গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পর্ব-দুই)

83
302
সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।

ধ্রুপদ গানে বিষ্ণুপুর ঘরানা

সু ক ন্যা   দ ত্ত

“প্রথম আদি তব শক্তি, আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারই হে,
গগনে গগনে”,…
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই গানটি ধ্রুপদ অঙগের গান। শুধু এই গানটিই নয়, বিভিন্ন সময়ে হিন্দুস্থানী ধ্রুপদ ভেঙে তিনি বহু উপাসনা সঙ্গীত রচনা করেন।রবীন্দ্রনাথের গানে এই ধ্রুপদের প্রভাব তার পারিবারিক আবহের কারণেই বলা যায়। তাঁর বাল্যকালে সঙ্গীত শিক্ষা দিতে বিষ্ণুপুর ঘরানার একাধিক ওস্তাদ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসতেন। এরা হলেন যদু ভট্ট,বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তী এবং রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী।এই বিষ্ণুপুর ঘরানা হলো বাংলার প্রাচীন ও একমাত্র সঙ্গীত ঘরানা। ধ্রুপদ গায়নের এই বিশিষ্ট ঘরানা বিষয়ে আলোকপাত করার পূর্বে ধ্রুপদ গীত পরিচয় জেনে নেওয়া যাক। প্রাচীন সময়ে গায়নের দুটি পদ্ধতির কথা জানা যায়। অনিবদ্ধ গীত ও নিবদ্ধ গীত। ভরতমুণি তার “নাট্যশাস্ত্রে” এই দুই গীতি সম্পর্কে বলেছেন- নিবদ্ধ গীতি তাল ও ছন্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু অনিবদ্ধ গীতি তাল ছন্দ নির্দিষ্ট নয়। ১৩ শ শতকে শার্ঙ্গদেবের “সঙ্গীত রত্নাকর” গ্রন্থে ও এই দুই গীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। তার মতানুযায়ী নিবদ্ধ গানের তিনটি নাম রয়েছে প্রবন্ধ,বাস্তু ও রূপক।প্রাচীন প্রবন্ধ গানের অন্তর্গত “সালগসূড়” থেকেই ধ্রুপদ গানের জন্ম বলে মনে করা হয়। অনেকেই গোয়ালিয়র অধিপতি রাজা মানসিংহ তোমরের রাজত্ব কালকেই ধ্রুপদ সৃষ্টির কাল বলেছেন। যদি ও এর বিতর্কিত মতও রয়েছে।

চিত্রঃ ২

ধ্রুপদ শব্দটি এসেছে ধ্রুব পদ( সংস্কৃত) শব্দ থেকে। ‘ধ্রুব ‘ শব্দের অর্থ অবিচল,অটল,চিরন্তন এবং পদ হল গীতি। আধুনিক যুগে যে সকল ধ্রুপদী গান প্রচলিত তাদের জন্ম ভক্তি আন্দোলনের সময়ে বিশেষত বল্লভ সম্প্রদায় বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হাত ধরে এবং পরবর্তী সময়ে তা আর ও ভক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পূর্বে, মন্দিরে দেবতার দিকে উপবিষ্ট হয়ে ভাবে বিভোর হয়ে গায়েনরা এই গান গাইতেন। মন্দিরে গীত হিন্দী বা ব্রজভাষায় রচিত এই গান পরবর্তীকালে হাওয়েলি ধ্রুপদ গানে পরিণত হয়।এই ভক্তিমূলক গীতির মধ্যেই পরবর্তীকালের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বীজ লুকিয়ে ছিলো।১৫০০ শতকে এই ধ্রুপদ সঙ্গীত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজদরবারে জায়গা করে নেয়।
Octavio Paz ধ্রুপদ গীতি সম্পর্কে বলেছিলেন,
” Ragas are soliloquies and meditations passionate melodies that draw circles and triangles in a mental space,a geometry of sounds that can turn a room into a fountain,a Spring, a pool.”.
বিষ্ণুপুর ঘরানার বিকাশে বৈষ্ণব ধর্ম ও শাস্ত্রীয় কীর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।ধ্রুপদ সঙগীতের একটি বিশিষ্ট ঘরানা হলো বিষ্ণুপুর ঘরানা।বাংলার একমাত্র এই ঘরানার ইতিহাস সুপ্রশস্ত নদীর মতোই প্রবাহিত।
১৩৭০ খ্রিঃ বড়ু চন্ডীদাস রচিত ” শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” এর সময়কালকে বিষ্ণুপুর ঘরানা কে আদিপর্বের সূচনা বলা হয়। জয়দেবের “গীতগোবিন্দ ” এর আদর্শে বাংলা ভাষায় রচিত রাগ – তাল নিবদ্ধ কাহিনী “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”।
১৪৮৬ থেকে ১৫৩৩ খ্রিঃ অর্থাৎ চৈতন্যদেবের সময়কালে বৈষ্ণবধর্ম তথা ভক্তিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলায়। ১৫৮৬ থেকে ১৬২০ অর্থাৎ মল্লরাজা বীর হাম্বীরের সময়কালে শ্রীনিবাস আচার্য শাস্ত্রীয় কীর্তন ও কথায় মল্লরাজ সভা জয় করেন। সেই সময় তার হাত ধরেই বৈষ্ণব ধর্ম শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে।এই শ্রীনিবাস আাচার্য ছিলেন নরোত্তম দাসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। এই নরোত্তম ঠাকুর বৃন্দাবনে থাকাকালীন সময়ে তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামীর কাছে প্রায় ছয় সাত বছর ধরে ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। বৃন্দাবন থেকেম পুঁথির গাড়ি নিয়ে,গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের গোস্বামী সিদ্ধান্তের প্রচারের জন্য গৌড়ে আসছিলেন শ্রীনিবাস, নরোত্তম ও শ্যামানন্দ। বিষ্ণুপুরের কাছে গোপালপুরে পুঁথি চুরি হয়। পরে সে পুঁথি মল্লরাজ বীর হাম্বির আচার্য শ্রীনিবাসকে প্রত্যর্পন করেন। আচার্য শ্রীনিবাস রাজা বীর হাম্বিরকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দেন ও বিষ্ণুপুরে রয়ে যান। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য কীর্তন ও কথকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

        বিষ্ণুপুরে, সংগীতের বিকাশ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অভ্যুত্থানের পাশাপাশিই ঘটছিল।  শ্রীনিবাস আচার্যের উদ্যোগে নরোত্তম দাসের শাস্ত্রীয় কীর্তন বিষ্ণুপুরে আসে। ডঃ সুকুমার সেনের মতে, রাজাদের একাধিক ঠাকুরবাড়িতে প্রাত্যহিক ছিলো কীর্তনের সমারোহ। অপরদিকে বৃন্দাবনী কথকতা ছিল মার্গসংগীত ভিত্তিক। শাস্ত্রীয় কীর্তন ও কথকতাই ছিল বিষ্ণুপুরে মার্গসংগীতের সাম্ভাব্য উৎসমুখ।

অপর দিকে মনে করা হয়, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে (১৬৫৯-১৭০৭) ইসলামি শাসন কঠোর আকার ধারণ করে। বহু জ্ঞানী, গুনী মানুষ তাঁর দরবার ত্যাগ করে চলে যান। কথিত আছে, তানসেনের বংশধর ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ এবং মৃদঙ্গ বাদক পীর বক্স এসময় দিল্লীর দরবার ছেড়ে চলে আসেন বিষ্ণুপুরে, তৎকালীন মল্লভূমের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেবের (১৭০২-১৭১২) দরবারে। মল্লরাজার দরবারে তিনি সভাগায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। বাহাদুর খাঁ এর সুযোগ্য শিষ্য গদাধর চক্রবর্তী তার গুরুর কাছ থেকে গায়ন এবং সুরশৃঙ্গার,রবার,বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষা লাভ করেন। গদাধর চক্রবর্তীর সুযোগ্য শিষ্য রাম শঙ্কর ভট্টাচার্যের হাত ধরে বাংলায় বিষ্ণুপর ঘরানা বিস্তার লাভ করে। অর্থাৎ বলা যেতেই পারে, বাহাদুর খাঁ বাংলার মাটিতে বিষ্ণুপুর ঘরানার বীজ বপন করলেন এবং রাম শঙ্কর ভট্টাচার্য তাকে বৃক্ষে পরিণত করলেন।

       বিষ্ণুপুর ঘরানার আদিপুরুষ পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে (১৭৬১-১৮৫৩) ওস্তাদ বাহাদুর খানের শিষ্য বলে অনেকে মনে করেন। সে হিসেবে সেনিয়া ঘরানার সাথে বিষ্ণুপুর ঘরানার সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে অনেক ভিন্নমত আছে। শ্রী দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায় সন তারিখ বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন যে, ১৭০০ এর পূর্ববর্তী কোনো এক সময় বাহাদুর খাঁ মল্লভূমিতে আসেন অন্যদিকে রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের সময়রেখা শুরুই হচ্ছে এর চুয়ান্ন বছর পর।এই রাম শঙ্কর ভট্টাচার্যের সুযোগ্য শিষ্যই ছিলেন পূর্বে উল্লিখিত যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট।

    শ্রী দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৬৩) প্রতিষ্ঠিত মতটি হলো, মথুরা-বৃন্দাবন সংগীত কেন্দ্রের আচার্য স্থানীয়, ‘পণ্ডিতজী’ নামক জনৈক গায়ক পুরীধামে তীর্থযাত্রার সময় বিষ্ণুপুর রাজ চৈতন্য সিংহের (১৭৪৮-১৮০১) দরবারে কয়দিন থাকেন ও রাজার সভাপণ্ডিত গদাধর ভট্টাচার্যের ছেলে তরুণ গায়ক রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে অনুপ্রাণিত করেন। ফেরার পথে তিনি ওই দরবারে দুই বৎসরকাল অবস্থানকালে রামশঙ্করকে ধ্রুপদ শিক্ষাদান করেন। আর একটি মত প্রতিষ্ঠা করেছেন সঙ্গীতাচার্য্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রকৃত ইতিহাস ও রাগরূপের সঠিক পরিচয়’ গ্রন্হে। তার মতে, রামশঙ্কর পশ্চিম থেকে আগত খুব বড়ো এক হিন্দুস্হানী ধ্রুপদ গায়কের কাছে শিক্ষা করেন, তারপর সেই গায়কের সঙ্গে চলে যান। তাঁর কাছে অনেকদিন থেকে ধ্রুপদ শিক্ষা করেন। পরে সেই স্হানের একজন ওস্তাদ খেয়াল গায়কের কাছে খেয়াল ও টপ্পা গান শিখে বিষ্ণুপুরে ফিরে আসেন।
পরবর্তী পর্বে ধ্রুপদ গানের অন্যান্য ঘরানা নিয়ে আলোচনা করবো।
রমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায় তার ” দ্বিতীয় দিল্লী বিষ্ণুপুর ” গ্রন্থে রামকেশব ভট্টাচার্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন রাম শঙ্কর ভট্টাচার্যের পুত্র। ওই গ্রন্হ থেকে জানা যায় রাম কেশব ভট্টাচার্য কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ানের দরবারের গায়ক ছিলেন।
     বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যান্য বিশিষ্ট গায়করা হলেন, রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়,ক্ষেত্র মোহন গোস্বামী, অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। বিষ্ণুপুর ঘরানার গায়ক আলাপের মধ্য দিয়ে  রাগের সৌন্দর্য মেলে ধরেন। এই কাজটি সহজভাবে এবং কোনো রকম অতিরিক্ত অলংকরণ ছাড়াই করা হয়। তালের জটিল বাদ্যও পরিহার করা হয়। ধামারে লয়কারী অনুমোদন করা হয়। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ  মিষ্টি সুরেলা সংগীতের জন্য খ্যাত। পরবর্তী পর্বে ধ্রুপদের অন্যান্য ঘরানা নিয়ে আলোচনা করবো।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here