যে জন থাকে প্রানের মাঝে

0
159
পরিচিতিঃ সনৎকুমার বটব্যাল ও হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে ২০১৫ সাল থেকে সম্পাদনা করে চলেছেন একটি মননশীল  সাহিত্য পত্রিকা ‘পৃথ্বী’। থাকেন তমলুকে। জন্মসুত্রে পুর্বমেদিনীপুরের মানুষ। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে দীর্ঘকাল লেখালিখি করে আসছেন। ২১/১১ তেঘরিয়া, নন্দনকানন, কলিকাতা-৭০০১৫৭। বাইফোকালিজম্-এ আজ একটু অন্য স্বাদের লেখা।

স ন ৎ কু মা র  ব ট ব্যা লর জীবনীচর্চায়

যে জন থাকে প্রানের মাঝে

আজ আপনাদের কাছে ভারতবর্ষের একজন সঙ্গীত সাধকের কথা বোলবো। তাঁর তৈরী স্বর্গীয় সুরের মূর্ছনা, কণ্ঠের জাদুকরী, নিজস্ব ঘরানার গায়কী, তারপর ঋষিতুল্য জীবন বেদ।সবকিছু মিলিয়ে তপোবনে বসে ঈশ্বর উপাসনার মাঙ্গলিক উপাচার।আসুন আলাপ করিয়ে দিই আজকের সেই সুমহান শিল্পীর সাথে-

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়

ভূমি স্পর্শঃ– ৭ ই জুন,১৯২৩ সাল

লক্ষ্ণৌ, উত্তর প্রদেশ

ব্রিটিশ ভারত

যাত্রাঃ– ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সাল

কলকাতা, ভারত

বাবা– তারক চন্দ্র মুখোপাধ্যায়

স্ত্রী- উৎপলা সেন (সঙ্গীত শিল্পী)

একজন খ্যাতিমান ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী, মরমী সুরকার,গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তিনি আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সংগীত ও গজল শিল্পী হিসেবে সারা ভারতবর্ষে পরিচিত ছিলেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯২৩ সালে ভারতের লক্ষ্ণৌতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা তারকচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাবা চাকরিসূত্রে লক্ষ্ণৌতে ছিলেন। সতীনাথের জন্ম লক্ষ্ণৌতে হলেও ছোটবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। এখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা ও বিএ পর্যন্ত পড়াশোনা। এরপর এমএ পড়ার জন্য কলকাতা আসেন।

ছোটবেলা থেকেই সতীনাথ সংগীতানুরাগী ছিলেন ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা – ঠুংরী শেখেন। তাঁর ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন ও বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে কেউ পেশাদারি ছিলেন না। কলকাতায় এসে পড়া বাদ দিয়ে সতীনাথ চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করেন। কলকাতার অ্যাকাউটেন্ট জেনারেলে (এজি বেঙ্গল) এ চাকরি তে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে সতীনাথ সংগীত শিল্পী উৎপলা সেনকে সাথে বিয়ে করেন।

সতীনাথের বহু জনপ্রিয় গানসমূহের
মধ্যে অন্যতম কয়েকটি–

★আকাশ এত মেঘলা

★ জীবনে যদি দীপ

★ মরমীয়া তুমি

★ পাষানের বুকে

★ও আকাশ প্রদীপ

★ জানি একদিন

★ তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি

★ কত না হাজার ফুল

★হায় বরষা

★ এখনো আকাশ

★ বন্ধু হয় অনেকে

জীবনে এরকম ঘটনা একবার ঘটেছিল ।কার সুর বেশি ভালো, উৎপলা সেনের কাছে হাজির হলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্র
উৎপলা পড়লেন সমস্যায়। অগ্নিপরীক্ষা সিনেমায় অনেকগুলো অসামান্য গান ছিল। আমার মা সিনেমাটা দেখতে বসলে ‘জীবননদীর জোয়ার-ভাটায় কত ঢেউ এসে পড়ে’ গানটার জন্যে বসে থাকত। অদ্ভুত দৃশ্য না? মধ্যবিত্ত বাঙালিবাড়ির রান্নাঘরের কাজ ফেলে রেখে একজন ভদ্রমহিলা কয়েক মিনিটের ফুরসত নিত এই গানটায়। পরে আমিও থেকেছি কতদিন সতীনাথের এ-গানটার জন্য। মহান কলাকার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ। ২০২৩ এলে শতবর্ষ। একটা সময় জুড়ে এই সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, তরুন বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, অখিলবন্ধু ঘোষে-রা যে রাজত্ব করে গেলেন, হ্যাঁ রাজত্বই করলেন বাংলা গানে, ইদানীং কেমন যেন বিশ্বাস হয় না। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছবি মনে পড়লেই খালি মনে হয় একজন নিপাট ভদ্রলোক।ভাবা যায়, এই সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ই রেডিওর অডিশনে দশবার ফেল করেন। কারণ তাঁর গলা নাকি স্যুট করে না মাইক্রোফোনে। এগারোবারের বার পাশ করলেন। সেটা ১৯৪৮ সাল। তার অনেক আগে ১৯৪৩ সালে প্রথম রেকর্ড। তবে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় রেকর্ডের পর বোধহয় সিনারিও বদলে গেল, ‘পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ-জীবনে যেন আর কিছু ভালো লাগে না’ গান দুটোয়।
কীভাবে ইতিহাস হয় কতকিছু! ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে…’ এটা সতীনাথ সুর করেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্যর জন্যে। উৎপলা সেন বলেছিলেন এটা লতা মঙ্গেশকরকে দিতে। বাকিটা ইতিহাস…
উৎপলা সেনের কথা উঠলই যখন, একটা গানের উল্লেখ করি। নচিকেতা ঘোষের সুরে পবিত্র মিত্রের কথায়, ‘আকাশ ছেয়েছে ঐ কাজল মেঘে সে মেঘ ছড়ায় যে গো আমার মনে, তুমি তার কিছু কী গো জেনেছ!’ এ গানটা শেষ একমাস ঘুর ঘুর করছে। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে মহম্মদ রফি বলেছিলেন, আপনি বোম্বে চলে আসুন, এখানে কী করছেন! ভাগ্যিস সতীনাথ যাননি, সুধীন দাশগুপ্তকে গীতা দত্ত বোম্বে নিয়ে গেছিলেন, তাতে বোম্বের লাভ হয়নি, সুধীন দাশগুপ্তেরও নয়। যাঁরা বড়ো কণ্ঠশিল্পী এবং একই সঙ্গে বড়ো মাপের সুরকার, তাঁদের গলার তলায় সুরকীর্তিগুলো হারিয়ে যায়। যেমনটা প্রবলভাবেই হয়েছে শ্যামল মিত্রের সঙ্গে, মান্না দে-র সঙ্গে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্তকে দিয়ে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় দুটো আধুনিক গান গাওয়ালেন, ‘আর কত রহিব শুধু পথ চেয়ে’ আর ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই।’ প্রথম গানটা প্রচারিত হলেও, তেমন হয়নি শেষ গানটা।
সুর প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আছে, সেবার উৎপলা সেনের কাছে শ্যামল মিত্র আর সতীনাথ গেছেন কার সুর ভালো হয়েছে তদ্বির করতে। সে-বছর দুজনেই দুজনের জন্য সুর করেছেন, উৎপলা সেন শ্যামল মিত্রের সুরের প্রশংসা করে বললেন, তবে এবার সতীনাথের সুর হিট হবে। যার সুর হিট হবে সে কার্টন সিগারেট পাবে অন্যের থেকে। ১৯৫৭ সতীনাথ শ্যামলের সুরে গাইলেন, ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে’। শ্যামল সতীনাথের সুরে গাইলেন, ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর হাসি আর গানে ভরে তুলব’। সিগারেটটা সতীনাথই পেয়েছিলেন।

শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়

অলোকনাথ দে-র সুর রম্যগীতি গেয়েছিলেন, ‘অনেক তারা ফুটবে যখন আকাশ পারে কস্তুরি মন পাতাল আপন গন্ধে ভরে…’। কী অসম্ভব ভালো গান! ‘রাধিকা বিহনে কাঁদে রাধিকা রমণ’, পুরোদস্তুর রাগাশ্রয়ী বাংলা গান, অথচ কোথাও কোনো দেখানেপনা ছাড়াই এত অসামান্য পরিবেশন সতীনাথের মতো অতি বড়ো শিক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই মানায়। যখন দেখি দেড় বছর ক্লাসিক্যাল শিখে একটা গানে অবান্তর কাজকর্ম জুড়ে দেন শিল্পী, তখন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়দের মতো মানুষকে মঙ্গল গ্রহের মনে হয়। এঁদের আরেকটা গুণ ছিল, এঁরা সবাই সঞ্চারী তৈরিতে মাস্টার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন করে সঞ্চারী এনেছিলেন বাংলা গানে সেটাকেই এঁরা সতীনাথ, হেমন্ত, মান্না দে শ্যামল মিত্র সহ সবাই একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। এখানে সতীনাথের সে সব গানের উল্লেখ করলে দীর্ঘ তালিকা হবে, তার দরকার নেই।

এদিকে হিন্দি গানে কিন্তু সঞ্চারীর প্রয়োগ নেই৷ খুঁজে দেখলে কিছু পাওয়া যাবেই। এ-মূহূর্তে ও পি নাইয়ারের সুর মনে পড়ছে। আসলে একটা জাতের বাংলা আধুনিক গান একটা ব্যাকবোন বা শিরদাঁড়া। ভারতের অন্য কোনো আঞ্চলিক ভাষায় আধুনিক গানের এই রমরমা ছিল না। আর সেটাই এখন আমাদের কাছে গর্বের বিষয় আর দুঃখেরও বিষয়, দুটোই। আজ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের শুভ জন্মদিন। আসুন সবাই মিলে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম জানাই। আমরা তোমার নাম পাষাণের বুকে লিখিনি, হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছি। হে মহান শিল্পী যেখানে থাকো ভালো থাকুন।

সহযোগিতাঃ– হিমাদ্রি বর্মন
তথ্যসূত্রঃ– প্রহর
কৃতজ্ঞতাঃ-উইকিপিডিয়া

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here