কৃষ্ণা মালিক-র কবিতাগুচ্ছ

4
219
পরিচিতিঃ  কৃষ্ণা মালিক পূর্ব বর্ধমানের একটি ছোট্ট গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে দিয়ে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্য। এখন গদ্যে বাসা বেঁধেছেন। 

কৃ ষ্ণা   মা লি ক -র কবিতাগুচ্ছ

মা 

তোমার কাছে যেতে আমার পায়ে ছিলো না সহজ,
বরং সংকোচ ছিলো সহজ অভ্যাস

বড়-গুঁড়ি গাছের এডাল ওডাল ধরে বেড়ে উঠেছি
যৌথ সংসারের বেড়াল ছানাদের সঙ্গে। যতদূর মনে পড়ে, সংসারে তুমি সদ্য গ্রাম ভেঙে আসা
চির ভাড়াটে ।
উনুনের কমলা শিখায় ক্রমাগত তোমার সূর্য ওঠা-ডোবায় ক্লান্ত হতে হতে তোমার বুকের
ওম অস্ত গেল

আমার কুন্ঠিত আঙুল এখন ওই মলিন শয্যায় প্রলেপ রাখে ;
পুরনো অভ্যাসের খুঞ্চিপোষে ঢেকে গেছে
দু-হাতের ভেতর না-পাওয়া তোমার গায়ের মা-গন্ধ।

জলতল বাড়লে দ্বীপ কোনঠাসা

আকাশ বিষয়ে শিক্ষানবীশ আমার দুটি শাবক উড়াল দিচ্ছে বাসা থেকে ক্রমশ দূরে। বাসা ফেলে –

দূরের আকাশ ডেকে নেবে তাদের,

অনাগত শূন্যতার ভারে
কেঁপে ওঠে তার সপ্তক –
প্রবহমান নাড়ীতে পড়ে টান

 

অনন্তের থেকে বেশী দূরে নয়

 

সেই কবে ধুলোপথে পদছাপ এঁকে ফিরে গেছ বন্ধু!

কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ বিনে বড় ফাঁকা লাগে।

কতবার কচু পাতা থেকে জল টুপিয়ে পড়ল,
কতবার হিমে ভেজা শিউলি টুপটাপ ঝরে পড়ে
আমাদের বয়সের সংখ্যা গুনে গেল – কিন্তু দেখা হলো না আমাদের। তবে বুকের উত্তাপে আমরা কাছাকাছিই আছি।
শেষে পাহাড়ের ওপারে বন্ধুর কাছে যাবো বলে বেরিয়েছি।

বাঁকের মুখে এসে মনে হয় এ বাঁক শেষ হচ্ছে না। ওপারে পাহাড়টাও একই রকম দূরে।
তবু  অতিক্রম করতে থাকি। বুকের রন্ধ্রে জোনাকির মতো দিপদিপ্ করে বন্ধুর নাম।   যেন আশ্বাস দেয় , মনে হয়
পথের ওই বাঁক আর পাহাড়টাও
অন্তত অনন্তের থেকে বেশি দূরে নয়।


শব্দ

 

সন্ধ্যাকালীন এই বৃষ্টি যেন
আনমনা মা। সজনে ফুলের মতো আনমনে ঝরে পড়ছে। সমস্ত আবহ জুড়ে নীচু গ্রামে জল পড়ার শব্দ বুনে তুলছে উলকাঁটায় কোনো নিপুণ মেয়ে।

দু-গ্রাস খেয়ে ঘুমোতে যাবে সংসারগুলি,
হাওয়া শুধু ঘুরে ঘুরে জলের সজনে-শব্দের কাছে ফিরে আসে প্রাক-বসন্তে…
চিনচিনে ব্যথা নিয়ে মা ঘুমিয়ে যাবে – যে ব্যথার উৎস জানা নেই।

পাশ ফেরে মা।
পাশ ফেরে গ্রাম। টিকটিকি দেয়াল থেকে বলে – ঠিকঠিক!
তক্ষক ডাকে রাতের আনাচে কানাচে …

এইসব শব্দের ভেতর আজও প্রাণ জেগে থাকে

 

আমপান, ভেড়ার পাল ও অন্নদাস ভেড়া রাখেয়াল

 

পাল-ছেঁড়া নৌকো যেন দুর্যোগ
তীরে তীরবেগে আছাড় খেলো। –
পিঁপড়ে কেঁচো উচ্চিংড়ের মতো নীচেতলার প্রাণীরা ভিজেকাঁথা ঘুমচোখ,  – মানে মাটির নীচের আর কি,
তারা তো নড়বড়ে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসবেই!

আমরা যদিও সবাই মাটির পৃথিবীতেই থাকি, আর ওরা ওই নীচেকার -!

দুপুর থেকে সারারাত বৃষ্টি কেন যে রাগী সুন্দরবন – বনবিবির আহত বাহন? আর
সন্তান হারানোর ব্যথা খাওয়া হাওয়া…

আর একটা কথা, একটা উপকথার মতো।

শীতের সব ফসল গদিতে গদিতে,কাপড়ের খুঁটে বাঁধা হলে বিহারের গ্রাম থেকে ভেড়ার পাল ঢলে বাংলার ঘাস খেতে।
ঘরের টান, পেটের টানও… । তবু তারা তো ভেড়ার পাল,- একজনকে রাস্তায় নামিয়ে দিলেই ফতে!
তাছাড়া পালের গোদা যে মানুষটা তার অমোঘ শিস, অন্নশিস, মানতেই হবে!

 

সবাইই শিস-পরাজিত 

দুর্যোগের দুপুর ঢেলেছে নিরাশ্রয়  –

সারারাত সেই অবোলাদের কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাদের ছাদ।

আরও একটা কথা ভুলে যাচ্ছিলাম।

গাছের ছেঁড়াখোড়া পত্র-ছাউনির নীচে বসে একটি মানুষ। ফাঁকফোকড় দিয়ে সে
এলোপাথাড়ি বৃষ্টির চাকু-নিথর।
তবে তার বোল আছে বলে সে চিৎকার করে কাঁদতে পারে না।

কালো রাত ভেজে।
আরও দু’মাস দূরে খোঁয়ারে ফেরা; বিবর্ণবিষাদে হয়তো তখন মুছে নেবে বন্ধকী ভিজেশরীর -!

 

মৃতদের কবিতা
(দোজখনামা”র অনুসরণে)

 

এপাড়ে মাটির গভীরে ডুব দিলে ওপারে শুশুকের অবগাহন ভেঙে উঠি আমি, কারণ
মৃতদের একটাই দেশ।
উপরেই শুধু কাঁটা তারের ফাজলামি।

দিনের দেহ পুড়ছে, নুলো সব রাত।  হাতখসড়ার পাতায় পাতায় মরচে – আর জীবন খসে পড়ছে মোমবাতির ভেতর উত্তপ্ত হাওয়া দিলে।

টোটেমভোজের যে জয়পতাকা, আমি তাকে অহংকার দেখি – ওই দ্যাখো, কৃষ্ণগহ্বরের পেটে কালো আকাশে উড়ছে।

পতাকার নীচে গলিত শবদেহে বেতাল গল্প বলেঃ – পৃথিবী শুয়োরেরই খোঁয়ার;
যদিও সব সাদা-কালো-বাদামী-গরীব-ধনী-গৃহস্থ-বেশ্যা – সব কাঁটাতার বুকে নিয়ে পড়ে আছে।
আর শুয়োরের প্রসব বেদনা ছড়িয়ে যাচ্ছে, কাঁটাতারে আটকাচ্ছে না তাদের চিৎকার। – সব বেকার….

বিগতদেহ মৃতরাই জানে মাটির উপরও মৃতের শহর

পরমায়ু

 

এই চামড়ার নীচে মৃত্যু বুনে দিয়েছে শ্রাবণ-শস্য
অথচ সেসব রোমাঞ্চ-কদম ফুটে থাকে –
বেশ জোস আছে যাদের বর্ষায়।

চোখ হেনে তাদের সাইকেল অভিযান ভেজা রাস্তায় –
বর্ষাতি ভেদ করে তারা কদম ধারণ করে আশরীর, হয়তো সফলভাবে
জ্যোৎস্নাও নিয়েছে শরীরে, কিংবা
মেঘের ভেতর কয়েক-পা ছন্দ মিলিয়েছে

আমার চামড়ার নীচে চাঁদ জ্বালিয়েছে ঝিনিক ঝিনিক বিষাদ

কু-ইচ্ছা ছুঁড়ে দিই তোমার দিকে –  অসহ্য দীর্ঘায়ু পাও তুমি, চাঁদ!

 

মৃত্যুসখা

 

প্রকৃতি নিঃসঙ্গ ও স্বয়ংপ্রভ জেনেও তা সান্বনা হতে পারে নি কোনোদিন।
পৃথিবী পটিয়সী। তার আসঙ্গে বাতাসে ঝরে ঘাম – শিউলিও ভেজে, কিছুটা আঁধার সরে তাতে, তবু
সকল আশ্রয় হারানো প্রাণীকুল জানে মৃত্যুর থেকে বড় বন্ধু আর কেউ হতে পারে না
কত আয়লা আমফানের নটরাজ; উড়িয়ে দেয় চঞ্চুতে গড়া বাসা-আবাসের আকুলপরায়নতা, আমার পাখি-বাসা –
কখনও কান্নার রেশ রাখে বর্ষার শেষ রাত। এটাই অমোঘ নয় হয়তো; তাই মাঘে শীতল খড় দশনে কেটে তীক্ষতা বজায় রাখে মেঠো ইঁদুর।
কুসুম-কুসুম গরম ও ব্যথারঙা সকাল ফোটে ; সকাল তো ফুটবেই।
জ্বরের তাড়স সারাটা দিন। ধূসর চড়ুই ধুলিস্নানের আনন্দেও গায় গেরুয়া গান। মেঘলা মেঘলা ম্যাজিক তাস যতদূর চোখ যায়…উড়ছে – উড়ছে – অন্যদিকে চাঁদের মার্কিন থানে এরিগেড়িদের মৃত্যুসখা
প্রকৃতি নিঃসঙ্গ ও স্বয়ংপ্রভ বলে সে কখনও কখনও সান্ত্বনা হতে পারে

 

 কৃতজ্ঞতা

 

উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না তাকে অকৃতজ্ঞ বলা হয়।
কিন্তু আমি তো তোমাদের উপকার স্বীকার করেছি সবসময়!
নতুন কলোনির ন্যূব্জ ও রুগ্ন যে মহিলাটি – তার যেমন ক্ষুদ্রতম উপকারটুকুও স্বীকার করেছি, সে শিখিয়েছে করুণা, তেমনি সৌরমন্ডলের অগ্নিপুরুষটির উপকারও –
যেটুকু আগুন তোমার ভেতর না থাকলে তুমি টিকতেই পারবে না চরাচরে – সেই আগুন আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি।
তবে কিছু মানুষ তো থাকেই যে তোমাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে তোমায় নিঃশেষ করে দেবে। তোমার অন্তর্গত রক্তের বিপন্নতার খোঁজ সে রাখে না, তোমার ভেতর অযুত ফুল ফোটা ও ঝরার সৌন্দর্য সে দেখে না। শুধু দেখে তুমি কতটা মাংস ও মেদে চর্বিভাসা কাঁসার বাটিতে উপচে যেতে পারছো।
আমি এই মানুষের কাছেও কৃতজ্ঞ, কারণ আমি কেবল তার জন্যেই ঈশ্বরকে ডাকি, বলি – হে ঈশ্বর তুমি ওদের করুণা করো

 

ভয়

 

সন্ধ্যের পর
আমার মেয়ের খুব ভূতের ভয়।
আসলে তো ভূত নয়
কত অজানা আশঙ্কাকেই চেনায় ভূত বলে ;

ঘরের ভেতর আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকে সে –
তাকে আশ্বাস দিই আমি

কিন্তু জানেন তো, আমারও খুব ভয় –
যদি হারিয়ে ফেলি দেশ পরিচয়!

কানকো

 

বসেছিলাম তোমার মূল ছুঁয়ে বাতাসের সহজতায়, জেনে তো ছিলাম তুমি পুরোনো বটগাছটি
অথচ ছ্যাবলা জল চিরকাল, ভাব পালটে যায়, স্ব-এর – টানাটানি। মুদ্দোফরাস টান মেরে ছুঁড়ে দেয় ছেঁড়া কাপড়ের মতো গন্ধ ওঠা দেহ। আমাকে হাতফেরতায় হাট দিয়েছ ঘরে

তবু তোমার মূল ছুঁয়ে
কঠিন মুঠোয় নিয়েছি নাড়ি, মহা ধমনী

ঘরের ভেতর একলা হবার দিন মানে খুশনসিব। সেদিন রাংতার চটক-ফতুর গতর আর আলো খাবলানো আঁধার। দম যত ফুরোনো তত মস্তির ফুটানি এ পাড়ার বাতাসকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। খুপড়ির ফোকড় ছাড়িয়ে – বটের ছায়ায় জুঁইফুলী জ্যোৎস্না ফোটে , যেন জিনপরীদের ফিনকি মারা কাপড়…
যার তলায় একদিন ডুবে মরেছিলাম তোমার শেকড়বাকড়ে।
মাজাকি উড়িয়ে বালিশের পর বালিশ ডিঙোলে তুমি
তবু শরীর বাঁচন আমার, মলিন অন্তর্বাসের ভেতর টাঙিয়ে রেখেছি জুঁইফুলে কানকোর বিশ্বাস

লেখা পাঠাতে পারেন

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here