কবিতা সিং ঘোষ-র কবিতা গুচ্ছ

2
213
পরিচিতিঃ
কবিতা সিং ঘোষ পেশায় একজন চিকিৎসক। অরণ্যসুন্দরী ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা তিনি। অনিয়মিত কিছু শারদীয়া পত্রিকা ও টুকটাক লিটল ম্যাগাজিনেই তার লেখার হাতেখড়ি। লিখেছেন কান্ডারী পত্রিকা, প্রয়াস, শব্দ সাঁকো , অক্ষর সংলাপ , সাতকাহন , আবেগ ,আঁতুড়ঘর- প্রভৃতি পত্রিকায়।
যৌথ কবিতা সংকলন : “কবিতার চিলেকোঠা” (সাতকাহন প্রকাশনী) এবং “যৌথ কবিতা সংকলন ২”(কবিতা কুটির)।একক কাব্যগ্রন্থ “মন কেমনের মেঘ ” 2020 বইমেলাতে বার্তা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ।
গল্প, গদ্য, কবিতা সবক্ষেত্রেই তিন স্বচ্ছন্দ্য।বাইফোকালিজম্-র পাতা আজ তারই কিছু কবিতা নিয়ে সেজে উঠল।

ক্ষয়াটে চাঁদের পান্ডুলিপি

ক বি তা সিং ঘো ষ

সময়

মখমলের এই গদি , এই চার দেওয়াল , গোপন ইতিহাস জেনে রাখা এই আয়না , এই শার্শি বাঁধা জানলা ;
এই শারীরবৃত্তিক ঘেরাটোপ ছেড়ে চলো অনির্বাণ একবার খোলা আকাশের তলায় এসে দাঁড়ায়।

সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আমরা তেতোলা’ র জীবন সন্ধিক্ষণের প্রায় কাছে।
পায়ে পায়ে আমাদের একসাথে চলার সময়টাও কমে এসেছে।
হয়তো আর বছর খানেক কিংবা আর গুটি কয়েক মাস !
আর তারপর…! !
তারপর আলাদা তোমার হেঁটে এগিয়ে চলে যাবার জীবন।

একটা কথা দেবে অনির্বাণ ?
না ঠিক প্রতিশ্রুতি নয় ।
এই ফুরিয়ে যেতে থাকা বিকেল , এই আঙুল গোনাগুন্তি কিছু ভালোবাসা , চাঁদের ন্যায় ক্ষয় হতে থাকা আবেগ মুহূর্ত ;
না এসব ভেবে জীর্ণতায় বাস করতে চাই না।
শিয়রে সম্পর্কের মৃত্যুধ্বনির ঘন্টা স্মরণ করে আতঙ্কিতও হতে চাই না।
শুধু ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের নামে একটা মস্ত রামধনু চাই তোমার কাছে।

দেবে অনির্বাণ আমায় সাত রঙা সেই মস্ত রামধনু!!
বেনীআসহকলার মাধুর্য্য’এ ভরা একটা আস্ত পলাশের দুপুর ;
কিংবা অরণ্যসুন্দরীর সবুজ শীতল একখান বিকেল।

পূর্ণ করে দিয়ে যাবে কি আমার সমগ্র অস্তিত্ব রামধনুর রঙে !!
যবনিকার মুগ্ধ উপসংহারের বেশে।

সংসার

বড়ো বেশি ছুঁয়ে যাও তুমি …।
রোদ্দুর হয়ে তোমায় আগলে নিতে নিতে জেনে গেছি ভালোবাসা অনুভূতি কতোটা দামী।
নীল আকাশের মতো তোমার বিস্তীর্ণ রঙে মজে যেতে যেতে টের পেয়েছি তোমায় নিয়ে মনের রঙ কতোটা গাঢ়।
আমাদের একটা না হওয়া সংসার আছে।
আমাদের একট সম্পর্ক আছে।
হয়তো বছর কয়েকের ব্যবধানে আমাদের একটা ভাঙ্গা সম্পর্ক থাকবে।
সত্যি করে বলতো, বুকের গভীরে ভালোবাসার সিঞ্চন করে রাখলে ,সত্যিই কি সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙ্গে ! !
আমার বুকের পাঁজরের তলায় আমাদের একদিনের সংসার আজও মজুদ। আমাদের সম্পর্কটা সময়ের টানে হয়তো উথালপাতাল হবে।
কিন্তু জেনে রেখো আমার ভালোবাসা , আমার অনুভূতি , তোমায় ঘিরে থাকা আমার নিজস্ব সম্পূর্ণতার সংসার আমার স্তব্ধ হৃদস্পন্দনের সাথেই ভাঙবে…তার আগে নয়।
বড্ড মনটা নিগড়ে দিয়ে যাও তুমি ..।
কি দরকার বার বার মনে করিয়ে দেবার …
“আমাদের একটা না হওয়া সংসার ছিলো।”

বেসুরো তাল

তোমার চারপাশে বড্ড বেশি ভীড় অনির্বাণ।
আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।
এতো মানুষের ভীড়ে তুমিও কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছো।
আমিও কেমন যেন তাল কাটা ছন্দ হয়ে গেছি।
বেসুরো তালে তুমি চলো না।
ছন্দ জুড়তে গিয়ে আমিও কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছি।
তোমার আকাশ একতারার সুরে বেমানান।
আমার ফ্যাকাশে রোদ্দুর আর প্রয়োজন রাখে না।

এই বার বরং ফিরে যায় পরিযায়ীর ঠিকানায় ।
বড়ো ভীড় , বড়ো ভীড় তোমার উষ্ণ বাগিচায়।
ভালো থেকো অনির্বাণ।

বৃত্তের বাইরের মানুষ

তোমার ব্যক্তিগত পরিসরে আমার ঢোকার কোন অধিকার নেই।
বুঝে নেবার , জেনে নেবার কোন অধিকার নেই তোমার সব অনুভূতি।
আমি তোমায় হাওয়ার মতো ছুঁয়ে যেতে পারি ,
ফুলের সৌরভের মতো ক্ষণিক আচ্ছন্ন করতে পারি ,
প্রতিটা রোমকূপের সম্পূর্ণ পরিসর জুড়ে সাময়িক সুখ হতে পারি,
শুধু তোমার ব্যক্তিগত পরিধির প্রবেশপত্র পাইনি।
পারিনি হতে হৃদস্পন্দনের কোন অংশীদার;
আজও তাই তোমায় ঘিরে থাকা রেখা থেকে দূরে দাঁড় করিয়ে,
বার বার আমায় মনে করিয়ে দাও ,
আমি বৃত্তের বাইরের মানুষ।

বিষন্ন

নির্লিপ্ততার অহংকার তুমি বোঝো অনির্বাণ!
কখনও কাউকে ভালোবেসে নির্লিপ্ততা উপহার পেয়েছো ?
আমি পেয়েছি তোমায় ভালোবেসে।
তোমার নির্লিপ্ততার অহংকারে জর্জরিত হতে হতে,
নিজেকে দিশাহীন ডিঙির মতো ভাসিয়ে বেড়িয়েছি তোমার উদাসীন সমুদ্রের একূল ওকূল।
পিছুটান ছিড়তে চেয়ে বার বার ক্ষত বিক্ষত করেছি নিজেকে।
তবু কেন জানি না বার বার ফিরে আসি ,
সেই নির্লিপ্ত , উদাসীন দেশে।
হয়তো ভালোবাসি , হয়তো এটাই প্রাপ্তি তোমার দেওয়া এই শূন্যতাকে ঘিরে ।

কিংবা হয়তো বিষন্নতার গা বেয়ে লেখনীর আবেগে তোমায় ঘিরে আমার শেষ কাব্যের অজুহাতে ।

বেহায়া

মরণকালে অষ্টাদশীর সুখে হয়েছি নিমজ্জিত।
খই বাতাসা ছড়ানোর কালে ,
ছড়িয়ে দুরে ফেলেছি যতো নূজ্ব্য সময়।

ভালোবাসার আবেগে হার মানাতেও পারি তোমার প্রাক্তনকে ।

অতোটাই অনুভূতি পুষি বুকের মাটিতে,
শুধু তোমার জন্য ,
একখণ্ড সবুজ হৃদয়ের।

জটিল ধাঁধার মতো তুমি।
আমায় ঘিরে আবেগ উচ্ছ্বাস অনুভূতির ,
তোলপাড় হতে দেখিনি কখনও তোমার মনে।

বুঝিনি কখনও কতোখানি মূল্যদর আমার ,
তোমার ওজনদাঁড়িতে।

টের পায়নি কখনও আমার শরীরি ঘ্রাণের মাদকতা তোমার রোমকূপ জুড়ে।

কেবলই বুঝেছি তোমার নির্লিপ্ততা , জলের বুকে ঢেউহীন স্থির চিত্রের মধুময়তা।

তোমার প্রাক্তন এখানেই জিতে গেছে প্রিয় আমার থেকে।
যাকে তুমি ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে গেছো।

আর আমি যাকে নিঃস্ব হয় ভালোবেসেও ,
কোথাও সামান্যতম তরঙ্গ অনুভব করাতে পারিনি উচ্ছ্বাসহীন বুকে।

শেষকালে ভালোবাসতে বাসতে হেরে যাচ্ছি অনায়াসে ,

হয়তো এবার তোমার যাবার সময় হয়ে এলো বলে।

অস্তিত্ব

কালো আকাশের বুক হতে ,
সর্পিল গতিতে নীহারিকা নামিয়ে আনতে চেয়েছি।

জোরালো পায়ের আঘাতে ধূলো উড়িয়ে দেখতে চেয়েছি বায়ু তুমি কোন পথে ! !

শরীর থেকে সাদা খাতায় একেকটা অঙ্গ প্রতংগ নামিয়ে নামিয়ে কবিতা খুঁজি।

কবিতা খুঁজি নিজের বোকা অস্তিত্বের।

এ যাবৎ কলমের গাঁথা শুধু তোমাতেই নিমজ্জিত ;

চোখ নামিয়ে কোনদিন দেখা হয়নি নিজের বেআব্রু কবরের দিকে।

তোমার চাবুক কলম , বিদ্যুৎ শাণিত লেখনী স্পর্শ জয়জয়কার করে ওঠে।

আমি আঁধারে কবরের মাটি আঁকড়ে রাখা কীট এখনও মোহ জালের ব্যাধিতে ।

বোকা দের কবিতা হয় না।

বোকা দের বুকের নাম কোথাও লেখা
হয় না।

তোমাদের জন্য চিরঞ্জয়ী পুরুষ বোকাদের বুকে হাজারো গোলাপ ফোঁটে হাজার আলোকবর্ষ ধরে।

স্মরণ করে শেষঅবধি কবর খুঁড়ে কেউ একমুঠো শব্দধারণ করেনা আলোকে।

বোকা শব্দ তুমি কবরেই থাকো ।

কবিতা হতে ভাগ্য লাগে ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here