গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পর্ব- এক)

0
419
সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।

গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পর্ব-১)

সু ক ন্যা   দ ত্ত

বর্তমান সময়ের একটি বড়ো সমস্যা হলো হতাশা, মানসিক চাপ।সেই সমস্যার অবসানের অন্যতম উপায় হলো গান। “হাত দিয়ে দ্বার” না খুলতে পারলে ও “গান দিয়ে দ্বার খোলা যায়”, এমনই শক্তি নিহিত আছে সংগীতে। বৈজ্ঞানিকভাবে বলা যায়, পছন্দের সুর বা গান মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাস কে স্পর্শ করলে তা উদ্দীপিত হয়।তাই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মিউসিক থেরাপি একটি জায়গা
করে নিয়েছে। মহান অভিনয় শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চিকিৎসার জন্য মিউসিক থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়েছিলো।
সঙ্গীত একটি বিস্তারিত বিষয়। একটি জলাশয়ে একটি ধানের কণা ফেলে তাকে খোঁজার চেষ্টা যেমন বৃথা তেমন সঙ্গীতের আলোচনাকে একটি পরিধিতে বেঁধে রাখাও কঠিন। সঙ্গীত হলো নিরাকার।
সঙ্গীত সম্পর্কে নানান জায়গায় নানান উক্তি পাওয়া যায়।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,
” সংগীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিতকলা এবং যারা তা বোঝেন তাদের নিকট উহা সর্বশ্রেষ্ঠ উপাসনা।”

সংগীত হলো মুক্তির মাধ্যম। ভারতীয় সংগীতের উপাদান ও আধিপত্য ধর্মীয় ভাবাপন্ন। তাই আমরা দেখি, যুগ যুগ ধরে ভক্তরা তাদের ভক্তেরা আকুতি জানিয়েছেন সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রামায়ণ, মহাভারত, জয়দেবের সুললিত “গীত গোবিন্দ”, মঙ্গলকাব্য, রামপ্রসাদ কমলাকান্তের শাক্ত সঙ্গীত,বিদ্যাপতি-গোবিন্দদাসের পদাবলী কীর্তন,কবীরের দোঁহা, মীরাবাঈ এর সুরের ধারায় এ ভারতভূমি সিঞ্চিত হয়েছে। গেয় কবিতা বা পদ মনে রাখার সুবিধা বলেই হয়তো এগুলির মধ্যে সুরারোপিত করা হয়েছিলো। তবে কেবল ধর্মীয় ভাবে আবদ্ধ না থেকে শ্রমিক,কৃষক, মাঝির কঠোর জীবন সংগ্রামের পরিশ্রম লাঘবের মাধ্যম হয়ে উঠেছে গান। ভগবান স্বয়ং নারদ কে বলেছিলেন,
” নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে যোগীনাং হৃদয়ে ন চ,
মদ্ভক্তাং যত্র গায়ন্তী তত্র তিষ্ঠামি নারদ”।
অর্থাৎ, “নারদ,আমি বৈকুন্ঠে থাকতে পারিনা,যোগীদের হৃদয়ে ও নয় কিন্তু ভক্তেরা যেখানে আমার নাম গান করেন আমি সেখানেই সর্বদা থাকি”।


   প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ” সঙ্গীত পারিজাত” এ অহোবল সঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,
“গীতং, বাদ্যং, নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীত মুচ্যতে”।।
অর্থাৎ গান,বাদ্য, নাচ এই তিনের সমন্বয়ে সঙ্গীত। বিষ্ণুপুরাণে আছে, সকল গীতিকা শব্দমূর্তিধর বিষ্ণুর অংশ।সমগ্র জগৎ সুরের আসনে অধিষ্ঠিত।এই মহাবিশ্বের পরতে পরতে সঙ্গীত ছড়িয়ে আছে।বৃষ্টিধারায়, বজ্রপাতে, নদীর কল্লোলে,পাখির কলতানে, পাতার মর্মর শব্দ সুরের চাদরে মুড়িয়ে আছে।ভারতীয় সঙ্গীত ধারায় আমরা দেখি, দেবতার সঙ্গীত ও মানব সঙ্গীত। এর মধ্যে মানব সঙ্গীত বিবর্তনের ফলে লোক সঙ্গীত হয়ে উঠেছে আর দেবতার সঙ্গীত নানান পথ পেরিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রূপ লাভ করেছে।সামবেদ কে ভারতীয় সঙ্গীতের আতুরঘর বলা যেতে পারে।
বেদের যে সকল মন্ত্র বা মন্ত্রের অংশ সুর সহযোগে গাওয়া হয়, তাকে সাম বলা হয়। ভারতের বৈদিক যুগে চর্চিত এই গানকেই ভারতবর্ষের আদি গান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সে সময়, ঋষিরা সুরসহযোগে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন। এর সাথে কখনো কখনো বাদ্যযন্ত্রও ব্যবহার করা হতো। এই সব শ্লোক বা মন্ত্র সামবেদে সংকলিত হয়। মূলত বৈদিক গান বলতে সামগান কে বোঝায়। ফিটস স্টাল সামবেদ কে সুরারোপিত ঋগ্বেদ বলে উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে ভরতমুণির ” “নাট্যশাস্ত্রে” ও সঙ্গীতের উল্লেখ আছে।
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ঘরানার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ঘরানার বিষয়ে আলোচনা করা মানে সমুদ্রে ডুব দিয়ে রত্ন সংগ্রহের সমান। তবু ও জ্ঞান সমুদ্রে সুরের বৈঠা বেয়ে চলতে মন চায়।
“ঘরানা” শব্দটি ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হিন্দি ঘর ওয়ানা শব্দ থেকে ঘরানা শব্দটি এসেছে। হিন্দি ‘ঘরানা’ শব্দের অর্থ পরিবার। সতীর্থ শিল্পীরা একই পরিবারভুক্ত। একই গুরুর শিষ্যদের বোঝাতে ঘরানা শব্দের ব্যবহার চলে আসছে।


প্রতিটি ঘরানার একজন গুরু এবং নিজস্ব গায়ন কিংবা বাদন শৈলী থাকে, যার দ্বারা সেই ঘরানাটি চিহ্নিত হয়। ঘরানার নামকরণ করা হয়, প্রবর্তকের নামানুসারে কিংবা উৎপত্তিস্থলের নামানুসারে। প্রত্যেকটি ঘরানায় নিজস্ব শিক্ষাক্রম অনুসারে তার শিষ্যদের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং একটি ঐতিহ্যবাহী ঘরানা কয়েক পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে।
১৯ শতকের পূর্বে রাজ দরবারে গায়ক,বাদকরা রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন কিন্তু ১৯ শতকের পর এই প্রথায় ভাঙন লাগে।তখন বাধ্য হয়ে তারা প্রাসাদ ত্যাগ করে নগরে বসবাস শুরু করে।নিজেদের হৃত পরিচয় ও সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য নিজ নিজ স্থানে ফিরে যায়।সেই স্থান থেকেই সম্ভবত ঘরানা শব্দের নামকরণ হয়েছে।ঘরানার ঘর হলো সঙ্গীত পরিবার, প্রত্যেক আদি পুরুষ হলো ঘরানার পিতা।তার যোগ্য শিষ্যরা হলেন, সেই পরিবারের প্রথম প্রজন্ম। গুরু তার পরিবারের সদস্য নিয়েই সঙ্গীতের ঘরানা তৈরি করেন না। শিষ্য-প্রশিষ্যের ধারা মিলিত হয়ে একটা পরম্পরা সৃষ্টি হয়। সঙ্গীত-গুরু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে, যে ঐতিহ্য স্থাপন করেন তিনি সেই ঐতিহ্যের ঘরানা-প্রবর্তক রূপে গণ্য হন, একেকটি ঘরানা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়। ঘরানায় আঞ্চলিকতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। খানদানি ঘরানা কয়েক পুরুষের প্রতিষ্ঠার ফলেই হয়ে থাকে। ঘরানার সঙ্গীত-সাধকরা নিজের নিজের সাধনার দ্বারা ঘরানাকে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করে থাকেন।
কন্ঠ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গায়ন ঘরানা তৈরি হয়।এই গায়ন ঘরানার দুটি পদ্ধতি হলো, খেয়াল ও ধ্রুপদ।
খেয়াল ঘরানার ভাগগুলো হলো,
১. গোয়ালিয়র ঘরানা,
২.আগ্রা ঘরানা,
৩.পাটিয়ালা ঘরানা
৪.কিরণ ঘরানা,
৫.ইন্দোর ঘরানা,
৬.জয়পুর -আটরৌলি ঘরানা,
৭.ভেন্ডিবাজার ঘরানা,
৮.মেওয়াটি ঘরানা,
৯.রামপুর সাহাসন ঘরানা
১০.শ্যাম চৌরাসিয়া ঘরানা।

ধ্রপদ গায়নের প্রধান ঘরানা হলো বিষ্ণুপুর ঘরানা। তবে পরবর্তীকালে এই গায়নের চারটি শৈলীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
ক).গওহর বাণী
খ).ডাগর বাণী
গ). খান্ডহার বাণী
ঘ).নওহার বাণী….
এই গায়ন শৈলী থেকেই পরবর্তীতে চারটি ঘরানার বিষয়ে জানা যায়….
১.দ্বারভাঙ্গা ঘরানা
২.তালওয়ান্দি ঘরানা
৩.বেট্টিয়া ঘরানা
৪.ডাগর ঘরানা।

পরবর্তী পর্বে ঘরানাগুলির বিস্তারিত আলোচনা করবো।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here