ম য়ূ রী মি ত্র-র গদ্যকাব্য

0
72
পরিচিতিঃ প্রবাসী। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে গভীর অনুরাগ। মাঝে মধ্যে লিখে ফেলেন ইচ্ছাখুশি। তাঁরই কিছু গদ্যকাব্য নিয়ে বাইফোকালিজম্ সেজে উঠল

 

ম য়ূ রী   মি ত্র-র গদ্যকাব্য

মাঝি চল

একঃ

এই শহরের এক মায়ের কথা বলব আজ৷ একটি দোকানে শাড়ি বিক্রির চাকরি করেন ভদ্রমহিলা৷ দিনান্তে মালিককে বিক্রির  হিসেব বুঝিয়ে চলে যান৷ অনেকদিন ধরেই শাড়ি কিনি তাঁর কাছে৷ ফলে একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে দুজনে৷ খুব কম কথা বলেন৷ শোনেন বেশি -ক্রেতার পছন্দ অপছন্দ৷ ভদ্রমহিলার এই শোনার ভঙ্গিটা খুব আকর্ষক ৷যেন বক্তার প্রতিটা শব্দ মেপে নিচ্ছেন নিখুঁত গণিতে ৷ ভাবতাম -বেশি পরিমাণ ক্রেতার কাছে পৌঁছোতেই  এই শোনার অভ্যেস৷ সেদিন বুঝলাম, শোনাটা নিজের হৃদয়কে মানুষে নিবিষ্ট  করতেই ৷ সেদিনও আমার পছন্দ বুঝে বুঝে শাড়ি দেখাচ্ছিলেন ৷ হঠাৎ উদভ্রান্ত এক ভদ্রলোক৷ হাউহাউ করে কাঁদছেন  –মেয়েটি তাঁর কাল থেকে ভর্তি হাসপাতালে৷ বললেন -আজ মরবে -মরবে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই৷ তবু শেষ চেষ্টার জন্য ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়েছেন কটা৷ কিনে এখনই দিতে হবে নার্সকে৷ কেনা হয়েও গেছে৷ শুধু আড়াইশো টাকা কম হওয়ায় ওষুধগুলো দিচ্ছে না দোকান৷ আমার সেদিন ব্যাগে অনেক টাকা৷ শাড়ি কিনতে গেছি তো৷ তবু বার করছি না৷ কষ্ট হচ্ছে ভদ্রলোকের কথা শুনে৷ আবার মনে হচ্ছে– গুল দিচ্ছে না তো লোকটা৷ বুদ্ধিজীবী তো! তাই বুদ্ধিকেই জেতাচ্ছিলাম খচ্চরের  কৌশলে৷

হঠাৎ দেখি,শাড়ি ফেলে শাড়িবিক্রেতা ভদ্রমহিলা হাঁ করে শুনছেন সেই বাবার কথা৷ হাঁ করে মানে একদম হাঁ করেই৷ বিরক্ত হয়ে নিশ্চিত ক্রেতা যে ফসকে  যেতে পারে খেয়ালই নেই তাঁর৷ শাড়ি ফেলে , আমাকে ফেলে এগিয়ে গেলেন সেই বাবার দিকে -আজ যে সন্তান হারাবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে৷ অবাক হয়ে দেখলাম –সেই সামান্য দোকানের কর্মচারী ব্যাগ হাতড়ে দিলেন দুশ টাকা৷ আর হয়ত ছিল না তাঁর কাছে৷ কী প্রত্যয় তাঁর সেই অচেনা বাবার ওপর৷ বললেন -আপনাকে পুরো বিশ্বাস করছি ৷আর দেরি করবেন না৷ যান ওষুধ নিয়ে এখনই যান৷ যদি কোনোদিন নিজের  উচিত মনে হয় তবেই টাকাটা ফেরত দেবেন৷ না পেলেও  আমার কোনো  ক্ষতি হবে না৷ একটা বাচ্চাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছি৷ ঈশ্বর নিশ্চয় বুঝবেন৷ আমায় বুঝবেন৷ আপনার বাচ্চার কষ্টও বুঝবেন৷ প্রতিটি বাক্য গোটা গোটা করে বলেছিলেন৷ ছেলেবেলায় নীতিশিক্ষার  ক্লাসে যেমন করে লিখতাম –নীতিবাক্য, ঈশপের গল্প -ঠিক অমনটা৷ বাবাটি ভদ্রমহিলার পায়ে পড়েছিলেন- নিঃসংকোচে৷

বুঝলাম -এ হল ধর্ম না জেনে প্রেম ৷
ধর্ম স্পষ্ট করে প্রেমভঙ্গি নয় ৷

এমন প্রেমের শেষ জানতে নেই৷
ফুল তার খুশিমতো ফোটে৷
ফুটুক৷
যত্ত খুশি৷

 

দুইঃ

লালরঙ খুব ভালো লাগে –রক্তলাল  –সলমালাল — উনুনলাল — ইঁট পাটকেল লাল৷ কত রকম যে লাল  যে আমার ছেলেবেলার ব্রহ্মাণ্ডে! সেই কবে থেকে লালে  খ্যাপামি আমার৷ আমার তখন পাঁচ কি ছয়। টুকটুকে লাল শাড়ি পরে টুকুশ টুকুশ গেছি  শীতের মেলায়৷ ইচ্ছে -লাল শাড়ির ওপর পড়ব একটি লাল কোট৷ বাবা কত করে বোঝালেন –ওরে লাল শাড়ির ওপর একটা কালো কোট পর৷ লালে আর কালোয় কতটি সুন্দর লাগবে তোকে৷

সে শোনে কে! দুই রঙের তালমিল কি তখন বুঝতাম ছাই! চারপাশের গোটা ভুবনখানি লালে ছইছটটি  হয়ে যাক, এমনই ছিল আমার লালের বাই৷ লাল শাড়ি আর লাল কোট পরে লালবাঈ হলাম৷ ষাঁড় তাড়া করল মেলায়৷ ওর মধ্যেও শাড়ি আর কোট সামলাতে ব্যস্ত৷ এক হাতে শাড়ি খুলতে খুলতে  আর এক হাতে লাল কোট নিয়ে দৌড়োচ্ছি৷ চিৎকার করছেন বাবা– হাতের থেকে লালগুলো  ফেল৷ নাহলে ষাঁড় আরো রাগবে৷ পাগল! লাল কেউ ফেলে?

দু মুঠোতে দুটুকরা লাল নিয়ে ষাঁড় খেপাচ্ছে খেপি ময়ূরী। মায়ের মুখে শোনা, ওই সময় থেকেই বিয়ের জন্য আকুলিবিকুলি আমার৷ আছাড়িপিছাড়ি দিতাম বরের জন্য৷ বড় সাধ– কিশোর  বর নিজের হাতে বুনে দেবে একটা লাল শাড়ি৷ সামান্য বড় হয়ে  তাঁত বোনার শব্দ পেতাম বাতাসে৷ ঠাকুমা জিজ্ঞেস করতেন, “শাড়ির পাড়টা কি হবে রে? লজ্জা হারিয়ে বলতাম, আরো লাল৷

“আরো লাল মানে? সে আবার কী রে?–

“আহা! এই সহজ রঙটা বুঝতে পারছ না! আরো লাল মানে অন্য কোনো লাল৷ এক নম্বর ছেড়ে দুই কি তিন নম্বর লাল৷ কিন্ত লালই হবে ঠাকুমা৷ পিলিজ -পিলিজ ৷মরে গেলেও লাল বেনারসিতে যেন লাল ভিন্ন অন্য কোনো পাড়  বসিও না৷”

যখন আমার সত্যি বিয়ে হবে কী করে যেন আমার এই লাল বাইয়ের কথা  রঙ্গদুলাল জেনে ফেলেছিল৷ অবিকল নেপালীদের মতো দেখতে এই যুবক তখন আমাদের গোটা পরিবারের তাঁতী হয়ে গেছে৷ নানারকম লাল   শাড়ি  দিয়ে আমার ফুলের শয্যা সাজিয়ে দিল রঙ্গদুলাল৷ ফুলের বিছানায়  শাড়িগুলোর লাল্টুস চেহারা  দেখে সেরাতে তার নামের আগে বড় সাধ করে রঙ্গ শব্দটা বসিয়েছিলাম৷ তিনটে বোন, একটা মা আর একটা বাবা হারিয়ে তাঁতীটির মুখে তখন চির দুঃখের ভাব বসে গেছে ৷ তাই বর আর শাড়ি পাওয়ার আনন্দ ভাগ করে দিয়েছিলাম রঙ্গকে৷

তারপর থেকে ফি বছর পয়ালা বৈশাখ কি পুজোয় আমার জন্য অন্যান্য শাড়ির সাথে একটি করে লাল রেখেই যেত রঙ্গ৷ মায়ের কাছে যখন যেতাম মা প্রথমেই রঙ্গের লালটি বার করে বলতেন –তাঁতী বলে গেছে এইটে দিয়ে পুজোর বাজার শুরু –তোর রঙ্গের হুকুম তার দেয়া  লাল  পরবি ষষ্ঠীতে৷ বলাবাহুল্য এ শাড়ি তন্তুবায়ের তরফ থেকে –দাম দিতে হত না৷ ভালোই হল –অমূল্যের দাম নির্ধারণ করতে হলে অঙ্ক গুলোতাম৷ লালের সূত্র ধরে এক গরিব দুখী শিল্পীর সাথে ভাবটা আমার এমন করে ক্ষীর হত না৷ কারণ রাঙাবরণ বস্ত্র আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে আমার কাছে রঙ্গদুলালের বরাদ্দ হয়েছিল –দুটি বড় রসগোল্লা, দুটো চাকবাদাম আর দু গ্লাস জল৷ যখনই আমার সাথে তার দেখা হত তখনই৷ দুটো রসগোল্লার একটা অবশ্য সে আমার জন্য রাখত –আর চাকবাদামের একটু৷ বোধহয় আমায় না খাইয়ে প্রাণে ধরে খেতে পেত না৷

বছর দুই আগে যেদিন আমার জন্য সে তার শেষ লাল শাড়িটি এনেছিল সেদিনই জনতা কারফু হয়ে গেল৷ কাপড়ের ব্যাগটি সেদিন সে আমাদের বাড়ি রেখে চলে গিয়েছিল৷ মা ফোনে বললেন –এবার তোর জন্য একটা দুর্দান্ত লাল শাড়ি এনেছে তাঁতী৷ ও ব্যাগে সেটা এখানেই রেখে গেছে৷ কিন্তু ও না এলে ব্যাগ খুলে নিস না৷ আমি মাঝে মাঝেই রঙ্গার শাড়ির ঝুলিতে হাত বুলোই -কল্পনা করি তার আনা লাল রঙ৷ খানিক পরেই ছুটি কোভিড রোগীর শ্বাস জোগাড়ে৷ সাদা সাদা মরা শরীর জমে দেশের আনাচে কানাচে৷ ভুলি রঙ্গকে -ভুলি লাল৷
এক হপ্তা আগে আমার কথাহারা মাকে দেখতে এল রঙ্গদুলাল৷ মা চিনতেও পারছিলেন না৷ রঙ্গ সংকোচ  পেলেও আমি সেদিন নির্লজ্জ্ব হয়ে রঙ্গার  ফেলে যাওয়া ব্যাগ খুলে মায়ের চোখের সামনে আমার সেই না পরা লাল শাড়িটা খুলে নাড়াতে লাগলাম৷ যদি  রাঙ্গাজবার মতো শাড়িটি

মায়ের মুখে কথা ফেরায়৷ দেখি -শাড়িটি ঝুরঝুর করে খুলে পড়ে যাচ্ছে৷ জনমদুখী রঙ্গা হেসে বলে –দুবছর তোমাদের নিচের ঘরে পোঁটলাটা রাখা ছিল ৷ ড্যাম লেগে তোমার শাড়িটিই নষ্ট৷ ওটা আলাদা করে তোমার জন্য সব শাড়ির নীচে ছিল তো৷

রসগোল্লা ও ফাটা পোঁটলা বেঁধে নিয়ে সেদিন যেন চলে যাবার জন্য বড্ড তাড়া করছিল রঙ্গদুলাল৷ এক নিঃশ্বাসে জলটুকু খেয়ে বললে —দিদি যাই৷ আজ মাঝপথে হয়ত বাসের ঝামেলা হতে পারে৷  আজ পার্টি থেকে মৃত পশু বহনকারী  যানের উদ্বোধন হবে৷ দশখানা গাঁয়ের মানুষ জড়ো হয়ে সে যেন এক জমকের উৎসব৷

বারান্দা থেকে দেখলাম –মোটা থলথলে রঙ্গা  ব্যাগ কাঁধে দৌড়চ্ছে৷ ভার  আজ  কম কি?  আসলে অনেক কটা  শাড়ি খসে খসে মেঝেতে উড়ে বেড়াচ্ছে৷ রঙ্গার ভারী ঝোলা বাচ্চা খেলানোর ফাঁপা বল হয়ে গিয়েছে৷

তিনঃ

গিয়েছিলাম তো সেদিন আমার কুসুমলতার কাছে৷ তবে তাঁর পছন্দের শাড়িটি নিয়ে যেতে পারিনি —সাদা খোলে সরু পাড় ছাপা শাড়ি৷ এ শতকের  দুর্দান্ত ও দামী বুটিকের মেলায় এমন সাধারণ সাতসস্তা শাড়ি খুঁজে পেলাম না৷ অবশ্য খুঁজেওছিলাম যাওয়ার মাত্তর দুদিন আগে৷ তাঁর উপহার আরো যত্ন করে সময় নিয়ে খুঁজতে হবে এমনটা হয়ত মনে আসেনি আমার৷ আমার কুসুম যে এমনই — সংসার কুসুমের সেবা লুটেপুটে খায়৷ কুসুম সেবা করে সুখী থাকেন৷ ক্ষুধায় ভুগেও পূর্ণ তৃপ্ত  সে মানবী৷

একটা ছেলে ছিল কুসুমের৷  মরে গেছে৷ কুসুম ভাসুরঝিদের ডাকেন –ও বড়মেয়ে –ও আমার  ছোটমেয়ে৷ বড়মেয়ে  বলে –আমার বাড়ি থাকুন জেঠিমা৷  তিনলাখ  খরচ করে  কুসুম মেয়ের বাড়ি সাজান৷  শেষ করে ফেলেন সব অর্থ৷ আহল্লাদে ফেটে পড়ে মেয়ে– ও জেঠিমা বাড়ি ভেঙে প্রমোটার  ফ্ল্যাট বানাবে যে এবার৷ মেঝে দেয়াল ঝকঝক করবে সব৷ আপনি কোথায় থাকবেন বলুন৷ জিনিসপত্তরসমেত নামিয়ে দিয়ে আসবক্ষণ৷ কোনো অসুবিধে হবে না৷

কুসুম নিঃশব্দে উঠে আসেন তাঁর স্বামীর গড়ে তোলা সেবাকেন্দ্রে ৷ নামিয়ে দিয়ে আত্মজন চলে যায় — কুসুম তখনো জিনিস নিয়ে চত্বরে বসে ৷ খানিক পরে সেবাকেন্দ্রে একটি কুটুরি মেলে ৷  তার খানিক পর থেকে ভালোবাসতে শুরু করেন কোটরের  চারপাশের মানুষদের ৷  বিশেষ করে সেবাকেন্দ্রের মুসলমান পরিবারের ছেলেগুলোকে নানারকম খাবার বানিয়ে খাওয়ান ৷ কাউকে কাউকে নিয়মিত ৷ তাদের ফেলে যাওয়া পাত নিজের হাতে পরিস্কার করেন ৷

এ পর্যন্ত শুনে আর থাকতে পারিনি৷ বললাম– হাঁটতে পারেন না ভালো করে৷ এত করেন কেন? উত্তর এল নিরুত্তরে– দ্যাখো আমার মানুষকে রেঁধে খাওয়াতে খুব ভালো লাগে৷ বিশেষ করে ওই যে রেহানকে দেখছ– ও আমার রান্না খুব তৃপ্তি করে খায়৷ তবে আমার কাছে পড়তে বসে৷ নাহলে নয়৷ বাহ রে! বেজাতের শিশুর থালা মাজার ভালো যুক্তি তো আপনার কুসুম!

কুসুম অবশ্য গর্ব ভরে বললেন– “আমি কিন্তু জাত মানি। ওদের ঘরে যে খাব না তা ওরা ভালো জানে৷”  জাত মানেন অথচ মুসলমান বধূদের সেলাই শেখান। সন্ধেবেলা বউয়ের রান্না খেয়ে মুসলমান বর নাক কুঁচকে বলে– “কুসুম মার থেকে রান্নাটা শিখে নিতে পারনি ৷” আপনি জাত মানেন অথচ  আপনার পাতানো মেয়ে  মৌসুমীদিকে কড়া  নির্দেশ দেন –রেহান আর তার বন্ধুদের জন্য চকলেট আনতে। ওহ! পাতানো শব্দে পাপ লেগে আছে। তাই তো কুসুম? মৌসুমীদি তো আপনার সত্য মেয়ে তাই না? মৌসুমীদি  আপনার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন দুজোড়া জুতো। আপনাকে পায়ে  নতুন জুতো পরাচ্ছিলেন –আপনি তখনো ভ্রূক্ষেপ না করে বলছিলেন –রেহানের চকলেট?

কী ভেবেছিলেন আপনার জাত মানার মিছে কথা বিশ্বাস করব৷ ভালোবাসাটা দেখব না ? চৌকাঠ দেখব অথচ টপকাতে পারব না৷ আমি পেরেছি কুসুম।আপনাকে আমরা সেদিন সবাই চিনতে পেরেছি৷

আমাদের সবার মনে আছে আপনার প্রতিটি কথা–সবার৷ আহা আমায় থামাবেন না৷ আমি তো আপনার মত নীরব মানব নই৷ জানেন না আমি সরব খচ্চর? তাই আপনার বলা দুটো লাইন বলবই আমি ৷ কোট আনকোট বলব –“জানিস রে  আমার হাঁটার কষ্ট তো বাড়ছে দিন দিন৷ এবার ঠিক করেছি  আমার মরা ছেলেটার জন্মদিনে বাচ্চাগুলোকে শুধু খিচুড়িই নাহয় বানিয়ে দেব। আর কাউকে বলব পরিবেশন করে দিতে। হ্যাঁ রে –তাতে হবে না? খুশি হবে তো রেহানরা?”

আর একটা কথা শুধু আমায় বলেছিলেন কুসুম৷ বা সবাইকে বললেও আমি আপনার শব্দগুলো অধিকার করে নিয়েছিলাম৷ জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে–আছছা এত বঞ্চনায় এত কম পয়সায় খুশি থাকেন আপনি! এমন কোনো বিষয় নেই যাতে আপনারও কান্না পায়?

—-” পায় ময়ূরী ৷ আমারও কান্না পায় ৷ শীতের ভোরে যেদিন বেশি কুয়াশা জমে–আমার জানলা দিয়ে শুকতারাটা আর দেখতে পাই না৷ মনে হয় সে আরো দূরে চলে যাচ্ছে–আজ আর ভোরের নক্ষত্র জ্বলল না৷ আমার তার সাথে গপ্প করা আজ হল না৷ তখন খুব কষ্ট হয় গো!”

আপনি হয়ত শোনেননি৷ বিদায়বেলায় আমাদের সেদিনকার যাত্রাপথের এক সাথী অতনু  বিড়বিড়িয়ে বলেছিলেন–এমন মানুষ৷  মনে হচ্ছে –আজ থেকে এমন মানুষকে সেবা করাটা আমার দায়িত্ব হয়ে গেল৷

— না না আমি ভুল করিনি কুসুম৷ কখনো মানিনি — অতনুর এ বাক্য নারীর প্রতি পুরুষের স্তুতি৷  বিশ্বাস করেছি–এ হল মহান মানবের প্রতি ক্ষণিকের অতিথির শ্রদ্ধা৷

ফেরার পথে গাড়ি থেকে দেখলাম–আস্তে নামা সন্ধের মাঝে গরুর পাল নিয়ে ফিরছেন এক মুসলমান বৃদ্ধ৷ আমার সেদিনের যাত্রার আরেক সাথী তরুণ গবেষক সুদীপ্তা গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন–আরে! এই কাকুটাকেই তো সকালবেলা দেখলাম৷

আপনি   আমার অর্জিত কুসুম৷
যাত্রার অভিজ্ঞতা সবাইকে দিলাম৷
আপনি থাকুন আমার হয়ে৷
আমার স্তনে৷
সবুজ ক্ষেতে মানব হাঁটে৷

চারঃ

উৎসুক হচ্ছি৷ বহুত  মজা লাগছে জানতে–গহীন শোকের ভাষাটা  ঠিক কীরকম?  কীরকম হওয়া সম্ভব? শোকের কতখানি জমাব হৃদয়ের অতলে আর কতখানিই  বা খরচা  করব  উন্মোচনে?

কান্না? কেবল কান্নাতেই কি বেদনার কথন? ঠাকুমা রাধারানি বলতেন– নিরন্তর শোকপ্রকাশে শোকের নিঝুমপনাটাই ছানা কেটে যায়৷ তেরটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন রাধারানী৷ বাবা কাকা পিসি মিলে বেঁচে রইলেন মাত্র চারজন৷ বাকি কটা  তাদের শিশুকালেই শেষ হল৷

তখন ঊনিশ কুড়ি বছর বয়স আমার৷ শোকতাপ শোনার  মতো পাকা  হয়ে গ্যাছি৷ এক উনিশ কুড়ি শুনত আরেক  উনিশ কুড়ির গল্প৷ ভরন্ত দুপুরে  মুখে  খানিক ফিকে হাসি  নিয়ে বুড়ি রাধারানি  শোনাতে বসতেন তাঁর খোয়া যাওয়া সন্তানদের মৃত্যুগাথা৷ এক একটা শিশুর চলে যাওয়ার এক এক রকম  গল্প৷ কাহিনিগুলো মরে যাওয়ার৷ তাতেও কত রকম গন্ধ  আস্বাদ যে দিতেন রাধারানী৷ বোধহয়  দিতে চাইতেনও৷ এ চাওয়া রাধার ইচ্ছেকৃত৷

বলতেন–“জানিস সেবার কী হল? তোর সেই পিসিটা কী করে মরলো? কতবার করে খবর করার পরও সময়ে পৌঁছতে পারলেন না ডাক্তার৷ ওষুধের অভাবে কোলে ঘুমুতে ঘুমুতেই চলে গেল আমার তিন বছরের মেয়েটা৷ আরেকটা তো   জন্মকালে নাড়ি ছেঁচতে গিয়েই গেল৷”

থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করতাম–“কেন? সেকী কেন?” নিরুত্তেজ উত্তর– এট্টুস ভুলে৷ হিক্কা  বেরোত আমার গলা দিয়ে–“কেন ভুল হল বলবে তো নাকি!”

জট চুল ফাঁপিয়ে খোঁপা করতে করতে খ্যাকর খ্যাকর হাসতেন আমার রানী ঠাকুমা–“আর কেন!  বাঁশের ছ্যাঁচারী  সরু করে নাড়ি কাটত তখন। ধাইয়ের চোখ যদি প্রখর না হত তো গেলাম৷ পেট থেকেই বাচ্চা মৃত্তিকার গভভে৷ তোর বাপ বাঁচল বাঁশ ছ্যাঁচারী ডলে আবার পরেরটা গেলও ঐভাবে! মাটি গিলল আমার মরা বাচ্চা৷

অনেক সময় গল্পের খোয়ারি ভেঙে মনেও করে উঠতে পারতেন না– আমার সেই না হওয়া কাকা পিসীদের  জম্মকালেই  পালাবার কারণ৷ যেন নিজের নয়, পড়শির গাছে পাখির ছানা মরার গপ্পো শোনাচ্ছেন রাধারানি৷ দানাপানি পেলো না তো শেষ হলো পাখির খোকা৷

বিরামহীন মৃত্যুর গল্প একদিন বেগবান করল আমায় স্পষ্ট কথা কইতে৷ বললাম– “ডাক্তার যখন এলোই না, মেয়েটা যখন তোমার  সেই গ্যালোই  –তখন সেই  চলে যাওয়ার গল্প ওমন খাঁটি  দুধের মতো ঘন করে তোমার লাভটা  কী? তোমার কথায় কান্না কেন ছড়ায় না গো রাধা? ”

আবার! আবার সেই অসহ্য “নেই কান্নার” গলা!  রাধা কহিলেন —” এতগুলো গ্যাছে– কান্না  আমার পুড়ে কয়লাকাঠ! জ্বলে খাক৷ মনের ভেতরে মাটির ঢ্যালা নড়ে  ! ”

—-” রাধা কী বলতে চেয়েছিলে তুমি সেদিন? ও রাধা বল না–মরার গল্প বলতে বলতে  কী ঘটত গ তোমার মনটায়? শস্যবিহীন মাঠ হয়ে যেত মনটা? তাই না রাধা?”

মরা যাদের  সর্ব অঙ্গে  তার   শোকে  বিলাসতেল আর ঢালি কেন?

ওরা মরেছে৷ আরো মরবে তারা– পূর্ণচাঁদে কিংবা ব্রহ্মদৈত্য রাতে!

ঘুমো বাপ! এই তো বুকে নিচ্ছি তো!

হুই দ্যাখ! আকাশের বাস ছুটছে তোর ভাইগুলোকে  নিয়ে!

ঘুম আয়! ঘুম আয়!

মাঝির চলা শেষ হয় না ৷

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here