ্জি খান, কেশরভাই কেরকার, হায়দার আলী খান প্রমুখ।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here