গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(ষষ্ঠ পর্ব)”

0
71
পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান-র ষষ্ঠ পর্ব

 

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(ষষ্ঠ পর্ব)

 

“Floating straight obedient to the stream” Shakespeare
তেঁতুলতলার ঘাটে বসে আছে দুর্গা। ঘাট মানে তেমন কিছু নয়, নৌকা লাগে,  লোক নেয়, এপার ওপার করে, তাই লোকে ঘাট বলে। নইলে ঘাটের কোনো চিহ্ন নেই। কাদা আর কাদা। এক হাঁটু কাদায় লোক নামে, ওঠে, নৌকায় উঠে বালতি করে জল তুলে পা ধোয়। লোক নামা ওঠা করে, তাই সুরেন লস্করের বৌ একটা ভাঙা ছাতা টাঙিয়ে বসে থাকে। বিড়ি বাণ্ডেল কতক পড়ে থাকে সামনে পেতে রাখা চটের বস্তার উপর। পাতা মশলা কিনে একা একা বিড়ি বাঁধে, উনুনে মাটির তাবায় সেঁকে, রোজ নিয়ম করে সকাল বিকেল ঘাটে বসে থাকে। বুড়ি মানুষ, বাচ্চা কাচ্চা পিছনে লাগে। বুড়ি রেগে যায়, বাচ্চা কাচ্চা আরো লাগে। বড়রা বাচ্চাদের বকাবকি করে। কিন্ত সে আর কতক্ষণ!  বাচ্চারা সারাক্ষণ নদী বাঁধে দৌড়াদৌড়ি করে। ইচ্ছে হলেই বুড়ির পিছনে লাগে, গালাগাল খিস্তি শুনতে তাদের মজা লাগে।
  পাড়ার বুড়ো বুড়িরা বলে, অনেক বছর আগে সুরেন বৌ আর জোয়ান বাচ্চা নন্দীগ্রামে রেখে জমিদারের তসিলদার খগেন গিরির সংগে চলে এসেছিল বনশ্যামনগরে। সংগে এনেছিল তার রাঁড়। পরের বৌকে নিয়ে পালিয়ে আসা ছাড়া তখন আর এমনি এমনি এখানে কে আসবে? দেশে জমি জায়গা রেখে সদ্য জংগল কাটাই দ্বীপে এসে সুরেন উঠেছিল স্রেফ রাঁড় নিয়ে থাকার জন্য। এখানে এসে তারা কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মতোই ছিল। বরং সারাজীবন তাদের ভাব ভালোবাসার গভীরতা দেখে অন্যেরা হিংসা করেছে। সুরেনের রাঁড় কৌশল্যা বলে, ” ওই মানুষটাই আমাকে সব দিছে। আগের ভাতারটা আমাকে তো বেবুশ্যির মতো ব্যাভার করত। চ্যালা কাঠ লিয়া পিটতো, অলাওউঠার ব্যাটা। সুরেন আমাকে সব দিছে, সব।” লোকে বলে নির্লজ্জ বুড়ি, ভাতারের নাম ধরে। কৌশল্যা বলে ” আমার ভাতারের নাম আমি ধরবোনিতো,  কার নাম ধরবো? পরপুরুষের?  অমন ধম্মের মুখে আগুন দেই আমি, নিব্বংশ হ’ “
  বাঁধে বসে বসে দুর্গা দেখে ধীরেন মালোর ব্যাটা পুটা মাণ্ডাসে করে ভেসে ভেসে জোয়ারের জলে যেমন চলে গেছিল কামদেবপুর ছাড়িয়ে বাঁক ঘুরে আরো পূর্বে,  ঠিক ভাঁটার টানে আবার ফিরছে কামদেবপুরের দিক থেকে। বড্ড ধার দিয়ে যাচ্ছে বেচারা পুটা! কে জানে, ওর সংগে তো আর বেহুলা নেই যে, কোনো গাছের ডাল বেলেল্লাপনা করে পুটাকে আটকে রাখলে আবার স্রোতমুখী করে দেবে, ঠেলে দেবে গর্ভাশয়ে। একটা অদ্ভুত আবেশ আসে দুর্গার মধ্যে। একটা স্বপ্ন, না ঘুমিয়ে, জেগে জেগেই সে স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে পড়ে।
লখাইকে সাপে কেটেছে। কথায় আছে, সাপের লেখা আর বাঘের দেখা। সাপে কাটলে কে আর খণ্ডাবে তার মরণ! মরা লোকের সৎকার যেভাবে হয় সেভাবে করতে দিলেনা বেহুলা। চাঁদ সওদাগর বিপন্ন। মনসার কোপে হারিয়েছে ছয় ছয়টি ছেলে। তার সপ্ত ডিঙা মধুকর দরিয়ায় ডুবিয়ে দিয়েছে মনসার ক্রোধ। এদিকে সতী বেহুলা ছাড়ার পাত্র নয়। সে পণ করেছে এভাবে প্রাণপ্রিয় স্বামী লখাইকে প্রথম রাত্রেই সে হারাবে না। গোটা জীবন পড়ে আছে তার সামনে। কার ভালোবাসায় ফুলে ফলে সে পুষ্ট হবে! সে পণ করেছে সতী সাবিত্রীর মতো। স্বয়ং যমরাজ এলেও সে ছাড়বেনা তার স্বামীর মৃতদেহ। অগত্যা, কলা গাছের মাণ্ডাস অর্থাত ভেলা তৈরী করা হলো। সেই ভেলায় লখিন্দরকে নিয়ে উঠে বসলো বেহুলা। গাঙুড়ের জলে ভেলা ভেসে চল্ল। সে দেবলোকে গিয়ে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করে ফিরিয়ে আনবে প্রিয়তম লখিন্দর কে।
    বাপের মুখে দুর্গা শুনেছে, গাঙুড় নামে সত্যি নদী আছে সোঁদরবনে। বাপ সেখানে যাত্রাদল নিয়ে গেছিল। কত জায়গার গল্প করে যাত্রা করে ফিরে আসার পর। কত রকম জায়গা, কত রকম মানুষ, কত রকম তাদের আদব কায়দা! একটা গ্রাম আছে গাঙুড়ের ধারে। জংগল। ঘন বানি, গরান, গেঁওয়া, টরার জংগল। কত পাখি সেখানে। এখানেও আছে এসব। দুর্গা ভাবে আসলে গোটা সোঁদরবনই একটা গেরাম। কত রকম মানুষ! কিন্তু সবাই গরীব। সবার জগত বলতে একটা দুটো নদী, একটা দুটো জংগল। নৌকা ঘাট, ঘাটের কাছে একটা বুড়ি, ঘাটের খুব কাছ দিয়েই ভেসে যায় একটা মাণ্ডাস… আর ঘাটের উপর বসে আছে নেত্য। হ্যাঁ, স্বর্গের ধোপানি। বাপ বলে, ” তুই আমার মহামায়া, তুই লক্ষ্মী, তুই তো দেবকন্যা। ”  কিন্তু দুর্গা জানে মানুষ ঠাকুর হয়না। মানুষ আবার দেবতা হতে যাবে কেন? দেবতারা কি অত দুঃখ কষ্টে থাকে? অত অভাব তাদের থাকে? একবেলা না আনলে পরের বেলা উপোষ কি দেবতারা করে?  কিন্তু বাবা তবুও তাকে তাই বলে। দুর্গা জানে সে দেবী না হোক,  এই যে তার ঘাট, এই যে ভেলা ভেসে আসে কোন গেরাম থেকে, সে তো নেত্যর মতো তাদের স্বর্গের দুয়ার দেখাতে পারে? মানুষ হয়ে দেবতা হয় না, কিন্তু দেবলোকের ধোপানি হওয়া নিশ্চই যায়।
   একটা বাচ্চা মেয়ে পুটাকে তুলে আনে ভেলা থেকে। পুটা আর কই! ক’গাছা হাড় মাত্র। পুটার পাশে মাণ্ডাসে যে বসে ছিল এতক্ষণ  সে খুব বাচ্চা একটা মেয়ে। কপালে সদ্য সিঁদুরের ওপর নোনা জল ছিটিয়েছে। রক্তিম ধারা নেমে আসছে কপাল থেকে নাক বরাবর ঠোঁট থুতনি অব্দি। তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে হাত জোড় করে বলে ” মা, তুমি সাধারণ কেউ নও, তুমি তোমার সন্তানকে মারতে পারো আবার একটা চড় মেরে বাঁচিয়ে তুলতেও পারো। তুমি কে মা?” ” আমি নেত্য, এটা নেতা ধোপানীর ঘাট, আমি স্বর্গের ধোপানী। তোর এই পুটলিতে কী আছে? পুটার শরীরের হাড়গোড়?” দুর্গা পরম মমতায় বলে। ” আমি সব জানি, চল। তোকে নিয়ে যাবো স্বর্গে,  তুই নাচবি, গাইবি, মহাদেবকে তুষ্ট করবি। তোর স্বামী ফেরত পাবি তুই, চল মা।”
একটা প্রবল ঝাঁকুনিতে দুর্গার সম্বিৎ ফেরে। ছোট বোন যমুনা তাকে ডাকতে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে ডাকতে ডাকতে শেষে নদী বাঁধের উপর এসে কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকুনি দেয় সে। দুর্গা হঠাত স্বর্গ থেকে ধপাস করে পড়ে যায় তেঁতুলতলার ঘাটে। ” কী অত ভাবু ক’ত? মানুষ আইজ আছে,  কাল নেই। মাণ্ডাস দেখিয়া কষ্ট লাগছে তো? ধুর, চলতো। চল, বাবা আসসে। তোর জন্য কী ল্যাসসে দেখবু চল!”  এক নিশ্বাসে যমুনা বলে বটে, কিন্তু দুর্গার কানে সবটা যায় না। তবে ” বাবা আসসে” কথাটা তার কান এড়ায়নি। সে উঠে পড়ে। বাবা কাল বুড়াবুড়ির তটে যাত্রা করতে গেছিল, ফিরেছে। বাবার ফেরার খবর দুর্গাকে সর্বদা খুব খুশি করে। কেন, কে জানে! অথচ, বাবার ফেরা তো দৈনন্দিন ঘটনা। যমুনার জন্যেও দুর্গা  দাঁড়ায় না আর, দ্রুত পা চালায় ঘরের দিকে।
ক্রমশ…
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(পঞ্চম পর্ব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here