দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে জঙ্গলমহলের বাঘের কথা

1
330
সেই দিনের ইতিহাস

     দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে দেখা 
                     লালগড়ের বাঘ 


                  লেখা ও ছবি রাকেশ সিংহ দেব

জানুয়ারি ২০১৮ লালগড়ের জঙ্গলে গ্রামবাসীদের বাঘ দেখতে পাওয়ার খবর দিয়ে যে ঘটনার সূত্রপাত, ১৩ এপ্রিল ২০১৮ পশ্চিম মেদিনীপুরের বাঘঘরার জঙ্গলে চোয়ালে বল্লম বেঁধা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নিথর দেহ উদ্ধারের মধ্যে ঘটেছিল তার যবনিকা পতন। বেচারা পথভ্রষ্ট কুল গোত্রহীন বাঘটি খুন হয়ে গিয়ে প্রমাণ করেছিল ,এই জঙ্গলেই ছিল তার আস্তানা। দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে বাঘটিকে সশরীরে খুঁজে না পাওয়া এবং সবশেষে তাঁর এই মর্মান্তিক পরিণতি, আসারা দুনিয়ার সামনে পশ্চিমবঙ্গ বন্যপ্রাণ দপ্তরের ব্যর্থতা এবং অকর্মণ্যতার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন বলে মনে করছেন বন্যপ্রান সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা সহ সংশ্লিষ্ট সব মহল। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ভাষায় মুখরিত হয়ে উঠেছে সমাজ থেকে সোশ্যাল মিডিয়া। এই দুর্ভাগ্যজনক অপ্রত্যাশিত ঘটনায় শোকস্তব্ধ হয়েছে জঙ্গলমহলের হৃদয়। 
জঙ্গলমহলের বাঘ সংস্কৃতি বহু প্রাচীন। এখানকার লোককথায়, লোকক্রীড়ায়, লৌকিক দেবদেবীর ভাবনায়, গ্রামের নামের সাথে রয়েছে বাঘের প্রসঙ্গ। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মূলনিবাসীরা বাঘের সঙ্গে পরিচিত। সুন্দরবনের দক্ষিণরায়ের মতো জঙ্গলমহলেও রয়েছেন লৌকিক ব্যাঘ্রদেবতা ‘বাঘুত’। সুন্দরবনের দক্ষিণরায়ের মতো বাঘুতের কোনও প্রচলিত রূপ নেই। গ্রামের শেষে গাছতলায় গরাম থানে কিংবা শীতলা থানে মাটির হাতি-ঘোড়ার ছলনে বাঘুতের অধিষ্ঠান। গ্রাম দেবতার সঙ্গে ব্যাঘ্রদেবতার সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্য হল, গৃহস্থের গবাদি পশুগুলি যেন জঙ্গলে বা চারণভূমিতে গিয়ে অক্ষত থাকে। জঙ্গলে গিয়ে মানুষের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। শুধুমাত্র ঝাড়গ্রাম বা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাই নয়, পড়শি জেলা পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া সহ ছোটোনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ন এলাকার মূলনিবাসীদের গ্রামে গঞ্জে বাংলা কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত ‘বাঁদনা পরব’-এ গৃহস্থের গোয়াল ঘরে বাঘুতের পুজো হয়। মাঘ মাসের প্রথম দিনে গরাম থানে বাঘ-দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের প্রথা চলে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। তাই আজ মন ভালো নেই জঙ্গলমহলের। বিগত কয়েকমাস ধরে লালগড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া বাঘটির মর্মান্তিক পরিণতি বিচলিত এবং দুঃখিত করেছে সকলকে।  

৩০ জানুয়ারি, ২০১৮ : এদিন জঙ্গলমহলে প্রথম বাঘের কথা শোনা যায়। লালগড়ের মধুপুর এলাকায় জঙ্গলে চরতে যাওয়া কয়েকটি গরুকে এক অজানা প্রাণী আক্রমণ করে। রক্তাক্ত গরুগুলির গায়ে ও গলায় গভীর নখের আঁচড়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। এই ঘটনা থেকে গ্রামবাসীদের মধ্যে জঙ্গলে বাঘের উপস্থিতির কথা চাউর হয়। যদিও সেইসময় এলাকার মানুষজন এই ঘটনাকে নেকড়ে বা হায়েনার আক্রমণ বলে সন্দেহ করেন। 
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ : এরপর মধুপুর এর আশেপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন সময়ে এক অজানা প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়ার খবর আসে। বহু মানুষ এগুলিকে বাঘের পায়ের ছাপ বলে দাবী করে। সোস্যাল মিডিয়ায় এরপর বাঘের পায়ের ছাপের ছবি ও খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ এত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে এই ঘটনার পর লালগড়ের জঙ্গল লাগোয়া স্কুলগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ করে স্থানীয় মানুষজন। 

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ : পরিস্থিতি সামাল দিতে এবার মাঠে নামে বন দপ্তর। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে লালগড়ের কাছে মেলখেড়িয়ার জঙ্গল এবং মধুপুরের জঙ্গলে বিভিন্ন জায়গার মোট সাতটি ট্র্যাপ ক্যামেরা লাগানো হয়। এরমধ্যে জঙ্গলে থাকা হাতির পাল কয়েকটি ট্র্যাপ ক্যামেরা ভেঙে দিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে। 
২ মার্চ, ২০১৮ : অবশেষে লালগড়ের মেলখেড়িয়ার জঙ্গলে বন দপ্তরের পাতা ক্যামেরা ট্র্যাপে পাওয়া যায় এক পূর্ন বয়স্ক পুরুষ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ছবি। মেদিনীপুর বন বিভাগের ডি. এফ. ও. রবীন্দ্রনাথ সাহা সাংবাদিক সম্মেলন করে এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি জানান ছবিতে দেখতে পাওয়া প্রাণীটি যে একটি বাঘ এবিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয় ওড়িশার সিমলিপাল থেকে বাঘটি এখানে চলে আসতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাঘটিকে নিয়ে বাড়ে উৎসাহ। বাঘটির সনাক্তকরনের জন্য ট্র্যাপ ক্যামেরায় পাওয়া ছবি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ন্যাশানাল টাইগার কনজারভেশন অথারিটির কাছে। বন দপ্তর জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে মাইকিং করে এবং লিফলেট সাঁটিয়ে স্থানীয় মানুষদের জঙ্গলে যেতে নিষেধ করে। 

৩ মার্চ, ২০১৮ : বাঘ ধরবার জন্য সুন্দরবন থেকে আসে বিশেষ খাঁচা এবং বিশেষজ্ঞের টিম। জঙ্গলের মধ্যে যেখানে বাঘের ছবি পাওয়া গিয়েছিল তার আশেপাশে ছাগলের টোপ দিয়ে খাঁচা পাতা হয়। খাঁচায় বাঘ ধরা না পড়লেও মধুপুরের জঙ্গলে খাঁচার সামনে পাওয়া যায় বাঘের বিষ্ঠা। পরবর্তীকালে সেই বিষ্ঠা পরীক্ষা করে তাতে বন্য শুয়োরের লোমের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায় বাঘটি জঙ্গলে বন্য শুয়োর শিকার করে খাচ্ছে। তাই এবার ছাগলের পরিবর্তে টোপ হিসেবে খাঁচায় দেওয়া হয় শুয়োর। 
৫ মার্চ, ২০১৮ : ন্যাশানাল টাইগার কনজারভেশন অথারিটি (NTCA) লালগড়ের ট্র্যাপ ক্যামেরায় পাওয়া বাঘের ছবির চামড়ার দাগের প্যাটার্ন, অদূর অতীতে সিমলিপালে পাওয়া বাঘের ছবির সাথে তুলনা করে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্ট দেয়। লালগড়ের জঙ্গলে আগত বাঘটির সম্ভাব্য বাসস্থান হিসেবে সিমলিপালের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় উঠে এসেছিল ঝাড়খন্ডের পালামু এর নাম। বাঘটির লালগড়ের জঙ্গলে আসবার সম্ভাব্য তিনটি রুটের কথা উঠে এসেছিল বিশেষজ্ঞদের মতামতে। 
           • ওড়িশার সিমলিপাল থেকে গরু মহিষানি – দুমারিয়া হয়ে সুবর্নরেখা – কংসাবতী পেরিয়ে         
            ঝাড়গ্রামের জঙ্গল দিয়ে বাঘ ঢুকে থাকতে পারে লালগড়ে। 
           • ঝাড়খন্ডের পালামু থেকে পূর্ব সিংভূম – হাতিবাড়ি হয়ে লালগড়ে এসে থাকতে পারে বাঘ।                          
           • ঝাড়খন্ডের দলমা থেকে বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোড় হয়ে লালগড়ের জঙ্গলে এসে থাকতে 
            পারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।  
তবে যাই ঘটে থাকুক এব্যাপারে বন দপ্তর নিশ্চিত ছিল যে, এটাই ছিল সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাঘের অন্যত্র গমনের ঘটনা। 

৭মার্চ, ২০১৮ : মেদিনীপুর শহরের সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় জঙ্গলের বাঘ এবং জঙ্গল লাগোয়া এলাকার গ্রামবাসীদের সুরক্ষার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বন দপ্তরকে দ্রুত বাঘটি ধরতে ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালানোর এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। 
বাঘের দেখা মিলে মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে কনকাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের মুড়াকাটা–কুয়াবুড়ির জঙ্গলে। জঙ্গল–লাগোয়া গ্রামের মানুষজন মঙ্গলবার রাত ১০টা নাগাদ বাঘের গর্জন শুনতে পেয়ে বেরিয়ে এসে বাঘটিকে দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা খবর দেন বন দপ্তরে। ছুটে আসেন সুন্দরবন থেকে আসা বাঘ বিশেষজ্ঞরা। ততক্ষণে বাঘটি গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। সকালে কনকাবতী, মুড়াকাটা, কুয়াবুড়ি গ্রামের কাছের জঙ্গলে বাঘের পায়ের বেশ কয়েকটি ছাপ দেখতে পান বাসিন্দারা।

৮ মার্চ, ২০১৮ : বাঘ খুঁজতে বন দপ্তর এবার সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে আকাশে ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালায় পরডিহা, কামরাঙি, আমালিয়া, মধুপুর -এর জঙ্গলে। বাঘের দেখা পাওয়া যায়না।

৯ মার্চ, ২০১৮ : হুমগড় রেঞ্জের আওলিয়া গ্রামে পাওয়া যায় বাঘের পায়ের ছাপ। 
১৩ মার্চ, ২০১৮ : বাঘের উপর নজরদারী চালাতে গিয়ে বন দপ্তরের অত্যাধুনিক ঐরাবত গাড়ির ভেতর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বনকর্মী দামোদর মুর্ম্মু (৪৭) এবং ড্রাইভার অমল চক্রবর্তী (৪০)-কে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, বাঘের আতঙ্কে গাড়ির সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে গভীর রাতে ঘুমিয়েছিলেন দুজন। গাড়ির ভেতর চলতে থাকা ছোট জেনারেটারের বিষাক্ত ধোঁয়ায় গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় দমবন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। 
১৪ মার্চ, ২০১৮ : নারায়ণগড়ে পাওয়া যায় বাঘের পায়ের ছাপ। 
২৭ মার্চ, ২০১৮ : জঙ্গলমহলে ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায় শিকারের মরসুম। এলাকার আদিবাসী মানুষজন দলবেঁধে জঙ্গলে শিকার করতে যেতে শুরু করে। এদিকে জঙ্গলে রয়েছে বাঘ। এমতাবস্থায় মেদিনীপুর বন বিভাগের ADFO পূরবী মাহাত শিকারের ময়দানে এক বৃদ্ধ আদিবাসী দলপতির পা ধরে তাদের শিকারে না যেতে অনুরোধ করেন। এই ঘটনায় কিছু মানুষ এতে ফিরে গেলেও শিকার বন্ধ হয়নি জঙ্গলে। 

৩০ মার্চ, ২০১৮ : (Latitude : 22°31’54.31″ N    Longitude : 87°8’9.62″ E) বন দপ্তরের অসতর্কতায় নজরবন্দী বাঘটি পালিয়ে গেল মেদিনীপুরের চাঁদড়া রেঞ্জের বাঘঘরার জঙ্গল থেকে। বাঘটি গত দুদিন ধরে তার আত্মগোপনের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাঘঘরার শাল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়া কংসাবতী সেচ ক্যানেলের প্রায় তিন ফুট ব্যাস বিশিষ্ট একটি দুমুখ খোলা কংক্রিটের পাইপ। বন দপ্তরের লোকেরা খবর পেয়ে পাইপের দুইদিকে জাল পেতে ট্রাঙ্কুলাইজেশন ডার্ট ছোঁড়ার প্রস্তুতি নেন। এমন সময় পাইপের ভেতরে থাকা বাঘ সচকিত হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। গম্ভীর রক্তহিম করা হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জালের উপর। এই ঘটনায় দুই বন কর্মী ভয় পেয়ে জাল ছেড়ে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় ছোঁড়া ডার্ট! শক্ত ল্যাটেরাইট এর উপর নখের দাগ রেখে দ্রুতগতিতে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে যায় বাঘ। পাইপের ভেতর থেকে পাওয়া যায় বাঘের ইউরিনের ছাপ আর গায়ের লোম। বন দপ্তরের এই ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এলাকার মানুষজন। 
১৩ এপ্রিল, ২০১৮ : আশঙ্কাকে সত্যি করে শেষপর্যন্ত লালগড়ের অতিথি বাঘটিকে খুন হতে হল শিকারিদের হাতে। বাঘটির চোয়ালে যেভাবে বল্লম বিঁধে ছিল তাতে বাঘটিকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে বলে মনে হয়। মেদিনীপুরের চাঁদড়া বনাঞ্চলের বাঘঘরার জঙ্গলে বাঘটির বিগত আশ্রয়স্থল থেকে কয়েকশ মিটার দূরে উদ্ধার হয় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মৃতদেহ। বাঘের হামলায় জখম হয়ে মেদিনীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয় বাবলু হাঁসদা (৩৫) এবং বাদল হাঁসদা (১৯)। বাঘের মৃতদেহের কিছুদূরে এক ঝোপ থেকে উদ্ধার হয় এক আধ খাওয়া বন্য শুয়োরের মৃতদেহ। অনুমান শিকার হওয়ার আগে এটিই ছিল হতভাগ্য বাঘটির শেষ শিকার। 
বাঘের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘঘরার জঙ্গলে ভিড় জমে যায় মানুষের। মৃত বাঘকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য হুলুস্থুল পড়ে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। সবাই যাতে একবার চোখের দেখা দেখতে পায়, সেজন্য বাঘঘরার ফুটবল মাঠে লালগড়ের বাঘের দেহ রাখার দাবি জানায় উপস্থিত জনতা। এই নিয়ে পুলিশের সাথে রীতিমতো বাকবিতাণ্ডা বেঁধে যায় তাদের। যদিও তারপর অবশ্য তাদের দাবি মোতাবেক বাঘঘরার মাঠে রাখা হয় বাঘের দেহ। গাড়িতে শায়িত নিথর লালগড়ের বাঘকে দেখতে মাঠে উপছে পড়ে ভিড়। কেউ বাঘের গা ছুঁয়ে নিশ্চিত হয় মৃত্যু সম্পর্কে। কেউ কেউ প্রমাণ হিসেবে ছিঁড়ে নেয় বাঘের লোম। অনেককে আবার দেখা যায় বাঘের নিথর দেহের সাথে রীতিমতো পোজ দিয়ে সেলফি তুলতে। কেউ কেউ আবার মৃত বাঘকে প্রণামও করে।
বন দপ্তর বাঘটির মৃতদেহটি এনে আড়াবাড়িতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করে। ‘ন্যাশানাল টাইগার কনজারভেশন অথারিটি’ (NTCA)-এর গাইডলাইন মেনে মৃত বাঘটির দেহের পোস্ট মর্টেম করা হয়। বন কর্মী এবং আধিকারিকরা ছাড়াও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন WWF এর প্রতিনিধি, NTCA এর টাইগার হ্যাণ্ডলিং কমিটির প্রতিনিধি ও একজন নিরপেক্ষ পশু চিকিৎসক। প্রয়োজনীয় ভিসেরা নমুনা সংগ্রহের পর ওখানেই বাঘটির দেহ দাহ করা হয়। ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি’-র নিয়ম অনুযায়ী, কোনও জেলায় বাঘের মৃত্যু হলে, সেই জেলাতেই তার শেষকৃত্য করতে হয়। তবে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য বাঘের লিভার, হৃৎপিণ্ড-সহ বিভিন্ন অংশ কলকাতার ‘স্টেট ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি’তে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে সংরক্ষিত ভিসেরা পরীক্ষার জন্য হায়দরাবাদের ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’-তে পাঠানো হবে।
মেদিনীপুরের চাঁদড়া বনাঞ্চলের রেঞ্জার নিবেদিতা মাজি Section 9 of Wildlife Protection Act,1972 এবং Section 39 of Wildlife Protection Act,1972 এর ধারায় গুড়গুড়িপাল থানায় এফ. আই. আর. (FIR NO 109/CH 15 , DATE – 13/04/2018) করেন। এফ. আই. আর.-এ বাঘের হামলায় আহত বাবলু হাঁসদা (৩৫) এবং বাদল হাঁসদা (১৯) এর নাম উল্লেখ রয়েছে। 
১৪ এপ্রিল, ২০১৮ : বন দপ্তরের প্রকাশিত ময়না তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায় বিষক্রিয়া নয়, বল্লমের খোঁচায় মারা গেছে রয়্যাল বেঙ্গল। হতভাগ্য বাঘটির গলায় ছিল ধারালো অস্ত্রের আঘাত।  টাঙির মতো ধারালো অস্ত্রের গভীর আঘাত রয়েছে বাঁ-গাল এবং বাঁ-কাঁধে। এই মারাত্মক আঘাতের ফলে বাঘটির চোয়াল এবং খুলির একাংশ ভেঙে গিয়েছিল। মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার ফলে খুলি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তারপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় পথভোলা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটিকে।অস্ত্রের আঘাতে ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঁ-চোখ। বন দপ্তরের রিপোর্টে প্রকাশ, মৃত বাঘটির বয়স আনুমানিক ১০ থেকে ১২ বছর। পূর্নবয়স্ক এই পুরুষ বাঘটির ওজন ২২০ কেজি এবং লম্বায় ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। 
১৫ এপ্রিল, ২০১৮ : বাঘ হত্যার প্রতিবাদে ঝাড়গ্রামে একটি নাগরিক মিছিল হয়। জলপাইগুড়িতে প্রতীকী পথ অবরোধ এবং মিছিল করে বাঘ হত্যার প্রতিবাদ জানায় বন্যপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন SPOAR – Society for Protecting Ophiofauna and Animal Rights । প্রতিবাদ মিছিল সভা থেকে দাবী উঠে অবিলম্বে ঘটনার সাথে জড়িত দোষীদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহন এবং স্থানীয় বন আধিকারিকদের শাস্তিমূলক বদলি। 
১৮ এপ্রিল, ২০১৮ : বাঘঘরার জঙ্গলে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যু নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়ায় কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। কেন্দ্রীয় নারী ও সমাজকল্যান মন্ত্রী মানেকা গান্ধী বাঘের মৃত্যুতে রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। এই ব্যর্থতার জন্য তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কাঠগড়ায় তোলেন সেখানকার আদিবাসীদের প্রথাগত শিকারকে। মানেকা গান্ধীর এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর মন্ত্রীরা। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী জানান সঠিক না জেনে বাংলার সংস্কৃতি এবং আদিবাসীদের অসম্মান করবার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।  
২২ এপ্রিল, ২০১৮ : বাঘের মৃতদেহের অদূরে উদ্ধার হওয়া আধ খাওয়া বন্য শুয়োরের মৃতদেহটির ময়না তদন্ত করা হয়। রিপোর্টে শুয়োরটির দেহাংশে কোনও বিষক্রিয়ার উপস্থিতি মেলেনি। প্রয়োজনীয় ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। ভিসেরা পাঠানো হচ্ছে হায়দরাবাদের ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’-তে। 
২১ মে ,২০১৮ : বিষ নয়, আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে লালগড়ের বাঘের। পশ্চিমবঙ্গ ‘স্টেট ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’-র রিপোর্টের পর কয়েকদিন আগে হায়দরাবাদের ‘সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ থেকে যে রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে রাজ্য বন দপ্তরের হাতে, সেখানেও স্পষ্ট বলা হয়েছে ভিসেরাতে কোনও বিষক্রিয়া বা কোনওরকম জীবাণুঘটিত সংক্রমণ ছিল না। ফলে মাথায় এবং গলার আঘাতের ফলেই বাঘটির মৃত্যু হয়েছে।
 লালগড়ে রয়্যাল বেঙ্গলের মৃত্যুকে ঘিরে উঠতে শুরু করেছে এরকম বিবিধ প্রশ্ন৷ সবার জানা, বাঘটি একেবারেই অজ্ঞাতবাসে ছিলনা৷ মাঝে মধ্যেই সে বিভিন্ন জায়গায় তার উপস্থিতির জানান দিয়েছে৷ কখনও খাঁচায় বাঁধা ছাগলকে দেখে ফিরে গিয়েছে, কখনও আবার ক্যানালের পাইপে আশ্রয় নিয়ে প্রায় বন্দি হয়ে পড়েছিল৷ গত দেড়মাসে বাঘবন্দি অভিযানে আকাশে ড্রোন চক্কর কেটেছে, ঐরাবত গাড়ি করে সারারাত জাগতে গিয়ে দুই বনকর্মীর মৃত্যু হয়েছে৷ তবুও, তাকে জীবিত ধরা যায়নি৷ 
বন দপ্তর কেন ধরতে পারল না বাঘটিকে। তারা কেন পারলনা বাঘ-মানুষের এই সংঘর্ষ এড়াতে?  এই ঘটনার পর বনকর্মীদের একাংশ স্বীকার করেছে, যেহেতু এই এলাকার জঙ্গলে বাঘ আসে না, তাই তাদের তাড়ানো বা খাঁচাবন্দি করার প্রশিক্ষণ তাদের নেই৷  এই কারণে সুন্দরবন থেকে আনা হয়েছিল বাঘ বিশেষজ্ঞদের। পরিবেশবিদ এবং বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞগন স্থানীয় আদিবাসীদের এব্যাপারে কাঠগড়ায় তুলে জানান, এই শিকারের নামে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা পরিবেশ এবং সংরক্ষণের পক্ষে খুব ক্ষতিকর৷ বন দপ্তরের কর্মীরাও মনে করছেন, জঙ্গল শান্ত থাকলে বাঘটিকে বাঘঘরার জঙ্গলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হত না৷



                                   ★★★

Leave a Reply to RobertAburo Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here