সহজ মানুষ-সহজপাঠ

0
79
পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

লাউ কুমড়ো(এক)

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়


ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ঘরে বসে একমনে
পুতুল নিয়ে খেলছে। কোনো হুঁস নেই, ভাবনা নেই। নিজেরা নিজেদের নিয়েই মত্ত। যেই মা’কে
দেখল, অমনি পুতুল ফেলে দিয়ে ‘ মা মা ‘ বলে
মার কাছে দৌড়। কোলে ওঠার জন্যে বায়না।
যে বেশি চেচিয়ে কাঁদে, কোলে ওঠার জন্যে, মা
তাকে আগে কোলে নেন। বিরক্ত হলেও নেন।
ঠাকুর বলেছেন, আমাদের মত সংসারী, গৃহীদের-
“তোমরাও এখন সংসারে বসে পুতুল নিয়ে খেলছ। বাড়ি গাড়ি মান যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি কামনা বাসনা — এগুলো সব নানা রঙের খেলনা।
পুতুল।হাত- পা ওয়ালা রঙিন পোশাকের পুতুল।
ঈশ্বর এগুলো দিয়ে তোমাদের ভুলিয়ে রেখেছেন।
যত পার খেলে নাও। পরে যখন ত্যাগ আসবে মনে, বৈরাগ্য আসবে চেতনায়, জাগতিক ভোগ
আদি, যখন তোমার ” বোধের ” চৌকাঠ পাড় হবে
না, তখন তোমার” মন “নামক বস্তুটি ঈশ্বরাভিমুখী
হবে।
তবে কিছু মানুষের শেষদিন পর্যন্ত ওই পুতুল
খেলাই ভাললাগে। মন আর কিছুতেই ভোগ ছেড়ে
ত্যাগে যায় না। কেন জায় না? বাধাটা কোথায়?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সে প্রশ্নের উত্তরও নিজেই দিয়ে
গিয়েছেন। বলেছেন; ” ভোগের সামগ্রী হাতের
নাগালের মধ্যে পাওয়া খুবই সহজ।সোজা। কিন্তু
ঈশ্বরের নাগাল পাওয়া বেশ কঠিন। পয়সা ফেল্লেই যা চাও তাই পাবে।লোকে তোমার দুয়ার
পর্যন্ত এসে এগিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্ত ঈশ্বর তো
টাকা পয়সায় ভক্ত নন। “
আবার কিছু মানুষ ভাবেন, সত্যিসত্যিই তিনি
আছেন, না পুরো ব্যাপারটাই ভাঁওতাবাজি! কই
কে ঈশ্বর দেখেছে? চাক্ষুষ? আর যখন এটাই
পরিষ্কার নয়, তখন হাতের কাছে যা ভোগ্যবস্তু
পাচ্ছি সেটা ছাড়া ঠিক হবে না।
আর যা আমার অচেনা অজানা তার
পেছনে ছোটবার দরকারই বা কি? তার চেয়ে
ভোগের ” আনন্দ ” যা পাচ্ছ এগুলোকে সরিয়ে
সেই অজানা অচেনা ” আনন্দময়ী ” কে নিয়ে
ভাবতে বসা টা নিতান্তই বোকামি হয়ে যাবে।
সুতরাং, মনের মতো একটা রঙিন ধারনা
মনের মধ্যে রেখে স্ফূর্তিতে বাঁচো। কেউ তোমাকে
মারবে না। বকাবকি করবে না। জেল, জরিমানা,
ফাইন কিচ্ছু হবে না।
আবার কিছু কিছু মানুষ ঈশ্বরাভিমুখী
হন।কোনো একটা সূত্র থেকে তাঁরা একটা আলোর দিশা দ্যাখেন। একটা অনুভূতি। ঈশ্বরীয়
অনুভূতি। কারোর আপনা থেকে এটা আসে।
কারোর বা কোনো দৈবী সূত্র কাজ করে। কোনো
অনুঘটক এই দুই পথকে জুড়ে দেয়। এসব প্রারব্ধ
কর্ম থেকে হয়। শুভ সংস্কার থেকে হয়। ভালো
পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবার পরিজন তাদের মনকে ঈশ্বরের দিকে চালনা করে।
সেই মানুষটার তখন ঈশ্বর- ব্যাকুলতা আসে। ঈশ্বর প্রসঙ্গ ভাললাগে। দেবদেবীর মূর্তি ভালোলাগে। ধর্মস্থান ভাললাগে।
তীর্থ- পথে সে আনন্দ পায়। জীবের কল্যানে,
জীবের সেবায় আত্ম নিয়োগ করে।
সংসারের নিবিড় বাঁধন তার ভাললাগে না। জগত
সংসার তার আলুনি লাগে। নুন ছাড়া তরকারি যেন। বিস্বাদ। খেতে হয় তাই খাই।
ঠাকুর উপমা দিয়েছেনঃ মৌমাছির। বলেছেন
মৌমাছি ততক্ষনই গুঞ্জরণে মত্ত থাকে, যতক্ষণ
সে ফুলের ভেতরের মধুর আস্বাদ পায় না। আর একবার মধুর সন্ধান পেলে আর গুঞ্জরণ নেই। তখন
নিবিড় আস্বাদন।

পুকুরে কলসি নিয়ে জল ভরতে গেছে কেউ।
দেখবে যতক্ষণ কলসি পূর্ণ না হয়, ততক্ষণই
শব্দ। কলসি পূর্ণ হলে, কলসির ভেতরের জল
আর পুকুরের জল এক হয়ে গেলে আর কোনো
শব্দ নেই। তখন নিঃশব্দ…. নিরাকার…….

কী অসামান্য অসাধারণ সব উপমা ঠাকুরের।
কত গভীর পর্যবেক্ষণ! কত নিখুঁত দর্শন! কী
অপূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ এই মানুষটা কোনো
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন। বলেছেন – বেদ,
বেদান্ত, শাস্ত্র, পুথি পন্ডিতি আমি কিছু জানি না।
সব আমার “মা” জানেন। তিনিই আমায় সব বলে
দেন তলেতলে।
বিশ্বাস। বিশ্বাসে বিশ্বের সব হয়। শিশুর বিশ্বাস।
মা বলেছেন। মা কি ভুল বলতে পারেন কখনো?
শিশু বললে, “জানো মা, পাঠশালায় যেতে যে বনের
পথটা আছে ওই খানটায় একলা আমার খুব ভয়
করে। কাল থেকে তুমি যাবে আমার সংগে। নাহলে আমি আর পাঠশালে যাবনি। ” মা বললেন, ” বাছা, তোমার ‘ মধুসূদন ‘ দাদা আছেন
তো! ঐপথে ভয় পেলে তুমি তাঁকে ডাকবে। তিনি
এসে দেখবে তোমার হাত ধরে ভয়ের পথ পার করে দেবেন।

হলোও তাই। জংগলের পথে শিশুটি একা ভয়
পেয়ে গেল। মা বলেছেন, তাকি মিথ্যে হতে পারে?
“বিশ্বাস”। সরল মনের সাদাসিধা বিশ্বাস। “ও দাদা,
ও মধুসূদন দাদা, কোথায় তুমি? আমার যে ভয়
করছে খুব। এসো না, দাও না এই পথটা পার করে “। এলেন তিনি। শিশুর আন্তরিক আকুতিতে। তার আত্মার ডাকে। আর বিশ্বাসের
জোরে। না এলে যে জগত থেকে’বিশ্বাস’ কথাটাই
মিথ্যে হয়ে যাবে। এক রাখাল বালকের বেশে
এলেন স্বয়ং “রাখালরাজা”। গরু বাছুর তারানোর
লাঠি হাতে। ” এই তো আমি এসেছি। ভয় কী?”
হাত ধরে ভয়ের পথ, বনের পথ, জংগলের পথ
পার করে দিয়ে গেলেন।

তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ তোরাও যদি
শিশুর সরলতা নিয়ে, ব্যাকুলতা নিয়ে ডাকতে
পারিস তাহলে তোদেরও তিনি ‘ হাত ধরে’ জীবনের পথ পার করে দেবেন। তবে… এখানে
একটা ‘তবে’ আছে। সেটা কী? সেটা হলো
ব্যাকুলতা। সরলতা আর শিশুর মত শর্তহীন
বিশ্বাস। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন নররূপী নারায়ন।
মানুষের মাঝে, মানুষের ঘরে, মানুষ হয়ে, জন্মে
ছিলেন মানুষ নিয়ে লীলা করার জন্যে। বলেছেন
“মানুষ কী কম গা! ” অর্থাৎ মানুষই দেবতা।
তাই উদার হও। দয়ালু হও। মহৎ হও। মানুষের
সেবা কর। মানুষই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বলেছেন; ” সব ধর্ম যেমন সমান, তেমনই সব
মানুষও সমান। সব যেন এক একটি বালিশের
খোল। আমি তাই দেখি। ওপরে দেখতে নানা রঙের। কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি তো
কোনোটা কমলা রঙের। কিন্তু ভেতরে সব সেই
তুলো ভরা। মানুষও কেউ সুন্দর, কেউ কুৎসিত
কেউ সাধু, কেউ ধান্দাবাজ। কিন্তু সকলের মধ্যে
সেই এক ঈশ্বর। “

চ ল বে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here