কাকচক্ষু দর্শন – ভাষা ভাবনা[২]

0
156

কাকচক্ষু দর্শনঃভাষা ভাবনা[২]

কা মা রু জ্জা মা ন 

সম্প্রতি শংকরের ’স্বামীজির শেষ ছবি কোথায়?’ নামে একটা লেখা দেখলাম।
হ্যাঁ, দেশ-দুনিয়া যখন অন্যায় দহনে জ্বলছে, অবিচারে মানুষের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকের উপাধি পাওয়া পেটের দায়ে বাইরে কাজ করতে যাওয়া মানুষেরা শতশত কি হাজার মাইল পা’য়ে হেঁটে বাড়ি আসতে গিয়ে লাইনে কাটা পড়ে বা না খেতে পেয়ে বা ক্লান্তিতে বাড়িতে এসে ঢোকার আগেই অমানুষের মতো মারা যায়, তখন স্বামীজির শেষ ছবি খোঁজার এটাই মোক্ষম সময় বটে, এবং জরুরী তো বটেই। এইরকম জরুরী অবস্থায় ওইরকম জরুরী মানুষদেরই ডাক পড়ে, বা তারা নিজেরাই সেই মহা-কর্ত্তব্যের আহ্বান শুনতে পায়। তারা রামকৃষ্ণ (তিনি প্রায়-নিরক্ষর অতি সাধারণ মানুষ, তাঁর আন্তরিকতা ও সততায় কোনো খাদ ছিল না), বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখের অহিফেন বাণী শুনিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখে তাদের সর্ব্বাত্মক দুঃখকষ্ট থেকে – এটা নিছক বুদ্ধিবিলাসী অস্তিত্ববাদী সঙ্কট নয়, এটা তাদের প্রকৃতই অস্তিত্বের সঙ্কট, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার পার্থিব সঙ্কট। তাদের সঙ্কট মোচনে জরুরী মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না, খয়রাতির একটা বরকত চলে বটে। যুগ-যুগান্ত ধরে মানুষ তেমনই আছে।
ওইরকম জরুরী কাজের জরুরী কথকরা হোল তথাকথিত বরেণ্য বুদ্ধিজীবি, সুধীজন, সুধী সমাজের বাসিন্দা, বুদ্ধি বেচে খায়। তাদের বুদ্ধি সাধারণ মানুষের মাথায় মাথা গুঁজতে পারে না। সাধারণ মানুষ পরিচিত সমাজের উদ্বাস্তু মানুষ। তারা বোকা, তাদের ততধিক বোকা করেই রাখা হয়।
এইরকম দৃষ্টান্ত আরও অনেক আছে। সব বলতে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হোয়ে যাবে। কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। শুনলে অনেকের খারাপ লাগবে। প্রয়াত নবারুণ ভট্টাচার্য্যরে সঙ্গে আমার একটু আধটু আলাপ ছিল। তিনি ভালো মানুষ। একবার তাঁর পত্রিকার অফিসে গিয়ে তাঁকে বলি, শুনেছি আপনি দূরদর্শন চ্যানেলে কী সব আলোচনা করতে যান, কেন যান? তিনি বলেন, না এটার দরকার আছে। কী দরকার, তাতে ঘোড়ার কাঁচকলা কী হয় তা আর আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়নি। তাঁর মারা যাওয়ার পর তাঁর একটা সাক্ষাতকার শোনার সুযোগ হয়। তাঁকে সরাসরি সেখানে জিজ্ঞাসা করা হয়, চৌঁত্রিশ বছরের অরাজক বাম শাসনের পর কী হতে পারে? জবাবে তিনি বলেন. যারা শাসনে আসবে তাদের ওই চৌঁত্রিশ বছরের জঞ্জাল সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এই জবাব শোনার পর আমার আর কিছু শোনার ইচ্ছা থাকেনি। মনে হোল, আরে,এটা তো তাঁর মা’য়ের ভাবনারই প্রতিধ্বনি। সেখানে সেই নবারুণের ভাবনা কোথায় যিনি অসীম সাহসে লিখে গিয়েছেন ’এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। এটা কি অধঃপতন?
সমাজের জঞ্জাল সরানো যায় না। জমে জমে আস্তাকুঁড় হয়ে ওঠে। সেখানে খুঁড়ে দুঃখী মানুষরা দু’টো উচ্ছিষ্ট খুদকুঁড়ো ও পরিজ সসেজ খুঁজে খায়। সভ্য সমাজ বা সভ্যতা বলে আমরা যা জানি তা আসলে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে জঞ্জাল জমিয়ে যাওয়ার নিরাপদ আখড়া, ভাইরাসের বীজতলা।
আসলে এই সবকিছু ভাবনার অধঃপতন বললে কমই বলা হয়, এটা ক্ষমতার রাজনীতির রক্তচক্ষু দর্শন, মানুষকে নিজেদের কথায় দাবিয়ে রাখার দর্শন। দর্শন মানুষকে নীতিকথা শেখানের কথা বললেও তা অনেক ক্ষেত্রেই পরোক্ষে প্রতিষ্ঠানের রাজনীতির মুখরা হয়েই কাজ করে চলে।
এগুলো কি শুধুই কথার কথা? না, সমাজ-বাস্তবতা নিয়ে ভাষায় বা ভাষার আলাপন। কথা কথা বলে, না- কথাও বলে। সোজা কথাই বেশী বঙ্কিম।

দার্শনিক কার্ল পপার তাঁর একটা লেখায় বলেছেন, দুনিয়ায় কেউ নাই যাকে মহান ব্যক্তি (এইদেশে: মহাপুরুষ) বলে বড়াই করা যায়, মহান মানুষ বলে যারা পূজিত তারা কেউই মানুষ হিসাবে সম্পূর্ণ নয়। মহান মানুষ আবার কে, কী জিনিস? শুধু তোতাবুলি কপচে যাওয়া ছাড়া আর কী? কিন্তু কথায় মন ভিজলেও চিঁড়ে ভেজে কি, ঠাকুর। যা হয়েছে তা নিকোলাই বুখারিনের ভাষায় বলতে হয়: In a succession of thousand of years/ In years of poverty and disaster/ What existed was not a person/ But countless disfigured cripples. মহান মানুষদের মহান কীর্তিতে দেশ-দুনিয়ার মানুষ কঙ্কালের মতো হাড্ডিসার হোয়ে বেঁচে থাকে, তবুও মরে না, কুসুমের স্বাদ পায় না বলে আসলে তাদের কবরেও জায়গা হয় না । তারা বলতে গেলে মহান মানুষদের ভাবনার উদ্বাস্তু, উদ্বাস্তু নিয়ে তারা অনেক ভাবলেও, তারা উদ্বাস্তু থেকেই যায়।
এই দেশের যত্রতত্র ইন্দিরা গান্ধী সহ বহু ’মহান’ নেতা-নেত্রীর মূর্ত্তি ছড়িয়ে আছে, অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে আছে। কেউ বিশেষ কোনো মূর্ত্তি গড়েছে কি না জানি না, তবে বিকাশ ভট্টাচার্য্য ইন্দিরার প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এম এফ হুসেনও তাই করেছেন, কিন্তু তিনি তো ঘোড়া আঁকেন বলে জানি, (এবং আর কাউকে ন্যাঙটো করতে না পারলেও তিনি দেবী সরস্বতীকে ন্যাঙটো করে ছাড়েন), আমজাদ আলি খান তাঁর সরোদে ’প্রিয়দর্শিনী’ নামে রাগিনী সৃষ্টি করেছেন – এইসব মূর্ত্তি, ছবি ও রাগিনীর নিহিত ভাষা মোটেই বিমূর্ত নয়, বরং আরও বেশী মূর্ততায় সমসুরে মহানের অনুপ্রেরণার অন্তর্লীণ ভাষার অনৃত ভাষণ। কলকাতায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নামে পার্ক আছে বলে লক্ষ্য করেছি, খুব সম্প্রতি ’লৌহ মানব’ বলে পরিচিত সর্দ্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার উঁচু বিশাল মূর্ত্তি বসানো হয়েছে – এলিয়টের ভাষায়: Here the stone images/ Are raised, here they receive/ The supplication of a dead man’s hand/ Under the twinkle of a fading star. কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যার পর সারা বিশ্বে শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্বের (White Supremacy) বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে, অথচ গত চারশো বছর ধরে নিগ্রোদের উপর নিগ্রহ হত্যা হেনস্থা চলে আসছে। সেখানে চুরাশি হাজার নিগ্রোদাসের মহান মালিক এডওয়ার্ড কোলস্টনের মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানবতাবাদী দার্শনিক বলে পরিচিত মহান ডেভিড হিউমের জাতিবিদ্বেষী মনোভাব উদ্ঘাটিত হোয়ে পড়েছে (১৭৫৩ সালে লেখা ’অফ ন্যাশানাল ক্যরেক্টার’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন: I am apt to suspect the negros and all other species of men (for there are four or five different kinds) to be naturally inferior to the whites. Therte never was a civilized nation of any other complexion than white, nor any individual eminent either in action or speculation. No ingenious manufactures amongst them, no arts, no sciences…)। অবভাস দর্শনের (Phenomenology) অন্যতম প্রবক্তা মার্টিন হাইডেগার হিংস্র ফ্যাসিবাদের মধ্যে অন্তর্সত্য (inner truth) ও মহানতা খুঁজে পেয়েছেন এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নাক ঘষাঘষি করেছেন (যে-কারণে দার্শনিক হান্না আরেন্টের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে)। এইরকম মহান মানুষদের দৃষ্টান্ত অসংখ্য – এদের চরিতাবিধান অসংখ্য ভ্রষ্টাচার ও অনাচারে পচিত, শটিত। মানুষ তাদের কি মহান বলে সমীহ করে চলবে?
সমর সেনের মতো আর কে এমন নির্লোভ নিঃস্বার্থ নিরভিমান মানুষ আছে? তিনি মহান ছিলেন না, তিনি মানুষ ছিলেন।
এই প্রসঙ্গে কামুর ’দি প্লেগ’ উপন্যাসের ডাঃ রিউ-য়ের মন্তব্য স্মরণ করলে অপ্রাসঙ্গিক হয় না (যা কামুর নিজের দর্শন বলেই মনে হয়): …I feel more fellowship with the defeated. Heroism and sanctity don’t really appeal to me, I imagine. What interests me is – being a man. সার্ত্রে এই মত পোষণ করতেন না, এবং এই কারণেই কি কামুর সঙ্গে সার্ত্রের দার্শনিক বিচ্ছেদ ঘটেছিল?


মানুষ মহান কোনো জীব নয়, পথভ্রষ্ট উদ্ভ্রান্ত, তার ধর্ম্মে লেখা থাকে: হন্যদ্ হন্যেত বা পুনঃ – মরতে হবে, না হয় মারতে হবে। মহান মানুষেরা মানুষের জন্য যা ভালো করেছে বলে দাবী করা হয় তা মন্দের থেকেও খারাপ। তার চেয়ে বরং তেলা মাথায় তেল বুলিয়ে যাওয়া অনেক মহান কাজ। এবং সেটাই তারা করে। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে তারা কখনই বলে না, মানুষের কাজ মানুষের নিজের হাতে করার অধিকার থাকবে – কেউ তার হোয়ে ভাববে না, মানুষের নিজের ভাবনা নিজেই ভেবে নেওয়ার অধিকার তার আছে, সেই ক্ষমতা থেকে কেন সে বঞ্চিত থাকবে?
বলা হয় যে পার্থিব ও অপার্থিব বিস্ময় থেকে পার্থিব দর্শনের উদ্ভব। তা নয়, আসলে সামাজিক অসমতার গর্ভনিষিক্ত নৈতিক সঙ্কট থেকেই দর্শনের বিকাশ ও প্রসার। গ্রিক দর্শনের উদ্ভবের যুগে অন্ততঃ দর্শন চর্চ্চা তেমনই ছিল – মানুষের নৈতিক সঙ্কটের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাওয়া লড়াই, শিল্পোত্তর যুগ থেকে অদ্যাবধি দর্শনের ধারা কিন্তু অন্যখাতে বইতে শুরু করেছে। দর্শন এখন আর মানুষের লড়াই নয়, মুষ্টিমেয় মানুষের ভাষাবিলাস, শুধু কথার উপর কথার নির্বিরত তরজা যা বলতে গেলে ভাষার উপর তাদের অকথ্য নির্যাতন। ভাষার দুর্বোধ্য বিমূর্তায়নের কারণে দর্শনে সাধারণ মানুষ সামিল হতে পারে না, দার্শনিকদের উক্ত ভাষা ও ভাবনা মানুষের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। মানুষ বলতেই পারে, পাগল মা কি তোর একার?
ভাষা ও ভাবনার বিমূর্তায়ন ঘটে যাওয়ার মধ্যে ভাষার মানুষের হাতছাড়া ও কাছছাড়া হয়ে পড়ার নিবিড় যোগসূত্র রয়েই যায়। মানুষ এখন ভাষাবন্ধ।
’কৃষ্ণ বলো সঙ্গে চলো’ বলে দেশ না কি দুদ্দার এগিয়ে চলেছে, আর মানুষ খুঁজে চলেছে তার বন্ধ হয়ে যাওয়া কথা বলার বন্দর যেখানে তার অপহৃত অধিকার ফিরে পেতে চাওয়াটা ন্যায্য দাবি যা দিয়ে অন্ততঃ কিছু সে নিজে কিছু বলতে পারে। হারিয়ে যাওয়া ভাষার লড়াইয়ে সে পরাস্ত, এখন সে শেখানো ভাষায় কথা বলে, ভাবে না। সে বলতে পারে না, বলিতে স্বরূপ কথা ছাড়ি না পিতায়। কথা বলে কিছু না হলেও অন্ততঃ অনেক কিছু হয়।
স্বামীজির শেষ ছবিটা কোথায় আছে বা ছিল তা জানাটা কতটা জরুরী তা নিয়ে তর্ক করার কী আছে? বিতর্কটা তো লুকিয়ে আছে ওই প্রতর্কের মধ্যেই যার কারণেই প্রকরান্তরে মানুষ নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলেছে (ভাষা এখন গুরুমুখী) যা ফিরে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরী যাতে অন্ততঃ মানুষ দাবী করতে পারে: আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, জীবসেবা বা ঈশ্বর সেবা করে নয়, আমরা নিজেরা নিজেদের সেবা করে বাঁচতে চাই। কিন্তু অনেক দহনে দহিত হয়েও সে আর বলে না: সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক! কারণ সাম্রাজ্য নিপাতে যায়নি, মানুষই বরং নিপাতে গিয়েছে। চিনের চেয়ারম্যান কি আর আমাদের চেয়ারম্যান হয়? এইভাবে ক্রান্তিকারী ভাষা অচল হয়ে পড়ে নতুন নামশব্দের অভিবাসনে। পপুলিস্ট রাজনীতির টেকনোক্র্যসির যুগ এখন। না চাইলেও হাতের মুঠোয় এসে যায় বিনে পয়সার চাল, মাথাটা শুধু বেচে দিতে হয় – এই যা। ভাষাটাও।
সহজ কথা আর সহজে বলা যায় না। ভাষা তার মুখ পাল্টিয়েছে, সহজ করে বলতে গেলেই জলের মতো মুখ ফস্কিয়ে গলে যায়, তাকে ধরা যায় না।
এখন সহজ কথাটা সহজ করে বলার সময়, এমন অঘোষিত জরুরী অবস্থায় আজ সেটা আগের থেকেও অনেক বেশী জরুরী হয়ে উঠেছে। এই কথা বলাটা কতটা যে জরুরী তা ফুটে উঠেছে অ-ইহুদি মার্টিন নিয়েমোলার (১৮৯২-১৯৮৪) লিখিত একটা কবিতায় যাঁকে সাত বছর নাৎসি কনস্ট্রেসন ক্যাম্পে কাটাতে হয়েছিল: Then they came for me – and there was no one left to speak for me. সহজ কথা কী ভয়ঙ্কর সুন্দর!

ধান ভানতে শিবের গীত? কিন্তু সংলাপের আগে কিছু না কিছু আলাপ ঝালা তো লাগেই।
মনে রাখতে হবে সঙ্গীত ভাষা-ই, ভাষাও সঙ্গীত। কথার ঝালাপালা মানুষকে বলতেও হবে, শুনতেও হবে। অন্যমত থাকাটা সাধুতার লক্ষণ: যস্য মতং ন ভিন্ন ন অসৌ মুনিঃ – যার মত অন্যের থেকে আলাদা নয়, সে মুনি নয়। রাজনীতি না বুঝলেও রাজনীতির রাজনীতিটা বোঝা অত্যন্ত দরকার।
কিছু বলতে গেলে কথায় কথার সূতো বুনতে হয়, সূতো পাক খেতে খেতে একটা ঘুড়ি হোয়ে ওঠে, ঘুড়িটা মানুষের মুক্তকচ্ছ মন হোয়ে তার যা বলার কথা তা শুনিয়ে বেড়ায়। যা আসলে খুব বেশী করে বলা দরকার, তা খুব বেশী বলা হয় না, না জেনে বা জেনেও ইচ্ছে করে কিছু বলা হয় না, এবং যা বলার তা বলতেও সাহস হয় না। কিন্তু বলতে গেলে এইভাবে সূতো পাকিয়েই বলতে হয়, তাতে অপ্রকাশ্য অনেক কিছু ক্রমশঃ প্রকাশ্য হোয়ে ওঠে কারণ অপ্রকাশ্যে গুপ্তহত্যা হয়ে চলে, ঠেকাবেটা কে?। ভাবনার অলিন্দ আলোকিত করে তুলতে না চাইলে বলার দরকারই বা কী, তার চেয়ে বরং বোবা হোয়ে থাকা অনেক ভালো। বোবাযুদ্ধেও অনেক ক্ষেত্রে খুব সহজ যুদ্ধজয হয়, অনেক ক্ষেত্রে জনযুদ্ধের সহযোদ্ধাও হয়। হিতে যদি বিপরীত হোতে পারে, তবে অহিতেও বিপরীত হবে না কেন? সবই ভাষার মাহাত্ম বা কারচুপি। কারচুপি ধরতে ভাষাকে বুদ্ধত্বের জ্ঞানে আয়ত্ত করতে হয়।
পাঠকের স্বভাবতঃই মনে হোতে পারে ভাষার কথা বলতে গিয়ে আমি এ কী সব গাওনা গাইছি। বুঝতে চাইলে বা বোঝার মতো মন বা ইচ্ছা থাকলে ওইসব গাওনা থেকে তার সারসত্তা বা অন্তর্সত্যটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। গাওনাও একটা ভাষা, গাওনাতেও বলার মতো সত্যপৃক্ত অনেক কিছু থাকে যাতে স্বেচ্ছায় কান লাগাতে হয়। ভাষা কানে হাঁটে। সেই ইচ্ছার অভাবই মানুষকে মূর্খ করে রাখে, মূর্খ হোয়ে থাকাটা নিরাপদও বটে, অন্যথায় অনেক ঝুঁকি থাকে। কেউ ঝুঁকি নেয় না, বা নেয়নি এটা অবশ্য সত্য নয়। এই পোড়ার দেশেও অন্ততঃ কিছু মানুষ ঝুঁকি নিয়েছেন, তা নিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকারও করেছেন, অনেকের মাথার উপর এখনও ঝুঁকির খাঁড়া ঝুলে রয়েছে, তবুও তাঁরা শহীদ নন, মনান্তরালের মানুষ। তাঁদের ক’জন মানুষ চেনে, ক’জন মানুষই বা তাঁদের খবর রাখে? কথা বলার ঝুঁকি নিতে গেলে নৈতিক উদ্যম থাকতে হয়, একনিষ্ঠ নীতিবান মানুষ হয়ে চলতে হয়। অন্যথায়, কথার দাম ও দম থাকে না। শরীরের দাম ও দমের আগে মনের দাম ও দম থাকাটা অত্যন্ত জরুরী এবং সেটা যে নির্গুণ ব্রহ্ম নয় সেটা কায়মনে বুঝে নেওয়াটাও কম জরুরী নয়। এখানে যে-কথা বলা হচ্ছে তা বলা কথার বিরুদ্ধে বলা কথা কেন না অনেক কথাই মানুষের জীবসত্তা ও তার চেতনার বিরুদ্ধে আগ্রাসন। হিংসাকে প্রতিহত করতে হয় হিংসা দিয়েই, এখানে আমিরী নিরামিষ সেজে থাকলে আগ্রাসন ক্রমশঃ বেড়ে চলে।

আসলে এই গাওনার মধ্যেই ঠাসা আছে ভাষা, কথার ভাষা বা ভাষার কথা (চিহ্নতাত্ত্বিক ফার্দিনান্দ স্যসুর কথা ও ভাষাকে দু’টি স্বতন্ত্র গোত্রে বিভক্ত করেছেন – ভাষা হোল একটা সিস্টেম বা তন্ত্র আর কথা তার আনুষঙ্গিক বিধায়ক)। স্যসুর যাই বলুন, কথা ও ভাষাকে একাসন করে না দেখলে ভাষার তান্ত্রিক পরিকাঠামো ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, তন্ত্র হিসাবে ভাষা তান্ত্রিক সাধনার কাপালিক হয়ে মানুষকে হাড়িকাঠি দেখিয়ে শাসিয়ে রাখে, তার চিহ্নের চিহ্নায়ক হয়ে ওঠারও দায় ও সাধ থাকে না, মানুষের সম্যক উপলব্ধিতে চিহ্নায়িতও হয়ে ওঠে না। চিহ্নের চিহ্নায়ক থেকে চিহ্নায়িত হয়ে ওঠাটাই ভাষার দাবি। এটাও সত্য যে ভাষা কাপালিক তন্ত্রাচার নয়, ভাষা গণতান্ত্রিক, তাতে গণের অধিকার, তা গণের মুখের ভাষা। কিছু শাস্ত্রবিধি উপচার নিয়েই তো একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থাতন্ত্র যা কিছু মানুষের দ্বারা গড়ে ওঠে এবং বাকি সব মানুষ তাতে পিঠ ঠেকিয়ে তাত পোহায়। ভাষাতন্ত্রে রাজনীতিই কথা বলে, শ্রেণীর রাজনীতি যা থেকে শ্রেণী-সচেতনতা গড়ে ওঠার সম্ভ্যব্য নির্দ্দেশ থেকেও যায়। (এখানে কথা মানে শব্দের আন্তঃসম্পর্কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ভাষকের বলা একটা কথা বা ভাবনা (ভার্জিনিয়া উলফ প্রায় স্যসুরের সঙ্গে মত মিলিয়ে শব্দের সঙ্গে শব্দের আন্তঃ-সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছেন: Words belong to each other.), এই কথার ভাষার সঙ্গে মানুষের আরও সবাক ও নির্ব্বাক আচরণ ইঙ্গিত উচ্চারণ সহ আরও অনেক কিছু ভাষার উপাদান হিসাবে কাজ করে কেন না সেই উপাধানে শায়িত হোয়ে ক্রমশঃই ভাষার উপ্ত ভাবনা জেগে ওঠে -কখনো অন্তর্মনে, কখনো বা অন্তর্মন থেকে বহির্মনে একটা শরীর পায় – শরীরটা যেমন ভাষার, তেমনই মানুষের, মানে মানুষের মনের বা ভাবের। নীরবতারও একটা সবাক শরীর থাকে, তার শক্তিও আসুরিক। স্যসুর কথিত ভাষার সিস্টেম এটাই। কিন্তু আবার এটাও ঠিক নয় যে শব্দের সঙ্গে শব্দের একটা সম্পর্ক থাকবেই কেন না ভাবকথার একটা ছেঁড়া ছেঁড়া আভরণ থাকে যা ভাষারই অনন্ত মঞ্জিমার প্রকাশ। একটা শব্দ নিয়মবিধি ভেঙ্গে তার নিজস্ব ভাবকে অতিক্রম করে যেতে পারে, যেমন – শাক ধুই ধুই ফেলা পানিরে – এখানে ভাবের সম্প্রসারণ ভাবকে কোথায় কোন নির্দ্দেশ্যতায় নিয়ে যায় তা লক্ষ্যণীয়। শিল্প-সাহিত্যের ভাষায় এবম্বিধ ব্যতিচার লক্ষ্য করা যায়। যখন বলা হয় ’ছিঁড়ে কুটিকুটি কামজ নীচ দেহসুখ/ রাতস্বর নদীতে তখন উজ্জ্বল মাছের ঝাঁক একমুষ্ঠি ক্ষুধা নিয়ে চেয়ে থাকে নিভে আসা এক নক্ষত্রের পানে…’ তখন শব্দের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কবির মনের ভাবনাটা অনুধাবন করতে গিয়ে শব্দের মধ্যে শব্দের আন্তঃসম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হোয়ে ওঠে, এবং পাঠককে অন্যতর ভাবনার সন্ধানে ছুটে যেতে হয়, পাঠকই এখানে সব, কবি নয়। কবি নিজস্ব ভাবনায় কথা ছড়িয়ে দিয়েই দায়মুক্ত, পাঠককে নিজস্ব অনুধাবনে তাকে ভাবনাবন্দী করতে হয়।
ভাষা সব মানুষের, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের একার অধিকারে নয় যারা ভাষার উপর নিজেদের একচ্ছত্র ক্ষমতা/আধিপত্য কায়েম করে সাধারণ মানুষকে ব্রজবুলি শুনিয়ে যুগান্ত ধরে ঠকিয়ে চলে তাদের ভাষাচ্যুত করে রেখেছে। তারা তাদের ভাষাকে, মানে ভাষার অন্তর্বস্তু বা সত্যকে সাধারণ মানুষকে বুঝতে দেয় না, সাধারণ মানুষের বোধের আড়ালে আড়াল করে রাখে। মানুষকে ভাষাচ্যুত করে রাখতে পারলে ক্ষমতার সুবিধা হয়। দুষমন ক্ষমতার শিহরণ অনুভব করতে হোলে তাই মানুষকে ভাষার ছায়ামূর্ত্তিকে চোখের সামনে স্পষ্টাক্ষরে তুলে আনতে হয় যা আসলে ভাষার অন্তর্বস্তু বা অন্তর্সত্য। সেই কারণেই বোধ হয় এ্যারিস্টটল বলেছেন: There is no understanding without a phantasm. নিৎসেও তাই বলেন, ঘটনা বলে কিছু নাই, ঘটনার ঘটায়ন বা তার সবিশদ ব্যাখ্যা ও তার সম্যক উপলব্ধিই ঘটনা, এখানে তার ন্যারেটিভ তেমন জরুরী কিছু নয়, কিন্তু ঠিক গন্তব্যে উপস্থিত হোতে হোলে ন্যারেটিভকে পথ ও পাথেয় করে নিতেও হয়। বাক্যের অতীতকে কীসে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তার একটা সাধূ উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হয় – বাকপাথিত কাহিব কী স। মানুষ অনেক কথা শোনে, ভাষার স্বরান্তর ঘটিয়ে তার অন্তঃস্বরে তাকে না বুঝলে তা অস্ফুট থেকে যায়। অস্ফুট থেকে যাওয়াটা ভাষার অভিসন্ধি নয়। ভাষার সন্ধি সব মানুষের সঙ্গে, তার সন্ধি-বিচ্ছেদ ঘটাতে চাওয়াটা রাজনীতির নিষ্ঠুর দর্শন। ভাষা আয়ত্ত করেই তবে মানুষকে জীবনে বাঁচতে শিখতে হয়, তাতেই মানুষের জীবনের প্রকৃতিস্থতা। অথচ মানুষ ভাষা শেখা সম্পূর্ণ করেছে বলে মনে হয় না।
একটা ঘটনা অন্য ঘটনাকে ঘটায়, না কি একটা ঘটনা অন্য ঘটনার পরে ঘটে? সেটা মানুষ ঠিক করে, ভাষা নয়, এবং সেটা ঠিক করতে গিয়ে লক্ষ্য করা যায সেটা ভাষাই তার হোয়ে জবাব ঠিক করে দিােচ্ছ, তাতে মনে হয় যেন মানুষ ভাষার দাস, ভাষা-ই মানুষকে দিয়ে সবকিছু বলিয়ে কইয়ে নিচ্ছে, ভাষাই তার স্বীকৃত উপযাচক। ভাষার একক যে-কথা মানুষকে তা ভাষার কাছ থেকে ধার করতে হয়, ধারকরা কথার উপযোগ ঘটিয়ে তবেই মানুষের কথাবলা শিক্ষা শুরু হয় – এখানে ’কথা’ মানে নিছক অর্থবোধক কিছু শব্দ নয় (অনেক সময় না-অর্থক শব্দও অর্থ সৃষ্টি করে), এমন কি শুধু কিছু ধ্বনিচিহ্ন নয়, এর মধ্যে মানুষের সার্ব্বিক জীবনের আচরিত অভ্যাসও অন্তর্ভুক্ত, তদর্থে ভাষা আমাদের জীবনের চরিত-অভিধান ব্যঞ্জনা, কিন্তু সব মানুষের ভাষা এক ও সমান নয়, সমরূপ নয়, এর মধ্যে বহুরূপত্বও থাকে (সমরূপত্বের ধারণা কী বিপজ্জনক রাজনীতি!), চরিত্র ও শ্রেণী সাপেক্ষে এক একজনের ভাষা প্রকার ও প্রকরণে এক একরকম। ভাষা দিয়ে মানুষকে আলাদা করে চেনা যায়, ভাষা মানুষকে উলঙ্গ করে চিনিয়ে দেয়। ভাষায় তো মানুষ শুধু খাওয়া-পরার কথা বলে না, খাওয়া-পরা সহ মানুষ আর যা যা কথা বলে বা আচরণ করে তা-ই মানুষের জীবন সংস্কৃতি তথা জীবন দর্শন যা মানুষের চিহ্নায়ক ধর্ম, মানুষ নিজেকে নিজে চিহ্নায়িত করতে না পারলে মানুষ কী করে বা কীভাবে আর সব মানুষের কাছে স্বতন্ত্র হোয়ে উঠবে?
এখানেই স্যসুরের চিহ্নতত্ত্বের ম্যাজিকানা। কুমড়ো গড়াগড়ি খেলেও মাঠে হাট্টিমাটিম টিম ডিম পাড়ে। সেই ডিম থেকেও ছানা ফুটে বের হয়। তবুও একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায় যে যখন বলা হয় যে ভাষা মানুষকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেয়, কাজ করিয়ে নেয়, তখন মনে হয় না কি মানুষ ও ভাষা দু’টি পরস্পর বিরোধী সত্তা? সম্পর্কটা দাস-মালিকের? ভাষা আগে, না মানুষ আগে? এসবের সদুত্তর হয় না। ভাষা একটা পরিবেশ, পবিবেশ বলতে যা আমরা বুঝি ভাষা তারই অংশভূত, মানুষ জিনের সমষ্টি হলেও পরিবেশই তাকে বাঁচার রসদ যোগায় (চমস্কি ভাষাকে মানুষের জিনগত শিক্ষা বলে বোঝাতে চেয়েছেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে) – মানুষকে যেমন তার পরিবেশ থেকে বিবিক্ত করা যায় না, ভাষাও তেমনই, কেউ কারুর থেকে আলাদা নয়, কার্টেজীয় নীতির বিপ্রতীপে যেমন দেহ ও মন আলাদা সত্তা নয়। ভাষার পরিবেশ থেকেই মানুষ শিখে তার সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি ঘটায়।

ভাষা এখন আর মানুষের নিজের মুখের কথা নয়, প্রতিষ্ঠান তথা তার গণ-মাধ্যমের সহবত ও সহমত শেখানো তোতাবুলি, মিথও (এ্যাডর্নো বলেছেন: All mass media under advanced capitalism served one purpose – nanufacturing onsent.) মিথ মিথ্যে, মিথ্যের রূপকও মিথ্যে, যা দিয়ে মানুষের অখণ্ড ও সমসত্ত্ব বাস্তবকে খণ্ডিত বাস্তব করে তোলা হয়, বাস্তব তখন আর বাস্তবে থাকে না, তার খণ্ডিত সত্তায় তা অবান্তর অবাস্তব হয়ে ওঠে (মাতৃভাষা কথাটা ক্ষমতা পোষিত একটা মিথ, মানুষ মুখে মুখে ভাষা শেখে) – সেইসুত্রে ভাষা এখন অবৈধ ক্ষমতাা রাজনীতির বুকের বল দলমাদল – ভাষা-ক্ষমতার উপর শাসন-ক্ষমতা প্রবল থাবা বসিয়ে মানুষের আর সবকিছু সহায়-সম্পদের মতো ভাষাকেও কুক্ষিগত করে নিয়েছে (appropriation)। এবং তার একটা পরিণাম হল যে মানুষের জন্মলালিত ও যাপিত লোকজ ভাষাবিশ্ব তথা তার উপভাষা সমৃদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতি এক এক করে বিলুপ্ত প্রজাতি হোয়ে উঠেছে – এটারই পরিভাষিক নাম ভাষাহত্যা (linguicide) যা গণহত্যারই নামান্তর। পৃথিবীতে এখনও প্রায় সাত হাজারের মতো ভাষা আছে, তার মধ্যে ৯৬ শতাংশ ভাষায় মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ কথা বলে – বোঝাই যায় হত্যা রাজনীতির পরিণতিটা কতদূর পর্য্যন্ত গড়িয়েছে। মানুষ কথা বলতে শেখে যে-পরিবেশ থেকে সেই পরিবেশ আজ ক্ষমতার অন্যায় শাসনে পরিষিক্ত ও কলুষিত, সেখানে ভাষা ও সংস্কৃতির এই করুণ দশা মোটেও আশ্চর্য্যরে কিছু নয়। পুঁজিতন্ত্রে সবসময় এমনই হয় (সমাজতন্ত্রেও তাই, কোন তন্ত্রে এর থেকে ভালো কিছু হয় তাও এখন আর পরিস্কার নয়, উত্তর-সমাজতন্ত্র কাল আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বের নানা দেশের জনজাতি ভাষা ও সংস্কৃতি কীভাবে এতদিন নিষ্পিষ্ট হয়ে ছিল এবং এখনও হয়ে আছে), যুগান্ত কালের ভাষার কৌম-ভাবনার বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্টকে মুছে ফেলে ব্যষ্টিকেন্দ্রিক ভাববিলাসী শিল্প-সংস্কৃতির কর্পোরেট দাপট গড়ে তুলেছে, ভাষার মাধ্যমেও মানুষে মানুষে হিংসাত্মক উচ্চাবচতার (hierarchy) অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আধিপত্যবাদী একমুখিন আগ্রাসনের শিকার হোয়ে ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের স্থান-কালিক বহুত্ববাদী আদর্শ হারিয়ে ফেলেছে। দেশ-দুনিয়ার রাজনীতি যেমন ফ্যাসিস্ট, তার রাজনীতির ভাষাও ফ্যাসিস্ট। মনে রাখতে হবে ভাষা নিছক একটা ভাষা নয় – ভাষা একটা জনজাতির স্মারক, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম্মও। সর্ব্বগরিষ্ট কোনো জাতি ও ভাষা তাই অন্যসব জাতির ভাষা ও ধর্মের তথা তাদের সংস্কৃতির উপর দমন পীড়ন নামিয়ে এনে তাদের লোপাট করে দিতে চাইছে। এক দেশ, এক ভাষা – এই এক দেশ, এক পার্টি রোম সম্রাট সিজারের দম্ভেরই প্রকাশ।
মানুষের মুখের ভাষাকে মুছে ফেলতে চাইলেও তাকে কেড়ে নেওয়া যায় না, মুখের দরজা বন্ধ থাকলেও মনের জানালা কিন্তু বরাবর খোলাই থাকে।
মনের খোলা জানালা দিয়েই ফোঁসফোঁস ফিসফাস আওয়াজ হয় দমন অবদমনের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ ও নির্ম্মানের মধ্যে দিয়ে – ভাষা ও মানুষ পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ সংহতিতে সম্বদ্ধ, কেউ কাউকে ছেড়ে সমাজ গড়তে পারে না। এবং এইভাবেই মানুষের গণতন্ত্রায়ন ঘটে, তার ক্রমপ্রসার ও বিস্তার হয়। হাবারমাসের মতে, সামাজিক সমতা ব্যতিরেকে এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্ভব হয় না। সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের আন্দোলনের তাত্ত্বিক ইন্ধন ভাষা কেন না ভাষা দিয়েই মানুষ সামাজিক অন্যায় অসাম্য ও অনাচারটা প্রত্যক্ষ করতে পারে, মানুষের মধ্যে শ্রেণীবোধ ও চেতনা গড়ে ওঠে এবং তখন.মানুষ মিছিলের ভাষায় কথা বলতে শিখে যায় – বলতে গেলে, সেটা একপ্রকার মানুষের স্বতঃই শিখে নেওয়া নিজের রক্তচঞ্চল ভাষা, সেটা তার অস্তিত্ব রক্ষার অধিকারের ভাষা – মানুষের সম্মিলিত চেতনার সামাজিক সংহতির বহিঃপ্রকাশ, যাবতীয় সামাজিক সৃষ্টির সামূহিক অনুঘটক, যে-সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ সমাজে নিজেদের জৈবিক অস্তিত্ব ও সত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে রাখার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলে বা তার গণতন্ত্রায়ন ঘটায়। এটা যুক্তির বিস্তারও বটে, এবং একইসঙ্গে তা যৌক্তিকতার বিকাশও। এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার পরাকাষ্ঠাও। মনে রাখা দরকার যে মানুষ ভাষার ব্যবহার করে না, বরং ভাষার প্রত্যক্ষ অনুঘটনেই মানুষ ভাষাকে দিয়ে তার ব্যবহার ঘটায় – সম্পর্কটা যান্ত্রিক নয়, সামাজিক সংস্থিতির দ্বান্দ্বিকতা।
ভাষা প্রথমতঃ একের সঙ্গে অন্যের সঙ্গে আসঙ্গ সংলাপ, এবং নিজের সঙ্গে নিজেরও, ভেবে দেখলে বোঝা যায় একজন মানুষ তার জীবনের বেশীর ভাগ সময় নিজের সঙ্গেই কথা বলে অন্তহীন ভাবনার প্রবাহে, এমন কি ঘুমের মধ্যেও, তার অবচেতনেও – stream of consciousness. ভাষা দুনিয়াকে নিয়ে ঈশ্বরের মতো নিজেকে মানুষের থেকে আলাদা করে রাখে না বা তার মাথার উপর চেপে থাকে না। হাইডেগার বলেন, মানুষের কাছে ভাষাই তার বিশ্বভুবন যেখানে তার অস্তিত্ব ও সত্তা নিহিত – যা কারুর একার নয়, বিশ্বায়িত। ভাষার অবস্থিতি পরিধিতে, সেই পরিধি জুড়েই মানুষের বাস, পরিধিটা সীমায়িত বলে মনে হলেও ক্রমিক সামাজিক বিবর্তনের ধারায় তার বিস্তৃতায়ন ঘটে চলে এক অবস্থা থেকে অন্যতর আর এক অবস্থায়।


ভাষা প্রথমতঃ একের সঙ্গে অন্যের সঙ্গে আসঙ্গ সংলাপ, এবং নিজের সঙ্গে নিজেরও, ভেবে দেখলে বোঝা যায় একজন মানুষ তার জীবনের বেশীর ভাগ সময় নিজের সঙ্গেই কথা বলে অন্তহীন ভাবনার প্রবাহে, এমন কি ঘুমের মধ্যেও, তার অবচেতনেও – stream of consciousness. ভাষা দুনিয়াকে নিয়ে ঈশ্বরের মতো নিজেকে মানুষের থেকে আলাদা করে রাখে না বা তার মাথার উপর চেপে থাকে না। হাইডেগার বলেন, মানুষের কাছে ভাষাই তার বিশ্বভুবন যেখানে তার অস্তিত্ব ও সত্তা নিহিত – যা কারুর একার নয়, বিশ্বায়িত। ভাষার অবস্থিতি পরিধিতে, সেই পরিধি জুড়েই মানুষের বাস, পরিধিটা সীমায়িত বলে মনে হলেও ক্রমিক সামাজিক বিবর্তনের ধারায় তার বিস্তৃতায়ন ঘটে চলে এক অবস্থা থেকে অন্যতর আর এক অবস্থায়। ভাষা কীসে নাই। মানুষের শরীরে ভাষা, মনে ভাষা। আমরা যা দেখি শুনি বলি, এবং যে-ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তার সবই তো ভাষা, ভাষার প্রকাশ বা ভাষাতে তার প্রকাশ। ভাষা না থাকলে এমন কি ঘটনা ঘটেও ঘটে না – মানে, সেটা মানুষের বোধায়নে প্রকৃতিস্থ হয় না। ভাষা না হলে কিছুই চলে না, কারুরই চলে না। মানুষের অস্তিত্ব ও সত্তার নির্বিকল্প প্রকাশক ভাষা। ব্যাপারটা বিস্ময়কর মনে হোতে পারে। ভাষা সব নয় বললে এই অর্থ হয় যে ভাষা মানে শুধু কিছু কথার কথা, কিন্তু তা নয়, কথার তো অর্থ গূঢ়ার্থ থাকেই, তার সঙ্গে আরও বহু কিছু, এবং তাই দিয়ে বহু কিছু প্রচার ও অপপ্রচার করতে চাওয়া হয়। এই বলতে ও বোঝাতে চাওয়াটা মানুষে মানুষে একটা যাচিত মুক্তকচ্ছ বন্ধন সৃষ্টি করে, এবং,সেটা ঘটে প্রথমতঃ ভাষার মাধ্যমে – শুধু তাই নয়, পরিবাহী তারের মতো ভাষা মাধ্যম মানুষে মানুষে বার্তা ও ভাবের (যেমন – ভালোবাসা ঘৃণা ইত্যাদি) সংযোগ ঘটায়, তার বিগত স্মৃতিকে প্রত্যক্ষে নিয়ে আসে এবং তাতে একটা স্থান-কালিক সেতু সৃষ্টি হয়। মানুষের অবধারণ বোধের (cognitive sense) পরিবাহক ভাষা যা ছাড়া জ্ঞানতত্ত্বের বিস্তৃত ক্ষেত্রটা ঊষর মরুভূমির মতো বালিয়ারি হোয়ে পড়ে থাকত, এমন কি তাতে একটা ক্যাকটাসও গজিয়ে উঠত না। আসলে ভাষাই সব, মানুষের জীবনের সার ও সারার্থ, স্তূতি ও ব্যজস্তূতি ((The speech of mortals rests in its relation to the speaking of language. – জ্যাক দেরিদা)। আমরা যা করি বা বলি তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় ভাষার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে সম্প্রচারিত হয়। সুতরাং নিছক গাওনা বলে কিছু নাই, গাওনা বলে কিছুকে হেয় করতে চাইলে তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটার ফাঁক ও ফাঁকি পড়ে যায় আর সেই ফাঁকে আসল ফাঁকিটা রেহাই পেয়ে যায়। ভাষা নিজে দুশ্চরিত্র নয়, কিন্তু দুষ্টচক্রের পাকে পড়ে ভাষাও তার ধর্ষকামী চরিত্র ও ক্ষমতার বাহন হোয়ে উঠতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভাষা ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়, যতটা সহজ সরল বলে মনে হয় ভাষা মোটেও তা নয়, যৌনতার হিংসার মতো তার সর্পচক্রে ধর্ষকামীকে জড়িয়ে ফেলে ঠিক সময়ে তা তার মাসুল উসুল করে নেয়, মানুষ যেমন তাকে বলায়, ভাষাও মানুষকে বলায় নিজের ভাষায়। ভাষা ব্যবহারে সাধুতা অবলম্বন না করলে মানুষকেই ফাঁকে পড়তে হয়। ভাষাকে নিয়ে তাই যথেচ্ছাচার করা চলে না। ভাষকের বলার উদ্দেশ্যটা বুঝে নিয়ে ভাষা নিজেই উৎকন্ঠিত হোয়ে নিজেকে সতর্ক করে রাখে। ভাষাকে অনেক সমঝে চলতে হয়, তার উদ্দেশ্য-বিধেয় বিচার করে চলতে হয়। আমাদের দেখতে গেলে ভাবতে হয়, দেখে আসার পরও ভাবতে হয় – কী দেখলাম? শোনার আগে ভাবতে হয়, শুনবো কি না, শুনে মনে হয় কী শুনলাম? বলার আগে ভেবে নিতে হয় কী বলবো, বলে মনে হোতে পারে ঠিক বললাম কি না? ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সমান সত্য – সত্যিই তো কী সব ঘটে, ঘটছে, আরও কী সব ঘটার জন্য প্রস্তুত হোয়ে আছে – ঘটনার ভাষা দিয়ে না বুঝলে বা ঘটনাকে বোঝা যায় না : ঘটনার অনুধাবনে ভাষার মাধ্যমে ঘটনার অনুবাদায়নে ঘটনা সম্পর্কে মানুষের ভাবায়ন/বোধায়ন ঘটে এবং এইভাবে তার মন-কি-বাত সবার সাথে সবার (ভাবনার) বিকাশ হোয়ে চলে, ভাবতে না পারলে বা বলতে বুঝতে না পারলে মানুষকে বাকহীন হোয়ে থাকতে হয়, শাসনের ক্ষমতা ও ক্ষমতার শাসন ঠিক এটাই চাই। হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন: Whereof one can not speak, thereof one must be silent. বলতে না পারলে, মানুষ চুপ করে থাকবে – চুপ করে থাকাটাও একটা ভাষা। তবুও বলেেতই হবে, আমাদের ঠোঁটটা তো খোলা: হাম দেখেঙ্গে/ লাজমি হ্যায় কি হাম ভি দেখেঙ্গে…

বিনা স্বদেশী ভাষা/ মেটে কি আশা? এপার ও ওপার বাঙলার শিল্পসংস্কৃতির দশা দেখে মনে হয় ৫২’র ভাষা আন্দোলন সত্যিই হয়েছিল তো? না হলে বাঙলায় এ্যাতো ইরেজি শব্দের (অপ)প্রয়োগ কেন? দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে এটা হোয়ে আসছে রবীন্দ্রনাথ ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আমল থেকেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here