অ জি তে শ   না গ-এর ছোটগল্প “প্রতিসরণ”

0
23
পরিচিতিঃ জন্ম উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে। লেখালেখির জীবন সাড়ে তিন দশকের। সিগনেট, মিত্র ও ঘোষ, প্রতিভাস, কবিতা আশ্রম, হাওয়াকল, ধানসিড়ি সহ বহু প্রকাশনী থেকে ৮টি উপন্যাস, ৫টি গল্পগ্রন্থ, ১টি প্রবন্ধের বই আর ১৪টি কবিতার বই এযাবৎ প্রকাশিত। পেয়েছেন সোপান সাহিত্য সম্মান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ন্যাশনাল ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড, রেওয়া সাহিত্য সম্মান সহ প্রচুর সম্মাননা।

অ জি তে শ   না গ-এর ছোটগল্প

 

প্রতিসরণ

স্নিগ্ধা ইলেকট্রিক কেটলিতে জল গরম করছিলো। ছেলেটার ক’দিন হল গলাটা খুশ খুশ করছে। গরম জলে নুন মিশিয়ে গার্গেল করিয়ে দিতে পারলে একটু আরাম পাবে। তাছাড়া নিজেরও মন একটু চা-চা করছে। একটু আদা কুঁচিয়ে আর একটা হাজমোলা ফেলে দিয়ে এক কাপ নিজের জন্য বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না। কাজল অবশ্য গাঁইগুঁই করে, ‘দিদি, আমি এত কাজ করছি, তোমার পছন্দের মৌরলা মাছের ঝোল আর রন্টিবাবার পাস্তা না খাস্তা কী বলে ঐসব বানিয়ে ফেলতে পারছি আর তোমার জন্য এক কাপ চা বানাতে পারবো না?’
স্নিগ্ধা জানে কাজলের দৃশ্যত দুটো হাত, কিন্তু আরও গোটা ছয়েক হাত নির্ঘাত আছে, নইলে সকাল ছটায় এসে আটটার মধ্যে স্নিগ্ধা আর রন্টির জলখাবার থেকে শুরু করে রন্টির স্কুলের টিফিন করে দেওয়া, ছেড়ে রাখা কাপড় জামা কেচে ছাদে মেলে দেওয়া, সব বাসনপত্র মেজে ঝকঝকে করে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে কম পক্ষে চার পাঁচ পদ রেঁধে দেওয়া, চারটে বড় বড় ঘর মোছা, আসবাবের ধুলো ঝেড়ে দেওয়া আবার এরই মধ্যে টুক করে কাঁচা সব্জির বাজার করে আনা, আরও কত কী – এসব কী আর শুধু দু হাতের কাজ! তার মধ্যে এক-দু কাপ চা করে দেওয়া তো নস্যি।
বিয়েতে পাওয়া জিনিসপত্র সব তো আর কাজে লাগে না মানুষের। বাড়তি জিনিসগুলো বক্স-খাটের ভেতরে গুপ্তধন সেজে বসেছিলো। একদিন সেই ডালা খুলে ইলেকট্রিক কেটলিটা আবিষ্কার করে স্নিগ্ধা। কে দিয়েছিলো কে জানে? খাসা জিনিসটা। গ্যাস জ্বালিয়ে চায়ের জল চড়িয়ে চা পাতা দিয়ে ছাকনি ছেঁকে চা বানানোর হ্যাঙ্গামা নেই। শুধু কেটলিতে জল ভরে প্লাগে লাগালেই মিনিটের মধ্যে জল টগবগ। এইবার কাপে ঢেলে একটা টি-ব্যাগ চুবিয়ে নিলেই হল। চিনি-দুধ ছাড়া চা খাওয়া স্নিগ্ধার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। অভ্যেসটা অবশ্য ধরিয়েছিল অরিজিত, বিয়ের পর থেকেই। সেই থেকে চলে আসছে। কাজলকে একদিন বানিয়ে দিয়েছিলো। এক চুমুক মুখে দিতেই ঠোঁট বেঁকে গিয়েছিলো কাজলের, ‘এ ম্যাঃ, চিনি দুধ বাদ দিয়ে চা! বিচ্ছিরি।’
এখন রন্টির সামার ভেকেশন। এই পুরো গরমকালটা কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব লাগে স্নিগ্ধার। রন্টির স্কুল নেই বলে সে দেরিতে ওঠে ঘুম থেকে। কাজলকে বলে দিয়েছে ছ’টার বদলে সাতটায় আসতে। রন্টিকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে কেটলিটা প্লাগে লাগিয়েছিলো স্নিগ্ধা। কেটলির মুখ দিয়ে ফুসফুস করে হাওয়া বেরোতে শুরু করতেই দরজার পাশের ফোনটা বেজে উঠলো। তার মানে সিকিউরিটির ছেলেটা ফোন করেছে। ‘আমি দেখছি’ বলে কাজল চলে গেলো আর রিসিভার রেখে ফিরে এলো চোখে-মুখে অপার বিস্ময় নিয়ে, ‘দিদি, একজন সাহেব গো। তোমার সাথে দেখা করতে চায়। কী বলব?’
টি-ব্যাগটা হাতেই ধরা রয়ে গেলো স্নিগ্ধার। সাহেব! সল্টলেকের প্রায় সব ব্লকই নির্জন, তার উপরে ব্লক-জিএফের এই অ্যাপার্টমেন্টটা তো আরও। এই অ্যাপার্টমেন্টে কম করে চল্লিশটা ফ্ল্যাট আছে, স্নিগ্ধারটা এগারো তলায়। চারদিকের পরিবেশ ভারি সুন্দর। বিশেষ করে ওয়েস্টসাইডের বারান্দাটায় দাঁড়ালে সবুজে সবুজ গাছপালা চোখে পড়ে, সন্ধ্যেবেলা পাখির ডাক ভেসে আসে। অরিজিত এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিলো বছর চারেক আগে। অবশ্য সেকেন্ড হ্যান্ড। কিন্তু স্নিগ্ধার পারিপাট্যে কে বোঝে এই ফ্ল্যাটে আগে কেউ থাকতো?

চিত্রঃ ২

স্নিগ্ধা অবাক হল এই কারণে যে প্রথমত এই দারুণ গরমে বিশেষ দরকার না পড়লে কেউ রাস্তায় বেরোয় না, দ্বিতীয়ত তার কাছে সাহেব আসবে কোত্থেকে? এমনিতেই এই ফ্ল্যাটে অতিথির আগমন হাতে গুণে। অরিজিত ছিলো ডাক্তার মানুষ। সারাদিনই চেম্বার আর পলিক্লিনিক করেই কেটে যেত। অরিজিতের বাবা-মায়ের দিকে কেউ বেঁচে নেই, কোনও ভাই নেই। এক বোন আছে, বিদেশে থাকে বটে, কিন্তু তার টিকির দেখা সে পায়নি এতগুলো বছরে। এই ফ্ল্যাটে আগে দুচারটে ডাক্তার বন্ধুবান্ধব ছিটকে ছুটকে আসতো, তবে তারা সবাই সল্টলেক, করুণাময়ীর বাসিন্দা। অরিজিতের এক পিসি থাকতেন গলফগ্রীনে। তিনি ন’মাসে ছ’মাসে আসতেন, এখন কার্যত পঙ্গু। স্নিগ্ধার বাপের বাড়ি মালদহে। যদিও বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। দুই ভাই আছে। তারা প্রতিবার পুজোর সময়ের আসে। একমাত্র ছোটকাকু থাকে ঝামাপুকুর লেনের একটা বাড়িতে। এই বাড়িতে থেকেই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছিলো স্নিগ্ধা। এ বাদে আর তো কেউ নেই। আর সে অথবা অরিজিত কারোরই কোনদিন অ্যাক্টিভ ফরেন-কানেকশন নেই। তবে?
স্নিগ্ধার বেডরুমের বারান্দা থেকে অ্যাপার্টমেন্টের মেইন গেটটা দেখা যায়। সে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঁকি দিলো। ঠিকই তো। এত উঁচু থেকে সেভাবে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছেন সে বুঝতে পারলো এবং তার পরনে কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট আর মাথায় হ্যাট। হাতে একটা কোটজাতীয় কিছু ঝুলিয়ে রেখেছেন সম্ভবত। কে হতে পারে? সে রিসিভার তুলে সিকিউরিটিকে ধরল, ‘সুকুমার, উনি আমার নাম বলেছেন?’
-‘হ্যাঁ ম্যাডাম। তবে ফ্ল্যাট নাম্বারটা বলতে পারছেন বলে আটকে রেখেছি। পাঠিয়ে দেবো?’
একটু চিন্তা করল স্নিগ্ধা। দিনকাল তো ভালো না। আজকাল কত রকমের ঠকবাজ বেরিয়েছে। অনলাইন নিউজপেপারে প্রায় রোজই একটা না একটা চালিয়াতের খবর বেরোচ্ছে। কে যে কোন ভেক ধরে ডাকাতি করতে চলে আসবে কে জানে? স্নিগ্ধা বলল, ‘তিওয়ারিজী কোথায়?’
-‘টয়লেটে গেছে ম্যাডাম।’
-ও এলে ওকে বসিয়ে তুমি নিয়ে চলে এসো ভদ্রলোককে।’

মিনিট পাঁচেক পর কলিং বেল বেজে ওঠে। সন্তর্পণে দরজা খোলে স্নিগ্ধা। টুপি হাতে সামনে যে মানুষটা হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে তাকে খুব চেনা চেনা লাগে স্নিগ্ধার। তবু সে জিজ্ঞেস করে ‘সরি?’
ভদ্রলোকের মুখের হাসি এবার দরাজ হয়, ‘ঠন্ডক?’
সারা পৃথিবীতে একজন মানুষ আছে যে এই নামে তাকে ডেকেছিল কোনও এক সময়। সে যেন কতকাল, সে যেন কোন মহাসমুদ্রের ওপার থেকে। স্নিগ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘অমিতাভ?’
সুকুমার ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। আর দরকার নেই বুঝে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা বলল, ‘এসো, ভেতরে এসো।’
ভদ্রলোক ভেতরে এসে ফিতে দেওয়া জুতো খুলে সোফায় এসে বসে বলল, ‘হ্যাভিং টি?’
স্নিগ্ধার চোখ মুখ থেকে তখনও বিস্ময়ের ভাব কাটছে না। সে থতমত খাওয়া গলায় বলল, ‘তুমি খাবে?’
-‘আই প্রেফার কফি, ইফ ইউ…’
কাজল এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। ‘কফি’ শব্দটা কানে যেতেই ‘আমি এনে দিচ্ছি’ বলে কিচেনে সেঁধিয়ে গেলো। ভদ্রলোক পায়ের উপরে পা তুলে বললেন, ‘চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ঠন্ডক। ফিনিশ ইট।’
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। অমিতাভ কলেজ জীবন থেকেই ফর্সা, বন্ধুবান্ধবেরা ‘শাদা পাটালি’ বলে যাকে খ্যাপাতো, এখন বিদেশ থেকে ফিরে আরও যেন রঙ ফেটে পড়ছে। গায়ে সামান্য মেদ জমেছে, তবে তেমন কিছু নয়। আগে চুল ছিলো কাঁধ অবধি, এখন ছেঁটে প্রায় কদমছাঁট, শৌখিন দাড়ি-গোঁফ ছিলো আগে, এখন সরু গোঁফের সাথে মানানসই ফ্রেঞ্চকাট। কথায় সামান্য টান পড়েছে এটাও লক্ষ্য করল স্নিগ্ধা। হাতের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে সে বলল, ‘আমিও কফি নিচ্ছি, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। অমিত, তুমি আমার খোঁজ পেলে কোত্থেকে? এতদিন ছিলে কোথায়? কবে এসেছ দেশে? বেড়াতে, নাকি কাজে….’
স্নিগ্ধার দিকে একটা হাত তুলে ভদ্রলোক বললেন, ‘সব বলছি বাবা কিন্তু একটা কন্ডিশন আছে। মে আই এক্সপেক্ট আ গ্লাস অফ ওয়াটার ফার্স্ট?’
-‘সরি, সরি। আমার উচিৎ ছিলো।’
স্নিগ্ধাকে উঠতে হল না। কাজল একটা ট্রেতে এনে সামনে রাখলো। ভদ্রলোক চোঁ চোঁ করে সবটা গলায় ঢেলে চারদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘স্প্লেন্ডিড রেসিডেন্স। সব নিশ্চয়ই তোমার চয়েস? আচ্ছা তোমার এই….’
মাঝপথে কথা থামিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘হু ইজ দ্যাট জেন্টলম্যান?’
রন্টি নিজের কামরা থেকে কখন বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর অবাক চোখে ভদ্রলোককে দেখছে খেয়াল করেনি স্নিগ্ধা। এইবার সে বলল, ‘আমার ছেলে। স্ট্যান্ডার্ড থ্রি।’
ভদ্রলোক হেসে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘কাম অন ম্যান, হ্যাভ আ হাগ।’
রন্টি দুবার ইতস্তত করে, একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে উঠে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রন্টিকে, তারপরে বসে পড়ে বললেন, ‘ওয়েট, আই হ্যাভ সাম্থিং ফর ইউ।’ বলেই কোটের জামার পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে ধরিয়ে দিলেন রন্টির হাতে। স্নিগ্ধা দেখলো এখানকার নয়, নাম লেখা আছে ‘মোজের রথ’। সে বলল, ‘তুমি জার্মানিতে আছো? আমি শুনেছিলাম কানাডা না কী সব।’
কাজল এসে দু মগ কফি রেখে গেলো। রন্টিকে ছেড়ে দিতে সে চকোলেট হাতে নাচতে নাচতে নিজের কামরায় চলে গেলো। ভদ্রলোক কফির মগটা হাতে তুলে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘এখনও আগের মত তুমি অনেক প্রশ্ন কর একসাথে। ‘ভার্সিটিতে যেমন করতে। প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে তুলতে। উফ।’
আরেক চুমুকে সবটা কফি শেষ করতেই স্নিগ্ধা বলল, ‘আর তুমি এখনও আগুন গরম চা খেয়ে ফেলো। অমিত, মনে আছে হরেদার চায়ের দোকান?’
এক পায়ের উপরে আরেক পা তুলে অমিতাভ বললেন, ‘হ্যাঁ। মনে আছে, শুধু মাঝখান থেকে দশটা বছর….’
-‘এগারো। বাদ দাও, যে প্রশ্নগুলো করলাম তার উত্তর দাও। ভালো কথা দুপুরে খেয়ে যেও কিন্তু।’
-‘নাহ, আজ থাক। এখানে আসতেই যা ঝামেলা হয়েছে। প্রথমে তো গেলাম তোমাদের সেই ঝামাপুকুর লেনের বাড়িটায়। ছোটকা দেখলাম আগের মতই আছেন। সেইরকম মজাদার, ঘরে একপাল ছেলেমেয়ে এখনও পড়তে এসেছে। আমাকে দেখেই বসালেন, দুটো কড়াপাকের সন্দেশ খাওয়ালেন, সেই আগের মত। ওনার কাছে থেকেই তোমার ঠিকানা জোগাড় করে একটা অ্যাপ-ক্যাব নিয়ে চলে এলাম। বাপরে! সল্টলেক এলাকাটা আগেও বুঝতাম না, এখন তো আরও মুশকিল। সব গলিই একরকম। ড্রাইভার তো কোথায় একটা নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে খুঁজতে খুঁজতে…।’
-‘এই গরমে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে তোমার?’
-‘তোমার ছেলেকে তো দেখলাম। হাজব্যান্ড? কী করেন তিনি?’
দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটা দেখিয়ে দিলো স্নিগ্ধা। সেইদিকে তাকিয়ে অমিতাভ বললেন, ‘ওহ, এক্সট্রিমলি সরি।’
-‘নো। ডোন্ট বি অমিত। অরিজিত ডাক্তার ছিলো। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ওয়ান ফাইন মর্নিংএ। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এতে তো আমার কোনও হাত নেই। তুমিই বা কেন…?’
-‘বাদ দাও। আমার কথা বলি। আমি স্টেটসএ গিয়েছিলাম পড়তে, সেটা তুমি জানতে। কোর্স কমপ্লিট করলাম। মন ভরল না। আরও হায়ার স্টাডিজ করতে সেখান থেকে জেনিভা। জেনিভা থাকতে থাকতে রিসার্চের ডাক আসে। হেইডেলবার্গ। এক মাসের লিভ নিয়ে ইন্ডিয়া এলাম। কিন্তু ততদিনে পাখি ফুড়ুৎ। বাদ দাও। আমি জিজ্ঞেস করবো না কেন আমার জন্য ওয়েট করলে না। বিকজ আই বিলিভ ইন ফিউচার, নট পাস্ট। হাউএভার, ফের উড়ে গেলাম জার্মানি। সেই থেকে সেখানেই আছি।’
-‘আগেও তাই ভাবতে। বিদেশে পড়তে যাবে বলে কত বই ঘাঁটাঘাঁটি, কত দৌড়োদৌড়ি।’
স্মিত হাসেন অমিতাভ।
-‘বিয়ে করেছ? বাচ্চা ক’টি?’
সামান্য অন্যমনস্ক হন অমিতাভ। প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনেন সিগারেটের একটা প্যাকেট। স্নিগ্ধা বলে, ‘সরি অমিত, ঘরে না।’
-‘মাই গড। দেন?’
-‘এসো। বারান্দায় বসি আমরা।’
ওয়েস্টসাইডের বারান্দায় মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে ওরা। স্নিগ্ধা বলে, ‘তোমার লাল সুতোর বিড়ি কী হল?’
বারান্দা কাঁপিয়ে একটা হাসি উপহার দিয়ে অমিতাভ হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা দেখিয়ে বলল, ‘এই যে পলমল। ওদেশের বিড়ি।’
-‘আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।’
-‘ওয়াইফ? হুম। সে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়।’
-‘আরে বাঃ। জানো, আমার ননদ থাকে শুনেছি ক্যালিফোর্নিয়ায়। যদিও তাকে কোনদিন চোখে দেখিনি। অরিজিত বলত।’
-‘গুড।’
-‘বেড়াতে গেছে? বাচ্চাদের নিয়ে? তাই তুমি ফুট কেটে ইন্ডিয়ায়?’
-‘ঠন্ডক, আমার ওয়াইফ চলে গেছে। আই মিন ফরএভার, পারহ্যাপস। অ্যান্ড নো ইসু। অন্য কথা বল।’
স্নিগ্ধা চুপ করে গেলো। অমিতাভ কিছুক্ষণ দূরের নারকেলগাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সো? তুমি আর তোমার চাইল্ড?’
-‘হুম। আর কী!’
-‘এইভাবে একা কাটিয়ে দেবে? এনি বয়ফ্রেন্ড?’
চোখ গোল গোল করে তাকালো স্নিগ্ধা, ‘অমিত, এটা তোমার জার্মানি নয়।’
-‘আরে, ওয়েট ওয়েট, মেরো না, আমি মজা করছিলাম। সিরিয়াসলি।’
বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। নীরবতা কাটিয়ে স্নিগ্ধা বলল, ‘তোমাকে মারবার অধিকারটাও আমার নেই অমিত। তুমি কি বাবা মা-র কাছে এসেছো?’
-‘উঠেছি প্রিন্সটনে। হুম। গিয়েছিলাম লেকটাউন। দেখা করে এসেছি।’
-‘কেমন আছেন মাসিমা, মেসোমশাই?’
-‘মা? ভালো আছেন। সুমিতাভ ভালো চাকরি করছে।’
-‘আর মেসোমশাই?’
চুপ করে থাকল অমিতাভ। স্নিগ্ধা বলল, ‘মাই গড, তোমার রাগ এখনও যায়নি অমিত? এত বছর পরেও কেউ রাগ পুষে রাখে?’
-‘চাইলে সব রাখা যায়। রাগ রাখা যায়, ঘৃণা রাখা যায়, প্রেম রাখা যায়।’
-‘আচ্ছা? তাই বুঝি? তাহলে আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে?’
-‘কেন? ভালোই তো আছো।’
-‘জানো, আমি সুইটজারল্যান্ডের স্নো-ফল দেখিনি, আমি মাচু-পিচু দেখিনি, আমি পিসার টিল্টেড মিনার দেখিনি, আমি নায়াগ্রা দেখিনি… কত কী দেখিনি। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে অমিত?’
-‘হাহাহা। তোমার হিউমার একমাত্র আমিই ধরতে পারি। এখনও। তাই না?’
প্রবল হাসিতে ফেটে পড়ে স্নিগ্ধা। হাসি থামলে চোখ মুছে বলে, ‘সত্যি, তুমি ঠিক সেই অমিত আছো। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে নির্ঘাত সত্যি বলে ভেবে নিতো।’
-‘ভার্সিটিতে এই করে কতবার কত ছেলেকে বোকা বানিয়েছ, এক্সেপ্ট মি। আই নো দিস ট্রিক্স । বাট ঠন্ডক, ইউ অলরেডি ট্রাভেল্ড থাউজেন্ড অ্যান্ড থাউজেন্ড মাইলস।’
বিস্মিত হয় স্নিগ্ধা, ‘হাউ?’
পেছন পকেট থেকে পার্স বের করে অমিতাভ। তার ভেতর থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে স্নিগ্ধার হাতে ধরিয়ে দেয়।
-‘মাই গড! তোমার কাছে? কেন?’
-‘ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে চাকরি করব, চাকরি করব বলে নেচে উঠেছিলে মনে আছে? ফর্মটা আমি ফিলাপ করে দিয়েছিলাম। রাইট? তোমার থেকে তিন কপি ফটো নিয়েছিলাম। দু কপি ইউসড। আর….’
অন্যমনস্ক হয়ে যায় স্নিগ্ধা। কাজল এসে খবর দেয়, ‘খাবার বাড়ব দিদি? রন্টিবাবাকে খাইয়ে দিয়েছি।’
অমিতাভ উঠে পড়ে। স্নিগ্ধা সচকিত হয়, ‘খেয়ে যাও।’
অমিতাভ সোফা থেকে নিজের কোট আর হ্যাটটা তুলে নেয়, ‘নো ম্যাডাম। আই হ্যাভ আ লট অফ প্ল্যানস। বাই দ্য ওয়ে, তুমি রেঁধেছ?’
-‘না, তা নয়, তবে কাজলের রান্না তোমার মুখে রুচবে।’
-‘নো ওয়ে। আরেকদিন এসে তোমার হাতের রান্না খাব। নিশ্চয়ই এখনও ওয়ারথলেস কুকিং কর।’
-‘মার খাবে অমিত। এবার সত্যি।’
-‘আমার ছবিটা।’
হাত বাড়ায় অমিতাভ। ছবিটা নিয়ে তরতর করে লিফটে উঠে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর তখনই স্নিগ্ধার মনে পড়ে গত দশ বছরে একবারও অমিতাভের মুখটা তার মনে পড়েনি।

অমিতাভ এলো। ঠিক তিনদিন পরে। সকালে। হাতে কম করে সাত-আটটা ব্যাগ। স্নিগ্ধা বিস্মিত হল, ‘এসব কী?’
-তোমার জন্য শাড়ি নয়। রন্টিসোনার জন্য সামান্য জিনিস।
রন্টি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। কত খেলনা, কত জামা, প্যান্ট, কালার পেন্সিল, একটা স্কেচবোর্ড, আরও কত জিনিস। স্নিগ্ধা বলল, ‘কী দরকার ছিলো এতকিছু কিনে আনার? বাদ দাও। তুমি ভালো করেছ সকালে এসে। আজ আমি ঢুকছি রান্নাঘরে।’
রন্টিকে দুহাতের বেষ্টনীতে জড়িয়ে অমিতাভ বলে, ‘মে গড সেভ আস।’
আজ আর রাগ করে না স্নিগ্ধা। হাসতে হাসতে কিচেনে ঢুকে যায়। মাঝে একবার টোস্ট, অমলেট আর কফি নিয়ে এসে দেখে দুজনে দিব্যি মেতে গেছে খেলায়।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে স্নিগ্ধা বলে, ‘আছো তো কিছু দিন?’
-‘নো। কাল চলে যাচ্ছি শান্তিনিকেতন। কত কাল পরে দোল উৎসব দেখবো। তোমরা যাবে আমার সাথে?’
খানিক চিন্তা করে স্নিগ্ধা বলে, ‘রন্টির স্কুল খুললেই এক্সাম। এখনও হোমওয়ার্ক হাফ কমপ্লিট করে উঠতে পারেনি। আচ্ছা, তুমি আছো তো ওখানে ক’দিন?’
-‘তা আছি। আপটু কামিং স্যাটারডে।’
-‘তারপর?’
-‘দেখি। হয় কোলকাতা ফিরে আসবো, নয়ত অন্য কোথাও। আদারওয়াইজ ফ্লাই টু হেইডেলবার্গ।’
-‘ওকে। তুমি যাও। আমরা পারলে কামিং ফ্রাইডে-তে আসছি। কথা দিতে পারছি না।’
রন্টি এসে দাঁড়িয়েছিলো পাশে, সে বলল, ‘তুমি আবার কবে আসবে আঙ্কল? কাল?’
হাহাহা করে সেই দিলখোলা হাসি হাসে অমিতাভ। বলে, ‘অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। তবে অন ওয়ান কণ্ডিশান।’
-‘হোয়াট?’
-‘এর মধ্যে আমাকে একটা ছবি এঁকে দিতে হবে। তোমার পছন্দের বেস্ট ছবিটা। অ্যাগ্রি?’
প্রবল আনন্দে মাথা দোলায় রন্টি।

পরদিন সকাল হতেই কলিং বেল। স্নিগ্ধা দেওয়ালঘড়িতে দেখে সাড়ে পাঁচটা। কাজল এত সকালে কেন? আই হোল দিয়ে তাকিয়ে হতবাক। অমিতাভ!
দরজা খুলতেই ভেতরে আসে অমিতাভ। স্নিগ্ধা বলে, ‘কী ব্যাপার? যাওনি বোলপুর? যাবে না?’
-‘নাহ। গেলাম না।’
-‘বাট হোয়াই?’
-‘জল খাওয়াবে?’
স্নিগ্ধা কিচেন থেকে গ্লাসে জল ভরে আনতেই প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে ঢকঢক করে সবটা জল খায় অমিতাভ। তারপরে সোজা ঢুকে যায় রন্টির ঘরে। পেছন পেছন হাঁটতে থাকে স্নিগ্ধা। হল কী? সে দেখে, ঘুমন্ত রন্টির কপালে একটা চুমু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো অমিতাভ। অমিতাভ’র কি ঠাণ্ডা লেগেছে? চোখ দুটো সামান্য লাল আর ছলছল করছে না? কপালে হাত দিয়ে একবার দেখবে? ভাবতে ভাবতেই অমিতাভ বলে, ‘আমি ফিরে যাচ্ছি।’
-‘কোথায়?’
-‘হেইডেলবার্গ।’
-‘মানেটা কী? রাতারাতি প্ল্যান পাল্টে গেলো? এখন টিকিট পাবে?’
খানিক কী ভাবে অমিতাভ। স্নিগ্ধার চোখের দিকে তাকায় গভীরভাবে। সামান্য কেঁপে ওঠে স্নিগ্ধা। রবীন্দ্রভারতী’র সেই সন্ধ্যেতে এমন করেই বকুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধার হাতদুটো চেপে ধরেছিল অমিতাভ। স্নিগ্ধা টের পেয়েছিলো অমিতাভর গায়ে জ্বর। এইভাবেই গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে অপলক তাকিয়েছিলো অমিতাভ, তারপর ধীরে ধীরে জ্বরতপ্ত ঠোঁট দুটো নামিয়ে এনেছিল আর পুড়তে পুড়তে খাক হয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধা।
অমিতাভ চোখ সরিয়ে নেয়। জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘টিকিট আমি কেটে নেবো।’
-‘কিন্তু আজকালকের টিকিট তো পাবে না, আই গেস। তখন?’
-‘জানিনা। দেখে নেবো।’
-‘আবার আসবে তো?’
-‘হয়ত। হয়ত কোনদিনই আর না।’
-‘অমিত!’
স্নিগ্ধার ডাকে পেছনে আর তাকায় না অমিতাভ। আজ আর লিফট নয়, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। হতবাক স্নিগ্ধা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দৌড়ে যায় ওয়েস্টসাইডের বারান্দায়। কিছুক্ষণ পরে দেখতে পায় অমিতাভ’র দীর্ঘ শরীরটা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে মেইন গেট পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
কতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো মনে নেই, হুঁশ ফিরতে ড্রয়িং রুমে এসে একটা জিনিসে স্নিগ্ধার চোখ আটকে যায়। ডাইনিং টেবিলের এক কোণে রাখা জিনিসটা। একটা ফটো। সাদা-কালো। এক যুগ আগের। সে ফটোতে একটি মেয়ের দুই বিনুনি, গলায় সরু চেন, মুখে স্মিত হাসি।

লেখা পাঠাতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here